থিমপুজোর বাড়বাড়ন্তের পর থেকে সাবেকি প্রতিমার চাহিদা কিছুটা হলেও কমেছে। কিন্তু এই থিমপুজোর হাত ধরেই সাবেকি সাজসজ্জার ছোট সাইজের দুর্গা প্রতিমার চাহিদা আবার বেড়েছে। যার ফলে বিশাল সাইজের প্রতিমা না বানিয়েও দেড় থেকে তিন ফুট উচ্চতার ছোট ছোট মূর্তি বানিয়েই বছরের পর বছর জীবিকা নির্বাহ করছেন কুমোরটুলির একাধিক মৃৎশিল্পী। ছোট প্রতিমা বানানোর অন্যতম সুবিধা হল, কুমোরটুলির ঘিঞ্জি এলাকায় জায়গার সঙ্কট হলেও খুব ছোট্ট একটি ঘরে রেখে দেওয়া যাচ্ছে ৩০-৪০টি এমন দুর্গাপ্রতিমা। এই ধরনের প্রতিমা যে শুধু থিমপুজোর কর্মকর্তারা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন, এমন নয়। শহর ও শহরতলির বিভিন্ন আবাসনে ১০-১২টি পরিবার মিলে যে অজস্র ছোট ছোট পুজো হয়, তারাও কেনেন এমন প্রতিমা।
এখন পুজোর বহুদিন আগে পেশাদার থিমশিল্পীকে দিয়ে থিমভাবনা ঠিক করা হয়। অনেক বছর আগে বোসপুকুরে মাটির ভাঁড়ের মণ্ডপ দিয়ে যে থিমপুজোর বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল, তা এখন জাঁকিয়ে বসেছে শহরের ছোট-মাঝারি-বড় সব ধরনের পুজোতেই। কিন্তু থিমপুজোর কর্তারা এমন ছোট প্রতিমা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন কেন? এখানকার শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, থিমপুজোয় সাবেকি মৃন্ময়ী মূর্তির বদলে কোথাও বসানো হচ্ছে ফাইভার গ্লাস, কোথাও কাঠ বা পাথরের মূর্তি। কিন্তু নিয়মনীতি মেনে পুজো করতে হলে মাটির প্রতিমাই দরকার। আবার কোথাও থিমের মধ্যেই সাবেকি ঘরানার বা মাটির মূর্তি থাকলেও, তা এতটাই উচ্চতাবিশিষ্ট হয় যে, পুরোহিত পুজোর সময় মূর্তির গলায় মালা পরাতে পারেন না। এসব দিক বিবেচনা করেই দর্শনীয় প্রতিমার ঠিক নীচেই মাটির তৈরি ছোট্ট সাইজের প্রতিমা রাখা হয়। সেই ছোট মূর্তিকেই পুজো করা হয়। আর বড় প্রতিমা থাকে কেবল দর্শনের জন্য। কলকাতার মাঝারি ও বড় পুজোগুলির প্রায় সবক্ষেত্রেই এটা লক্ষ্য করা যায়। তাই কলকাতায় থিমকেন্দ্রিক পুজোর চল এসে সাবেকি মাটির প্রতিমার চাহিদা কমালেও, এই ছোট সাইজের প্রতিমার নতুন করে চাহিদা বেড়েছে। থিমপুজোর সঙ্গে পাল্লা দিয়েই। এমনটাই জানাচ্ছেন মৃৎশিল্পী বঙ্কিম পাল, ভানু রুদ্রপাল, মালা পাল, কাকলি পাল’রা। সারা কুমোরটুলিতে ঘুরলে দেখা যাবে, বড় বড় সাইজের দুর্গাপ্রতিমা স্টুডিওর ছাদ ছুঁয়ে ফেলেছে। কিন্তু এই শিল্পীদের স্টুডিওতে গেলে দেখা যাবে, দেড়-দু’ফুট উচ্চতার অনেক সংখ্যক প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত তাঁরা।
কথা হচ্ছিল বঙ্কিম পালের সঙ্গে। তিনি বলেন, থিমপুজোর জন্য যা-ই হোক না কেন, সবারই এই সাবেকি প্রতিমার দরকার পড়ে। ফি-বছর এরকম প্রতিমা ৫০-৬০টি তৈরি করেন তিনি। এক-একটির দাম পড়ে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা। আবার বিদেশে পাঠানোও হয় এমন প্রতিমা। বড় সাইজের প্রতিমা বিদেশে নিয়ে যেতে গেলে নানা কর, কাস্টমসের ঝক্কি অনেক। এই রকম প্রতিমা ‘প্যাকিং’ করার অনেক সুবিধা আছে। শিল্পী কাকলিদেবী বলেন, অনেক আবাসনে ১০-১২টি পরিবার মিলে নিজেদের মতো অনাড়ম্বর পুজো আয়োজন করে। তাঁরা কুমোরটুলি এসে এরকম ছোট সাইজের প্রতিমা খোঁজেন। তবে বড় পুজোকমিটিগুলি মূল পুজোর জন্য এই প্রতিমা বেশি নিয়ে যান। মহিলা মৃৎশিল্পী মালা পাল, ভানু রুদ্রপাল বলেন, আমাদের তো এমন মূর্তিই বেশি তৈরি হয়। বিভিন্ন হস্তশিল্প প্রদর্শনী, সরকারি উদ্যোগে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরে প্রদর্শনের জন্য এরকম মূর্তিই বেশি তৈরি করি। এগুলি নিয়ে যেতেও সুবিধে। আবার বিক্রিও হয়ে যায়। না বিক্রি হলেও খুব বেশি লোকসানের কবলে পড়তে হয় না। জায়গাও অনেক কম লাগায় সুবিধা আছে বলে জানান তাঁরা।