মুথুভেল করুণানিধি। জনতার কালাইনার।
তিনি যখন প্রথম বিধানসভায় নির্বাচিত হন, তখন জওহরলাল নেহরু ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আজ নেহরুর চতুর্থ প্রজন্ম রাজনীতিতে, অথচ তিনি তখনও রাজনীতির ময়দানে। নটআউট। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত স্বপ্ন ছিল, বিধানসভা নির্বাচনে জয়ললিতার দল এডিএমকেকে হটিয়ে তাঁর দল ডিএমকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে তিনিই হবেন তামিল মুখ্যমন্ত্রী। নিজেকে ৯৪ পেরনো নবতিপর যুবক বলেই মনে করতেন। এক সময় তাঁর আগুন ঝরানো বক্তৃতা মুগ্ধ করে রাখত লাখো তামিল হৃদয়।
কন্যাকুমারী থেকে কাঞ্চিপুরম, তাঁকে এক নজর দেখতে জনসভাগুলোতে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ছিল চোখ সওয়া। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য লোকজন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে। তিনি পৌঁছলেই সভায় আতসবাজির আলো। চেণ্ডা মেলমের ঢাক। কম্বু সানাই। জনতার ‘ডক্টর কালাইগনার’-এর নামে জয়ধ্বনি। মঞ্চে কালো চশমা পরে হুইলচেয়ারে বসে তিনি। এসবই ছিল তামিল রাজনীতিতে চিরপরিচিত ছবি। প্রিয় নেতাকে এক নজর দেখা, তাঁর পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ কামনা তো ছিল সাধারণ ঘটনা। হবেই বা না কেন? পাঁচবারের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। তামিল রাজনীতির অন্যতম স্তম্ভ সিএন আন্নাদুরাইয়ের শিষ্য ধীরে ধীরে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। আন্না শিষ্যদের মধ্যে রামচমন্দ্রন, জয়ললিতার সঙ্গেই তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে এতকাল। গুরু-শিষ্য পরম্পরায় জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছেন প্রত্যেকেই। সেই প্রজন্মের শেষ নেতা হলেন মুথুভেল করুণানিধি।
রোমাপুরী পাণ্ড্যিয়ান। তামিল রাজা পেরুভারুথি পাণ্ড্যিয়ানের সঙ্গে সুদূর রোম সাম্রাজ্যের মিত্রতার কাহিনী। সেই ঐতিহাসিক উপন্যাসকে ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছিল মেগাসিরিয়াল। ডিএমকে-র সদর দপ্তরে আজও তার বিরাট হোর্ডিং। ঔপন্যাসিকের নাম এম করুণানিধি। দ্রাবিড় রাজনীতির এই বৃদ্ধ সম্রাটের নিজের জীবনও যেন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা গল্প। তামিল রাজনীতিতে তিনি যে অনুগামীদের প্রিয় ‘কালাইগনার’। শিল্পী। নিখুঁত চিত্রনাট্য তাঁর। সিনেমার চিত্রনাট্য লেখার পাশাপাশি তিনি অনেক উপন্যাস, গল্প, গান ও কবিতাও রচনা করেছেন। তামিল সাহিত্য ও সিনেমায় তাঁর অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করা হয়।
১৯২৪ সালের ৩ জুন তামিলনাড়ুর থিরুভারুর জেলায় জন্ম। বিদ্যালয়ের শিক্ষা তিনি সমাপ্ত করতে পারেনি। পরে নাম লেখান তামিল চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখক হিসেবে। তিনি দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। যে দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম (ডিএমকে)-এর আত্মপ্রকাশ ১৯৪৯ সালে। ১৯৫৭ সালে প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৩ বার নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এবং সবক’টিতেই নির্বাচিত হয়েছেন। পাঁচবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাঁর জনপ্রিয়তার শিকড় তৃণমূলের অনেক গভীরে। তামিলনাড়ুতে বিগত ছয়-সাত দশকে যা কিছু পরিবর্তন হয়েছে সবকিছুর সঙ্গে জড়িত করুণানিধি।
প্রথম স্ত্রী পদ্মাবতীর মৃত্যুর পর দু’বার পাণিগ্রহণ করেছেন। আলাগিরি-স্ট্যালিন-তামিলারাসুর মা দয়ালু আম্মালকে তিনি ডাকতেন ‘মানাইভি’ বা ‘স্ত্রী’ বলে। দয়ালু থাকেন গোপালপুরমের বাড়িতে। এক কিলোমিটার দূরের সিআইটি কলোনির বাংলোয় থাকেন আরও এক স্ত্রী। কানিমোঝি-র মা রজতী আম্মাল। যাঁকে করুণা ‘থুনাইভি’ বা সঙ্গিনী বলে সম্বোধন করতেন। করুণানিধি কাজকর্ম করতেন দয়ালুর বাড়িতে বসে, বিশ্রাম নিতেন রজতীর বাংলোয়। গোটা চেন্নাই জুড়েই করুণানিধি এবং তাঁর ভাগ্নে মারানদের পরিবার ও ট্রাস্টের অগুন্তি বাংলো, স্থাবর সম্পত্তি। এক দিকে তাঁর রাজ্যপাট নিয়ে দুই পুত্রের লড়াই। সিংহাসন থেকে বঞ্চিত হয়ে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন বিতাড়িত জ্যেষ্ঠ পুত্র আলাগিরি। এই বিদ্রোহের পিছনে রয়েছে ডিএমকে ট্রাস্টের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি। করুণানিধি অবশ্য নিজের উত্তরসূরী হিসেবে বেছে নিয়েছেন পুত্র স্ট্যালিনকেই। তা নিয়ে বিবাদ কম হয়নি করুণানিধির সংসারে। স্ট্যালিনই ডিএমকে-র কোষাধ্যক্ষ। তাঁর পকেটেই কোষাগারের চাবি। কত টাকার সম্পত্তি? আমজনতা অবশ্য তার আন্দাজই করতে পারে না। অন্য দিকে তাঁর কন্যা কানিমোঝি, ভাগ্নে-পুত্র দয়ানিধি মারান থেকে শুরু করে প্রিয় শিষ্য এ রাজার নামে দুর্নীতির কালিমা। ইউপিএ-সরকারের টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির জালে জড়িয়ে থাকা করুণানিধির গোটা পরিবার হালে মুক্তি দিয়েছে আদালত। লড়াই তাই ছিল ঘরে ও বাইরে— সর্বত্র। যা সামাল দিতে গোপালপুরমের দোতলা বাড়ি থেকে প্রতি সন্ধ্যায় স্বয়ংক্রিয় হুইলচেয়ারে বসেই বেরিয়ে পড়তে হতো নবতিপর করুণানিধিকে। জনগণের দরবারে।
তাঁর দিন শুরু হতো ঘড়ির কাঁটা মেলানো ভোর পাঁচটায়। যদিও শেষদিনগুলিতে সূর্য পাটে বসার আগে আর প্রচারে বের হতে পারতেন না তিনি। বহু বছর ধরে মেনে চলা প্রাতর্ভ্রমণ আর করতে পারেন না। প্রাতর্ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এম নাগানাথন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান। ডিএমকে জমানায় রাজ্যের যোজনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যানও বটে। প্রাতর্ভ্রমণ না করতে পারলেও কিন্তু নিজের শেষ লড়াইয়ের জন্য ফিট থাকতে ভোরবেলায় হুইলচেয়ারে বসেই পনেরো মিনিট যোগব্যায়াম সেরে নিতেন রুটিনমাফিক। দুপুরে কিলিংগা অর্থাৎ শংকর মাছের আগুন-ঝাল ‘কারি’ বা প্রিয় কড়াই বিরিয়ানি আর সহ্য হতো না। খাওয়াদাওয়া হয়ে গিয়েছিল অতি সাদামাঠা। তবে রোজ চাই দিশি মুর্গির স্টু। আর দিনে অন্তত ৫ কাপ কফি।
তামিলনাড়ুর তিরুভারুভার জেলার তিরুকুভালাই গ্রাম থেকে উঠে এসে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যিনি দক্ষিণের এই রাজ্যে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন এক পৃথক সাম্রাজ্য। আন্নাদুরাইয়ের হাতে গড়া দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাঘাম (ডিএমকে) তাঁর হাত ধরেই জাতীয় রাজনীতিতে এখন একটা ‘ফ্যাক্টর’। তামিল রাজনীতিকে নিজের হাতের তালুর মতো চেনা করুণানিধি বিলক্ষণ টের পেয়েছেন জীবনের লড়াই। যাকে বলে ‘কাঁটে কা টক্কর’। তাঁর উত্থানের প্রতিটি ধাপেই জড়িয়ে রয়েছে কত কাহিনি। সেই চল্লিশের দশকে একজন নাস্তিক ও স্বঘোষিত যুক্তিবাদী হিসেবে তিনি দ্রাবিড় আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতিতে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। এই আন্দোলন ব্রাহ্মণদের বর্ণ শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল এবং তিনি রাজ্য জুড়ে হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশ সংগঠিত করেছিলেন। সালটা ছিল ১৯৭০। দেশের মন্দিরে ‘পৌরহিত্য পেশায়’ কোনও জাত-পাতের বিভেদ থাকবে না। ব্রাহ্মণ ছাড়াও অব্রাহ্মণ, সমাজের তফসিলি জাতি এবং উপজাতির অন্তর্ভুক্ত যেকোনও ব্যক্তিও মন্দিরের পুরোহিত হতে পারবেন। এমনই একটি বিষয়ই সুপ্রিম কোর্টে পাশ করানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে, ১৯৭০ সালে সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে। পরে ২০০৬ সালে ফের সেই অর্ডারটি রাজ্যে পাশ করান করুণানিধি। এরপর সুপ্রিম কোর্টেও ওঠে বিষয়টি। তবে, এবার সুপ্রিম কোর্ট করুণানিধির এই নির্দেশকে সমর্থন করে। করুণানিধির যুক্তি ছিল, মন্দিরে পৌরহিত্য করার অধিকার সকলেরই রয়েছে। শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের এই অধিকার থাকলে অন্যদের মনে ক্ষোভ থাকতে পারে। সেই ক্ষোভ দূর করতেই দশকের পর দশক ধরে চলে আসা নিয়মের বিরোধিতা করে গিয়েছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে এই নির্দেশ পাশ হতেই ২০৬ জন পুরোহিতের ট্রেনিং নিতেও শুরু করেন। যাদের মধ্যে ২৪ জন ছিলেন তফসিলি জাতি, উপজাতির। যারা তামিলনাড়ুর একাধিক মন্দির থেকে এবং চ্যারিটেবল এনডাউনমেন্ট বিভাগ থেকে জুনিয়ার পুরোহিতের সার্টিফিকেট পান। আসলে বিপুল সংখ্যক মানুষ তাঁকে একজন অভিজ্ঞ প্রশাসক হিসেবে বিবেচনা করেন। যে কারণে, তামিলনাড়ুর মানুষ মনে করত, যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁকে ছাড়া নির্বাচন কল্পনাও করা যায় না। তাঁর বয়স ৯৯ বা ১০৯ যা-ই হোক না কেন, বেঁচে থাকলে তিনি রাজনীতি করবেন এবং নির্বাচনেও দাঁড়াবেন। এটাই বাস্তবতা।
কালাইনারের জীবনাবসানে শেষ হয়ে গেল তামিল তথা ভারতীয় রাজনীতির একটি বর্ণময় সুদীর্ঘ যুগ।