রাজ্য সরকার যত টাকা ঋণ নিচ্ছে, তার একটা বড় অংশ বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে নেওয়া ঋণের টাকা সুদে-আসলে মেটাতেই খরচ হয়ে যায় বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র প্রায়ই বলে থাকেন। বাম আমলের ঋণ পরিশোধ করতেই তৃণমূল সরকারকে বাধ্য হয়ে নতুন করে ঋণ নিতে হচ্ছে, এটাও বলেন তাঁরা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল অফিস (পিএজি) রাজ্য সরকারের আর্থিক অবস্থা পর্যালোচনা করে সেই একই কথা বলেছে।
২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে রাজ্য সরকারের আর্থিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট পিএজি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে রাজ্য সরকার মোট ৩৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এই ঋণের ৩০.২১ শতাংশ (১১ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা) খরচ হয়েছে সম্পদ সৃষ্টি ও পরিকাঠামো নির্মাণে। বাকি টাকা খরচ হয়েছে পুরনো ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে। পিএজি মনে করে, ঋণ বাবদ অর্থ সম্পদ সৃষ্টি করার কাজে পুরোপুরি ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু এখানে তা করা হয়নি। ঋণ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ থেকে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে বাম জমানার ঋণ পরিশোধ করতে। চলতি বছরেও রাজ্যকে ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ শোধ করতে হবে।
প্রসঙ্গত, বাম আমলের পর রাজ্য সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। বাম জমানার ২ লক্ষ কোটি টাকা বিপুল ঋণের বোঝা তৃণমূল সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সময় যত এগিয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও নতুন করে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে। ফলে বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের মাথায় তিন লক্ষ কোটি টাকারও বেশি ঋণের বোঝা। পুরনো ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে বিশেষ ছাড় চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তাতে রাজি হয়নি। ফলে ঋণজালে জড়িয়ে পড়ছে রাজ্য সরকার।
২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে শুধু বাজার থেকে রাজ্য সরকার প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। চলতি ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরে তা বেড়ে প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা হবে বলে এবারের বাজেট প্রস্তাবে জানানো হয়েছে। চলতি আর্থিক বছরে রাজ্যকে সব মিলিয়ে সুদ ও আসল সহ প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
পিএজি রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সরকারি সংস্থা, বিধিবদ্ধ সংস্থা প্রভৃতিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হলেও সেখান থেকে খুব সামান্য লাভের অর্থ আসছে। ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে এসব জায়গায় রাজ্য সরকারের বিনিয়োগ ছিল ১৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। সেখানে ওই সব সংস্থা থেকে ডিভিডেন্ড, সুদ বাবদ আয় ছিল মাত্র ১ কোটি ১২ লক্ষ টাকা। বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়লেও আয় কমেছে। ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে বিনিয়োগ বেড়েছিল ৬২৫ কোটি টাকা। সেখানে আয় কমে গিয়েছে মোট ১০ কোটি ১৭ লক্ষ টাকা।
রাজ্য সরকার প্রয়োজন ছাড়াই বাজেট বরাদ্দের থেকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করেছে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে ১৭ হাজার ২৯৪ কোটি টাকার অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রস্তাব পাশ করানো হয় বিধানসভায়। এর মধ্যে ৩৫টি ক্ষেত্রে ৫৪৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা অপ্রয়োজনীয় ছিল বলে পিএজি রিপোর্টে জানানো হয়েছে। বিভিন্ন কাজের প্রায় ২ লক্ষ ৪৬ হাজার ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা না পড়ার কথা বলা হয়েছে। ওই কাজের আর্থিক মূল্য ১ লক্ষ ২২ হাজার কোটি টাকা।
রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যেই বিপর্যয় মোকাবিলায় পর্যাপ্ত অর্থ না পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। কেন্দ্র অর্থ দিচ্ছে না বলে রাজ্য অভিযোগ করে। পিএজি’র অফিস-এর রিপোর্ট থেকেও তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
রাজ্য সরকার ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিল থেকে ৪৬০ কোটি টাকা পেয়েছিল। কিন্তু এই টাকা রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিলে স্থানান্তরিত হয়েছিল পরের ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে। ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষের জন্য নতুন করে কোন টাকা আসেনি।
(সংগৃহিত)