১২ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৯ সাল। সে দিন ছিল সরস্বতী পুজো। চৈতন্যধাম নবদ্বীপ থেকে কয়েকশো মাইল সুদূর দক্ষিণ ভারতের পুদুচেরির অরবিন্দ আশ্রমে এক ঐতিহাসিক যাত্রার সূচনা হচ্ছিল। যার পরিসমাপ্তিস্থল হিসাবে আগে থেকেই প্রস্তুত হচ্ছিল নবদ্বীপ।
ঋষি অরবিন্দের স্মৃতিতে নবদ্বীপের একদম শেষপ্রান্তে গঙ্গার তীরে নিদয়া ঘাট সংলগ্ন মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠছে অরবিন্দের ভাবাদর্শে পরিচালিত ‘বঙ্গবাণী’ নামে এক অভিনব আশ্রম এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেখানে পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠে তেরোটি বিষয়ে পৃথক পাঠ্যক্রম সম্বলিত এক বিরাট আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
নবদ্বীপের সেই বঙ্গবাণী আশ্রমই প্রথম স্থান যেখানে পুদুচেরির বাইরে শ্রীঅরবিন্দের দেহাবশেষ স্থাপিত হয়েছিল। সেটা ছিল ১৯৫৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। সেই সময়ে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা বলে চিহ্নিত হয়েছিল। ১২ই ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুদুচেরি আশ্রমে শ্রীমা স্বয়ং বঙ্গবাণীর ১২ জন কর্মকর্তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন শ্রীঅরবিন্দের দেহাবশেষ। অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শী, সে কালের হাসির গানের রাজা এবং শ্রীঅরবিন্দের অনুগামী নলিনীকান্ত সরকার তার বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন।
তাঁর রচনা থেকে থেকে জানা যায়, কী ভাবে ওই চিতাভস্ম নিয়ে পরবর্তী ন’দিন ধরে কলকাতা-সহ নবদ্বীপ জুড়ে বিপুল উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছিল। সে কালের মাদ্রাজ মেলের বিশেষ ভাবে সুসজ্জিত একটি কামরা এ জন্য রিজার্ভ করে সেটি কলকাতা হয়ে নবদ্বীপে আনা হয়েছিল। পথে মাদ্রাজ, মেলোর, ওঙ্গোল, বেজওয়ারা, ওয়ালটেয়ার, খুরদারোড, ভুবনেশ্বর, কটক, বালেশ্বর, ভদ্রক, খড়গপুর, বাগনান, সাঁতরাগাছি এবং রামরাজাতলা প্রভৃতি স্টেশনে মানুষের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য ট্রেন দাঁড়িয়েছিল। ট্রেন হাওড়ায় এসে পৌঁছায় ১৪ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টের পর। দেহাবশেষ গ্রহণ করার জন্য স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার মেয়র ত্রিগুণা সেন-সহ অনেকে।
সেই দেহাবশেষ বিশেষ রথে রেখে এক বিরাট শোভাযাত্রা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে কলকাতার বুকে প্রায় পনেরো মাইল পথ অতিক্রম করে লেক ময়দানে পৌঁছয়। কলকাতার হাজার হাজার মানুষ সেই শোভাযাত্রায় যোগ দেন। এক দিন সেখানে থাকার পর ১৬ই ফেব্রুয়ারি শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগর হয়ে নবদ্বীপের পথে যাত্রা করে বিশেষ ট্রেন। নবদ্বীপে যখন দেহাবশেষ এসে পৌঁছয় তখন সন্ধ্যায় নেমে এসেছে।
পরে ২১শে ফেব্রুয়ারি নবদ্বীপের নিদয়া ঘাটে নির্মিত সমাধি মন্দিরে স্থাপিত হয় সেই দেহাবশেষ। এখনও নবদ্বীপে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত সেই দেহাবশেষ। ১৯৫৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শ্রীমায়ের জন্মতিথিতে শ্রীঅরবিন্দের পবিত্র দেহাবশেষ নবদ্বীপের স্মৃতিমন্দিরে স্থাপন করেন শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন। তখন তিনি বঙ্গাবাণীর সভাপতি। সেই থেকে ষাট বছর ধরে নবদ্বীপের অরবিন্দ আশ্রমে সংরক্ষিত দেহাবশেষ ঘিরে প্রতি বছর উৎসব হয়।
১৯০৮ সাল। আলিপুর বোমা মামলা।
“ধর্মাবতার, আমার চূড়ান্ত আবেদন এই, অভিযুক্তের তকমা দেওয়া এই মানুষটি আজ শুধু এই আদালতের সুবিচারের প্রত্যাশী নন, তিনি মুখাপেক্ষী ইতিহাসের ন্যায়ালয়ের। আমার আবেদন, এই মামলার বিতর্কের অভিঘাত সময়ের প্রলেপে ক্ষীণতর হয়ে পড়ার দীর্ঘদিন পরও, এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাওয়ার বহুকাল পরও, এই মানুষটির প্রয়াণের দীর্ঘদিন পরও, ওঁকে মানুষ মনে রাখবে দেশপ্রেমের কাব্যরচয়িতা হিসাবে, জাতীয়তাবাদের দিকদর্শক হিসাবে। মানবতার পূজারী হিসাবে। ওঁর বাণী দেহত্যাগের বহুদিন পরও ধ্বনিত হবে দেশদেশান্তরে।”
অরবিন্দ ঘোষ সম্পর্কে উপরের উদ্ধৃতিটি চিত্তরঞ্জন দাশের, আলিপুর বোমা মামলার বিচারপর্বে। যে মামলায় অভিযুক্ত অরবিন্দের আইনজীবী ছিলেন চিত্তরঞ্জন। জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে অরবিন্দের বহুবর্ণ ভাবমূর্তি নিখুঁত পরিস্ফুট হয় এই উদ্ধৃতিতে।
সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির এক অন্যতম পুরোধা, স্বদেশী আন্দোলনে উত্তাল বঙ্গদেশে যাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। দেশমাতৃকার জন্য ত্যাগস্বীকারে বঙ্গজ যুবসমাজকে তিনি যে ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, ধরা আছে ইতিহাসের পাতায়।
দ্বিমতও অবশ্য রয়েছে অরবিন্দের ব্যাপারে। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন অরবিন্দের তথাকথিত বিভাজনমূলক রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে। স্বাধীনতার একাত্তর বছর পরে, আজ কতটা প্রাসঙ্গিক অরবিন্দের রাজনৈতিক দর্শন ?
ইতিহাসবিদ সুগত বসু ‘The Spirit and Form of an Ethical Polity: A Meditation of Aurobindo’s Thought’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখছেন, “অরবিন্দের রাজনৈতিক ভাবনা এবং তার নৈতিক ভিত্তিস্থল বিষয়ে অনেকেরই সম্যক ধারণার অভাব রয়েছে। ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। তার কারণ হল, অর্ধশতক ধরে রাষ্ট্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার একরকম প্রথাগত অধ্যয়নের প্রভাব।”
এক ইংরেজি দৈনিক কে দেওয়া এক ই-মেল সাক্ষাৎকারে ঐতিহাসিক রাহুল গোবিন্দ বলেছেন, “এ বিষয়ে পাশ্চাত্যের গবেষণা এবং বর্তমান ভারতে যে ধর্মীয় চেতনাভিত্তিক রাজনৈতিক ভাবধারার আধিপত্য, কোথাও গিয়ে যেন আশ্চর্যভাবে এক সূত্রে মিলে যায়। যাঁদের রাজনৈতিক-ভাবনার মধ্যে ওই ধর্মীয় চেতনার স্বর খোঁজার চেষ্টা হয়, অরবিন্দ তাঁদের অন্যতম। যদিও, অরবিন্দের বিষয়ে এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি তেমন। বরং, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সঞ্জয় পালশিকর তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, ‘গীতা’-র বিষয়ে অরবিন্দের বিশ্লেষণ পশ্চিমি ধারার ব্যাখ্যারই অনুগামী (‘হামবোল্ডট’-এর কথা স্বর্তব্য এখানে)। ‘শঙ্করা’-র মতো প্রাচ্য ঐতিহ্যের অনুসারী নয়।
১৯০৯। পরাধীন ভারতের এক অদ্ভুত মুহূর্ত। ইংরেজ শাসনের চাপ ক্রমবর্ধমান, কেননা স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষী যুবসম্প্রদায়ের তীব্র চাওয়া ফুটে উঠছে নানা দিক থেকে। আর সেই সব চাওয়ার মাঝখানে অরবিন্দ ঘোষের মত এক যুবকের শিক্ষিত মেধাবী অসামান্য মনন আর অদ্ভুত দ্বিখন্ডিত, আশ্চর্য চুরমার জীবন, বেছে নিচ্ছে আবেগের সঙ্গে মেধার উত্তুঙ্গ মেলবন্ধনের কবিতা তথা প্রার্থনা, স্বপ্ন তথা কামনা, ভক্তি তথা শপথের এক লেখা, দুর্গা স্তোত্রকে। ১৯০৮ থেকে ১৯০৯ সলিটারি কনফাইনমেন্টে, একাকি জেলবাসে থাকতে হয়েছিল শ্রী অরবিন্দকে। এই সময়েই তাঁর বিপ্লবী জীবন আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে ঘুরে যেতে থাকে। আর এই সময়ে লেখা হয় দুর্গা স্তোত্র।
“মাতঃ দুর্গে! সিংহবাহিনি সর্ব্বশক্তিদায়িনি মাতঃ শিবপ্রিয়ে! তোমার শক্ত্যংশজাত আমরা বঙ্গদেশের যুবকগণ তোমার মন্দিরে আসীন, প্রার্থনা করিতেছি,– শুন, মাতঃ, ঊর বঙ্গদেশে, প্রকাশ হও।।
মাতঃ দুর্গে! যুগে যুগে মানবশরীরে অবতীর্ণ হইয়া জন্মে জন্মে তোমারই কার্য্য করিয়া তোমার আনন্দধামে ফিরিয়া যাই। এইবারও জন্মিয়া তোমারই কার্যে্য ব্রতী আমরা, শুন, মাতঃ, ঊর বঙ্গদেশে, সহায় হও।।
মাতঃ দুর্গে! সিংহবাহিনি, ত্রিশূলধারিণি, বর্ম্ম–আবৃত–সুন্দর–শরীরে মাতঃ জয়দায়িনি! তোমার প্রতীক্ষায় ভারত রহিয়াছে, তোমার সেই মঙ্গলময়ী মুর্ত্তি দেখিতে উৎসুক। শুন, মাতঃ, ঊর বঙ্গদেশে, প্রকাশ হও।।
মাতঃ দুর্গে। বলদায়িনি, প্রেমদায়িনি, জ্ঞানদায়িনি, শক্তিস্বরূপিণি ভীমে, সৌম্য–রৌদ্র–রূপিণি! জীবন–সংগ্রামে ভারত–সংগ্রামে তোমার প্রেরিত যোদ্ধা আমরা, দাও, মাতঃ, প্রাণে মনে অসুরের শক্তি, অসুরের উদ্যম, দাও, মাতঃ, হৃদয়ে বুদ্ধিতে দেবের চরিত্র, দেবের জ্ঞান।।
মাতঃ দুর্গে। জগৎশ্রেষ্ঠ ভারতজাতি নিবিড় তিমিরে আচ্ছন্ন ছিল। তুমি, মাতঃ, গগনপ্রান্তে অল্পে অল্পে উদয় হইতেছ, তোমার স্বর্গীয় শরীরের তিমিরবিনাশী আভায় ঊষার প্রকাশ হইল। আলোক বিস্তার কর, মাতঃ, তিমির বিনাশ কর।।
মাতঃ দুর্গে! শ্যামলা সর্ব্বসৌন্দর্য্য–অলঙ্কৃতা জ্ঞান প্রেম শক্তির আধার বঙ্গভূমি তোমার বিভূতি এতদিন শক্তিসংহরণে আত্মগোপন করিতেছিল। আগত যুগ, আগত দিন, ভারতের ভার স্কন্ধে লইয়া বঙ্গজননী উঠিতেছে, এস, মাতঃ, প্রকাশ হও।।
মাতঃ দুর্গে। তোমার সন্তান আমরা, তোমার প্রসাদে, তোমার প্রভাবে, মহৎ কার্য্যের মহৎ ভাবের উপযুক্ত হই। বিনাশ কর ক্ষুদ্রতা, বিনাশ কর স্বার্থ, বিনাশ কর ভয়।।”
এ স্তোত্র পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী যুবকদের জপমন্ত্র। গীতা পকেটে নিয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছ করা সশস্ত্র বিপ্লবী সেই যুবকেরা যারা আজকে আমাদের কাছে শুধু গল্পের বইয়ের চরিত্র।
অরবিন্দ বলছেন, তোমার শক্ত্যংশজাত আমরা বঙ্গদেশের যুবকগণ। আমরা প্রার্থনা করছি, ঊর বঙ্গদেশে, প্রকাশ হও। ঊর অর্থ এসো। মনে পড়বে বঙ্কিমের মা যা ছিলেন, মা যা হইয়াছেন, মা যা হইবেন।
কবি কল্পনায় শক্তিমূর্তি অনন্ত আশাপ্রদায়িনী। কিন্তু ভাষার ওজস্বিতা শ্রী অরবিন্দের এমনই, যে তিনি সে ভাষাকে কোথায় না নিয়ে যাচ্ছেন এ স্তোত্রে। সিংহবাহিনী মাকে বঙ্গদেশের যুবকেরা বলছে, জীবন সংগ্রামে ভারত সংগ্রামে তোমার প্রেরিত যোদ্ধা আমরা, তুমি আমাদের প্রাণে মনে অসুরের শক্তি দাও অসুরের উদ্যম দাও। সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে মুহূর্তে এ লেখা লেখা হল, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, যতীন বাগচিদের আত্মদানের যে গৌরব তখন রচিত হচ্ছে, তখন, সাদাকালো, দৈবী শক্তি-আসুরিক শক্তির ভেদ মুছে দেওয়া এ লেখাকে কী বলব, কবির কল্পনা, নাকি আজকের ভাষায় সাবভার্শান। ধর্মকে ব্যবহার করার নানা ফন্দিফিকিরে আক্রান্ত আমরা আজকের পাঠক, এ লেখার একমুখী বিশ্বাসী আবেগী অভিঘাতের সামনে নতজানু হই তাই।
আজকের এই মুহূর্তে আর এক বড় প্রশ্ন আসছে আমাদের সামনে। দুর্গাপূজা, সেটা কতটা প্রতীকী, আর কতটা হিন্দু ধর্মের এক চিরাচরিত বিধিমাত্র। এক প্রাতিষ্ঠানিক পূজা আচরণ। বসন্তের বদলে অকালবোধনে, এই শরতে দুর্গাপূজা তো রামায়ণের কাহিনির সঙ্গে জড়িত এক অন্য বিধিভঙ্গ। তাছাড়াও, এর প্রতীকায়ন তো বার বার ঘটে গেছে এ বাংলার সংস্কৃতিতে। আর বাংলা-উড়িষ্যা-অসম নিয়ে যে বৃহত পূর্বী ক্ষেত্র, সে ক্ষেত্রের সজল মাটিতে দুর্গা তো নানারূপে আরাধিতা। বাড়ির মেয়ে, ঘরের কন্যা উমার শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসা, শক্তিপীঠের শক্তি পূজা, আবার দেশমাতৃকা অথবা সত্য-ন্যায়-সম্প্রীতি-মানবতার পূজা। সাংস্কৃতিক বোধে উদ্দীপিত এক সামাজিক বোধন। এই সব কিছুর সুদীর্ঘ ইতিহাসে, এই দুর্গা স্তোত্রও একটি মাইল ফলক, নয়কি?আজকের এই ক্ষতবিক্ষত, নৈরাশ্যময় সময়ে, এই বাণী, এই আবাহন, “আর বিসর্জন করিব না” বলে এই প্রতিশ্রুতি, আর সবশেষে, আমাদের জীবন অনবিচ্ছিন্ন দুর্গাপূজা হউক, এ শপথ, অনেক আত্মবলিদানের স্মৃতি মনে আনে, আবার নতুন করে উদ্বুদ্ধও করে না কি?
অরবিন্দ (১৮৭২-১৯৫০) ঘোষকে আমরা বলতে পারি বিপ্লবী আন্দোলনের নেপথ্য নায়ক, জাতীয়তাবাদী নেতা, আধ্যাত্মিক সাধক এবং দার্শনিক। ১৮৭২ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতায় তাঁর জন্ম। পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ বিলেতফেরত ডাক্তার। ডিস্ট্রিক্ট সার্জেন। মাতা স্বর্ণলতা দেবী ছিলেন কলকাতার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, ব্রাম্ভসমাজখ্যাত রাজনারায়ণ বসুর জ্যেষ্ঠা কন্যা। একজন আলোকপ্রাপ্তা মহিলা। কবিতা লিখতেন। বোঝাই যায়, বনেদি পরিবার। বাবা মায়ের লক্ষ্য ছেলেকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় ও ভাবধারায় গড়ে তোলা। এই লক্ষ্যে ছেলেকে মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই দার্জিলিং এর লরেটো কনভেন্ট এ ভর্তি করা হয়। এরপর ১৮৭৯ সালে মাত্র সাত বছর বয়সে, তাঁর অগ্রজ দুই ভাইয়ের সঙ্গে তাঁকেও বিলেতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১৮৮৪ পর্যন্ত তিনি ম্যাঞ্চেস্টারের গ্রামার স্কুলে পড়েন। কেমব্রিজ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এর পর কিংস কলেজে অধ্যয়ন করেন। স্নাতক হন। ল্যাটিন, গ্রীক, ফ্রেঞ্চ ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। মজার বিষয় হল, তাঁর বাংলা ভাষা শিক্ষা শুরু ইংল্যাণ্ডেই, মিস্টার টাওয়ার্স নামের এক ইংগ্রেজ শিক্ষকের কাছে।
চৌদ্দ বছর বয়স থেকে তিনি দেশের স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেন এবং আঠারো বছর বয়সে পৌঁছানোর মধ্যেই তাঁর মনে এই বিশ্বাসই দৃঢ় হয়ে ওঠে যে, ব্রিটিশদের দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে ভারতের মুক্তি বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে অর্জন করতে হবে। ছাত্র জীবন থেকে তিনি ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ফরাসি বিপ্লবের নেতা দাঁতে এবং রোবসপিয়ার তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি এটা উপলব্ধি করেছিলেন যে, পিটিশনের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা লাভ করা যাবে না, বিপ্লবের মাধ্যমেই দেশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। ইংল্যান্ডে থাকার সময় তিনি বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির প্রতি আকৃষ্ট হন।
১৮৯০ সালে অরবিন্দ ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, কিন্তু অশ্বচালনা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করায় আই সি এস সম্পূর্ণ হয় না।বিলেতে থাকা অবস্থাতেই সংবাদপত্রের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ অপশাসনের কথা জানতে পারেন। সেখানেই তিনি তাঁর ভাইদের সঙ্গে এবং কিছু উৎসাহী ভারতীয় তরুণদের সাথে “Lotus and Dagger” নামে একটি গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলেন। ফরাসী বিপ্লব ও আইরিশদের মুক্তি সংগ্রাম খুব সম্ভবত তাঁকে এইরকম একটি সমিতি গড়ে তুলতে উৎসাহ দিয়েছিল। তখন থেকেই তাঁর অন্তরে ভারতকে বিদেশি শাসনমুক্ত করার বাসনা জেগে ওঠে। কেম্ব্রিজে পড়াকালীন তিনি সেখানকার “ভারতীয় মজলিসের” সম্পাদক ছিলেন। সেখানে তিনি এ নিয়ে নানা বক্তৃতাও দিয়েছিলেন। সেই সময়ে লণ্ডনেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় বরোদার মহারাজা সয়াজীরাও গায়কোয়াডের, যিনি ২০০ টাকা মাসিক বেতনে তাঁর স্টেট সার্ভিসে অরবিন্দকে চাকরি দেন। ১৯০০ সালে অরবিন্দ ঘোষ বরোদা কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হন। ১৯০৪ সালে অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৮৯৩ থেকে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বরোদায় কাজ করেন। এখানেই তিনি ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও শাস্ত্র গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। সংস্কত শিখে অধ্যয়ন করেন বেদ, উপনিষদ, গীতা, কালিদাস, ভবভূতি, রামায়ণ, মহাভারত, মনুস্মৃতি ইত্যাদি। বাংলার পাশাপাশি শেখেন গুজরাতি ও মারাঠি।
অরবিন্দের রাজনৈতিক সক্রিয়তার সুচনা হয় ১৮৯০ সালেই, কংগ্রেসের নরমপন্থী মনোভাবের বিরোধিতার মাধ্যেমে। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের বিকাশ ঘটে স্বদেশি আন্দোলনের সময়, যখন তিনি ডাক দিয়েছিলেন ‘নিষ্পৃহ প্রতিরোধ’ বা ‘Passive Resistance’-এর। সুগত বসুর মতে, “অরবিন্দের বক্তব্য ছিল, কৌশলগতভাবে ‘নিষ্পৃহ প্রতিরোধ’ নিয়ে আপত্তির কিছু নেই, তবে প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যেও কোন অনৈতিকতা নেই। আমাদের সেই সংগ্রামের রসদ নেই, এই যা।”
১৯০১ সালে অরবিন্দ ঘোষ বরোদায় থাকাকালীন ১৫ বছর বয়সী কলকাতার ব্রাহ্ম বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী, ভূপালচন্দ্র বসুর মৃণালিনী দেবীকে হিন্দুশাস্ত্র মতে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের বিবাহিত জীবন ছিল প্রায় ১৭ বছর। ১৭ বছরের বিবাহিত জীবনে মৃণালিনী দেবী খুব কম সময়ই স্বামী সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। বেশিরভাগ সময় দেশের কাজে ব্যস্ত থাকায় অরবিন্দ ঘোষ স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন চিঠিপত্রের মাধ্যমে। তিনি দেশের কাজে কবে কোথায় থাকতেন, তার কোনও ঠিক ছিল না। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী স্বামী সান্নিধ্য না পাওয়ায় মাঝে মাঝে মানসিকভাবে বিপর্যন্ত হয়ে পড়তেন। অরবিন্দ ঘোষ তাঁর অবস্থাটা চিঠির মাধ্যমে পরিষ্কার করে দিয়ে লিখেছিলেন, “আবার সেই কথা বলি, তুমি একজন সাধারণ লোকের স্ত্রী হও নাই, তোমার বিশেষ ধৈর্য ও শক্ততার দরকার। এমন সময়ও আসিতে পারে যখন একমাস কিংবা দেড়মাস নয়, ছমাস পর্যন্তও আমার কোনও খবর পাইবে না। এখন থেকে একটু শক্ত হইতে শিখিতে হয়, তাহা না হইলে ভবিষ্যতে অনেক দুঃখভোগ করিতে হইবে।”
বাংলার তরুণ বিপ্লবীদের নিয়ে গড়ে ওঠে স্বদেশী আন্দোলনের মূল সংগঠন “অনুশীলন সমিতি”। ১৯০৬ সালে শুরু হয় “যুগান্তর” সাপ্তাহিক পত্রিকা, যা ব্রিটিশ বিরোধী পত্রিকা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।যখন ব্রিটিশ শাসনের কঠোর দমননীতির বিরুদ্ধে বাংলায় সন্ত্রাসবাদ গড়ে উঠেছে, অরবিন্দ ঘোষ “আপস নয়” (১৯০৩) নামে একটি বই লিখে বিপ্লবী দলের সদস্যদের মধ্যে গোপনে প্রচার করেন এবং এই কাজে তাদের উৎসাহিত করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বাংলায় প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হল। অরবিন্দ বরোদার চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলায় চলে আসেন এবং জাতীয় কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯০৬ সালে কলকাতায় জাতীয় কলেজের, বর্তমানে যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রথম অধ্যক্ষ হন। একই সঙ্গে বিপিনচন্দ্র পালের “বন্দেমাতরম্” ইংরেজি সংবাদপত্রের সম্পাদক হন। এই পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধের জন্য বিপিনচন্দ্র পাল এবং তিনি রাজদ্রোহে অভিযুক্ত হন। বিপিনচন্দ্রের ছয় মাস কারাবাসের সাজা হয়। প্রমাণাভাবে অরবিন্দ মুক্তি পান। পাঁচ বছর (১৯০৬-১৯১০) সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। বিপ্লবী দলের নেপথ্য নায়ক ও কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান।
১৯০৫-০৬ সালের মধ্যে ভারতের সর্বত্র বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলন গড়ে ওঠে। বয়কট আন্দোলন ধীরে ধীরে স্ব-রাজলাভের আন্দোলনে রূপ নিতে শুরু করে। ঠিক এমন সময় বরোদা থেকে অরবিন্দ ঘোষ কলকাতায় চলে আসেন। তিনি বরোদার রাজ কলেজে ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসেবে চাকুরী করতেন। তখন তাঁর বেতন ছিল ১৫০০ (পনেরশত) টাকা। এত বড় অংকের বেতনের চাকরি পরিত্যাগ করে তিনি কলকাতায় এসে অনেক কম বেতনে ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে চাকুরী নেন। এখানে তাঁর বেতন ছিল মাত্র ১৫০ (একশত পঞ্চাশ) টাকা। এর পিছনে মূল কারণ ছিল বরোদা থেকে বিপ্লবী দল পরিচালনা করতে তাঁর খুবই অসুবিধা হচ্ছিল। বারবার কলকাতায় আসা-যাওয়া করে বিপ্লবী কাজ যথা সময়ে সম্পাদন করা যেত না। মাতৃভূমির বুকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে মেনে নিতে পারছিলেন না অরবিন্দ ঘোষ। তাই সুবিধামত বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও সংগঠিত করে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করার জন্য তিনি কলকাতায় চলে আসেন।
“রাষ্ট্রশক্তিতে বলীয়ান শাসকশ্রেনীর চরিত্রই হল তাদের অধীন জনগোষ্ঠীর কোনরূপ প্রতিবাদকে উগ্র এবং অপরাধমূলক বলে প্রতিপন্ন করা”, লিখেছিলেন অরবিন্দ ১৯০৭ সালে, “বন্দেমাতরম” পত্রিকায়। মধ্যতিরিশের অরবিন্দ তখন মনে করতেন, নিস্পৃহ প্রতিরোধ যে কোন সময় বদলে যেতে পারে সম্মুখসমরে। এবং যদি তা-ই হয়, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে আসা যাবে না। যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যারা দ্বিধাগ্রস্ত থাবে তাদের জন্য বরাদ্দ থাকা উচিত কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধবিমুখ অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের সস্নেহ তিরস্কার।
‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় “The Morality of Boycott” শীর্ষক আরেকটি নিবন্ধে অরবিন্দ কাব্যিক ভঙ্গিতে লিখেছিলেন “দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঝরানোর তৃপ্তি”-র কথা। ইতিহাসবিদ এম. কে. হালদার অরবিন্দের রাজনৈতিক চেতনার বিষয়ে লিখেছেন, “সহিংসা বা অহিংসা তাঁর কাছে দেশের স্বাধীনতার জন্য দুটি বিকল্প পন্থার বেশি কিছু ছিল না।”
অরবিন্দের কাছে দেশমাতাকে স্বাধীন করাই ছিল এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। গবেষকরা কেউ কেউ তাঁকে ‘Matrist’ (মাতৃতান্ত্রিক, মায়ের প্রতি অনুরাগ যার বাবার থেকে তুলনায় বেশি হয়) বলেও অভিহিত করে থাকেন। অরবিন্দ লিখেছিলেন, “মাতৃভূমি ছাড়া কোনও কিছুই রাজনৈতিকভাবে পূজ্য নয়। স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনও কিছুই রাজনৈতিকভাবে অভীষ্ট নয়। এবং কোনও পন্থাই রাজনৈতিকভাবে শুভ বা অশুভ নয়, যতক্ষণ না তা জাতীয়তাবাদের উন্মেষে সহায়ক বা ক্ষতিকারক হয়ে উঠছে।”
বরোদায় বিপ্লবী সংগঠন গোপনে কাজ করত। অরবিন্দ তাঁদের সংস্পর্শে আসেন। অনুজ বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে বিপ্লবীমন্ত্রে দীক্ষিত করে ওইরূপ দল গঠনের জন্য বাংলায় প্রেরণ করেছিলেন।
১৯০২ সালে বারীন্দ্র কুমার ঘোষ লন্ডন থেকে কলকাতায় আসেন। কলকাতায় এসে তিনি ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহের বহ্নি ছড়াতে থাকেন। কিন্তু বাঙালী ভদ্রলোকেরা মোটেই সাড়া দেয়নি। বিফল হয়ে তিনি বরোদায় বড়ভাই অরবিন্দ ঘোষের নিকট ফিরে যান। বারীন্দ্র কুমার ঘোষ বরোদায় বসে অনুধাবন করেন, রাজনীতিকে ধর্মের সঙ্গে একীভূত না করলে কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনে কাজ হবে না। এজন্য তিনি গীতা পাঠের সঙ্গে রাজনীতির পাঠ দেবার উদ্দেশ্যে অনুশীলন সমিতির পরিকল্পনা করেন ও উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন।
এরপর অরবিন্দর অনুপ্রেরণায় ও বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে কলকাতার ৩২নং মুরারিপুকুরে তৈরি হয় সশস্ত্র বিপ্লবী অনুশীলন সমিতি (দল)। ৩২নং মুরারিপুকুর রোডের বাগানবাড়িটি ছিল বারীন্দ্রকুমার ঘোষদের পৈত্রিক সম্পত্তি। সশস্ত্র বিপ্লবী নেতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষ তাঁর দলের আখড়া গড়েছিলেন এই মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে। এই বাগানবাড়ির মাঝখানে ছিল ছোটো একটি পাকাবাড়ি। বাড়িটির চতুর্দিকে ছিল গাছপালা। অরবিন্দ ঘোষ এবং অপর দুই ভাই মনোমোহন ঘোষ ও বিনয় ঘোষ এই বাগানবাড়িতে বসবাস করতেন। অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে পরামর্শ করেই বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, হেমচন্দ্র ঘোষ, অবিনাশ ভট্টাচার্যর মতো বিপ্লবীরা দলের নীতি নির্ধারণ করতেন। এক সময় ওই ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িটি হয়ে উঠে সশস্ত্র বিপ্লবীদের মূল কেন্দ্র। ১৯০৩ থেকে ১৯০৫ সাল ছিল বাংলাদেশে বিপ্লবের বাণী প্রচারের অধ্যায়। এই সময় প্রকাশিত হতে থাকে সন্ধ্যা, বন্দেমাতরম, যুগান্তর প্রভৃতি পত্রিকা।
সখারাম গণেশ দেউস্কর, পি মিত্র, যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের নানা তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে বিপ্লবী যুবকদের শিক্ষাদান পর্ব চলতে থাকে। ১৯০৩ সালে কলকাতায় প্রমথ মিত্র ও চিত্তরঞ্জন দাস ‘অনুশীলন সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রমথ মিত্র ১৯০৫ সালে বিপিন চন্দ্র পালের সঙ্গে ঢাকায় এসে অনুশীলন সমিতির একটি শাখা স্থাপন করেন এবং ঢাকা অনুশীলন সমিতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন পুলীন বিহারী দাস। এই সমিতির কেন্দ্র ছিল ঢাকার উয়াড়িতে। বহু দেশপ্রেমিক যুবক স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে যোগ দিয়েছিলেন এই বিপ্লবী অনুশীলন দলে। দলের সদস্যরা বিদেশি শাসকের বুকে আঘাত হানতে লাঠি খেলা, ছোরা ও আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। ১৯০৬ সালের দিকে বিপ্লবীদের দ্বিতীয় দল যুগান্তর সমিতির জন্ম হয় কলকাতায়। অরবিন্দ ঘোষ ও বারীন্দ্র ঘোষ যুগান্তর সমিতি পরিচালনার দায়িত্ব নেন। ১৯০৫ সালে কার্জন সাহেবের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা সমগ্র বঙ্গদেশকেই আলোড়িত করে তোলে। বিক্ষুব্ধ বঙ্গবাসীরা বিদ্রোহের ধ্বজা নিয়ে আন্দোলনের পথে অগ্রসর হয়। ১৯০৬ সালে অরবিন্দ ঘোষ বাংলাদেশে আসেন এবং বঙ্গবাসীকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করার অভিযান শুরু করেন। এই সময় বারুইপুরে ও উত্তরপাড়ায় তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ ইতিহাস হয়ে রয়েছে। তাঁর ভগিনী নিবেদিতাও তখন বিপ্লববাদী যুবকদের সাহায্য করতেন। এই সময় বিপ্লববাদীদের প্রচারের ধারার নিদর্শন হিসাবে ১৯০৬ সালের একটি লেখার উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলার বিপ্লবীদের মুখপত্র যুগান্তর ১৯০৬ সালে বরিশালে ব্রিটিশ শাসকদের নিষ্ঠুর দমনপীড়নের পর ২৬ এপ্রিল সম্পাদকীয়তে খোলাখুলি লেখে: “দেশের ৩০ কোটি মানুষ যদি তাদের ৬০ কোটি হাত প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞায় তুলে ধরে তবেই বন্ধ হবে এ অত্যাচার। একমাত্র শক্তি দিয়েই শক্তির প্রকাশকে স্তব্ধ করা সম্ভব।”
ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য বাংলার যুবকরা তখন জেগে উঠেছে। যেখানেই ইংরেজের অত্যাচার দেখছে সেখানেই তাঁরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এই প্রতিবাদের জন্য তাঁরা নির্যাতিত হতে থাকে। এই নির্যাতনের প্রতিবাদে বাংলার দিকে দিকে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত রূপ দেবার জন্য অরবিন্দ ঘোষের বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত যুবকরা সংঘবদ্ধ হন। ব্রিটিশ শাসকদের নির্যাতন যতই বাড়তে থাকে, বাংলাদেশে সশস্ত্র বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বিষয়টি ততই প্রবল হয়ে উঠে। ঝামাপুকুর ও মানিকতলায় বোমা তৈরির কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা করে বিপ্লবীরা। বিপ্লবের এই গোপন আয়োজন ক্রমে ক্রমে মেদিনীপুর, চন্দননগর, কৃষ্ণনগর, শ্রীহট্ট, বগুড়া, রংপুর, বরিশাল, ঢাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। অনুশীলন সমিতির শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে উঠে ঢাকায়।
১৯০৫ সালে অরবিন্দ ঘোষ বরোদা থেকে একটা চিঠি লিখেছিলেন স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে। চিঠির একাংশে লিখেছিলেন, “তুমি কি কোণে বসিয়া কাঁদিবে মাত্র, না তার সঙ্গেই ছুটিবে, পাগলের উপযুক্ত পাগলি হইবার চেষ্টা করিবে? অন্ধ রাজার মহিষী চক্ষুদ্বয়ে বস্ত্র বাঁধিয়া নিজেই অন্ধ সাজিলেন। হাজার ব্রাহ্মস্কুলে পড়িয়া থাক, তবে তুমি হিন্দু ঘরের মেয়ে, হিন্দু পূর্বপুরুষের রক্ত তোমার শরীরে, আমার সন্দেহ নাই, শেষোক্ত পথই তুমি ধরিবে।” এই চিঠিটিরই অপর অংশে তিনি লিখেছিলেন, “আমি স্বদেশকে মা বলিয়া জানি, ভক্তি করি, পূজা করি। মার বুকের উপর বসিয়া যদি একটা রাক্ষস রক্তপানে উদ্যত, তাহা হইলে ছেলে কি করে? নিশ্চিন্তবোধে আহার করিতে বসে? স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে আমোদ করিতে বসে? না, মাকে উদ্ধার করিতে পৌরোহিত্য করে?”
১৯০৭-এ কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে দলের নরমপন্থী অংশের সঙ্গে অরবিন্দ সহ অন্যান্য চরমপন্থী নেতাদের মতবিরোধ তুঙ্গে ওঠে। কংগ্রেস বিভক্ত হয়ে যায় এর কিছুদিন পরেই। অরবিন্দ অবশ্য ততদিনে কলকাতায় ‘অনুশীলন সমিতি’-র মতো সহিংস সংগ্রামে বিশ্বাসী গুপ্ত সংগঠনগুলির নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছেন।
১৯০৭ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে স্বদেশি ইংরেজি ‘দৈনিক বন্দেমাতরম্’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বিপ্লবী যুবকদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেন। অরবিন্দ ঘোষের সাথে যোগাযোগ ছিল ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সম্পাদক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ও ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধব উপপাধ্যায়ের। এই স্বদেশি পত্রিকাগুলোর মূলমন্ত্র ছিল বিদেশির হাত থেকে যে কোনও মূল্যে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া। সশস্ত্র বিপ্লবীরা ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হচ্ছিলেন এই স্বদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত জ্বালাময়ী নিবন্ধ পড়ে। বিপ্লবী যুবকরা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াতে বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের বিপ্লবী আখড়া গড়ে তোলেন। রাজদ্রোহের অভিযোগে ১৯০৭ সালে ‘বন্দেমাতরম্’ পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা করে ইংরেজ প্রশাসন। আসামি করে গ্রেপ্তার করা হল অরবিন্দ ঘোষ, হেমচন্দ্রনাথ বাগচি ও অপূর্বকৃষ্ণ বোসকে। ‘বন্দেমাতরম্’ পত্রিকার ম্যানেজার ছিলেন হেমেন্দ্রনাথ বাগচি আর অপূর্বকৃষ্ণ বোস ছিলেন পত্রিকার মুদ্রাকর।
সেই সময় কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মি. কিংসফোর্ড। অভিযুক্ত আসামি তিনজনকে তোলা হয়েছিল মি. কিংসফোর্ডের আদালতের আসামির কাঠগড়ায়। সাক্ষ্যসাবুদ নেওয়া হয়েছিল ১৯০৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। এই মামলাটির নামকরণ হয়ে গিয়েছিল ‘বন্দেমাতরম্ মামলা’। প্রমাণাভাবে মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল অরবিন্দ ঘোষ ও হেমেন্দ্রনাথ বাগচিকে। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারায় দণ্ডিত করা হয়েছিল অপূর্বকৃষ্ণ বোসকে। ‘বন্দেমাতরম্’ মামলায় সরকার পক্ষ থেকে সাক্ষী মানা হয়েছিল বিপিনচন্দ্র পালকে। সেইমত চিফ্ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেব বিপিনচন্দ্র পালের নামে সমন পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বিপিনচন্দ্র পাল সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করায় আদালত অবমাননা করার জন্য তাঁকে ছয়মাসের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। মি. কিংসফোর্ড সাহেবের আদালতে যখন ‘বন্দেমাতরম্’ মামলাটির শুনানি চলছিল তখন একদিন ১৪/১৫ বছরের বালক সুশীল সেন আদালত কক্ষে দাঁড়িয়ে আওয়াজ তুলেছিল, ‘বন্দেমাতরম্! বন্দেমাতরম।’ ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনি দেওয়ার অপরাধে নির্দয় কিংসফোর্ড বালক সুশীল সেনকে ১৫ ঘা বেত্রদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এক দেশপ্রেমিক বালককে বেত্রদণ্ড দেওয়ায় বিপ্লবীরা ক্রোধে ফুঁসে উঠলেন। এঘটনায় শুধু ভারতবাসী নয়, অনেক ইংরেজও ক্ষুব্ধ হলেন। এই ঘটনায় বিপ্লবীরা ক্ষুব্ধ হয়ে কিংসফোর্টকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই হত্যার দায়িত্ব নিলেন ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী।
বারীন ঘোষের নেতৃত্বে কলকাতার মানিকতলায় তরুণ স্বদেশীদের বোমা তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। মানিকতলার সেই জায়গাটি এখন “বোমার মাঠ” নামে খ্যাত। ১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল। ইংরেজ বিচারক কিংসফোর্ড সাহেবকে হত্যার দায়িত্ব পেয়েছেন ক্ষুদিরাম বোস ও প্রফুল্ল চাকী। এই কিংসফোর্ড ছিলেন ভারতবিদ্বেষী। সামান্যতম অপরাধে বিপ্লবীদের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দিতেন। কিন্তু এই হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বোমার আঘাতে দুজন ইংরেজ মহিলা মারা যান। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন। প্রফুল্ল চাকী ধরা না দিয়ে নিজের মাথায় গুলি করে মৃত্যূবরণ করেন। ১৯০৮ সালের ১১-ই আগস্ট ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়। ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী এই দুটি নাম উচ্চারিত হলেই একটি ফাঁসি ও নিজের বন্দুক থেকে মাথায় গুলি করার একটি দৃশ্য ভেসে ওঠে প্রতিটি ভারতবাসীর মানসনয়নে।
ব্রিটিশ প্রশাসকেরা বুঝতে পারেন মজফ্ফরপুরে কিংসফোর্ডকে হত্যার উদ্দেশ্যে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীকে কলকাতা থেকে পাঠানো হয়েছিল। তাই কলকাতার পুলিশ প্রশাসন আর অপেক্ষা না করে বিপ্লবীদের ডেরাগুলিতে হানা দিল। তল্লাসী শুরু হল ব্যাপকভাবে। পুলিশের কাছে আগে থেকেই অনেক গুপ্ত খবর ছিল। গুপ্তচরদের মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবীদের গতিবিধি লক্ষ্য করে যাচ্ছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৯০৮ সালের ২রা মে কলকাতার ব্রিটিশ প্রশাসনের পুলিশ আটটি জায়গায় খানা-তল্লাশি চালায়। মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত ও নলিনীকান্ত গুপ্তসহ ১৪ জনকে। ৫ই মে, ৪৮নং গ্রে স্ট্রিট থেকে অরবিন্দ ঘোষসহ তিনজনকে, ১৩৪নং হ্যারিসন রোড থেকে ৫ জনকে, রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট থেকে হেমচন্দ্র দাস কানুনগো, গোপীমোহন দত্ত লেন থেকে কানাইলাল দত্তসহ দুইজনকে গ্রেফতার করে। ১৩৪নং হ্যারিসন রোডের বাড়ি থেকে পুলিশ প্রচুর পরিমাণে বোমা তৈরির মাল-মশলা ও সাজসরঞ্জাম উদ্ধার করে। এ ছাড়াও পুলিশ ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি থেকে মাটির তলায় পুঁতে রাখা কতিপয় ট্রাঙ্ক উদ্ধার করে। এই ট্রাঙ্কগুলি থেকে পাওয়া যায় বেশ কিছু তাজা বোমা, কতকগুলি বোমা তৈরির খোল, বৈপ্লবিক পুস্তক-পুস্তিকা ও চিঠিপত্র। কিছু ডিনামাইট ও একটি রিভলভারও পাওয়া যায়। এই সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বোমা ষড়যন্ত্রের ও রাজদ্রোহের অভিযোগে মামলা।
এই মামলাটিরই নামকরণ হয়ে গিয়েছিল ‘আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা’। মোট ৩৭ জন অভিযুক্ত আসামিকে বিচারের জন্য চালান দেওয়া হয়। অচিরেই দেশের সাধারণ মানুষ জানতে পারেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, নির্মল রায়, কবিরাজ ধরণীধর গুপ্ত, ইন্দুভূষণ সরকার, শচীন সেন, কুঞ্জলাল সাহা প্রমুখ বিপ্লবী নেতৃত্ব রাজদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন। স্বাধীনতা-পিপাসু মানুষ এই সব দেশবরেণ্য বিপ্লবীদের গ্রেফতারের কথা জেনে ক্ষেপে উঠলেন। বিদেশি সরকারের বিরুদ্ধে, ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অগ্নিরোষ আরও গভীর হল। দিকে দিকে আওয়াজ উঠল ‘বন্দেমাতরম্’। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ১৯০৮ সালের ১৯ অক্টোবর আলিপুরের জেলা ও দায়রা জজ মি. চার্লস পোর্টেন বিচক্রফট্-এর আদালতে ‘মুরারিপুকুর বোমা মামলা’র সূচনা হয়েছিল। মামলায় অরবিন্দ ঘোষের উপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। একমাত্র চিত্তরঞ্জন দাশ বিনা টাকায় এই মামলায় লড়েন। তখন তাঁর মাসিক আয় ছিল পাঁচ হাজার টাকা। আর এই মামলা পরিচালনা করতে তাঁকে চল্লিশ হাজার টাকা দেনা করতে হয়েছিল। অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে এই মামলা চলে ১২৬ দিন। দু’শর বেশী সাক্ষীকে জেরা করা হয়। ৪০০০ কাগজপত্র এবং ৫০০ জিনিসপত্র প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর সওয়াল জওয়াবের পরিসমাপ্তি বক্তব্য দেন ৯ দিন ধরে। এই মামলায় তিনি যে সওয়াল করেছিলেন তা জ্ঞান ও দেশপ্রেমের অপূর্ব নিদর্শন। বিচারের রায়ে অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পান।
এই মামলা চলাকালীন স্বীকারোক্তিতে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ সম্পূর্ণ দায় নিজের উপর তুলে নিয়েছিলেন।এই মামলায় প্রথমে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যা পরে ‘কালাপানি’ অর্থাৎ আন্দামান সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বদল করা হয়। ১৯২০ সালে “জেনারেল এমনেস্টির” ফলে, ১২ বছর আন্দামানের জেলে কাটিয়ে বারীন ঘোষ সহ বাকি সকলে মুক্তি পান।
বিচার চলার সময় আরবিন্দ ঘোষ এক বছর ছিলেন নির্জন কারাগারে বন্দী। এই নির্জন বন্দীদশা তাঁর জীবনে এনে দিয়েছিল এক পরম আশীর্বাদ। কারাগার তাঁর কাছে কারাগার ছিল না, হয়েছিল আশ্রম। যোগ আর তপস্যার একাগ্রতার মধ্য দিয়ে অরবিন্দ ঘোষ সেই বন্দীদশাতেই ভগবানের দর্শন লাভ করেছিলেন। এক বছরের হাজত বাস অরবিন্দ ঘোষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন এনে দিল। এক বছর জেলে কাটানোর পর্বে তাঁর রাজনৈতিক ভাবাদর্শে ছোঁয়া লাগে আধ্যাত্মিক চিন্তার। অরবিন্দ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, “জেলে থাকার সময় আমি অবিরাম শুনতে পেতাম স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। যখন আমি এক পক্ষকাল ধ্যানমগ্ন ছিলাম একা একটি কুঠুরিতে, বিবেকানন্দ যেন রোজ আমার সঙ্গে কথা বলতেন।” জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর অরবিন্দ নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন আধ্যাত্মিকতায়। বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ রূপান্তরিত হলেন সাধক অরবিন্দ ঘোষ রূপে। তবে তিনি দেশসেবার ব্রত থেকে বিচ্যুত হননি। ধর্মপথে দেশসেবার ব্রত গ্রহণ করেন। তাঁর লেখনীতে তখন শুধু জাতীয়তার বাণীই থাকত না, আধ্যাত্মিক তত্ত্বও থাকত। কিন্তু সেই সময় হঠাৎ জানা গেল যে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার করার চক্রান্ত করছে। কলকাতার নানা পরিচিত জনের বাড়িতে তখন তিনি আত্মগোপন করে থাকতে লাগলেন।
ভগিনী নিবেদিতার বাড়িতেও রইলেন একদিন। শেষে নিবেদিতাই তাঁকে চন্দননগরে চলে যাবার সুযোগ করে দেবার জন্য গঙ্গায় একটি নৌকায় তুলে দিলেন। তখন চন্দননগর ছিল ফরাসী অধিকৃত এলাকা। সেখান থেকে তিনি চলে গেলেন পন্ডিচেরীতে। সেটাও ছিল ফরাসী অধিকৃত রাজ্য। ১৯১০ সালের ৪ এপ্রিল তিনি পন্ডিচেরীতে যান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্র স্থাপন করেছিলেন যে সব দেশনেতারা, অরবিন্দ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথম ধর্মীয় অনুষঙ্গ যোগ করেছিলেন রাজনীতিতে, তার পরে বিবেকানন্দও। ইতিহাসবিদ এম কে হালদারের মতে, “অরবিন্দের হাত ধরেই ভারতীয় রাজনীতি ধর্মের লক্ষণরেখা অতিক্রম করেছিল। সেই থেকেই ধর্ম ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গাঙ্গী উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়।”
একটি লেখায় অরবিন্দ বলেছিলেন,তাঁর রাজনৈতিক দর্শন প্রথমে উপনিষদ, এবং তারপর ‘গীতা’ দ্বারা প্রভাবিত। ডেভি অবশ্য মানেন না যে অরবিন্দের রাজনীতি কোন নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারী ছিল। ডেভির মতে, “অরবিন্দ দার্শনিক ছিলেন। উপনিষদ তো বেদেরই নির্যাস, এবং বেদ কোন নির্দিষ্ট ধর্মের কথা বলে না। বেদ মূলত দর্শনগ্রন্থ। ধর্ম তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অনেক পরে, পরোক্ষভাবে।” ডেভি আমাদের আরও মনে করিয়ে দেন, “হোমার সহ অন্যান্য ইউরোপিয় দার্শনিকদের কাজ মনোযোগ দিয়ে পড়েছিলেন অরবিন্দ। পড়েছিলেন বৌদ্ধদর্শনও। তিনি ছিলেন এমন এক দার্শনিক, সব ধর্মই যাঁর কৌতূহলের বিষয় ছিল।”
সুগত বসু অবশ্য মনে করেন, অরবিন্দের ধর্মীয় চিন্তাকে নৈতিকতার কষ্টিপাথরে যাচাই করা উচিত, “তাঁর ‘ধর্ম’ বিষয়ে ধারণার অবিচ্ছেদ্য যোগ ছিল আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে, নৈতিকতার সঙ্গে। তিনি বলতেন, ‘রাজনীতি থেকে ধর্মকে সরিয়ে নেওয়ার নামে রাজনীতি থেকে নৈতিকতাকে সরিয়ে নিও না’।”
তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ছিল তৎকালীন বিশ্বের অন্যান্য রাজনৈতিক ভাবধারার তুলনায় সবচেয়ে বেশি উদারমনা এবং উন্মুক্ত, এমনটাই ডেভির মত।
জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন অরবিন্দ। প্রথমে আত্মগোপন করেন চন্দননগরে। তারপর চলে যান পন্ডিচেরীতে (তখন যা ছিল ফরাসী উপনিবেশ) এবংদর্শন এবং আধ্যাত্মিকতায় নিজেকে ডুবিয়ে দেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দর্শনবিষয়ক পত্রিকার নাম ছিল ‘Arya’।
ঋষি অরবিন্দ সম্বন্ধে বিস্ময়কর যা তা হল বিপ্লবী থেকে তাঁর আধ্যাত্মিক সাধকে রূপান্তর প্রসঙ্গটি। জীবন যতই সামনের দিকে এগিয়েছে, ততই তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছে, মানব জীবনের উদ্দেশ্য কী? কী আমাদের প্রকৃত কর্ম ? ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ তাড়িয়ে স্বাধীনতা এলে মানবিকতা, প্রগতি এগুলোও আসবে তো? নাকি ব্রিটিশ রাজাদের হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে দেশি রাজাদের হাতে? আর আপামর জনগণের অবস্থা একই থাকবে? আসলে ক্ষমতার একটা নিজস্ব দোষ আছে। অধিকাংশ মানুষের মাথা ঘুরে যায়। পদস্খলন হয়, পাপ বাড়তে থাকে। এই বোধ ভেতরে যত জেগেছে, ততই অরবিন্দ সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। মানবজীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও কর্তব্য অন্বেষণে গভীর আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমজ্জিত হয়েছেন।
১৯১০ সালে পন্ডিচেরী তে এসে তিনি সনাতন ধর্ম প্রচার ও আশ্রম প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।এভাবে বিপ্লবী অরবিন্দ ‘ঋষি অরবিন্দে’ পরিণত হন। পন্ডিচেরিতে যোগসাধনা নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন এবং বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকায় নিয়মিত যোগসাধনা ও হিন্দুধর্ম-বিষয়ক রচনা প্রকাশ করেন। বেদ, উপনিষদ, ষড়দর্শন, গীতা, পুরাণ প্রভৃতি হিন্দুধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। প্রাচীন ভারতের ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
১৯১৪ সালে ফরাসী দম্পতি মীরা রিচার্ড ও পল রিচার্ড পণ্ডিচেরিতে এসে ঋষি অরবিন্দকে দেখে মুগ্ধ হন। ১৯২০ সালে মীরা রীচার্ড পণ্ডিচেরিতে বরাবরের মতো চলে আসেন। তিনিই পরবর্তীতে “ Mother” নামে খ্যাত হন এবং ১৯২২ থেকে আশ্রমের ভার গ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালের ২৪শে নভেম্বর শ্রী অরবিন্দের “সিদ্ধি” লাভ হয়। ১৯২৭ থেকে তিনি মাত্র ৪টি দর্শনের দিনে জনসম্মুখে আবির্ভূত হতেন এবং বাকি সময় নির্জনে সাধনা-মগ্ন থাকতেন।
পন্ডিচেরীতে থাকাকালীন অবশ্য অরবিন্দ রাজনৈতিক নিবন্ধও লিখেছিলেন। সুগত বসুর মতে, “The Sprit and Form of an Indian Polity” শীর্ষক নিবন্ধে তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের মূল্যায়ন করেছিলেন। এবং বলেছিলেন, মুঘল সাম্রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের অন্যান্য রাজশক্তিদের তুলনায় অনেক বেশি প্রগতিশীল ও সহিষ্ণু ছিল। মুঘলদের সম্পর্কে অরবিন্দের ধারণা একেবারেই মেলে না আজকের হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে।
শেষজীবন পন্ডিচেরির আশ্রমে অবস্থানকালে তিনি ধর্ম, দর্শন ও ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর ইংরাজী ও বাংলা, উভয় ভাষাতেই বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থের সংখ্যা ৩৮। যেমন: The Life Divine (১৯৩৯), Savitri (১৯৫০), Mother India, The Age of Kalidasa, The Significance of Indian Art, Essays on the Gita, The Foundations of Indian Culture, , Lights on Yoga, A System of National Education, The Renaissance in India ইত্যাদি lআর, ভারতের নবজন্ম (১৯১৫), পন্ডিচেরীর পত্র (১৯২১), কারা কাহিনী (১৯২১), ধর্ম ও জাতীয়তা (১৯৩১), যোগ-সাধনার ভিত্তি (১৯৪২), ভারতে রাষ্ট্রনীতিক প্রতিভা ইত্যাদি হল বাংলায় প্রকাশিত তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি l
তাঁর পন্ডিচেরীর জীবন ছিল যোগ সাধনার জীবন। সেখানে তিনি একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে দীর্ঘ চল্লিশ বছর সাধনা করে তিনি সিদ্ধি লাভ করেন ও অমৃতময় জীবনের সন্ধান পান। তাঁর সাধনায় আকৃষ্ট হয়ে দেশী বিদেশী বহু ব্যক্তি তাঁকে দর্শন করতে ও তাঁর আশ্রম পরিদর্শন করতে যেতেন। অনেকে স্থায়ীভাবে সেখানে বাস করেন। অরবিন্দ ঘোষ পন্ডিচেরী আশ্রমে সাধনায় বসার পর বাইরের কোন লোক তাঁর দর্শন পেতেন না। শেষ দিকে বছরে তিন দিন মাত্র তিনি জনসাধারণকে দর্শন দিতেন। ১৯৫০ সালের ২৪শে নভেম্বর তিনি তাঁর ভক্তদেরকে জীবনের শেষ দর্শন দিয়ে যান। তারপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে ৫ই ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯২৮ সালে পন্ডিচেরি তে শ্রী অরবিন্দ ঘোষের সাথে সাক্ষাৎ করার পরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন –
“অনেক দিন মনে ছিল অরবিন্দ ঘোষকে দেখব। সেই আকাঙক্ষা পূর্ণ হল। তাঁকে দেখে যা আমার মনে জেগেছে সেই কথা লিখতে ইচ্ছা করি।
খৃস্টান শাস্ত্রে বলে বাণীই আদ্যা শক্তি। সেই শক্তিই সৃষ্টিরূপে প্রকাশ পায়। নব যুগ নব সৃষ্টি, সে কখনো পঞ্জিকার তারিখের ফর্দ থেকে নেমে আসে না। যে-যুগের বাণী চিন্তায় কর্মে মানুষের চিত্তকে মুক্তির নূতন পথে বাহির করে তাকেই বলি নব যুগ।
আমাদের শাস্ত্রে মন্ত্রের আদিতে ওঁ, অন্তেও ওঁ। এই শব্দটিকেই পূর্ণের বাণী বলি। এই বাণী সত্যের অয়মহং ভো– কালের শঙ্খকুহরে অসীমের নিশ্বাস।
ফরাসি রাষ্ট্র-বিপ্লবের বান ডেকে যে-যুগ অতল ভাবসমুদ্র থেকে কলশব্দে ভেসে এল তাকে বলি য়ুরোপের এক নব যুগ। তার কারণ এ নয়, সে দিন ফ্রান্সে যারা পীড়িত তারা পীড়নকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই বাধালে তার কারণ সেই যুগের আদিতে ছিল বাণী। সে-বাণী কেবলমাত্র ফ্রান্সের আশু রাষ্ট্রিক প্রয়োজনের খাঁচায় বাঁধা খবরের কাগজের মোড়কে ঢাকা ইস্কুল-বইয়ের বুলি আওড়ানো টিয়ে পাখি নয়। সে ছিল মুক্তপক্ষ আকাশবিহারী বাণী; সকল মানুষকেই পূর্ণতর মনুষ্যত্বের দিকে সে পথ নির্দেশ করে দিয়েছিল।
একদা ইটালির উদ্বোধনের দূত ছিলেন মাটসিনি, গারিবাল্ডি। তাঁরা যে-মন্ত্রে ইটালিকে উদ্ধার করলেন সে ইটালির তৎকালীন শত্রু বিনাশের দ্রুত ফলদায়ক মারণ উচাটন পিশাচ মন্ত্র নয়, সমস্ত মানুষের নাগপাশ মোচনের সে গরুড় মন্ত্র, নারায়ণের আশীর্বাদ নিয়ে মর্ত্যে অবতীর্ণ। এইজন্যে তাকেই বলি বাণী। আঙুলের আগায় যে স্পর্শবোধ তার দ্বারা অন্ধকারে মানুষ ঘরের প্রয়োজন চালিয়ে নিতে পারে। সেই স্পর্শবোধ তারই নিজের। কিন্তু সূর্যের আলোতে নিখিলের যে স্পর্শবোধ আকাশে আকাশে বিস্তৃত, তা প্রত্যেক প্রয়োজনের উপযোগী অথচ প্রত্যেক প্রয়োজনের অতীত। সেই আলোককেই বলি বাণীর রূপক।
সায়ান্স এক দিন য়ুরোপে যুগান্তর এনেছিল। কেন? বস্তুজগতে শক্তির সন্ধান জানিয়েছিল বলে না। জগৎতত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞানের অন্ধতা ঘুচিয়েছিল বলে। বস্তুসত্যের বিশ্বরূপ স্বীকার করতে সেদিন মানুষ প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে। আজ সায়ান্স সেই যুগ পার করে দিয়ে আর-এক নবতর যুগের সম্মুখে মানুষকে দাঁড় করালে। বস্তুরাজ্যের চরম সীমানায় মূল তত্ত্বের দ্বারে তার রথ এল। সেখানে সৃষ্টির আদি বাণী। প্রাচীন ভারতে মানুষের মন কর্মকাণ্ড থেকে যেই এল জ্ঞানকাণ্ডে, সঙ্গে সঙ্গে এল সৃষ্টির যুগ। মানুষের আচারকে লঙ্ঘন করে আত্মাকে ডাক পড়ল। সেই আত্মা যন্ত্রচালিত কর্মের বাহন নয়, আপন মহিমাতে সে সৃষ্টি করে। সেই যুগে মানুষের জাগ্রত চিত্ত বলে উঠেছিল, চিরন্তনের মধ্যে বেঁচে ওঠাই হল বেঁচে যাওয়া; তার উলটাই মহতী বিনষ্টি। সেই যুগের বাণী ছিল, “য এতদ্বিদুরমৃতাস্তে ভবন্তি।”
আর-এক দিন ভারতে উদ্বোধনের বাণী এল। সমস্ত মানুষকে ডাক পড়ল– বিশেষ সংকীর্ণ পরামর্শ নিয়ে নয়, যে মৈত্রী মুক্তির পথে নিয়ে যায় তারই বাণী নিয়ে। সেই বাণী মানুষের চিত্তকে তার সমগ্র উদ্বোধিত শক্তির যোগে বিপুল সৃষ্টিতে প্রবৃত্ত করলে।
বাণী তাকেই বলি যা মানুষের অন্তরতম পরম অব্যক্তকে বাহিরে অভিব্যক্তির দিকে আহ্বান করে আনে, যা উপস্থিত প্রত্যক্ষের চেয়ে অনাগত পূর্ণতাকে বাস্তবতর সত্য বলে সপ্রমাণ করে। প্রকৃতি পশুকে নিছক দিনমজুরি করতেই প্রত্যহ নিযুক্ত করে রেখেছে। সৃষ্টির বাণী সেই সংকীর্ণ জীবিকার জগৎ থেকে মানুষকে এমন জীবনযাত্রায় উদ্ধার করে দিলে যার লক্ষ্য উপস্থিত কালকে ছাড়িয়ে যায়। মানুষের কানে এল– টিকে থাকতে হবে, এ কথা তোমার নয়; তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে, সেজন্যে মরতে যদি হয় সেই ভালো। প্রাণ যাপনের বদ্ধ গণ্ডির মধ্যে যে-আলো জ্বলে সে রাত্রির আলো, পশুদের তাতে কাজ চলে। কিন্তু মানুষ নিশাচর জীব নয়।
সমুদ্রমন্থনের দুঃসাধ্য কাজে বাণী মানুষকে ডাক দেয় তলার রত্নকে তীরে আনার কাজে। এতে করে বাইরে সে যে সিদ্ধি পায় তার চেয়ে বড়ো সিদ্ধি তার অন্তরে। এ যে দেবতার কাজে সহযোগিতা। এতেই আপন প্রচ্ছন্ন দৈব শক্তির ‘পরে মানুষের শ্রদ্ধা ঘটে। এই শ্রদ্ধাই নূতন যুগকে মর্ত্য সীমা থেকে অমর্ত্যের দিকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এই শ্রদ্ধাকে নিঃসংশয় স্পষ্টভাবে দেখা যায় তাঁর মধ্যে, যাঁর আত্মা স্বচ্ছ জীবনের আকাশে মুক্ত মহিমায় প্রকাশিত। কেবলমাত্র বুদ্ধি নয়, ইচ্ছাশক্তি নয়, উদ্যম নয়, যাঁকে দেখলে বোঝা যায় বাণী তাঁর মধ্যে মূর্তিমতী।
আজ এইরূপ মানুষকে যে একান্ত ইচ্ছা করি তার কারণ, চার দিকেই আজ মানুষের মধ্যে আত্ম-অবিশ্বাস প্রবল। এই আত্ম-অবিশ্বাসই আত্মঘাত। তাই রাষ্ট্রিক স্বার্থবুদ্ধিই আজ আর সকল সাধনাকেই পিছনে ঠেলে ফেলেছে। মানুষ বস্তুর সত্যকে বিচার করছে। এমনি করে সত্য যখন হয় উপলক্ষ, লক্ষ্য হয় আর কিছু, তখন বিষয়ের লোভ উগ্র হয়ে ওঠে, সে লোভের আর তর সয় না। বিষয়সিদ্ধির অধ্যবসায়ে বিষয়বুদ্ধি আপন সাধনার পথকে যতই সংক্ষিপ্ত করতে পারে ততই তার জিৎ। কারণ, তার পাওয়াটা হল সাধনাপথের শেষ প্রান্তে। সত্যের সাধনায় সর্বক্ষণেই পাওয়া। সে যেন গানের মতো, গাওয়ার অন্তে সে গান নয়, গাওয়ার সমস্তটাই মধ্যেই। সে যেন ফলের সৌন্দর্য, গোড়া থেকেই ফুলের সৌন্দর্যে যার ভূমিকা। কিন্তু লোভের প্রবলতায় সত্য যখন বিষয়ের বাহন হয়ে উঠল, মহেন্দ্রকে তখন উচ্চৈঃশ্রবার সহিসগিরিতে ভর্তি করা হল, তখন সাধনাটাকে ফাঁকি দিয়ে, সিদ্ধিকে সিঁধ কেটে নিতে ইচ্ছে করে, তাতে সত্য বিমুখ হয়, সিদ্ধি হয় বিকৃত।
সুদীর্ঘ নির্বাসন ব্যাপ্ত করে রামচন্দ্রের একটি সাধনা সম্পূর্ণ হয়েছিল। যতই দুঃখ পেয়েছেন ততই গাঢ়তর করে উপলব্ধি করেছেন সীতার প্রেম। তাঁর সেই উপলব্ধি নিবিড়ভাবে সার্থক হয়েছিল যেদিন প্রাণপণ যুদ্ধে সীতাকে রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করে আনলেন।
কিন্তু রাবণের চেয়ে শত্রু দেখা দিল তাঁর নিজেরই মধ্যে। রাজ্যে ফিরে এসে রামচন্দ্র সীতার মহিমাকে রাষ্ট্রনীতির আশু প্রয়োজনে খর্ব করতে চাইলেন– তাঁকে বললেন, সর্বজন-সমক্ষে অগ্নিপরীক্ষায় অনতিকালেই তোমার সত্যের পরিচয় দাও। কিন্তু এক মুহূর্তে জাদুর কৌশলে সত্যের পরীক্ষা হয় না, তার অপমান ঘটে। দশজন সত্যকে যদি না স্বীকার করে, তবে সেটা দশজনেরই দুর্ভাগ্য, সত্যকে যে সেই দশজনের ক্ষুদ্র মনের বিকৃতি অনুসারে আপনার অসম্মান করতে হবে এ যেন না ঘটে। সীতা বললেন, আমি মুহূর্তকালের দাবি মেটাবার অসম্মান মানব না, চিরকালের মতো বিদায় নেব। রামচন্দ্র এক নিমিষে সিদ্ধি চেয়েছেন, একমুহূর্তে সীতাকে হারিয়েছেন। ইতিহাসের যে উত্তরকাণ্ডে আমরা এসেছি এই কাণ্ডে আমরা তাড়াতাড়ি দশের মন-ভোলানো সিদ্ধির লোভে সত্যকে হারাবার পালা আরম্ভ করেছি।
বন্ধু ক্ষিতিমোহন সেনের দুর্লভ বাক্যরত্নের ঝুলি থেকে একদিন এক পুরাতন বাউলের গান পেয়েছিলুম। তার প্রথম পদটি মনে পড়ে:
‘নিঠুর গরজী, তুই কি মানস মুকুল ভাজবি আগুনে?’
যে মানসমুকুলের বিকাশ সাধনাসাপেক্ষ, দশের সামনে অগ্নিপরীক্ষায় তার পরিণত সত্যকে আশুকালের গরজে সপ্রমাণ করতে চাইলে আয়োজনের ধুমধাম ও উত্তেজনাটা থেকে যায়, কিন্তু তার পিছনে মানসটাই অন্তর্ধান করে।
এই লোভের চাঞ্চল্যে সর্বত্রই যখন সত্যের পীড়ন চলেছে তখন এর বিরুদ্ধে তর্ক-যুক্তিকে খাড়া করে ফল নেই; মানুষকে চাই; যে-মানুষ বাণীর দূত, সত্য সাধনায় সুদীর্ঘ কালেও যাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না, সাধনপথের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সত্যেরই অমৃত পাথেয় যাঁকে আনন্দিত রাখে। আমরা এমন মানুষকে চাই যিনি সর্বাঙ্গীণ মানুষের সমগ্রতাকে শ্রদ্ধা করেন। এ কথা গোড়াতেই মেনে নিতে হবে, যে, বিধাতার কৃপাবশতই সর্বাঙ্গীণ মানুষটি সহজ নয়, মানুষ জটিল। তার ব্যক্তিরূপের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বহু বিচিত্র। কোনো বিশেষ অপ্রশস্ত আদর্শের মাপে ছেঁটে একঝোঁকা ভাবে তাকে অনেক দূর বাড়িয়ে তোলা চলে। মানুষের মনটাকে যদি চাপা দিই তবে চোখ বুজে গুরুবাক্য মেনে চলার ইচ্ছা তার সহজ হতে পারে। বুঝিয়ে বলার পরিশ্রম ও বিলম্বটাকে খাটো করে দিতে পারলে মনের শক্তি বাড়ানোর চেয়ে মনের বোঝা বাড়ানো, বিদ্যালাভের পরিবর্তে ডিগ্রিলাভ সহজ হয়। জীবনযাত্রাকে উপকরণশূন্য করতে পারলে তার বহনভার কমে আসে। তবুও সহজের প্রলোভনে সবচেয়ে বড়ো কথাটা ভুললে চলবে না যে আমরা মানুষ, আমরা সহজ নই।
তিব্বতে মন্ত্রজপের ঘূর্ণিচাকা আছে। এর মধ্যে মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায় বলেই আমাদের মনে অবজ্ঞা আসে। সত্যকার মন্ত্রজপ একটুও সহজ নয়। সেটা শুদ্ধমাত্র আচার নয়, তার সঙ্গে আছে চিত্ত, আছে ইচ্ছাশক্তির একাগ্রতা। হিতৈষী এসে বললেন, সাধারণ মানুষের চিত্ত অলস, ইচ্ছাশক্তি দুর্বল, অতএব মন্ত্রজপকে সহজ করবার খাতিরে ওই শক্ত অংশগুলো বাদ দেওয়া যাক– কিছু না ভেবে না বুঝে শব্দ আওড়ে গেলেই সাধারণের পক্ষে যথেষ্ট। সজীব ছাপাখানার মতো প্রত্যহ কাগজে হাজারবার নাম লিখলেই উদ্ধার। কিন্তু সহজ করবার মধ্যেই যদি বিশেষ গুণ থাকে তবে আরো সহজইবা না করব কেন? চিত্তের চেয়ে মুখ চলে বেগে, মুখের চেয়ে চাকা, অতএব চলুক চাকা, মরুক চিত্ত।
কিন্তু মানুষের পন্থা সম্বন্ধে যে-গুরু বলেন, “দুর্গং-পথস্তৎ,’ তাঁকে নমস্কার করি। চরিতার্থতার পথে মানুষের সকল শক্তিকেই আমরা দাবি করব। বহুলতা পদার্থটিই মন্দ, এই মতের খাতিরে বলা চলে যে, ভেলা জিনিসটাই ভালো, নৌকাটা বর্জনীয়। এক সময়ে অত্যন্ত সাদাসিধে ভেলায় অত্যন্ত সাদাসিধে কাজ চলত। কিন্তু মানুষ পারলে না থাকতে, কেননা সে সাদাসিধে নয়। কোনোমতে স্রোতের উপর বরাত দিয়ে নিজের কাজ সংক্ষেপ করতে তার লজ্জা। বুদ্ধি ব্যস্ত হয়ে উঠল, নৌকোয় হাল লাগালো, দাঁড় বানালে, পাল দিলে তুলে, বাঁশের লগি আনলে বেছে, গুণ টানবার উপায় করলে, নৌকোর উপর তার কর্তৃত্ব নানাগুণে নানাদিকে বেড়ে গেল, নৌকোর কাজও পূর্বের চেয়ে হল অনেক বেশি ও অনেক বিচিত্র। অর্থাৎ মানুষের তৈরি নৌকো মানবপ্রকৃতির জটিলতার পরিচয়ে কেবলই এগিয়ে চলল। আজ যদি বলি নৌকো ফেলে দিয়ে ভেলায় ফিরে গেলে অনেক দায় বাঁচে, তবে তার উত্তরে বলতে হবে মনুষ্যত্বের দায় মানুষকে বহন করাই চাই। মানুষের বহুধা শক্তি, সেই শক্তির যোগে নিহিতার্থকে কেবলই উদ্ঘাটিত করতে হবে– মানুষ কোথাও থামতে পাবে না। মানুষের পক্ষে “নাল্পেসুখমস্তি’। অধিককে বাদ দিয়ে সহজ করা মানুষের নয়, সমস্তকে নিয়ে সামঞ্জস্য করাই তার। কলকারখানার যুগে ব্যবসা থেকে সৌন্দর্যবোধকে বাদ দিয়ে জিনিসটাকে সেই পরিমাণে সহজ করেছে, তাতেই মুনাফার বুভুক্ষা কুশ্রীতায় দানবীয় হয়ে উঠল। এদিকে মান্ধাতার আমলের হাল লাঙল খানি ঢেঁকি থেকে বিজ্ঞানকে চেঁচে মুছে ফেলায় ওগুলো সহজ হয়েছে, সেই পরিমাণে এদের আশ্রিত জীবিকা অপটুতায় স্থাবর হয়ে রইল, বাড়েও না এগিয়ে চলেও না, নড়বড় করতে করতে কোনো মতে টিকে থাকে। তার পরে মার খেয়ে মরে শক্ত হাতের থেকে। প্রকৃতি পশুকেই সহজ করেছে, তারই জন্য স্বল্পতা; মানুষকে করেছে জটিল, তার জন্যে পূর্ণতা। সাঁতারকে সহজ করতে হয় বিচিত্র হাত-পা-নাড়ার সামঞ্জস্য ঘটিয়ে; হাঁটুজলে কাদা আঁকড়ে অল্প পরিমাণে হাত-পা ছুঁড়ে নয়। ধনের আড়ম্বর থেকে গুরু আমাদের বাঁচান, দারিদ্র্যের সংকীর্ণতার মধ্যে ঘের দিয়ে নয়, ঐশ্বর্যের অপ্রমত্ত পূর্ণতায় মানুষের গৌরব বোধকে জাগ্রত ক’রে।
এই সমস্ত কথা ভাবছি এমন সময় আমাদের ফরাসি জাহাজ এল পণ্ডিচেরী বন্দরে। ভাঙা শরীর নিয়ে যথেষ্ট কষ্ট করেই নামতে হল– তা হোক, অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। প্রথম দৃষ্টিতেই বুঝলুম– ইনি আত্মাকেই সবচেয়ে সত্য করে চেয়েছেন, সত্য করে পেয়েওছেন। সেই তাঁর দীর্ঘ তপস্যার চাওয়া ও পাওয়ার দ্বারা তাঁর সত্তা ওতপ্রোত। আমার মন বললে ইনি এঁর অন্তরের আলো দিয়েই বাহিরে আলো জ্বালবেন। কথা বেশি বলবার সময় হাতে ছিল না। অতি অল্পক্ষণ ছিলুম। তারই মধ্যে মনে হল, তাঁর মধ্যে সহজ প্রেরণা-শক্তি পুঞ্জিত। কোনো খর-দস্তুর মতের উপদেবতার নৈবেদ্যরূপে সত্যের উপলব্ধিকে তিনি ক্লিষ্ট ও খর্ব করেন নি। তাই তাঁর মুখশ্রীতে এমন সৌন্দর্যময় শান্তির উজ্জ্বল আভা। মধ্য যুগের খৃস্টান সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে তিনি জীবনকে রিক্ত শুষ্ক করাকেই চরিতার্থতা বলেন নি। আপনার মধ্যে ঋষি পিতামহের এই বাণী অনুভব করেছেন, যুক্তাত্মানঃ সর্ব মে বাবিশন্তি। পরিপূর্ণের যোগে সকলেরই মধ্যে প্রবেশাধিকার আত্মার শ্রেষ্ঠ অধিকার। আমি তাঁকে বলে এলুম–আত্মার বাণী বহন করে আপনি আমাদের মধ্যে বেরিয়ে আসবেন এই অপেক্ষায় থাকব। সেই বাণীতে ভারতের নিমন্ত্রণ বাজবে, শৃণ্বন্তু বিশ্বে।
প্রথম তপোবনে শকুন্তলার উদ্বোধন হয়েছিল যৌবনের অভিঘাতে প্রাণের চাঞ্চল্যে। দ্বিতীয় তপোবনে তাঁর বিকাশ হয়েছিল আত্মার শান্তিতে। অরবিন্দকে তাঁর যৌবনের মুখে ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে যে তপস্যার আসনে দেখেছিলুম সেখানে তাঁকে জানিয়েছি–
অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহো নমস্কার।
আজ তাঁকে দেখলুম তাঁর দ্বিতীয় তপস্যার আসনে,অপ্রগল্ভ স্তব্ধতায়– আজও তাঁকে মনে মনে বলে এলুম –
অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহো নমস্কার।
শান্তিলি জাহাজ, ২৯ মে, ১৯২৮।”
অরবিন্দের রাজনৈতিক দর্শন তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি, এমনটা বললে অত্যুক্তি হয় না। সুগত বোস থেকে ডেভি, অনেকেরই মত হল, অরবিন্দের দর্শনকে সম্যকভাবে অধ্যয়ন না করার ফলেই তাঁর সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে। ফলে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের প্রজ্ঞা সেভাবে বন্দিত হয়নি আধুনিক ভারতে। পন্ডিচেরী চলে যাওয়ার পর তাঁকে অনেকাংশে আধ্যাত্মিক সাধক হিসাবেই দেখা হয়েছে, উপেক্ষিত হয়েছে সাধকজীবনে রচিত রাজনৈতিক দর্শনমূলক লেখালেখি।
অরবিন্দের প্রগাঢ় রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে গবেষকদের এই নিষ্পৃহতায় দক্ষিণপন্থীদের সুবিধে হয়েছে তাঁকে ‘আমাদের লোক’ বলে চিহ্নিত করতে, স্পষ্ট লিখেছেন সুগত বসু। তাঁর দ্ব্যর্থহীন মত, “যে লেখাগুলিতে অরবিন্দ বা বিবেকানন্দ ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, সেগুলো না পড়ে যদি স্রেফ ধর্মীয় ব্যাক্তিত্ব হিসাবেই তাঁদের দেখা হয়, ধর্ম তো তাঁদের গ্রাস করতে চাইবেই।”
(তথ্যসূত্র:
১- মহাবিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ, সমর বসু, বিপ্লবীদের কথা (২০১৪)।
২- অরবিন্দ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী।
৩- ত্রয়ী, অরবিন্দ ঘোষ, সন্ধ্যা প্রকাশন।
৪- The lives of Sri Aurobindo by Peter Heehs, Sri Aurobindo Ashram Publication Department, Pondicherry।
৫- Twelve years with Sri Aurobindo by Nirodbaran, Sri Aurobindo Ashram Publication Department, Pondicherry।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সাল।
৭- Beyond Man – The Life and Work of Sri Aurobindo and the Mother by Georges Van Vrekhem.
৮- Sri Aurobindo a Biography and a History by K.R.Srinivasa Iyengar.৯- Sri Aurobindo: Saga of a Great Indian Sage by Wilfried Huchzermeyer.)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত