রাশিয়ায় বসতে চলেছে ২০১৮ এর বিশ্বকাপের আসর! সারা বিশ্বের সাথে ভারতবর্ষ বিশেষতঃ আপামর বাঙালী ও উৎসবে বুঁদ হয়ে থাকবে আগামী কয়েক সপ্তাহ৷ আগামী কদিন বাঙালী লাল হলুদ,সবুজ মেরুন ভুলে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় বিভক্ত হয়ে যাবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্কের ঝড় উঠবে-মেসি,রোনাল্ডো,নেইমার দের নিয়ে৷ আট থেকে আশি সবাই ক্রিকেট, সিনেমা ভুলে উপভোগ করবে বিশ্বকাপের আনন্দ৷
গত বছর আয়োজক দেশ হিসাবে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়েছিল ভারত৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় একশো কোটির দেশ হয়েও যুব বিশ্বকাপ ছাড়া বিশ্বপর্যায়ের কোন ফুটবল প্রতিযোগিতায় ভারতবাসীর সুযোগ হয়নি দেশের সমর্থনে মেতে ওঠার৷ কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না ১৯৫০ এ ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে রহিম সাহেবের ভারত শৈলেন মান্নার নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছিল৷
১৯৩৮ এর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১২ বছর পর্যন্ত বিশ্বকাপ স্থগিত ছিল৷ ১৯৫০তে ফিফা ব্রাজিলে চতুর্থ বিশ্বকাপের আয়োজন করেছিল৷ মোট ১৬টি দেশের অংশগ্রহণ করার কথা ছিল৷ এর মধ্যে ব্রাজিল আর ইটালি আগের দুই বিশ্বকাপের জয়ী হিসাবে অটোমেটিক্যালি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল৷ বাকী ১৪টি দলের মধ্যে ইউরোপের ৭টি,আমেরিকা মহাদেশের ৬ টি আর এশিয়া থেকে ১টি দল সুযোগ পেয়েছিল৷ এশিয়া থেকে সুযোগ পাওয়ার জন্য ভারতের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া,বার্মা আর ফিলিপাইন্সের মধ্যে বাছাই পর্ব খেলার কথা ছিল৷ কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাকি তিনটি দেশ নাম প্রত্যাহার করে নেয়৷ তাই ১৯৫০ এর বিশ্বকাপ খেলার জন্য এশিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে ভারতের সুযোগ চলে আসে৷
কিন্তু ভারত দুর্ভাগ্যবশতঃ ১৯৫০ সালে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেনি৷
কেন করেনি? সে আলোচনায় যাওয়ার আগে যদি ভারত খেলত, তাহলে কাদের বিরুদ্ধে খেলতে হত তা দেখে নেওয়া যাক৷
১৯৫০ সালে ফিফা ভারতকে পুল-৩ তে স্থান দিয়েছিল৷ ভারতের প্রথম খেলা ২৫শে জুন প্যারাগুয়ের সাথে ছিল৷ সেই সময় ভারতীয় দলের ফরোয়ার্ড এ মেওয়ালাল, আহমেদ খান, ডিফেন্সে শৈলেন মান্না, তাজ মহম্মদ, মিড ফিল্ডে সাত্তার, মহাবীর প্রসাদের মতো খেলোয়াড় ছিল৷ দল হিসাবে ভারত প্যারাগুয়ের থেকে অনেক শক্তিশালী ছিল৷ খেলা হলে আহমেদ খান, মেওয়ালালরা প্যারাগুয়ের জালে একাধিক বল ঢোকাতেন বলে মনে হয়৷ দ্বিতীয় ম্যাচটি ছিল শক্তিশালী ইটালির বিরুদ্ধে৷ ইটালি শক্তিশালী হলেও ১৯৫০এর বিশ্বকাপে টিমে তাদের নিয়মিত আট জনকে নিয়ে ব্রাজিলে আসতে পারেনি৷ কারন ১৯৪৯ এ ইটালির ক্লাব টোরিনো পর্তুগালের লিসবান থেকে একটি ম্যাচ খেলে ফেরার পথে বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে এবং টিমের কোচ, সহকারী স্টাফ সহ পুরো টিম ধ্বংস হয়ে যায়৷
ঐ বিমানে ইটালির প্রথম একাদশের আটজন খেলোয়াড় ছিল৷ এই ঘটনার ফলে ইটালি সরকার তাদের ফুটবল দলকে ব্রাজিল পাঠানোর জন্য বিমানের বদলে জাহাজে যাওয়ার ব্যবস্থা করে৷ দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় ইটালি টিমের খেলোয়াড়রা শারীরিক ভাবে ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে৷ এছাড়াও ইটালি দলের প্রধান কোচ ডিট্টরিও পোজ্জ বিশ্বকাপ শুরুর আগে পদত্যাগ করে৷ এই দুই কারনে ভারত ইটালির সঙ্গে ভালোই ফল করত বলে আশা করা যায়৷
ভারতের গ্রুপ পর্যায়ের শেষ খেলাটি ছিল ৩রা জুলাই সুইডেনের বিরুদ্ধে৷ এই খেলাটি বরঞ্চ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এর সম্ভাবনা ছিল৷ তবুও বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস ছিল ভারত সহজে পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছাতে পারত৷
এ সুযোগ পেয়েও ভারত তাতে অংশগ্রহণ করেনি৷ এটা ভারতীয় ফুটবলের পক্ষে একটা ঐতিহাসিক ভুল৷
কিন্তু কেন ভারত অংশগ্রহণ করল না আমরা তার কারণটা খোঁজার চেষ্টা করি৷
১৯৪৮-১৯৬৩ এই সময়টা ছিল ভারতের ফুটবলের স্বর্ণযুগ৷ স্যার রহিমের কোচিং এ ভারত এশিয়ার প্রথম তিনটি স্থানের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল। ১৯৫১এ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশিয়ান গেমস্ , ১৯৬২তে জাকার্তার এশিয়ান গেমস্ দুটোতেই ভারত স্বর্ণপদক পেয়েছিল৷
এই সময় রহিম ভারতের কোচ ছিলেন যাকে আমরা সর্বকালের সেরা কোচ হিসাবে মনে করি৷ তিনি ভারতে প্রথম আধুনিক ৪-২-৪ ছক এনেছিলেন৷ এই সময় ভারতে একঝাঁক তারকা খেলোয়াড় ছিল৷ সেই জন্য ১৯৫০এর বিশ্বকাপে ভারতের ভালো ফল করার সম্ভাবনা ছিল৷ ভারতের ফরোয়ার্ড লাইনের আহমেদখান, রামন, সাত্তার, মেওয়ালাল-বিশ্বের যেকোন প্রথম সারির ডিফেন্সকে নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখত৷ অসাধারণ পাস্ ও ড্রিবলিং এর জাদুতে তারা ব্রাজিলিয়ান দর্শক সহ সারা বিশ্বকে মোহিত করে দিতে পারত৷
১৯৪৮এ শৈলেন মান্নার নেতৃত্বে ভারতীয় দল গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে যোগ দেয়৷ প্রথম ম্যাচে ফ্রান্সের সাথে ৮৯ মিনিট পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র রেখেও ২-১ গোলে হেরে যায় ভারত৷ হারলেও ভারতের খেলা সারা বিশ্বের ফুটবল প্রেমী মানুষকে মোহিত করেছিল৷ এই ম্যাচেই রামন ভারতের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক গোলটি করে৷ আমাদের অনেকেরই অজানা যে এই ম্যাচে ভারত দুটি পেনাল্টি ও নষ্ট করে৷ যদি তা না করত ম্যাচের ফল ভারতের পক্ষে যেতেই পারত৷
অংশগ্রহণ না করার প্রধান কারণ হিসাবে বহূল প্রচলিত যে প্রবাদটি আছে সেটি হল-ভারতীয় ফুটবলাররা সেই সময় খালি পায়ে খেলতেন৷ ফিফা ভারতকে খালি পায়ে খেলার অনুমতি দেয়নি৷ আমরা জানি ১৯৪৮ এর অলিম্পিকে অধিকাংশ ভারতীয় ফুটবলার খালি পায়ে খেলেছিলেন এবং কিছু জন শুধু মোজা পরে খেলেছিলেন৷ কিন্তু খালি পায়ের তত্ত্বের সমর্থনে ফিফা বা এআইএফফ এর কোনো নথিতে এর উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷
দ্বিতীয় মতটি হল অর্থনৈতিক কারণে এআইএফফ ভারতকে ১৯৫০ এর বিশ্বকাপে পাঠাতে পারেনি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধ পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব বিশ্বের সবকটি দেশে অল্পবিস্তর পড়েছিল৷ ১৯৫০এ ভারত থেকে ব্রাজিলে দল পাঠানোর একটা বিশাল খরচ তো ছিলই৷ আর এই একই অর্থনৈতিক কারণে তুরস্কের দল ১৯৫০ এর বিশ্বকাপ থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে৷ সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ ভারতের জন্য এই অর্থনৈতিক কারণটিকে যুক্তিযুক্ত কারন হিসাবে মেনে নেওয়া যেতেই পারত৷ কিন্তু ফিফা এর নথিতে দেখা যাচ্ছে অায়োজক দেশ ব্রাজিল,এশিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি ভারতকে , ব্রাজিলে আসার সমস্ত খরচ বহন করবে জানায়৷ এছাড়া ভারত সরকারের নথিতে দেখা যাচ্ছে যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু খেলাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন৷ তিনি বিশ্বাস করতেন খেলাই দেশ গঠনে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের পরিচিতিতে সাহায্য করবে৷
না খেলার অন্য আর একটি কারণ যেটি জনসমক্ষে প্রচলিত অাছে সেটি হল-ভারতীয় দল তখন ৭০ মিনিটের ফুটবল ম্যাচ্ খেলত৷ বিশ্বকাপে ৯০ মিনিটের খেলা হত৷ ভারতীয় ফুটবলে ১৯৭০ পর্যন্ত ৭০ মিনিটের খেলা প্রচলিত ছিল৷ তাই ভারতীয় দল ৯০ মিনিটের ম্যাচ্ খেললে শেষের ২০ মিনিট ক্লান্তির কারণে গোল খাওয়ার সম্ভাবনা ছিল৷ ৯০মিনিট খেলার জন্য যে ধরণের শারীরিক ক্ষমতার দরকার ছিল তা তখন ভারতীয় দলের খেলোয়াড়দের ছিল না৷ সেই কারণে এআইএফএফ ১৯৫০ এর বিশ্বকাপে ভারতকে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি৷
একমাত্র গ্রহণযোগ্য মতটি হল-সেই সময় এআইএফফ এবং ভারতীয় দল বিশ্বকাপ ফুটবলকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা হিসাবে বিবেচনা করেনি৷ তাদের ধারণা ছিল অলিম্পিকই সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবল খেলার একমাত্র জায়গা৷ শৈলেন মান্নার কিছু বছর আগের দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার এই তত্ত্বকে সমর্থন করে৷ তিনি বলেছিলেন-“আমাদের বিশ্বকাপ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না৷ আমাদের যদি কেউ এটির গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাতো তাহলে আমরা নিজেদের তরফ থেকে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার জন্য আরো বেশী উদ্যোগী হতাম৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা ভেবেছিলাম অলিম্পিকই সর্বসেরা, তার চেয়ে বড় ফুটবলে আর কিছু নেই৷”
এখন অামাদের মনে হয় ১৯৫০ এর বিশ্বকাপে ভারতীয় ফুটবলাররা যদি অংশগ্রহণ করত তাহলে সেটি ভারতীয় ফুটবলকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারত৷ অার ভারতীয় ফুটবলের পেশাদারিত্বের বীজ তখনই বপন হয়ে যেত৷ এই পেশাদারিত্বের অভাব এখনো ভারতীয় ফুটবলের এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রধান বাধা৷ ভারতকে কবে বিশ্বকাপে দেখা যাবে-এই প্রশ্ন ভারতবাসীকে প্রতি চার বছর অন্তর করতে হত না, এবং মেসি, নেইমার, রোনাল্ডোর বদলে অামরা হয়তো সুনীল ছেত্রী, গুরপ্রীত সিং, সন্দেশ জিংগাম, হোলিচরণ নার্সারি, জে জে, সুব্রত পাল এদের নিয়ে চর্চায় মেতে উঠতাম৷