নাটের গুরু কি তবে সুগন্ধিই! শনিবার রাত আড়াইটে নাগাদ আগুন লাগার পর থেকেই তার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছিল। শেষমেশ প্রাথমিক অনুমানের ওপর নির্ভর করে জানা যাচ্ছে, বাগরি মার্কেটের নীচে ফুটপাতের একটি সুগন্ধির স্টল থেকেই বাগরি মার্কেটের বিল্ডিংয়ে আগুন ছড়িয়েছে। এমনটাই মনে করছেন পুলিশ ও দমকলের অফিসাররা। জানা গেছে বিল্ডিং লাগোয়া ওই স্টলে আগুন লাগতে দেখেছেন স্থানীয় এক বাসিন্দা। ওই প্রত্যক্ষদর্শীর খোঁজও পেয়েছেন তদন্তকারী অফিসাররা। বাগরি মার্কেটে আগুন লাগার কারণ খুঁজতে নেমে এলাকার ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ওই প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলেছেন দমকল ও পুলিশ অফিসারেরা। তা থেকে তাঁরা জানতে পেরেছেন, মার্কেটের নীচেই ফুটপাত একটি সুগন্ধির স্টল ছিল। স্টল বন্ধের পর যেখানে থাকবন্দী করা ছিল হরেক রকমের সুগন্ধি স্প্রে-র ক্যান। সেই স্টলেই প্রথমে আগুন লাগে। ওই স্প্রেতে স্পিরিট থাকার কারণে সুগন্ধির বোতল ফাটতে থাকে। স্টলের পাশেই ছিল একটি বিদ্যুতের পোল। স্টল থেকে আগুন ছড়ায় ওই পোলে। বিদ্যুতের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। এরপরই তা বাগরি মার্কেটের একাংশকে গ্রাস করে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে গোটা মার্কেটেই। তাছাড়া, বাজারের বিভিন্ন এলাকায় ছিল প্লাস্টিক, পলিথিন থেকে শুরু করে গ্যাসের সিলিন্ডার। আগুন যত ছড়িয়েছে, বিকট শব্দে ফেটেছে সিলিন্ডারগুলি। এছাড়াও সমস্ত তলেই রয়েছে অসংখ্য এসি মেশিন। আগুন লাগার পর সেগুলিও ফাটতে শুরু করে। ফলে আগুন আরও ভয়াবহ আকার নেয়।
রাতেই ঘটনাস্থলে গেছিলেন কলকাতার মেয়র তথা দমকলমন্ত্রী শোভন চ্যাটার্জি এবং কলকাতার নগরপাল রাজীব কুমার। তাঁরা দীর্ঘ সময় আগুন নেভানোর কাজ তদারকি করেন। আসেন পুরসভা এবং কলকাতা পুলিসের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট দপ্তরের কর্মীরা। রবিবার সারাদিন দমকলকর্মীরা বাজারের বিভিন্ন তলায় আগুন নিভিয়েছেন। কিন্তু স্বস্তি পাননি। কারণ, আবার অন্যত্র দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে আগুন। দমকলের হোসপাইপ ও জেট লাগিয়ে আগুন আয়ত্তে আনার কাজ চলে। সারাদিনই দফায় দফায় পুলিসের তরফে মাইকিং করে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে বলা হয়। অবাঞ্ছিত দর্শকের ভিড়ও সরাতে হয় মাইকিং করে। যত সময় গড়িয়েছে, তত বেড়েছে আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ। শেষে রাতে ঠিক হয়েছে, এলাকা থেকে সমস্ত গাড়ি সরিয়ে অপরিসর ক্যানিং স্ট্রিট খালি করে সেখানে টার্ন টেবিল ল্যাডার বা উঁচু মই নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হবে।
বাগরি মার্কেটে রয়েছে প্রায় ১২০০ দোকান। একটি দোকানের ভেতরে আবার পার্টিশন দিয়ে দু–তিনটি দোকান করা হয়েছে। প্রতিটি তলেই কমবেশি ১০০ দোকান। সঙ্গে দোকানের ভেতর– বাইরে মজুত করা বিভিন্ন সামগ্রী। ডাঁই করা বিভিন্ন জিনিসপত্র। পাইকারি ব্যবসার এই কেন্দ্র ঘিরে বাজারের একতলা এবং সামনের ফুটপাথেও চলে ব্যবসা। সেই ব্যবসার যোগাযোগের প্রয়োজনেই গোটা বাড়িতেই জড়িয়ে অজস্র টেলিফোনের তার, কেবল এবং বিদ্যুতের লাইন। গোটা বাড়িতেই পারফিউম, প্লাস্টিক, জুয়েলারি, কেমিক্যাল, খেলনা, গৃহস্থালির বিভিন্ন সামগ্রীর বাজার। কিন্তু এত রাতে কীভাবে সেখানে আগুন লাগল, তা নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, এই অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা নয়, এর পিছনে অন্তর্ঘাত রয়েছে। শুধু ফুটপাত থেকে নয়, বাড়ির ভিতরেও আগুন লাগানো হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ। এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের কারণ খুঁজতে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। প্রয়োজনে অগ্নিকাণ্ডের তদন্তে সমস্ত দফতরকে নিয়ে সিট গড়া হবে বলে সূত্রের খবর। তবে ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, মাত্র কয়েকঘণ্টার মধ্যে আগুন এই বিল্ডিংয়ের একটি ব্লকে যেভাবে ছড়িয়েছে, তা শুধুমাত্র ফুটপাতের স্টলের আগুন থেকে সম্ভব নয়। বাড়ির বিভিন্ন তলায় ঢুকে কেউ বা কারা আগুন লাগানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। তাঁদের আরও দাবি, অত রাতে স্টলে কী করে আগুন ধরল, সেটাও বড় প্রশ্ন। বিদ্যুতের ওই পোলে কোনও শর্ট সার্কিট হয়নি। তাই স্টলের আগুনকে স্বাভাবিক দেখছেন না তাঁরা। এর পিছনে অন্য রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন। সেখান থেকেই অন্তর্ঘাতের সম্ভাবনা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে, মানছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মতে, এই বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তারক্ষীদের জেরা করা প্রয়োজন। তাঁদের থেকেই জানা সম্ভব গভীর রাতে এই বিল্ডিংয়ের ভিতরে বা সামনে কেউ ঘোরাঘুরি করছিল কি না। সেই কারণে ওই এলাকার সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা প্রয়োজন। বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তারক্ষীদের খোঁজা হচ্ছে। মার্কেটের রিজার্ভারে যে জল ছিল না, সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত তদন্তকারী অফিসাররা। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে কে বা কারা, তাঁদের চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা পুলিশকে জানিয়েছেন, এই বাড়িটির মালিকানা রাধা বাগড়ির। কিন্তু বাড়িটি জবরদখল করে রয়ছেন অন্যরা। এই কারণে মালিক আদালতে মামলা করেন। সম্প্রতি আদালত জরদখলকারীদের উচ্ছেদের নির্দেশ দিয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। তারপরই এই ঘটনা ঘটায় অন্য ইঙ্গিত মিলছে তাঁদের বক্তব্য। বাড়ির মালকিন রাধা বাগড়ির বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে গেলে কেয়ারটেকার জানান, তিনি বাইরে আছেন। রাধা বাগড়ি ফোনে জানিয়েছেন, আগুনের খবর তিনি শুনেছেন। এই ঘটনায় তিনি অত্যন্ত উদ্বেগে রয়েছেন।
ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে মেয়র জানান, পুরসভা থেকে বাজারগুলো পরিদর্শন করার পর ওই বাজারের কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হয়েছিল। নোটিশও পাঠানো হয়েছে। যথাযথ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা রাখতে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এজন্য পুরসভা সব সাহায্য করবে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের তরফে উদ্যোগ দেখা যায়নি। কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (বাজার) আমিরুদ্দিন ববি জানান, এটি একটি বেসরকারি বাজার। ডিজি (ফায়ার) জগমোহনও বলেন, ‘বাড়িটিতে দাহ্য পদার্থ এবং কেমিক্যাল জাতীয় জিনিস ছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না।’ তিনি জানান, ওই বিষয়ে দমকল আলাদা করে তদন্ত করবে।
বাড়িটির একতলায় একজন নিরাপত্তারক্ষী তাঁর পরিবার নিয়ে থাকতেন। পুলিস তাঁদের উদ্ধার করে অন্যত্র নিয়ে যায়। অভিযোগ ওঠে, রাতে বাড়িটির সবক’টি গেটেই তালা লাগানো ছিল বলে ভেতরে ঢুকে ব্যবসায়ীরা তাঁদের জিনিসপত্র সরাতে পারেননি। ব্যবসায়ীদের একাংশের অভিযোগ, বাজারে বর্গফুট হিসেবে দোকানঘর ভাড়া দেওয়া হত। ভাড়া নেওয়ার আগে লক্ষ লক্ষ টাকা অগ্রিমও দিতে হত। দীর্ঘসময় ধরে আগুনের তাপে গোটা বাড়িটির বিভিন্ন অংশের প্লাস্টার খসে পড়ে। দমকলকর্মীরা সবচেয়ে অসুবিধায় পড়েন অজস্র কেব্ল লাইন ও তারের জাল সরিয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে। সমস্ত তলেরই জানলাগুলি বন্ধ ছিল। ফলে গ্যাসকাটার দিয়ে একতলার দোকানের সামনের দিকের শাটারগুলি কেটে জলের পাইপ দিয়ে আগুন নেভানোর কাজ চলে।