রাজনীতি মানুষের জন্য। মানবিক সম্পর্ককে বাদ দিয়ে ডান-বাম-মধ্যপন্থী কোন রাজনীতি হয় না। আগেকার দিনে প্রায় সব সফল রাজনীতিবিদদেরই এই মানবিক গুণটুকু ছিল। আজকের রাজনীতিতে তা প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনা ঘটছে সব দলেই। সামান্য সাংবাদিকতার সূত্রে এই সাংবাদিকের বাংলার রাজনীতির এসময়ের সবচেয়ে আলোচিত দুই রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এদের একজন জ্যোতি বসু, আরেকজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একসময় জ্যোতিবাবু দিদিকে একদম সহ্য করতে পারতেন না। পরবর্তীকালে দিদির সঙ্গে দেখা হলেই তাকে আমি রাজনীতি ছাপিয়ে একজন স্নেহশীল পিতার মত আচরণ করতে দেখেছি। নানা বিরোধ থাকলেও এই দুই রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের মধ্যে সবচেয়ে মিলের বড় জায়গাটা ছিল দুজনেই দুদিক থেকে মানুষের কাছে পৌঁছেছেন। শুধু কেতাবি রাজনীতিতে তারা আটকে থাকেন নি। আজকের সৌজন্যহীন স্বার্থপর রাজনীতিতে তাই তাদের আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবাইকেই ছাপিয়ে গেছেন। আমি চোখের সামনে দেখেছি এই দুই রাজনীতিবিদের সম্পর্কের রসায়ন কীভাবে বদলে গেছে। আজকে জ্যোতিবাবুর ১০৪তম জন্মদিনে আমি এ ব্যাপারে আমার একান্ত ব্যাক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই।
মহাকরণে জ্যোতিবাবুর ঘরে ঢোকার আগে বাঁদিকে একটা অ্যান্টি চেম্বার ছিল। তিনি অতিথিদের সঙ্গে এ ঘরেই বৈঠক করতেন। একটা কাঁচ ঢাকা টেবিলের ওপারে বসতেন জ্যোতিবাবু, এপারে অতিথিরা। একদিন দুপুর থেকেই আমরা চিত্রসাংবাদিকরা সেই ঘরের সামনে হাজির কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। বলা হচ্ছে সৌজন্য সাক্ষাৎকার, তবুও আমাদের তৎপরতার শেষ নেই। কারণ, এই সেই বিরোধী দলনেত্রী, যাকে কয়েকবছর আগে মহাকরণের এই ঘরের সামনে থেকেই চুলের মুঠি ধরে তুলে, চ্যাংদোলা করে রাস্তায় বার করে দিয়েছে পুলিশ। তার অপরাধ ছিল গ্রামের অত্যাচারিত এক মহিলাকে নিয়ে তিনি সুবিচারের জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাকে ঘরে ঢুকতে না দেওয়ায় বাধ্য হয়েই তিনি সেই মহিলাকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনে ধর্নায় বসে পড়ে ছিলেন। মহাকরণে এভাবে নিগৃহীত হওয়ার পর তিনি যান লালবাজার, সেখান থেকেও লাঠি ও ধাক্কা মেরে বার করে দেওয়া হয় তাকে। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার মহাকরণে।
নির্দিষ্ট সময়ে জ্যোতিবাবুর ঘরে মমতার প্রবেশ। আমরা কয়েকজন চিত্রসাংবাদিক ধাক্কাধাক্কি করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম, আমি তখন আনন্দবাজারে। ঘরে ঢুকেই তিনি জ্যোতিবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। একগাল হেসে বাংলার দোর্দণ্ডপ্রতাপ মুখ্যমন্ত্রী হাত রাখলেন তার মাথায়। বাংলার রাজনীতিতে তখন এ এক বিরল ঘটনা। যথারীতি পরেরদিন সব কাগজে প্রথম পাতায় জ্যোতিবাবু্র দুর্লভ হাসির ছবি। এ হাসির জন্য তখন আমাদের মত চিত্রসাংবাদিকরা দিনভর ক্যামেরা তাক করে বসে থাকতাম। সেদিন যাকে বলে আমাদের মন খুশ করে দিয়েছিলেন প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী। মমতা ঘরে ঢোকার সময় থেকেই তিনি হাসতে থাকেন। এতটা আমরা ভেবেই উঠতে পারিনি! আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষায় এটা ছিল যাকে বলে ভাইরাল।
সেসময় সিপিএমের বিরুদ্ধে একের পর এক আন্দোলনের ঝড়ে বামফ্রন্ট সরকারকে বিধ্বস্ত করে দিচ্ছেন মমতা। ১৯৯০ এর ১৬ই আগস্ট হাজরার মোড়ে তার ওপর ঘটেছে লালু আলমের নেতৃত্বে সিপিএমের হেলমেট বাহিনীর নারকীয় আক্রমণ। দলীয় কর্মী, সাধারণ মানুষ ও কিছু কনস্টেবল তাকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে না পড়লে সেদিন তিনি প্রাণে বাঁচতেন না। এরপর বহুদিন তিনি নার্সিংহোমে ছিলেন। সেই মমতাকে মহাকরণে ডেকে কথা বলা শুধু আমরা কেন, বামফ্রন্টের কোন নেতারাই ভাবতে পারেন নি। অবাক হয়েছিলেন তারাও।
পেশার প্রয়োজনেই জ্যোতিবাবুর মুখোমুখি হয়েছি বহুবার। এমনিতেই উনি কম কথা বলতেন। সেই গাম্ভীর্যের পাঁচিল ডিঙিয়ে অন্তরঙ্গ হওয়া সত্যিই কঠিন ছিল। জ্যোতিবাবুর কথাবার্তার একটা বিশেষ ঢঙ ছিল। একে, ওকে, ওদের, তাদের বলে কথা বলা গম্ভীর মানুষটি মমতার নামও মুখে আনতেন না। শেষদিকে দেখেছি সেই দাম্ভিক জ্যোতি বসু দিদির কাছে জলের মত সরল হয়ে গিয়েছিলেন। মত ও পথের এত অমিল তবুও দিদির সঙ্গে দেখা হলেই স্নেহশীল পিতার মত একগাল হেসে তার গায়ে হাত রাখতেন। পরবর্তীকালে দিদি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার পরেও এই সুসম্পর্কে কোন ছেদ পরে নি। কেন্দ্রে যুবমন্ত্রী থেকে রেল মন্ত্রী হওয়ার পরে অনেক ব্যাপারে জ্যোতিবাবুর মতামত নিতেন, রেলের যে কোন অনুষ্ঠানে জ্যোতিবাবুকে আসতে বলতেন, জ্যোতিবাবুও যেতেন।
সত্যি বলতে কি, ভালোবাসা দিয়ে, শ্রদ্ধা দিয়ে, আবেগ দিয়ে, সম্পর্ক তৈরি করে মানুষকে কি করে কাছে টেনে নিতে হয় সে ব্যাপারে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা উদাহরণ হতে পারেন। আমার মনে হয় দেশের সব রাজনীতিবিদের অন্তত এই জিনিসটা তার কাছ থেকে শেখা উচিৎ। সাংবাদিক জীবনে এই ব্যাপারটা আমি বারবার দেখেছি। এটা দিদির একেবারে ভেতরের ব্যাপার। অন্তর থেকে চেয়েছেন বলেই জ্যোতিবাবুর মত এক বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন তিনি। আবার বাংলার মসনদ থেকে বামফ্রন্ট সরকারকে সরানোর ক্ষেত্রেও দলমত নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গে সব রাজনৈতিক দলকেই তিনি তার সঙ্গে নিতে পেরেছিলেন সম্পর্কের এই আশ্চর্য রসায়নটা তৈরি করতে জানার গুণেই।
জ্যোতিবাবুর মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে অবসর নেওয়ার পরেও দিদি তাঁর প্রতিটি জন্মদিনে ইন্দিরা ভবনে ধুতি, ফুল, মিষ্টি নিয়ে দেখা করতেন। মাঝেমধ্যে স্রেফ শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার জন্যই বিনা নোটিশে চলে যেতেন সেখানে। তখন জ্যোতিবাবুর অবসর জীবন। তার চারপাশ থেকে সরে গেছে দলের অনুশাসন, কর্মী ও অনুগ্রহপ্রার্থীদের ভিড়, চলে গেছে সাংবাদিকদের তৎপরতা, দিদি কিন্তু নিয়ম করে তাঁর খোঁজখবর নিয়ে গেছেন। শেষদিকে দিদি গেলে তিনি ইন্দিরা ভবনে আলাদা ঘরে নিয়ে গিয়ে গল্প করতেন, রাজনৈতিক, পারিবারিক সবরকম কথাবার্তাই হত। বহুবার আমিও তার সাক্ষী থাকলেও সেসব কথা প্রকাশ্যে আনা যাবে না। কারণ, দিদি বারণ করেছেন।
কংগ্রেস, সিপিএম ও বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির অনেক নেতাই আজ দিদির সঙ্গে রয়েছেন। আরও অনেকেই তার কাছে আসতে চাইছেন। আমি ১৯৮৬ সাল থেকে পেশাগত কারণেই দিদির এই দৌড়টাকে অনুসরণ করছি। দিদিও সেটা জানেন। সামান্য বুদ্ধি দিয়েও আমি কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম একদিন তিনি এমন একটা উচ্চতায় পৌঁছবেন। আমার একটা জিনিস খুব অবাক লাগে বহু রাজনীতিবিদের এই জিনিসটা বুঝতে এত দেরি হল কেন? জ্যোতিবাবু কিন্তু এক সময় বুঝতে পেরেছিলেন এই মেয়েটি একসময় বাংলার মসনদে বসবে। এই উপলব্ধি থেকেই তার প্রতি স্নেহশীল হয়ে উঠেছিলেন তিনি, তার কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার একটা মনোভাবও তৈরি হয়েছিল তাঁর। যে বুদ্ধবাবু তাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে কথা বলতেন, তার বাড়িতেই দিদি এখনও অবধি চার বার গিয়েছেন স্রেফ তার কুশল সংবাদ, সুবিধা অসুবিধা জানার জন্য। আজকের রাজনীতিতে এই স্বাভাবিক সৌজন্যবোধটাই প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। আজকের রাজনীতি মানেই যেন শত্রুতা আর কাদা ছোড়াছুড়ি। তা কোন ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্ম দেয় না। জ্যোতিবাবুর জন্মদিনে রাজনৈতিক সৌজন্যবোধের এই গল্পটা মনে পড়ে গেল। আগামী দিনের রাজনীতি দিদির এই দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করেই পথ চলবে।