কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স একদা বলিয়াছিলেন, “শোষিত মানুষের কাছে ধর্ম আফিম স্বরুপ “। এরপর রাইন, ভলগা, গঙ্গা, যমুনা দিয়া অনেক জল গড়াইয়াছে। লেনিনের পাদদেশে প্রনামীর থালা রেখে আসা হইয়াছে কারণ তিনি বাদে বাকি সব মূর্তি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো। তিনি সর্বশক্তিমান, প্রোলেতারিয়েত, ছবির ফ্রেমে বিপ্লবী মোটিভেশন। ভ্যাটিকান যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ যীশুকে জিসাস এ বদলে ফেলে অমরত্ব দান করেছিলেন, কমরেডস ও তাই করেছেন ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভকে। ঠাকুরের একটু নিচে, মহান বিপ্লবীর অনেক উপরে।
অখন্ড কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পিসি জোশীকে একসময় সমালোচনার মুখে পরতে হয়েছিল, কারণ তিনি চাইতেন রামায়ণ ও মহাভারতের Post Modern বিশ্লেষণ করা হোক। এর খারাপ দিককে কিভাবে পুরুষতান্ত্রিক প্রজন্ম ধর্ম ও পুরানের মোড়কে মানুষের মনে গেঁথে দিয়েছিলেন তার যুক্তিযুক্ত আলোচনা হোক। রে রে করে উঠেছিলেন নাকি এক টেবিল ভর্তি সাদা পাঞ্জাবি কমরেডস। এরা নাটকে কোরাসের মত৷ সমবেত না বা ঠিক ঠিক ঠিক বলতে হেব্বি কাজে লাগে৷ যৌথ খামারে ও।
ললাটের কি সিনেম্যাটিক লিখন৷ এতবছর পরে পিসি জোশীর সেই সব কিছুই ফিরে আসছে৷ কেরলে বাম মনস্ক সংগঠন রামায়ণ চক্র আয়োজন করছে। পার্টি ক্লাসে রাম ঠ্যাকাতে রামায়ণ সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি করা হচ্ছে৷ সবটাই জনগনতান্ত্রিকভাবে।
ইএমএস নামুদ্রিপাদু মন্দির যেতেন না। আলোচনা ও করতেন না। তবে ওনার স্ত্রী নিয়মিত যেতেন। প্রশ্ন করা হলে বলতেন প্রত্যেকের ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। আমরা বড় জোর তার ভাবনার উন্মেষ ঘটাতে পারি৷ ইএমএস গোটা দেশের ও ক্যাডারের উন্মেষ ঘটালেও ঘরে বিপ্লব আনতে পারেননি সে সময়৷ যে ভাবে দোর্দন্ড প্রতাপ লোকাল কমিটি নেতা বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে মা শীতলার প্রসাদ আর শান্তির জল নিতেন। জিজ্ঞেস করলেই ইএমএস নামুদ্রিপাদু।
হরকিষণ সিং সুরজিত্ ধর্মীয় আচার মেনে পাগরি পরতেন, কৃপাণ ও দাড়ি রাখতেন। সুভাষ চক্রবর্তী তারাপীঠে গিয়ে ভক্তিভরে পুজো দিয়েছিলেন। রেজ্জাক মোল্লা দলবল নিয়ে হজ যাত্রা করে এসেছিলেন৷ প্রবল ঝড় উঠেছিলো। তারপর পৃথিবী আবার শান্ত হয়েছিলো। পরাজিত যোদ্ধাদের লোকাল কমিটিতে যেভাবে আসে আরকি। এখন অবশ্য খুল্লামখুল্লা কালী পুজো, দুর্গাপূজার ফিতে কাটা রেওয়াজ হয়েছে৷ আমার বিশ্বাস এই ছবিটার পরে তা হকে বদলে যাবে।
ছবিদুটি ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের। মাথায় মহাকালী মায়ের ঘট ও মন্ত্রপূত ফুলের বোঝা নিয়ে পথ হাঁটছেন। মানুষের মাঝে মিশে যাচ্ছেন বোনালু উৎসবে।
তেলঙ্গানা রাজ্যে একাধিক উৎসব পালিত হয়। ধর্মীয় উৎসবগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বোনালু। বোনালু মানে হিন্দু দেবী মহাকালীর পুজো। অভিনব গুপ্তের তন্ত্রালোক ও তন্ত্রসার গ্রন্থদ্বয়ে কালীর ১৩টি রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। মহাকালী তার একটি রুপ। তেলঙ্গানার খেটে খাওয়া মানুষ একে আরাধনা শুভ বলে মনে করে। মান্যগণ্য ব্যক্তি এলে মায়ের কলস মাথায় তুলে দেয়৷ সমস্ত পাপ, গ্লানি, দোষ খন্ডন করে মা। ইয়েল্লামাকে উলু দিয়ে, সিঁদুর পরে, প্রনাম করে পুজো করা হয়৷ বলা হয় সমস্ত মনোকামনা পূর্ণ করে মা। রাজনৈতিক আশা আকাঙ্ক্ষা ও। তাই মাথায় ঘট তুলে নেয় মায়ের দাস ও দাসী। সীতারাম জী যেমন।
তাহলে কি দাঁড়ালো? ছিল বেড়াল হল রুমাল? কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স মতে স্ট্যালিনিয় বিপ্লব করতে এসে নরম সাম্প্রদায়িকতা শ্রেণী সংগ্রামের প্যাকেটে বেচা? মানে আপনি শপিং মলে ঢুকলেন দুকেজি চাল কিনবেন বলে। তিন ঘন্টা পরে বেড়িয়ে এলেন চারটে শোপিস, আটটা মোজা আর দুডজন ক্রিম বিস্কুট নিয়ে। কারণ এগুলো এবার কিনলে আপনাকে একটা গিফট ভাউচার দেওয়া হবে যাতে পাঁচ কেজি চাল তিন কেজির দামে পাওয়া যাবে। এবার বলো কে জিতলো তবে? জন্মভূমি জন্মভূমি!
আজকের এই ছবি অনেক কমরেডকে শান্তি ও স্বস্তি দেবেন। আমরা সবাই সম্বল খুঁজে বেড়াই। সুযোগ পেলেই দুম করে একটা প্রনাম ঠুকে দিই। ঠাকুরের কাছে প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর পতন কামনা করি। শনিবার নিরামিষ খেয়ে পার্টি ক্লাসে গনতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা নিয়ে পাঠ শুনি। আমাদের আনন্দই হচ্ছে। সাধারণ সম্পাদক মাথায় মা কালীর দক্ষিণী অবতারের ঘট নিয়েছেন মানে আমাদের আগামী কালী পুজো করতে কোন বাধা নেই। আলিমুদ্দিন থেকে কমরেডস আসবেন ফিতে কাটতে। লালে লাল করে দেবো প্যান্ডেল। কমরেড মার্ক্স বলিয়াছিলেন, “শোষিত মানুষের কাছে ধর্ম আফিম স্বরুপ ” তাই কোনমতেই আফিম রাখা হবেনা জনগনতান্ত্রিক প্যান্ডেলে। বুর্জোয়া, সর্বহারা, হোয়াইট কলার, খেটে খাওয়া, খুটে খাওয়া মানুষ একছাতার তলায় আসবে। তখন আমরা ‘দেশ ও সাম্প্রতিক শক্তির উত্থান’ নিয়ে প্যান্ডেল সভা করবো।
ভাবছিলেন পার্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য জীর্ণ যা কিছুর বিনাশ আর প্রগতিশীল মুক্তমনের অধিষ্ঠান? সকল শ্রেণির বিলোপ সাধন? দুনিয়াকে বদলে দেওয়ার এক অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক হাতিয়ার? দূর মশাই আগে সংসদীয় গনতন্ত্রে আরো কিছু সিট পাই। নিজে বিষ খেয়ে বিষধর সাপকে ঠেকাই তারপর তত্বকথা হবে। আপাতত সত্যজিৎ রায়ের ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ ‘ এ বিরিঞ্চি বাবার ওই দৃশ্য মনে করুন।একই সময় একই সাথে এক আঙুল এন্টি ক্লকওয়াইজ ঘোরান৷ অন্য আঙুল ক্লকওয়াইজ। ভাবলেন পার্টির ৫৪ বছর পরে বিরাট এগিয়ে গেছেন বিপ্লবের দিকে? ধ্যাৎ! তিন পা এগিয়েছেন। দু পা পিছিয়েছেন। জয় মা!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)