ফ্রান্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের বক্তব্যে শ্রীমান চৌকিদারের হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে চৌচির। তবে ফ্রান্সেরও তাতে বদনাম কম হচ্ছিল না। তাই তড়িঘড়ি ব্যাপারটা উল্টে দেবার জন্যে ওই ফরাসি সরকার বিবৃতি দেয়, রাফাল সংক্রান্ত ব্যাপারে দ্যাসো-র সঙ্গে রিলায়েন্সের গাঁটছড়া বাঁধার কাজ হয়েছে বেসরকারি স্তরে। এতে দুই দেশের সরকারের কোনো ভূমিকাই নেই। কিন্তু আদপে ব্যাপারটা ধোপে টিকছে না। ফ্রান্সের তরফ থেকে এটা যে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা সেটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে।
স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের প্রধান চৌকিদারের দলবল ফ্রান্সের সুরে সুর মিলিয়েছে। কারণ ফ্রান্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট চৌকিদারের বেইজ্জতির একশেষ করছিলেন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দ্যাসো নামক রাফাল নির্মানকারী সংস্থা একটি প্রেস বিঞ্জপ্তি জারি করে। তাতে একদম প্রথমেই তারা বলেন, ২০১৬-তে রাফাল নিয়ে চুক্তি হয়। কিন্তু পরিষ্কার নয় কাদের সঙ্গে? সরকারের সঙ্গে নাকি সরকারি দ্যাসোঁর সঙ্গে কোনো ভারতীয় সংস্থার? দ্বিতীয়ত, এই চুক্তির কোনও নির্দিষ্ট তারিখ ওই প্রেস রিলিজে নেই। শুধু বলা হয়েছে, ডিফেন্স প্রকিউরমেন্ট প্রসিডিওর ২০১৬ রেগুলেশন অনুযায়ী রাফায়েলের জন্য একটি ভারতীয় সংস্থাকে তারা নির্বাচিত করেছেন। এখানে ডিফেন্স প্রকিউরমেন্ট প্রসিডিউর তাদের প্রেস রিলিজ অনুযায়ী ২০১৬ সালে এ্যামেন্ডমেন্ট হয়েছে। যদিও ভারত সরকার যতটা যত্ন নিয়ে ও ব্যাপক ভাবে প্রধান সেবকজীর ছবি দিয়ে তাঁর প্রকল্পের বিজ্ঞাপণ করেন ততটা যত্ন নিয়ে ও ব্যাপক ভাবে এই এ্যামেন্ডমেন্টের প্রচার করেন নি। ফলে পুরোনো রেগুলেশনটি কেন বদলানো হল তার কোনও ধারণা পাওয়া গেল না।
প্রেস রিলিজের একটি ছত্রে বলা হয়েছে ‘রিলায়েন্স গ্রুপের’ সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছে। ১৭ এপ্রিল সিইও এরিক ট্রাপিয়ার ‘দ্যা মিন্ট’কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারেও এই কথাই জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেস রিলিজের ওই ছত্রে রিলায়েন্স গ্রুপ বলতে নির্দিষ্ট ভাবে রিলায়েন্সের কোনও সংস্থাকে বোঝানো হয়েছে নাকি পুরো গ্রুপটিকেই বোঝানো হয়েছে সেটা পরিষ্কার নয়। ওই প্রেস রিলিজের পরবর্তী ছত্রে আরও একটি সংস্থার নাম পাওয়া যায়, ‘দ্যাসোঁ রিলায়েন্স এ্যারোস্পেস লিমিটেড’ সংক্ষেপে ‘ডিআরএএল’।
এবার এই ‘ডিআরএএল’ সংস্থা সম্পর্কে কিছু জানা যাক। এই সংস্থাটি ১০ই ফেব্রুয়ারি ২০১৭-তে কেন্দ্রীয় সরকারী দপ্তরে নথিভুক্ত হয়। যার কর্পোরেট আইডেন্টিফিকেশন নম্বর UN35999MH2017PLC291083 এবং রেজেষ্ট্রেশন নম্বর 291083
এই কোম্পানির কর্তারা হলেন অনিল ধীরজলাল আম্বানি, অ্যান্থনী জ্যেসুদাসন, রিচার্ড জিন ল্যাঁভুউড, এরিক জোয়েল ট্রাপিয়ার (লক্ষ্যনীয় ইনিই কিন্তু দ্যাঁসোর সিইও এবং ‘দ্যা মিন্ট’ নামের পত্রিকাতে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন)। অর্থাৎ এই কোম্পানি রাফালের জন্যেই উক্ত এরিক ট্রাপিয়ার সাক্ষাৎকার দেবার প্রায় ১ বছর ২ মাস আগে জন্ম নেয়। তার ওপর রাফাল এমন একটি সংস্থার হাত ধরে আসছে যার ৪ জন কর্তার মধ্যে তিন জনই বিদেশী। অর্থাৎ সংস্থার নিয়ন্ত্রনের রাশ আপাতত বিদেশিদের হাতেই। অর্থাৎ যেখানে নিরপত্তার অজুহাতে রাফাল বিমানের দাম বলা যাচ্ছে না, সেখানে যে সংস্থা রাফাল বিমান আনছে তার সিংহভাগ কর্তাই বিদেশী। সেক্ষেত্রে ভারতের নিরাপত্তা অটুট থাকবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? ভারতে আমদানিকৃত রাফালের নকশা বিদেশে বা শত্রু দেশে পাচার হয়ে যাবে না সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
আরও প্রশ্ন উঠছে। যদি শুধু রাফালের জন্য ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭-তে এই ‘ডিআরএএল’ নামক কোম্পানির জন্ম হয় তাহলে দ্যাঁসোর সিইও তা এপ্রিল ২০১৮-তে প্রকাশ করলেন কেন?
বলা হচ্ছে, যেহেতু এইচএএল-এর পূর্ববর্তী পারফরমেন্স খারাপ তাই অন্য সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যে সংস্থা সবে জন্ম নিয়েছে তাকে রাফাল ডিল দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পূর্ববর্তী পারফরমেন্সের যুক্তি এখানে খাটছে না।
এবার যে রিলায়েন্স গ্রুপের কথা দ্যাঁসোর এরিক সাহেব বলেছেন, তাদের কোম্পানির সংখ্যা প্রচুর। এদেরই একটি কোম্পানির নাম রিলায়েন্স নাভাল। এই রিলায়েন্স নাভালের বেশ কয়েক হাজার কোটি টাকা এনপিএ হয়ে আছে বলে একটি সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে। এছাড়াও পুরোনো নথি থেকে জানা যাচ্ছে, চলতি বছরের আগস্ট মাসে ওই কোম্পানির ডাইরেক্টর পদ থেকে অনিল আম্বানি ইস্তফা দিয়েছেন। সম্ভবত ওই কোম্পানি এখন রিলায়েন্স ডিফেন্স হিসেবে কাজ করছে। এই রিলায়েন্স ডিফেন্স ২০১৫ সালের ২৮ মার্চ ভারত সরকারের কাছে নথিভুক্ত হয়। উক্ত রিলায়েন্স নভালের লোন বিজয়া ব্যাঙ্ক ও ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এন পি এ ঘোষণা করেছে মার্চ ২০১৮-তে। কিন্তু দুটি ব্যাঙ্কেরই কর্তৃপক্ষ এর বেশী আর কিছু জানাচ্ছে না। অর্থাৎ মার্চ ২০১৮-তে এনপিএ হল আর আগস্টে আম্বানি ওই সংস্থা থেকে ইস্তফা দিলেন। আর নভালের পরিবর্তে ক্রমশ প্রকট হল রিলায়েন্স ডিফেন্স যা ২০১৫ তে রেজিস্ট্রি হয়েছে। গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই টকটক গন্ধ ছাড়ছে।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আমলে রিলায়েন্সের যে মাত্রাতিরিক্ত বাড়বাড়ন্ত হয়েছে সেটা পরিষ্কার। আর সেই বাড়বাড়ন্ত হয়েছে সরকারী প্রশ্রয়েই। না হলে উক্ত ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ রিলায়েন্সের এনপিএ নিয়ে চুপ কেন বা সদ্য জন্মানো কোম্পানি গড়ে তাতে বিদেশী ডায়রেক্টর নিয়োগ করে রাফায়েলের অফসেট পার্টনার বানানো কেন?
ফ্রান্সের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা খণ্ডন করতে উঠেপড়ে লেগেছে দ্যাঁসো, ফ্রান্সের সরকার এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু দ্যাঁসো যাদের হয়ে সাফাই গাইছে সেই ডিআরএএল-এর বোর্ড অফ ডিরেক্টরে তাদের ডিরেক্টরের সংখ্যা বেশী। অর্থাৎ বকলমে এটি তাদেরই নিয়ন্ত্রাধীন একটি সংস্থা। বিশেষ করে তাদের সিইও যখন নিজেই অফসেট পার্টনার সংস্থার একজন ডিরেক্টর, তাহলে তাদের বয়ান কতোটা বিশ্বাসযোগ্য? এত ধরা পড়ার পর চোর বলছে আমি চুরি করিনি। অর্থাৎ রাফাল চুক্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে চাপানউতোর চলছে তা অনিবার্য। তবে এই ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রাখার দায়ে তাদের অবস্থান প্রকাশটাও জরুরী হয়ে পরেছে।
( মতামত লেখিকার ব্যক্তিগত )