হাওড়া ব্রিজের সঙ্গে পাগলদের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। না হলে মাঝে মধ্যেই কেন বেমক্কা সাঁকো নড়ে, আর পাগলেরা হাওড়া ব্রিজের মগডালে চেপে বসে বাদশাহি মেজাজে? এই আরোহণ অভিযান কত বার যে ‘খবর’ হয়েছে! ব্রিজের বপুটি নেহাত ক্ষুদ্র নয়। হেঁটে পেরনোর সময় বোঝা যায়, বাপ রে কী দানবিক স্ট্রাকচার! ব্রিজের মগডালের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। মন্থর হয়ে আসে মণি। আরও একটি কারণে হাওড়া ব্রিজ থেকে থেকেই ‘খবর’ হয়েছে। সেটার সৌজন্যে বাংলা বনধ। বনধের পরের দিনের কাগজে বেরত শুনশান হাওড়া ব্রিজের ছবি। নীরব, নিশ্চুপ, নিস্তরঙ্গ। জ্যাম ও জীবনের জমজমে রসরঙ্গ হারিয়ে খানিক বা উদাসীন। স্থির শূণ্যতা থেকে এই ব্রিজ দেখছে – নীচের এই নদী ও নিয়ন্ত্রণহীনতা, চরাচর ও চালচলন, তার দৃষ্টিপাত পদ্মপাতায় লেগে থাকা জলের মতো অনাবিল। একাকীত্বে অপরূপ।
‘হাওড়া ব্রিজ চলে মস্ত সে বিছে/ হ্যারিসন রোড চলে তার পিছে পিছে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সহজ পাঠ’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে যে হাওড়া ব্রিজ দেখেছিলেন সেটা সাবেক পল্টুন ব্রিজ। সেই উনিশ শতকেই স্যর ব্র্যাডফোর্ড লেসলির তত্বাবধানে তৈরি। নীচ দিয়ে জাহাজ বা জলযান যাতায়াতের জন্য ওই ব্রিজ ভাঁজ করা যেত। দু’দিক দিয়ে উঠে যেত পাটাতন।
বিলেত থেকে জাহাজে সেতুর কাঠামো নিয়ে এসে কলকাতায় জোড়া লাগিয়ে হুগলী নদীর বুকে তৈরি হয়েছিল পল্টুন ব্রিজ। ১৫২৮ ফুট লম্বা পল্টুন ব্রিজ চওড়ায় ছিল ৬২ ফুট। আরও ৭ ফুট করে পথচারীদের চলাচলের পথ ছিল। সেকালে পল্টুন ব্রিজ তৈরি করতে খরচ পড়েছিল ২২ লক্ষ টাকা। ১৯০৬ সাল থেকেই পোর্ট ট্রাস্ট-সহ বাংলা সরকার ভাবতে থাকল পল্টুন সেতুর বদলে স্থায়ী ঝুলন্ত সাসপেনশন ব্রিজের কথা। সেই মতো ১৯০৬ সালেই কমিটি গড়ল ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আর এস হাইটের নেতৃত্বে। কমিটি ফ্লোটিং ব্রিজ গড়ার সুপারিশ করল।
হাওড়া ব্রিজের ওপর বারবার যুদ্ধের ছায়া পড়েছে। এর মধ্যে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লি স্থানান্তরিত হয়েছে। ফলে সেতু গড়ার প্রস্তুতিতে বিঘ্ন ঘটেছে বারবার। এরমধ্যে বিখ্যাত ব্রিটিশ স্থপতি জেমস এম রেনডেল এবং তাঁর দুই সঙ্গী ইঞ্জিনিয়ার পালমার এবং ট্রিটন নতুন হাওড়া সেতুর নকশা আঁকলেন। ১৯৩৫ সালে নতুন হাওড়া ব্রিজ গড়ার বরাত দেওয়া হল ‘ব্রেথওয়েট’, ‘বার্ণ’ এবং ‘জেশপ’ সংস্থাকে। ১৯৩৬ সাল থেকে শুরু হল নতুন হাওড়া ব্রিজ তৈরির কাজ।
ব্রিজের প্রায় ৭০ শতাংশ কাজ যখন হয়ে গিয়েছে, সেই সময় শুরু হল দ্বিতীয় বিশবযুদ্ধ। সেই যুদ্ধ তুঙ্গে উঠল ১৯৪১ সালে জাপানি বিমানবহর পার্ল হারবার আক্রমণ করায়। তারওপর খিদিরপুর বন্দরে জাপানি হানার ঘটনায় নির্মীয়মান হাওড়া ব্রিজে বিমানহানার ভয় জাগল। এর মধ্যেই কাজ চলেছে দ্রুত গতিতে। ততদিনে মিত্রবাহিনীর শরিক মার্কিন সেনারাও কলকাতায় এসে গিয়েছে। তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪২ সালে শেষ হল ৮২ মিটার অর্থাৎ ২৬৯ ফুট উঁচু হাওড়া ব্রিজের নির্মাণ কাজ। ব্রিজ তৈরিতে লেগেছিল ২৬ হাজার ৫০০ টন ইস্পাত। সরবরাহ করেছিল টাটা স্টিল। এর মধ্যে ২৩ হাজার টন ছিল উন্নত মানের ট্রিসক্রম স্টিল। জাপানি বিমানহানার ভীতিতেই ৭৫ বছর আগে নিউ হাওড়া ব্রিজের উদ্বোধন ঘটা করে হয়নি। আগে থেকে কোনও ঘোষণাও হয়নি। ১৯৪৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে একটি ট্রাম কলকাতার দিক থেকে নতুন ব্রিজ ধরে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছয়। চালু হয়ে যায় নিউ হাওড়া ব্রিজ।
ব্রিজটিকে প্রথম থেকে নিউ হাওড়া ব্রিজই বলা হত। সরকারি নথিপত্রেও এই নাম, লোকমুখে তা হাওড়া ব্রিজই। এখনও বলা হয়, তবে ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন সরকারিভাবে এই সেতুর নামকরণ হয় রবীন্দ্র সেতু। সেতুর নকশা সাসপেনশন টাইপ, ব্যালান্সড কান্টিলিভার ট্রাস আর্চ। প্রতিদিন রবীন্দ্র সেতু দিয়ে এক লক্ষ যান চলাচল করে। পথচারী যাতায়াত করেন দেড় লক্ষ।
ভিনদেশীর কাছে হাওড়া ব্রিজ এক আকর্ষনের বিষয়। দৃশ্য কলকাতা বোঝাতে হাওড়া ব্রিজ দেখানো ছাড়া গতি নেই পরিচালকদের। ১৯৫৮ সালে নির্মিত ‘হাওড়া ব্রিজ’ জনপ্রিয় ছবি। এমনকি দোমেনিক ল্যাপিয়েরের কাহিনী থেকে রোলান্ড জফে যখন ‘সিটি অফ জয়’ করেন, পোস্টারে উঁকি দিয়ে যায় রবীন্দ্র সেতু। ২০০৭-এর আগস্টে ভারতীয় ডাক বিভাগ হাওড়া ব্রিজের ছবি-সহ ৫ টাকা মূল্যের ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। মেট্রো রেলের টোকেনেও জায়গা হাওড়া ব্রিজ। হাওড়া ব্রিজ আসলে চলমান কলকাতা মহানগরীর প্রতীক। রূপালী রঙের দুমুখ উঁচিয়ে থাকা সেতু সূর্যাস্তের শেষ আলোয় রং বদলায়। প্রবহমান গঙ্গাকে বুকে ধরে দুটি শহরকে বেঁধেছে এই হাওড়া ব্রিজ। তাই সে শুধু হাওড়া ও কলকাতার সেতু নয়, ব্যাপ্তি ও শূণ্যতার বন্ধনও। আমাদের মতো গড়পড়তা মানুষের কাছে হাওড়া ব্রিজ তাই বিস্ময়ের সমার্থক। যতটা চওড়া নয়, তার চেয়েও বেশী চওড়া। যতটা ইতিহাস নয়, তার চেয়েও বেশী ইতিহাস।