নাদিয়া মুরাদ। মেয়েটি হতে চেয়েছিল ইতিহাসের শিক্ষক। ইরাকের বারবার ক্ষতবিক্ষত হওয়ার ইতিহাস পড়াবে বলে, ইয়াজিদি ধর্ম সম্বন্ধে পৃথিবীকে জানাবে বলে। ১৯৯৩ সালে জন্মানো মেয়েটি ২০১৪ সালে ভাগ্যচক্রে হয়ে গেল আইসিস জঙ্গিদের সেবাদাসী। তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো বাকি পরিবারের পুরুষদের খুন করে৷ গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, ক্ষতবিক্ষত করা হলো ঘরের বৃদ্ধাদের। এসব কিছু হয়েছিল কারণ তারা বিধর্মী ছিল আইসিস এর চোখে। আর বিধর্মীদের গলা কেটে দেওয়া ও তাদের মেয়েদের শরীর ভোগ করা দস্তুর৷ খোদার নামে তালিবানী খোদগারী।
ইয়াজিদি মেয়েটি এরপর একাধিক বার হাত বদল হয়৷ তার নিজের কথাতেই রীতিমত বাজারে শিকল পরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় মালিকের অপেক্ষায়। প্রতিরাতে একাধিক দানবের শয্যাসঙ্গী হতে হয়৷ অকথ্য অত্যাচার করা হয় দু বছর। যতবার পালাতে গেছে আর ধরা পড়েছে, ততোবার শাস্তি হিসেবে গনধর্ষিতা হতে হয়েছে। একসময় কতজন পুরুষ শরীর খুবলে খেলো তা গোনা বন্ধ করে দিয়েছিল।
আল্লার প্রতি, অলৌকিকত্বের প্রতি, ইসলামের নখদাঁত বের করা আইসিস আচারের এর প্রতি যখন ঘেন্না চূড়ান্ত হয়েছে তখনই এক মুসলিম পরিবার তার জন্য নকল আইডি, মুসলিম পরিচয় তৈরি করে দেয়। ওর শেষপারে ছিল নাদিয়া মুরাদের মুক্তি।
এরপরের গল্পটা যেকোন বলিউডের ছবির মতো। রাষ্ট্রসংঘের সাহায্য পাওয়া, পৃথিবীকে নিজের গল্প বলা, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইয়াজিদি ধর্ষিতা আর কৃতদাসীদের উদ্ধার করে নতুন জীবন দেওয়া। আজ নোবলে ভূষিত করা হলো তাঁকে যুগ্মভাবে আর এক সুপারহিরোর সাথে।
আফ্রিকার এই ডাক্তারবাবুর নাম ডেনিস মুকওয়েজি। কংগো বলে একটি দেশে ডাক্তারি পড়েছেন। তাও চাকরি করবেন বলে না। ওদের গ্রামে ডাক্তার বলে কিছু হয় সেটাই তখন কেউ জানতো না। কঠিন অসুখ হলে প্রার্থনা করা হতো। আর হতো গৃহযুদ্ধ, জাতিদাঙ্গা, জেহাদ। প্রথমবিশ্ব থেকে উপহার দেওয়া অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ঝাঁঝরা করে দিতো নিজেরই দেশের মানুষকে। মেয়েদের জন্য থাকতো ছিন্নভিন্ন জরায়ু, গনধর্ষিতা হয়ে বেঁচে থাকার অভিশাপ।
প্রাচীনকাল থেকে যুদ্ধ রীতির অন্যতম ছিল শত্রুকে মানসিকভাবে ও খুন করা। তারজন্য চোখের সামনে স্ত্রী,মেয়েকে ধর্ষন করতে হবে। জরায়ুতে ঢুকিয়ে দিতে হবে পাথরের কুচি, কেটে দিতে হবে জঠরের চামড়া যাতে আর কোন শত্রু না জন্মায় ওর থেকে।
ডাক্তারবাবু যেখানে রুগী দেখতেন সেখানে রোজ আসতো এরকম মহিলা। অর্ধনগ্ন, অচৈতন্য, রক্তাক্ত নারী৷ কারোকে টানা দুমাস পালা করে সকাল বিকেল ধর্ষন করা হয়েছে, কারোর সারা শরীরে মোমের ছ্যাঁকা দিয়ে শেষে ওরই শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই মোম দানবীয় আনন্দে। এদের প্রত্যেকের একটা করে মেয়েবেলা ছিল। হয়তো প্রেমিক, পুরুষ বা প্রাক্তন কোন গল্প ছিল।
ডাক্তার মুকওয়েজি পড়াশোনা করেছিলেন শিশুদের রোগ নিয়ে কিন্তু তারপরে আবার এমডি করতে শুরু করেন গাইনোকোজলিতে। একটাই উদ্দেশ্য। ওই মেয়েগুলোর চিকিৎসা। মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে। ওদের ক্ষতবিক্ষত জরায়ুতে মলম লাগাতে, সুস্থ করে তুলতে।
শুরু হয়েছিল কংগো থেকে। তারপর গোটা আফ্রিকার এরকম গনধর্ষিতাদের, যুদ্ধে শত্রুর হাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া নারীদের চিকিৎসা শুরু হয় হোমে রেখে। শারীরিক ক্ষতের সাথে সাথে মানসিক ক্ষত মেরামতের কাজ চলে এবং চলে তাদের নারীত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই৷ অপারেশন করে, প্লাস্টিক সার্জারি করে আগের ফুরফুরে অষ্টাদশী করে তোলা আজকের রক্তাক্ত কুঁকড়ে থাকা মেয়েটিকে।
নাদিয়া মুরাদ আর ডেনিস মুকওয়েজি রোজ অনেকগুলো পুরস্কার পায় ধর্ষিতাদের থেকে। দোয়া পায়, কপালে চুমু ও খায় অনেকে। আজ তাঁদের পৃথিবী সম্মান জানালো শান্তি পুরস্কার দিয়ে। দারুণ খবর। অখ্যাত সুপারহিরোদের খবর কজনই বা লেখে? কতজনই বা উদযাপন করে এদের মতো রুপকথার লড়াই?
রুপকথার আবেশের মাঝে জানিয়ে রাখি, মায়ানমারের আং সান সুচি ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী। ওদেশে ওনার প্রত্যক্ষ মদতেই কিন্তু রোহিঙ্গা গননিধন, নির্যাতন, গণধর্ষণ চলেছে। এরা কিন্তু কেউ আইসিস ছিল না কিন্ত কি আশ্চর্য নির্যাতিত মেয়েদের জরায়ু গুলো কিন্তু একই ভাবে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছিল।