এ গল্পটি এক জাদুর বাক্সের৷ এ গল্পটি রেডিও-র৷ সময়ের ইথারের তরঙ্গ ভিন্ন, কিন্তু স্টেশন অভিন্ন৷ মহাকালের আলাদা ঘটনা, তবে গল্প একই৷ শব্দের পিঠে শব্দের এলিয়ে থাকার মতো স্বপ্নের ফোঁড়ে স্বপ্নের বুনন যেখানে৷ পিতা ও পুত্রের৷
আর তাতেই একাকার ব্রাজিলের ১৯৫০, ১৯৭০ এবং ২০১৮ বিশ্বকাপ!
১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ছিল যেন ব্রাজিলের ফুটবল-বিশ্বে সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠানের উপলক্ষ৷ নিজ দেশের আয়োজন, সেজন্য তৈরি করা হয় মারাকানার ফুটবলতীর্থ৷ একে একে সব বাধা টপকে চূড়ার কাছে পৌঁছে যায় স্বাগতিকরা৷ জুলেরিমে ট্রফির উড়ে যাওয়া পরীকে মুঠোবন্দি করা তখন কেবলই সময়ের ব্যাপার৷ ঠিক আগের দুই ম্যাচে ১৩ গোল দিয়েছে যে দল, তাঁরা কী আর উরুগুয়ের সঙ্গে নূন্যতম ড্র-ও করতে পারবে না!
‘ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন’ বিজয় সংগীত তাই তৈরি; সাম্বার তালে তালে তা বাজানোর জন্য প্রস্তুত ব্যান্ড দল৷ সংবাদপত্রের শিরোনামও ছাপা হয়ে যায়, ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’৷ মারাকানায় দুই লাখ সমর্থকের রূপালি মিছিলের মুহুর্মুহু স্লোগান সেই স্বর্ণালি মুহূর্তের সাক্ষী হবার জন্য৷ যাঁরা যেতে পারেননি, তাঁদের কান পাতা রেডিওর ধারাভাষ্যে৷ কিন্তু সবাইকে স্তব্ধ করে উরুগুয়ে যখন ২-১ গোলে জিতে যায়, শোকে নিস্তব্ধ গোটা ব্রাজিল৷ দোনদিনিয়োর চোখেও এক সমুদ্র জল৷ তখনই তাঁর ৯ বছরের ছোট্ট ছেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরে প্রতিশ্রুতি দেয়, ‘‘কেঁদো না বাবা, তোমার জন্য একদিন আমি ওই ট্রফি নিয়ে আসবোই৷”
৯ বছরের সেই ছেলেটিই পেলে, ৮ বছর পর ১৯৫৮ আসরে ঠিকই ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতান যিনি৷
পেলের ব্রাজিল এরপর বিশ্বকাপ জেতে আরো দু’বার৷ ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালে৷ রেডিও-র পরের গল্পটি ওই সর্বশেষ আসরের৷ সেখানে ৯ বছরের আরেকটি ছেলে রেডিও শুনছিল বাবার সঙ্গে৷ ১৯৭০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল৷ সেই ব্রাজিল-উরুগুয়ে৷ আগে গোল খেয়ে ‘সেলেসাও’রা পিছিয়ে পড়ার পর স্বপ্নকে শ্বাসবন্দি করে রেডিওর ধারাভাষ্যে সমস্ত মনোযোগ ছেলেটির৷ অপেক্ষা সেই অলৌকিক জাদুকরী শব্দগুচ্ছের৷ প্রথমার্ধ শেষ হবার ঠিক আগ মুহূর্তে যখন ধারাভাষ্যকার চিত্কার করে উঠলেন, ‘‘তোস্তাও… ক্লোদোয়ালদো… ক্লোদোয়ালদোদোদোদোদো’– তখন উল্লাসে নেচে ওঠে বাবা-ছেলে৷ সৌভাগ্য যে, ১৯৫০-এর মতো ট্র্যাজেজির আগুনে সেবার পুড়তে হয়নি ব্রাজিলকে৷ সেমিফাইনালের পর ফাইনাল জিতে জুলে রিমে ট্রফি নিজেদের করে নেয় চিরতরে৷
আর ৯ বছরের সেই ছেলেটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করে ব্রাজিলের বিখ্যাত হলুদ জার্সি গায়ে চড়ানোর৷ কিন্তু ২৭ বছর বয়সেই বিসর্জন দিতে হয় সে স্বপ্ন৷ হাঁটুতে সাত সাতটি অস্ত্রোপচারে থমকে যায় ক্যারিয়ার৷ স্বপ্নের প্রজাপতি ডানা এলিয়ে পড়ে যায়; কিন্তু শীঘ্রই আবার তা উড়তে শুরু করে ভিন্ন এক বাগানে৷
আর ঠিকই তো ১৯৭০ বিশ্বকাপে ক্লোদোয়ালদোর গোল রেডিওতে শুনে উদ্বেলিত ৯ বছরের সেই ছেলে আদেনর লিওনার্দো বাচ্চি ‘তিতে’ এখন এই ২০১৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের স্বপ্নসারথি৷ ব্রাজিলের কোচ হিসেবে৷
পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের আরেকবার বিশ্বসেরা করার অভিযান এখন তিতের৷ আর তাঁর দল যেমন ফর্ম নিয়ে যাচ্ছে রাশিয়ায়, তাতে তাঁদের উপেক্ষর উপায় নেই মোটেও৷
অথচ এই ব্রাজিল কেমন তাচ্ছিল্যের শিকারই না হযেছিল! হয়ে উঠেছিল উপহাসের উপলক্ষ৷ তা সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া সত্ত্বেও! ২০১৪ বিশ্বকাপে সুযোগ আসে ৬৪ বছর আগের অভিশপ্ত ‘মারাকানাসো’-কে কবরচাপা দেয়ায়৷ অথচ ওই ট্রাজেডির সৌধে যোগ হয় নতুন মিনার– ‘মিনেইরাসো’৷ নিজ দেশের আরেক বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ১-৭ গোলে বিধ্বস্ত হবার লজ্জা৷ এখানেই শেষ নয়৷ ধারাবাহিকতায় ২০১৫ কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনাল এবং ২০১৬ আসরের প্রথম রাউন্ডে বাদ হবার পর ব্রাজিল ফুটবলের এপিটাফই যেন লেখা হয়ে যায়৷
ফুটবলতীর্থের ত্রাতা হয়ে তখনই প্রবেশ তিতের৷
২০১৪ বিশ্বকাপ শেষে মনের কোণে আশা ছিল তাঁর– ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন হয়তো দায়িত্ব দেবে৷ দেয়নি৷ কী এক উদ্ভট কারণে ২০১০ বিশ্বকাপ কোচ কার্লোস দুঙ্গাকে ফিরিয়ে আনে তাঁরা৷ সৌন্দর্যের সঙ্গে আপোশ করে হলেও তাতে যদি শিরোপার দেখা মেলে! মেলেনি৷ পর পর দুটি কোপা অ্যামেরিকার বিপর্যর এর সাক্ষী৷ আর লাতিন অ্যামেরিকা অঞ্চলের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে যখন ৬ রাউন্ড শেষে ৬ নম্বরে ব্রাজিল, আতঙ্কের চোরাস্রোত তখন স্রোতস্বিনীর বেগে প্রবাহমান৷ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো না বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করতেই না ব্যর্থ হয় ব্রাজিল!
তিতে তাড়ালেন সে ভয়৷ দায়িত্ব নেবার পর প্রথম ম্যাচেই ইকুয়েডরকে ব্রাজিল হারায় ৩-০ গোলে৷ এমনিতে মনে হতে পারে, এ আর এমন কী! কিন্তু যখন জানবেন খেলাটি ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঢের উপরের ইকুয়েডরের মাটিতে, তখন নড়েচড়ে বসবেন কিছুটা৷ আর ব্রাজিলের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের হতশ্রী অবস্থা জানলে আরো বেশি৷ দুঙ্গার অধীনের ৬ ম্যাচে দুই জয়, তিন ড্র আর এক হারে মোটে ৭ পয়েন্ট ছিল সেলেসাওদের৷ তিতের অধীনে সেই যে জয়যাত্রা শুরু, রাশিয়া বিশ্বকাপের টিকেট নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বিজয়ের ওই ক্যারাভান থামানো যায়নি৷