দেবস্থানে নরবলি দানের প্রথা যে ভারতে বেশ ভাল মাত্রাতেই প্রচলিত ছিল তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে বহু সাহিত্য ও কিংবদন্তীতে। ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ থেকে শুরু করে ১৯ শতকের ‘কপালকুণ্ডলা’-তে পর্যন্ত নরবলি প্রদান করে ইষ্টদেবীর সন্তুষ্টিবিধানের বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে।
এই প্রথা ছিল হুগলি জেলার জিরাট পাটুলির মঠবাড়ির পুজোতেও। প্রলয় কান্ড ঘটে গেলেও অর্ধরাত্রির পুজো হবেই। একইসঙ্গে দিতে হবে নরবলিও। এমনই কড়া ছিল রীতি। এর অন্যথা হলেই নাকি ঘটে যেতে পারে বড় কোনও অঘটন। এমনটাই বিশ্বাস করতেন সকলে।
জানা গিয়েছে, এখন সপ্তমী ও অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে অর্ধরাত্রির পুজো হয়। তবে বাজারে প্রচলিত পুঁথি অনুযায়ী এই পুজো হয় না। পরিবর্তে পূর্বপুরুষদের তৈরি করা পুঁথি পড়ে পুজো সম্পন্ন হয়। এবং পুজো হয় বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতে।
কথিত আছে, জিরাট পাটুলির মঠবাড়ি তথা চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দুর্গাপুজোতে প্রত্যেক ১২ বছর অন্তর একটা নরবলি হত। আর এই নরবলি হত অর্ধরাত্রির পুজোর দিন। কিংবদন্তী শোনা যায়, ওইদিন নিজে থেকেই কোনও না কোনও মানুষ মঠবাড়িতে চলে আসতেন। পুজোর সব রীতি মেনেই দেওয়া হত নরবলি।
এখন অবশ্য সেসব অতীত। তবে পরম্পরা আছে। এখন সেখানে প্রতীকী নরবলি দেওয়া হয়। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, চালের গুঁড়ো দিয়ে কুলোর উপর ‘নকল’ নর তৈরি করা হয়। সেই নরকেই লাল চেলি কাপড় পরিয়ে মন্ত্রপূত করে অর্ধরাত্রির পুজোর দিন বলি দেওয়া হয়।
পুজোর দিন বিশেষ ভোগের ব্যবস্থা থাকে মঠবাড়িতে। কথিত আছে, পন্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার আর্থিক ভাবে দুর্বল ছিলেন। তাই তিনি মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী দিয়ে ভোগ দেবেন মায়ের। দৈববাণীতে দেবী তাকে আদেশ দিয়েছিলেন, ডাল-ভাত ও কচুর শাক দিয়ে ভোগ দেওয়ার। তারপর থেকে তাই দেওয়া হয় ভোগে।
প্রায় ৩৫৭ বছর আগে, সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মদনমোহন তর্কলঙ্কার স্বপ্নাদেশ পেয়ে জিরাট পাটুলির মঠবাড়িতে দেবীর পুজো শুরু করেন। সেই থেকেই বংশ পরাক্রমে এই বাড়িতে দেবীর পুজো হয়ে আসছে।