হাত বাড়ালেই এখন নানারকম গ্যাজেট। মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব,অ্যাপস, হেডফোন ইত্যাদির সুবাদে আমরা দুনিয়াটাকে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলতে পারি। কিন্তু প্রযুক্তির এই অগ্রগতি আমাদের মনের অন্ধকার কোনে কোন আলো ফেলতে পারছে? একেকটা ঘটনা এমন ঘটে যা দেখে মনে হয় আমরা বোধ হয় একচুলও এগোতে পারিনি। কোন গ্রাম, মফস্বল নয়, আমাদের শহরেই প্রকাশ্য দিবালোকে ঝাঁটাপেটা করে ভূত তাড়াচ্ছে কোন পিশাচসিদ্ধ গুণিন, কখনও বা ফুটপাথ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছেন দেবাদিদেব মহাদেব, কখনও বা লোকে ভিড় করছে গণেশের দুধ খাওয়া দেখতে।
দুদিন আগে খবরের কাগজে ঝাড়গ্রামে মা বাবার কুসংস্কারের ফলে অসুস্থ ছেলের মৃত্যুর খবরটা পড়ে মনখারাপ হয়ে গেল। খিঁচুনি ও শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে না গিয়ে ছেলের আরোগ্যের আশায় তারা গিয়েছিলেন লালগড়ের ধন্বন্তরি দেবীর থানে। টানা ১২ঘন্টা দেবীর থানে হত্যে দিয়ে বসে থাকার পর শিশুটিকে পুলিশ উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু না বলে একে হত্যা বলাই ভাল। জন্ম থেকেই খিঁচুনি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিল তাদের সন্তান তারাপদ। অসুস্থ ছেলেকে নদীতে স্নান করিয়ে খোলা জায়গায় সারাদিন ফেলে রেখেছিলেন তার বাবা মা। ছেলের চিকিৎসার এই নিদান স্বপ্নে ছেলের মা শিবানীকে দিয়েছিলেন লালগড়ের ধন্বন্তরি দেবী। স্থানীয় মানুষ নানাভাবে তাদের এই ভ্রান্ত ধারণার থেকে বার করে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা কারও কথাই শোনেন নি। এমন অনেক তারাপদর খবর কিছুদিন পরপরই গণমাধ্যমে ভেসে ওঠে।
কয়েকমাস আগেই চন্দননগরের ঘাটে গঙ্গার স্রোতে ভেলায় ভেসে এসেছিল এক মৃত কিশোর। পরিপাটি করে মশারি দিয়ে বিছানা করে তাকে শুইয়ে ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তার বাড়ির লোক। খাবার, জল সবকিছুই সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছিলেন তারা। এমনকি ছেলে বেঁচে উঠলে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য একটা কাগজে ঠিকানাও লিখে দিয়েছিলেন তারা। বাড়ির লোকের বিশ্বাস ছিল মা মনসার কল্যাণে সে বেঁচে উঠবে। একটা ঘটনাকে ঢেকে দেয় আরেকটা ঘটনা। এই তো কিছুদিন আগেই হাসনাবাদে অন্ধ বিশ্বাসের ফলে জ্যান্ত ও বিষধর সাপকে নিয়ে অভিনয় করার সময় সাপের ছোবলে প্রাণ হারান কালিদাসী মন্ডল নামে এক নাট্যকর্মী। মা মনসার আশীর্বাদধন্য কালিদাসীর ধারণা ছিল তার কিছুই হবে না। মনসার আশীর্বাদ কিন্তু তার প্রাণ বাঁচাতে পারে নি।
অন্ধবিশ্বাস এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব বহুক্ষেত্রে সর্পাঘাতে মৃত্যু ত্বরান্বিত করে দেয়। যে বাবা মা বা বাড়ির লোক সাপের কামড়ে মৃত ছেলেকে ভেলায় ভাসিয়ে দেয় কিংবা সাপে কামড়ানোর পর অ্যান্টিভেনম ইঞ্জেকশন না দিয়ে ওঝা, গুণিনদের দ্বারস্থ হয় তারা কুসংস্কারগ্রস্থ মানুষ। জেলা শহরে বহু হাসপাতালের পাশে ওঝা, গুণিনদের রমরমা কারবার। হাসপাতালে আসা মানুষদের গুণিনদের কাছে নিয়ে যায় তাদের এজেন্টরা। আগের তুলনায় একটু কম হলেও এখনও রয়েছে ডাইনি প্রথা। গ্রামের যাবতীয় রোগ বালাই, অকাল মৃত্যুর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয় এই ডাইনি থুড়ি কিছু অসহায় মহিলার ওপর। তাদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন, অনেককে মেরেও ফেলা হয়।
গ্রামের মেলা, হাট, শহর ও শহরতলির নানা গুরুর আশ্রম, আখড়ায় বুজরুকি ও মানুষের বোকামি আর অন্ধ বিশ্বাসের নমুনা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। শুধু যে অশিক্ষিত ও এক্সপোজার কম থাকা মানুষ কুসংস্কারের শিকার হন তা নয়। অনেক শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের মনের গভীরেও বাসা বাঁধে যুক্তিহীন অন্ধকার। সেই আঁধারে দাঁড়িয়ে তিনি বিশ্বাস করতে চান তন্ত্র, মন্ত্র, ঝাড়ফুঁক, যজ্ঞ তাদের ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। প্রিয় নায়ক নায়িকা, নেতা নেত্রীর আরোগ্য কামনায় যজ্ঞ, দুপুর রোদে রাস্তায় দণ্ডি কাটা ও উপোস তো আমরা আকছার দেখে থাকি। বস্তুত এসব কিন্তু একটা কুসংস্কারই। কিন্তু এর বিরুদ্ধে তেমন কোন যুক্তিবাদী আন্দোলন চোখে পড়ে না। বরং বহু জায়গায় এসব কাজ রাষ্ট্রীয় প্রশয় পায়।
কিছু বলতে গেলে এগুলি যারা করছেন তা তাদের ব্যাক্তিগত বিশ্বাস বলে থামিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু যে বিশ্বাস, বিজ্ঞানসন্মত ধারণা ও যুক্তিবুদ্ধির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, ডেকে আনে মানুষের মৃত্যু, ভ্রান্ত ধারণার প্রসার ঘটায় তা কি চলতে দেওয়া উচিৎ? ব্যাক্তিগত মতপ্রকাশের নামে যা ইচ্ছে তাই কি করা যায়? এব্যাপারে রাষ্ট্রের কী কোন দায়িত্ব নেই? আরও অদ্ভুত আমাদের রাজনীতি! ডান-বাম নির্বিশেষে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে এই ধরণের কাজকারবারকে প্রশয় দিয়ে চলে। ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখার স্বার্থে বহুক্ষেত্রে প্রকাশ্যে এর স্বপক্ষে দাঁড়ায়। তার ফলে জনমানসে নানাধরনের কুসংস্কারমূলক কাজকারবারের একটা বৈধতা তৈরি হয়। লোকে ভাবে অমুক নেতা বলছেন বা তমুক নেত্রী বলছেন তাহলে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ঠিক! কুসংস্কার ব্যবসায়ীরা মানুষের এই মানসিকতার সুযোগ নেয়। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের জেতার জন্য কলকাতায় হোমযজ্ঞের সঙ্গে খেলোয়াড়ি মানসিকতার কোন সম্পর্ক নেই। আদতে এটা একটা কুসংস্কার।
কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সর্বস্তরে এই কুসংস্কার রোখাটা আপনার, আমার সবার কাজ। দায়িত্ব এড়াতে পারেনা রাষ্ট্রও। স্কুল, কলেজের পাঠক্রমে শুরু থেকেই কুসংস্কারবিরোধী মানসিকতা গড়ে তোলার প্রয়াস করতে হবে। বাড়ির ছোটদের ভ্রান্ত ধারণা, অন্ধবিশ্বাস রোখাটা আমাদেরই কাজ। বিজ্ঞান ক্লাব, যুক্তিবাদী সমিতিগুলির লাগাতার প্রয়াস ছাড়া একাজে সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন আগেই বলেছিলেন, টিভিতে প্রচারিত কিছু সিরিয়াল কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। অত্যন্ত সঠিক কথা। এই ব্যাপারটাকে রুখতে টিভিতে কুসংস্কারবিরোধী আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান বা সিরিয়াল করা যেতে পারে।
কুসংস্কার বস্তুত একটা শর্টকাট রাস্তা। যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে কাজ করার বদলে তা মানুষকে একটা অন্ধবিশ্বাসে বেঁধে ফেলে। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে আমাদের আর কিছুই করার নেই। যা ঘটবে তা সব আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে। তাকে শুধু মেশিনের মত কিছু নির্দিষ্ট কাজ করে যেতে হবে। এ ভাবে আমরা কোন কাজে নিজস্ব চেষ্টা ও উদ্যমকে অস্বীকার করতে শিখে যাই। বাঁধা পড়ে যাই শুধু কিছু আচার বিচার, তন্ত্র মন্ত্রের জালে। লালগড়ের তারাপদ, হাসনাবাদের কালিদাসী কিংবা চন্দননগরের গঙ্গার ঘাটে ভেলায় ভেসে আসা ছেলেটি, এরা সবাই মানুষের যুক্তিহীন বিশ্বাসের বলি। এদের হত্যা করেছে কুসংস্কার।