মেধাই হবে ভর্তির একমাত্র মাপকাঠি। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতন রাজ্যের সমস্ত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। আর এতেই যত বিপত্তি বেঁধেছে ‘শিক্ষার উৎকর্ষ কেন্দ্র’ বলে পরিচিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
সরকারি ঘোষণার পর থেকেই উল্টো সুর যাদবপুরে। অনলাইনে মেধার ভিত্তিতে নয়, ভর্তি করতে হবে প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে— এই অনৈতিক দাবিতে বিক্ষোভ ঘেরাওয়ে সরগরম যাদবপুর। নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি চলবে না, এই আজব দাবিকে সমর্থন জানিয়ে ‘লড়াই’য়ে নেতৃত্বে দিতে নেমে পড়েছেন কয়েকজন ‘কমরেড’ শিক্ষক। ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করছেন নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি প্রক্রিয়াকে বয়কট করতেও!!
কলা বিভাগের এই শিক্ষকরা জানিয়েও দিয়েছেন তাঁরা ভর্তি প্রক্রিয়ায় অংশ নেবেন না। চূড়ান্ত বিভ্রান্তিতে পড়েছে সদ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা তরুণ আবেদনকারীরা।
নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি মানব না। ভর্তি হতে হবে প্রবেশিকা পরীক্ষার ভিত্তিতেই। এই দাবি অনেকগুলি প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। মমতা ব্যানার্জির সিদ্ধান্ত আসলে দীর্ঘদিন ধরে চলা একাংশ ‘কমরেড’ শিক্ষক–ছাত্রের সিন্ডিকেটের মূলেই আঘাত হেনেছে। দশকের পর দশকের মাতব্বরি আর দাদাগিরি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় আলিমুদ্দিনের স্নেহধন্যদের মাথায় বাজ পড়েছে। ভর্তি প্রক্রিয়াকে নিয়ে তথাকথিত ‘মার্কসবাদী’ আর মাওবাদীদের ‘আধিপত্য’ খর্ব হওয়ার সিঁদুরে মেঘ দেখেই এঁরা সরকার বিরোধিতায় নেমে পড়েছেন। ছাত্র খেপানোর দায়িত্ব নিতে দেখা যাচ্ছে আলিমুদ্দিনের কার্ড হোল্ডার শিক্ষকদেরই। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা মৌরসিপাট্টায় হাত পড়াতেই কি এত বিক্ষোভ? প্রশ্ন উঠছেই।
গোটা রাজ্যে যে পদ্ধতিতে ছাত্র ভর্তি হচ্ছে সেই একই পদ্ধতি যাদবপুরে কেন মানা হবে না? যাদবপুর কি রাজ্যের বাইরে? যাদবপুর কি রাজ্যের মধ্যে স্বতন্ত্র কোনও দ্বীপ? প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে যদি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যায়, তবে যাদবপুরে সমস্যা কোথায়? আসলে যাদবপুরে আলিমুদ্দিনের প্রতিনিধিরা নিজেদের সবার থেকে সেরা ও আলাদা মনে করেন। কলার তোলা মনোভাব নিয়ে দীর্ঘ সময় এঁরা হয়কে নয় করে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে মনে করেছেন ব্যক্তিগত জায়গির। ঔদ্ধত্য এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে প্রবেশিকা পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে বহিরাগত বিশেষজ্ঞ ব্যবহার করা নিয়েও এই সিন্ডিকেটের মাতব্বরেরা যুক্তিহীন আপত্তির দেওয়াল খাড়া করেছিলেন। আসলে বহিরাগত বিশেষজ্ঞরা যদি উত্তরপত্র দেখেন তাহলে তো সিন্ডিকেট বিপদে পড়ে যাবে।
অনলাইনে নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তি হলে নিজেদের পছন্দমতন প্রার্থীদের ভর্তি তো গ্যারান্টি করা যাবে না। নৈরাজ্য সৃষ্টির সাপ্লাই লাইনে বাঁধ পড়ে যাবে। তাই কলা বিভাগে আলিমুদ্দিনের প্রতিনিধিরা মাওবাদী, অতিবামপন্থী সবাইকে সঙ্গে নিয়েই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। শিক্ষক সমিতি জুটাতেও আলিমুদ্দিনের একাধিক প্রতিনিধি। প্রবেশিকা পরীক্ষার নামে অনিয়মেই কুঠারাঘাত করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মমতা ব্যানার্জির সিদ্ধান্তে সিন্ডিকেট উঠে যাওয়ার অবস্থা। তাই শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। ঘেরাওয়ের নামে অরাজকতা। যাদবপুরে কলা বিভাগে ভর্তির প্রবেশিকা পরীক্ষায় ব্যাপক অনিয়মের কথা ইংরেজি বিভাগের এক অধ্যাপক ইতিমধ্যেই তুলে ধরেছেন। যাদবপুর বিজ্ঞান বিভাগে সব বিষয়ে নম্বরের ভিত্তিতেই ছাত্র ভর্তি হয়। তাতে উৎকর্ষে তো ঘাটতি হয় না। তাহলে কলা বিভাগে হবে কেন? যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর দিতে পারছেন না ‘কমরেডরা’।
যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর যে নেই। যুক্তি দিয়ে যে এই নৈরাজ্যের আন্দোলনের ব্যাখ্যা হয় না কমরেড। দীর্ঘ সময় ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে আপনাদের কাছ থেকেই তো অজস্রবার শুনেছি, যুক্তিবাদের নিরিখেই সবকিছু বিচার করতে হবে। তা কোন যুক্তিবাদের কষ্টিপাথরে নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তির থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা বৈজ্ঞানিক, তা যদি একটু বুঝিয়ে বলেন, তাহলে আমাদের মতন সাধারণ রাজ্যবাসীর বুঝতে সুবিধে হয়।
যাদবপুরের কলা বিভাগে ছাত্র ভর্তি থেকে শিক্ষক নিয়োগ, সবেতেই সিন্ডিকেটের ছোঁয়া। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমার বিনীত আবেদন যে, ভবিষ্যতে কলা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের ইতিহাসটাও তদন্ত করে দেখা দরকার। যাঁরা কলা বিভাগে শিক্ষকের চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে চোখে পড়ার মতন আলিমুদ্দিনের কার্ড হোল্ডাররা আছেন। তাঁরা কি সবাই সোজা পথে পড়াতে ঢুকেছেন? যোগ্যতরদের টপকে তাঁদের জায়গা হয়নি তো? সে তদন্তও হোক।
কেন না এই নৈরাজ্যের পরিবেশকে আরও তীব্র করেছেন একাংশ ‘কমরেড’ শিক্ষকরাই। উসকে দিচ্ছেন ছাত্রদের। আর এই গোটা নৈরাজ্যে মদত মিলেছে মার্কসবাদী আর মাওবাদীদের মিলিত মহাজোট থেকে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও কুৎসা ছড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্ব পেয়েছেন কয়েকজন। সিন্ডিকেট রক্ষায় মাঠে নেমেছেন মার্কসবাদী, মাওবাদী, বিজেপি–র মধ্যে সমন্বয় রাখা এক স্বঘোষিত নেতা। জায়গির বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। মুখ্যমন্ত্রীর যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তকে তাই আক্রমণ করে ঘেরাও আন্দোলনের লাগাতার কর্মসূচি গৃহীত হচ্ছে।
দশকের পর দশক ধরে চলে আসা অচলায়তন ভাঙার কাজ যেই শুরু করেছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, অমনি বাস্তুঘুঘুদের ঘুম উড়ে গেছে। বাস্তুঘুঘুদের মনে রাখা দরকার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগ রাজ্যের বাইরে নয়। রাজ্য জুড়ে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নিয়ম চলবে আর যাদবপুরের কলা বিভাগে অন্য নিয়ম, তা কোনওভাবেই চলতে পারে না। মতের অমিল হলেই ঘেরাও আন্দোলনের নামে উপাচার্য ও ভিন্ন রাজনৈতিক মতের শিক্ষকদের হেনস্থা, এই সংস্কৃতির অবসান হওয়া দরকার। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত না মানলে যা খুশি চলবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এ জিনিস রাজ্যের মানুষ বরদাস্ত করবেন না।
সিন্ডিকেটের মাথাদের মনে রাখা দরকার, ছাত্র ভর্তি থেকে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যা খুশি করার দিন শেষ হয়ে গেছে। প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতেই ছাত্র ভর্তি সবথেকে বৈজ্ঞানিক। প্রবেশিকা পরীক্ষা কখনওই নম্বরের ভিত্তিতে ভর্তির বিকল্প হতে পারে না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে নৈরাজ্য কখনওই কাম্য নয়।
শিক্ষার উৎকর্ষে যাদবপুর আরও এগিয়ে যাক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কখনওই ঘেরাও আন্দোলন আর গা জোয়ারির আখড়া হতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্য সরকারের বিরোধিতা করতে চাইলে তা নিশ্চয় হোক। যুক্তির ভিত্তিতে। যুক্তি হারিয়ে ফেলা সিন্ডিকেটের মাতব্বররা এটা যেন ভুলে না যান যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলার বাইরে নয়। ছাত্রদের স্বার্থে, শিক্ষক– শিক্ষিকাদের স্বার্থে, শিক্ষাকর্মীদের স্বার্থে, পঠনপাঠনের স্বার্থে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বার্থান্বেষীদের অশুভ সিন্ডিকেট ধ্বংস হোক।
( সৌজন্য- আজকাল )