বিগত কয়েকবছর ধরেই দিন-রাত এক করে মেট্রোর কাজ চলছে শহরে। মাটির উপর এবং নীচে ভারী ভারী যন্ত্রদানবের অত্যাচারে, রোজই মুহুর্মুহু কেঁপে ওঠে আশেপাশের তল্লাট। জোকা-বিবাদী বাগ মেট্রোর জন্যেও তেমন দীর্ঘদিন ধরেই কাজ চলছে মাঝেরহাট ব্রিজের ঠিক পাশেই। মেট্রোর বিভিন্ন ভারী ভারী যন্ত্রের ধাক্কায়, পাশের এই মাঝেরহাট ব্রিজও নির্ঘাত কেঁপেছিল কোনও না কোনও সময়। না হলে হঠাতই এভাবে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে কেন? মাত্র ছ’মাস আগেই ফিট সার্টিফিকেট পায় এই সেতু। তৎকালীন পূর্ত সচিব ইন্দিবর পাণ্ডে এই ব্রিজকে ফিট সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। এরপর কী ভাবে ভেঙে পড়ল এই ব্রিজ, তার জন্য উচ্চপর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৈরি হয়েছে মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে কমিটিও। ঘটনাস্থলে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেছে ফরেনসিক টিম।
মঙ্গলবার বিকেলে মাঝেরহাটে সেতুভঙ্গের পর স্থানীয় মানুষের মনে গেড়ে বসেছে এই প্রশ্ন। তাঁদের অভিযোগ, জোকা-বিবাদী বাগ মেট্রো প্রকল্পের ধুন্ধুমার কাজের ফলে যে মাঝেরহাট ব্রিজের ভিত নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কারও নজর পড়েনি। তারই খেসারত দিতে হল এদিন। যদিও মেট্রো কর্তৃপক্ষের দাবি, মাঝেরহাটে সেতু বিপর্যয়ের পিছনে মেট্রোর কাজের কোনও ভূমিকা নেই। তাদের ব্যাখ্যা, ওই এলাকায় মেট্রোর মাটির উপর পিলার তৈরির এবং খোঁড়াখুড়ির কাজ এক বছর আগে শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন মাটির উপরে স্ল্যাব তৈরির কাজ চলছে। ফলে এখন এই দুর্ঘটনা মেট্রোর কাজের জন্য হওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু মেট্রো কর্তৃপক্ষ যা-ই বলুক, সংশয় থেকেই যাচ্ছে। প্রস্তাবিত জোকা-বিবাদি-বাগ মেট্রো রুটের একটা বড় অংশ পড়ছে মাঝেরহাটের এই অঞ্চলে। যা তৈরি করছে রেল বিকাশ নিগম লিমিটেড বা আরভিএনএল। পুরো প্রকল্পটিই মাটির উপরে। অর্থাৎ এলিভেটেড মেট্রো। আর সেই প্রকল্প রূপায়ণ করতে গিয়ে পুরো এলাকাজুড়ে চলছে কর্মযজ্ঞ। বছর কয়েক ধরেই একের পর এক উঠছে পিলার, মাটিতে খোঁড়া হচ্ছে ৩০-৪০ ফুটের গর্ত। ফলে বৃষ্টিতে সেখানে জল জমছে। মাটি আলগা হচ্ছে। সঙ্গে যন্ত্র চলায় এলাকায় কাঁপুনিও। এই সমস্তকিছুই ব্রিজের গোড়াতে গলদ তৈরি করে দিয়েছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞদের একাংশের অভিমত।
মাঝেরহাট ব্রিজের এই পরিণতির আভাস বছর দুই আগেই পেয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। মেট্রোর পাইলিংয়ের কাজ শুরু হতেই থর থর করে কেঁপে উঠত গোটা ব্রিজটি। এ বিষয়ে মেট্রোর ইঞ্জিনিয়ারদের তাঁরা সতর্কও করেছিলেন বলে দাবি করছেন বাসিন্দারা। কিন্তু অভিযোগ, তাঁদের কথাকে গুরুত্ব দেয়নি মেট্রো কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার গোলাম মোস্তাফা নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমাদের কথা শুনলে এই ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত। মেট্রোর কাজ শুরুর পর থেকেই আশঙ্কার প্রহর গুনছিলেন স্থানীয়রা। তাঁদের দাবি, পাইলিংয়ের ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে রীতিমতো কাঁপতো ব্রিজটি। মাটির উপরে মেট্রোর লাইন তৈরির পিলার বানানোর জন্য গভীর গর্ত খোঁড়ার কাজ চলছিল। তাতে ব্যবহৃত হচ্ছিল নানারকম ভারী ভারী যন্ত্রাদি। স্থানীয় লোকেদের একাংশ মনে করছেন, এই সকল যন্ত্রের অত্যাচারেই নাকি দুর্বল ব্রিজটি দিনে দিনে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে এবং অবশেষে তা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে গতকাল।