সারা দেশ আগ্রহের উত্তুঙ্গ শীর্ষে অবস্থান করছিল। দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় আরএসএস-এর মঞ্চে ৭ জুন নাগপুরে কি বলেন সেটার জন্যই এই আগ্রহ। আরএসএস-এর একটা মঞ্চে প্রণববাবু বক্তৃতা দেবেন এটা আমার মতো বহুজনের কাছে অকল্পনীয় ছিল। তাঁর কারণটি অতি সহজ। ৫০ বছরের বেশি সময় তিনি রাজনীতিতে প্রধান ভূমিকায় থেকেছেন। সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, সর্বোপরি দেশের এক নম্বর নাগরিক রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। মাত্র একবার ছাড়া তাঁর রাজনৈতিক পদযাত্রা ‘টালমাটাল’ হয়নি। বাংলা কংগ্রেস ছেড়ে কং(ই)-তে এসেছেন। তাঁর প্রয়াত পিতৃদেব শ্রী কামদাকিংকর মুখোপাধ্যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামী, গান্ধীবাদী কংগ্রেসী। তাঁর বিরোধী দলের মানুষদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা পেয়েছেন অকাতরে।
প্রণববাবুর কর্মধারার মধ্যেও তাঁর পিতা এবং পারিবারিক ঐতিহ্য প্রবাহিত। ঘনিষ্ঠভাবে তাঁর সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়েছে। ভারতের চিরায়ত ধর্মনিরপেক্ষ, সহিষ্ণু, উদার মনোভাব সম্পর্কে দৃঢ অবস্থান থেকে তাঁকে খুব ভালো লেগেছে। আরও যে দু’টি মহৎগুণ যেকোনও মানুষকে আকৃষ্ট করে তা হল তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি।
সেই প্রণববাবু যদি আরএসএস-এর মঞ্চে সামিল হন তাহলে সবার মনে আশঙ্কাজনক কৌতুহল থাকবে এটা স্বাভাবিক। একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে তিনি একজন কং(ই)। মাঝে কিছুদিন কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আকচাআকচিতে দল ছেড়ে অন্য দল করেছিলেন। কিন্তু ফিরে এসেছেন আবার। স্বমহিমায় প্রতিাষ্ঠিত হয়েছেন। সেই কংগ্রেস-এর আরএসএস সম্পর্কে মনোভাব খুব পরিষ্কার। অন্তত বর্তমানে কং(ই)-র সভাপতি প্রতিনিয়ত সারা দেশময় আরএসএস সম্পর্কে কড়া মন্তব্য করছেন। যে জহরলাল নেহেরু’র ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ থেকে আরএসএস মঞ্চে যখন কয়েকটি বাক্য পাঠ করে শোনালেন তখন আমার মনে পড়ছিল, পন্ডিত নেহেরু স্বাধীনতার কিছুদিন পরেই আরএসএস’কে নিষিদ্ধ সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। গান্ধীবাদী এই নেতা কি করে ভুলে গেলেন যে, গান্ধী হত্যার জন্য আরএসএস দায়ী। নাথুরাম এবং তার ভাই-এর জবানীতে সেই প্রমাণ মেলে। বল্লভভাই প্যাটেল-এর নিষেধ না শুনেও নেহেরু আরএসএস সম্পর্কে এমন ধারণা প্রকাশ করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর কথা বিস্তারিত বলেছেন প্রণব বাবু। ঠিক তাদেরই সমাবেশে, যারা এই মহান ব্যক্তিকে খুন করেছেন।
নতুন কথা কি বললেন প্রণব বাবু? একটাও নতুন কথা নয়। তাঁর ভাষণ শুনতে শুনতে আমার বারবার মনে হচ্ছিল উচ্চশ্রেণিতে পড়া কোনও স্কুল ছাত্র তাঁর লেখা ‘দেশ’ সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ পড়ছেন। প্রায় আধঘণ্টা’র এই ভাষণে তিনি যা বলেছেন তা প্রণববাবু বহুবার বলেছেন। তাছাড়া দেশের কোন বড় ব্যক্তিত্ব এসব কথা বলেননি, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের দেশের সংবিধানেই এই কথাগুলো লেখা আছে। ভারতের উদারতা নিয়ে সারা বিশ্বে চর্চা হয়। সংবিধান গ্রহণের গণপরিষদের বিতর্ক সভাতে জ্ঞানীব্যক্তিরা এই কথাগুলোর চর্চা করেছেন বহুভাবে। আর প্রণববাবুও এসব কথা বহু অনুষ্ঠানে বলেছেন। যেকোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে একথাগুলোই শোনা যায়। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ডিলিট উপাধি পাওয়ার পর তিনি যে ভাষণ দিলেন তার সঙ্গে এই ভাষণের পার্থক্য খুবই কম।
কিন্তু মূল বিষয় হল তিনি কোথায় এই সব মতবাদের কথাগুলো উচ্চারণ করলেন! বহুত্ববাদ যাদের কাছে একটি আপংক্তেয় শব্দ। যারা ধর্মের নামে দেশ শাসন করতে চায়, যারা দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য চূড়ান্ত সীমা পর্যন্ত পৌঁছাতে চায়। তাদের মঞ্চে একথাগুলো বলে মোহন ভাগবতজী’র মনোভাব ও কর্মধারা পরিবর্তনের কোনও আশা প্রণববাবু করেন কিনা আমার সরাসরি জানা নেই। তাহলেও বলব এটা দূরাশা মাত্র। সুতরাং এই মঞ্চ ব্যবহার করার প্রয়োজন তাঁর হল কেন? সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমাদের মতো আম জনতার কথায় তিনি না গেলে ক্ষতি হতো না। বরং দেশের বহু মানুষ আনন্দ পেতেন। তাঁর ভাষণে তিনি বলেছেন সামাজিক কর্মকান্ড মানুষ ভিত্তিক। মানুষই এখানে প্রধান বিবেচ্য। মহামতি কার্ল মার্ক্স বলতেন- মানুষ সম্পর্কে যা কিছু তা উপেক্ষনীয় নয়। গান্ধীজী’র কথা তো বলাই বাহুল্য। এদেশের আপামর জনসাধারণ তাঁর কথাতেই রাস্তায় নেমেছেন। তা রাজনীতি বা লবন সত্যাগ্রহ যাই হোক না কেন?
সারা দেশের আরও বড় বড় মঞ্চ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে তিনি অবলীলাক্রমে তাঁর ইতিবাচক মনোভাবগুলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারতেন। সবার কাছে সেটা অত্যন্ত সুখপ্রদ এবং আনন্দের কারণ হত। ইদানিং জানা যাচ্ছে মোহন ভাগবতজী’র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো এবং রাষ্ট্রপতি ভবনে দু’বার তারা মধ্যাহ্নের ভোজনে মিলিত হয়েছেন। দু’জনই স্বল্পহারী ও শাকাহারী। সেখানে একটা সাদৃশ্য আছে। কিন্তু এটা যে নাগপুর পর্যন্ত ধাবিত হবে তা বোঝা যায়নি।
আর একটি ইদ এসে পড়ল। গত ইদের মাত্র কয়েকদিন আগে জুনাইদ বলে একটি কিশোরকে শুধুমাত্র মুসলমান বলে যারা খুন করল তারা কিন্তু আরএসএস কর্মী। ২০১৫ সালে আখলাককে যারা খুন করেছিল মিথ্যা অভিযোগে তারাও খুনী আরএসএস। মাত্র কয়েকদিন আগে রাম নবমীর দিনে খুন হল আসানসোলের ইমাম রশিদি’র পুত্র সিবগা তুল্লাহ। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিল। ৪১২ নম্বর পেয়ে পাস করেছে- সবই এখন অতীত। এই সব মূঢ ম্লান মুখগুলি আপনার দৃষ্টি ছাড়িয়ে গেল কেমন করে? একবারও আপনার এই দরিদ্র ভারতের কথা মনে হল না?
সেই আরএসএস-এর মঞ্চে আপনি গেলেন তাদের সহবত শেখাতে। ছোটবেলা থেকেই ‘উলো বনে মুক্তো ছড়ানো’র কথাটি আমাদের দেশে চালু আছে। আপনি মস্ত মানুষ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আপনার না জানার কথা নয় যে সারা দেশের মনোভাব এখন কি? গুজরাত, কর্নাটক এবং একটার পর একটা উপনির্বাচন বিজেপি’র বিরুদ্ধে যাচ্ছে। সামনে আছে মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের মতো রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। বিজেপি এখন আরএসএস-এর হাতের ক্রীড়ানক মাত্র। এখানে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোনও জায়গা নেই। বিজেপি নিজেও বুঝতে পারছে আরএসএস তাদের কোন অন্ধগলির মধ্যে এনে ফেলেছে। যেখান থেকে ফেরার আর কোনও রাস্তা নেই।
আপনার ভাষণের মধ্যে বিশেষ নতুন কথা নেই। রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছেন। জাতীয়তাবাদের রাবীন্দ্রিক ধারণা অতীব সত্য-একথা আমার, আপনার মতো অনেকেই মনে করেন। কিন্তু আপনার নিশ্চয় মনে আছে যে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আরএসএস-এর ধারণা কতখানি রবীন্দ্রনাথের বিপরীত কোণে অবস্থান করছে। সেই আপনি আরএসএস মঞ্চে অবলীলাক্রমে আসীন হলেন?
সবচাইতে আশ্চর্য হলাম হেডগেওয়ার সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ণ দেখে। জানি না ইতিহাস পাল্টে শব্দগুলি বিজেপি লিখে দিয়েছে কিনা? ‘ভারত মাতার মহান সন্তান’। ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠা করে যিনি হিন্দুরাষ্ট্রের স্লোগান দিয়েছিলেন। বিজেপি যে হিন্দুত্বের কথা বলে রাস্তা চলছে তার মতাদর্শ আসছে যার কাছ থেকে, তাকে আপনি ভারত মাতার মহান সন্তান বললেন। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর যে আরএসএস’কে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। আজও যারা জাতীয় পতাকাকে মন থেকে মানেনি। সেই দলের প্রতিষ্ঠাতাকে এমন ভাবে সম্বোধন করাটা দেশের প্রতি অবমাননা’র সামিল।
দেশে বিজেপি বিরোধী ঐক্য গড়ে উঠছে। মানুষ বিজেপি’র দেশবিরোধী মনোভাব থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছে। বিজেপি এই ঐক্যে ভয় পাচ্ছে। তাই এই ঐক্যকে ভাঙতে চাইছে। বোধ হয় আপনাকে দিয়ে তা শুরু হল। আপনার কর্মধারা আপনি ঠিক করবেন। এই দ্বিতীয়বার বোধ হয় আপনি ভারতবাসীর মেজাজ বুঝতে ভুল করলেন। ভালো থাকবেন।
(সংগৃহিত)