ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। সেসব ঘটনার কথাই ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে, যা কিছু ভালো, যা কিছু প্রথম, যা কিছু মানবসভ্যতার আশীর্বাদ। আবার এমন কিছু ঘটনাও ইতিহাসে ঠাঁই পায়, যা শোকের। এই ইতিহাসের দিনপঞ্জি অনুসারেই আজ নব ভারতের জনক রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যুদিন। সমাজ সংস্কারক, বহুভাষাবিদ, চিন্তাবিদ, পন্ডিত রাজা রামমোহন ১৮৩৩ সালে আজকের দিনেই ইংল্যান্ডে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ব্রিস্টলের কাছে স্টেপলটনে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬১ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর। ব্রিস্টলের আর্নস ভ্যালে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে।
উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায় পাশ্চাত্য জ্ঞান, রীতিনীতি ও চিন্তাধারার সঙ্গে ভারতীয় জ্ঞান, রীতিনীতি ও চিন্তাধারার সমন্বয় সৃষ্টির প্রথম কারিগর। বাংলা গদ্যের বিকাশ সাধনে তার অবদান চিরস্মরণীয়। প্রাচীন সংস্কৃত শাস্ত্রসমূহকে বাংলায় প্রকাশ করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, গৌড়ীয় ব্যাকরণসহ ৩০টি বাংলা গ্রন্থ ছাড়াও প্রায় ৪০টির মতো ইংরেজি গ্রন্থের রচয়িতা তিনি।
তাঁর জন্ম ১৭৭২ সালে হুগলীর রাধানগরে। তরুণ বয়সেই তার মধ্যে আধ্যাত্মিক চিন্তার উন্মেষ ঘটে। যৌবনে কিছুকাল পিতার জমিদারির তত্ত্বাবধান করেন। পরে ইংরেজ কোম্পানির কাগজ ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা করে সফলতা পান। ১৮০৩ সালে মুর্শিদাবাদে একেশ্বরবাদ সম্পর্কে তার তুহফাৎউল মুয়াহহিদীন প্রকাশিত হয় আরবি এবং ফার্সি ভাষায়। ধর্মীয় গোঁড়ামি ত্যাগ করে পাশ্চাত্য ধারায় জীবনযাপন করেছেন। ১৮১৫ তে একেশ্বর উপাসনার উদ্দেশ্যে গঠন করেন আত্মীয়সভা। তার প্রচারিত ধর্মমতের নাম দেয়া হয় ব্রাহ্মধর্ম। এ নিয়ে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের সঙ্গে তার তুমুল বিরোধ বাধে। বাইবেলের ব্যাখ্যা নিয়ে বিরোধ বাধে পাদ্রিদের সঙ্গেও। ১৮২৮ সালে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরসহ বিভিন্ন খ্যাতিমানদের সহায়তায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মসমাজ। পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারকল্পে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দু কলেজ, অ্যাংলো হিন্দু স্কুল। হিন্দুসমাজে প্রচলিত সতীদাহ প্রথার বিলোপ ঘটানো তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা কীর্তি। সংবাদপত্রের বিকাশেও তার অবদান অপরিসীম। ইংরেজি-বাংলা দু’ভাষাতেই তিনি প্রকাশ করেছেন ব্রাহ্মণ সেবধি। বাংলায় সম্বাদ কৌমুদী বহুল আলোচিত পত্রিকা। ফারসি ভাষায় করেছেন মীরাৎ-উল আখবার। দিল্লীর বাদশা কর্তৃক রাজা উপাধি লাভের পর রাজার দূত হিসেবে ইংল্যান্ড যান। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি ধর্মীয় কুসংস্কার উপেক্ষা করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ড যান। প্রসঙ্গত, এ বছর তাঁর জন্মদিনে গুগল একটি ডুডল বানিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। ডুডলটি বানিয়েছিলেন কানাডার টরোন্টো নিবাসী ইউএক্স ডিজাইনার এবং ইলাস্ট্রেটর বীনা মিস্ত্রী।