সতেরো বছরের মেধাবী ছাত্রী কল্পনা কুমারী ২০১৮ সালের বিহার স্কুল শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। শুধু তাই নয়, ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট বা নিট, যা বিভিন্ন ডাক্তারি কলেজে পড়ার এক নতুন প্রবেশিকা পরীক্ষা, তাতেও সে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীকে টপকে দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। নিঃসন্দেহে, কল্পনার আকাশচুম্বী সাফল্য বিহার তথা দেশের অন্যান্য রাজ্যের ডাক্তার হতে চাওয়া ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। কল্পনার পথ ধরেই তারা ভারতবর্ষের সেরা ডাক্তারি কলেজগুলিতে ঢোকার ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য চেষ্টা করবে আপ্রাণ। ঠিক যেমনটা করেছিল অনিথা, বা প্রতিভা। ঠিক যেমনটা চায় আমাদের এই বাংলার অগুনতি প্রতিভারা। কল্পনাদের সঙ্গে প্রতিভাদের পার্থক্য একটাই। ওদের লড়াই লক্ষ্যে পোঁছানোর একটু আগেই থেমে গিয়েছে মৃত্যুতে, আত্মহননে। তামিলনাড়ুর এই দুই ছাত্রী, যারা তামিল বোর্ডের দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিল, তারা সিবিএসইর পাঠ্যক্রম অনুসারে সাজানো নিট পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়।
যদি বলা হয় অনিথা ও প্রতিভাদের স্বপ্নের দৌড় থেমে গিয়েছিল এই অভিন্ন মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষা বা ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট বা নিটের জন্যই, তাহলে বোধহয় খুব একটা ভুল বলা হবেনা। আসলে গতবছর থেকেই এই বিশেষ পরীক্ষাব্যবস্থাকে পড়তে হয়েছে নানা প্রশ্নবাণ ও সমালোচনার মুখে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাত ধরে শিক্ষা যুগ্ম তালিকা থেকে কেন্দ্রীয় তালিকায় যাওয়ার পর যে আশঙ্কা করেছিলেন ভাষার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যগুলির শিক্ষাবিদেরা, সেই আশঙ্কা, অর্থাৎ শিক্ষায় ক্রমবধর্মান কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের যে আশঙ্কা, তা যে ২০১৬র পর থেকে ঘনীভূত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। ২০১৬ সালের মে মাসে সুপ্রিম কোর্টের একটি নির্দেশিকায় মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়। আর তার পর থেকেই মূলত পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি রাজ্য, যেমন তামিলনাড়ু, কেরল, অসম, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি নিট বাতিল করার দাবি ওঠে মহারাষ্ট্র ও জম্মু ও কাশ্মীর থেকেও।
কেন এই অসন্তোষ? এই প্রতিটি রাজ্যের শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি শিক্ষক ও অভিভাবকদের আশঙ্কা ছিল যে নিট পরীক্ষাব্যবস্থা কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের অর্থাৎ সিবিএসইর ছাত্রছাত্রীদের বিশেষ সুবিধে পাওয়ানোর জন্যই তৈরি হয়েছে। আমরা যদি সারা ভারতের স্কুল ছাত্রছাত্রীরা কোন বোর্ডে পড়াশুনা করে সেই তথ্যের দিকে নজর ঘোরাই, তবে আমরা দেখতে পাব যে অহিন্দি রাজ্যগুলি (পশ্চিমবঙ্গ তার মধ্যে একটি) থেকে যত ছাত্রছাত্রী এই দিল্লি-কেন্দ্রিক বোর্ডের স্কুলে পড়াশুনা করতে যায়, তার অনেক বেশি যায় হিন্দি রাজ্যগুলি থেকে (অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি)। এবং শুধু তাই নয়, সিবিএসই বোর্ডে পড়াশুনা করা ছাত্রছাত্রীরা মূলত শহর, মফস্বল ও আশপাশের এলাকা থেকে উঠে আসে, এবং অনেকক্ষেত্রেই তাদের অভিভাবকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকে বাকি অনেকের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ, একটি অহিন্দি রাজ্যের ক্ষেত্রে সিবিএসই বোর্ডের স্কুলগুলি সেই রাজ্যের ভাষিক সংখ্যাগুরুর প্রতিনিধিত্ব করেনা।
পশ্চিমবঙ্গের দিকে আমরা যদি চোখ ফেরাই, ছবিটা আরো একটু পরিষ্কার হবে। ২০১৬ সালে, যখন নিট পরীক্ষা চালু হয়নি, পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের ছাত্রছাত্রীরা এ রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলির ৭৫% আসন পূর্ণ করেছিলেন। ২০১৭ সালে, যখন নিট ব্যবস্থা চালু হয়, সংখ্যাটা নেমে আসে ৭ শতাংশে! এবছরের নিট পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরা কেমন ফল করেছেন? এবছর পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই অভিযোগ করেছিলেন যে নিট পরীক্ষার ইংরিজি প্রশ্নপত্রের তুলনায় বাংলা ভাষায় হওয়া প্রশ্নপত্রের প্রশ্নগুলি ছিল আলাদা, প্রশ্নের মানের তারতম্যও ছিল বিস্তর। অথচ গত বছর এই একই ইস্যুতে তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও ব্রায়েন সরব হওয়ার পর এবং অন্য অহিন্দি রাজ্যগুলি থেকেও প্রতিরোধের মুখে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বলেছিলেন যে আগামী বছর, অর্থাৎ এই বছর থেকে নিটের প্রশ্নপত্র ভাষা নির্বিশেষে একই হবে।
বাস্তবে তা হয়নি। ফলত যা হওয়ার তাই হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সম্ভাব্য প্রথম হয়েছে ঋত্বিক কুমার সাহু। ৬৭৬ পেয়ে মেধাতালিকায় ১৩ নম্বরে আছে সে। ভিন রাজ্যের বাসিন্দা হলেও ঋত্বিক পরীক্ষা দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আদিত্য সারাওগি যে মেধাতালিকায় ৩৯ নম্বর স্থানে আছে। লক্ষ্যনীয়, বাংলা মাধ্যম ও বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের এবারে নিটে সাফল্য সেভাবে নেই বললেই চলে।
নিট পরীক্ষা ব্যবস্থা ও অহিন্দি রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের পিছনের সারিতে চলে যাওয়া যে কাকতালীয় নয় এবং তা যে আমাদের ছেলেময়েদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা আমাদের তামিল বোন অনিথা ও প্রতিভার অকালমৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। দ্রাবিড় জনজাতির প্রতিনিধিত্ব করা রাজনৈতিক দল ডিএমকে সমস্ত অহিন্দি জাতিকে নিট পরীক্ষার বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার আবেদন করেছে। এমনকি কেরল রাজ্যের ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশন অর্থাৎ সিপিআইএমএর ছাত্র সংগঠন এসএফআইও নিট বাতিলের দাবিতে পথে নেমেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিট পরীক্ষা আবার নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু তা কি সত্যিই যথেষ্ট? সত্যিই কি প্রশ্নপত্র বিভ্রাটই নিটের একমাত্র খারাপ দিক? নাকি নিট তৈরি করবে এমন চিকিৎসক, যাঁরা হয়তো রোগীর ভাষাই বুঝবেননা? আমরা কি এমন সমাজের অংশ হতে চলেছি যেখানে আমাদের রাজ্যের হতভাগ্য প্রতিভারা হারিয়ে যাবে অতলে? রাজ্য সরকার ও রাজ্যের বিরোধী রাজনীতির অনেকটা জায়গা দখল করে থাকা বাম দলগুলি এই গভীরতর সত্য অনুধাবন করবে কবে?
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)