তখন বিমল মিত্র মানেই ‘বেস্ট সেলার’। তাঁর বইয়ের দারুণ কাটতি। তখন একের পর এক বই বেরোচ্ছে ত্রিশ-চল্লিশের দশকের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক বিমল মিত্রের। প্রকাশকেরাও ব্যবসা করছেন দুহাতে। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’, ‘সাহেব বিবি গোলাম’ সহ তাঁর সব বই-ই সে সময় হিট। কিন্তু একটা সময় দেখা গেল বিমল মিত্রের বইয়ে বাজার ছয়লাপ। এমন অনেক বই বেরোল, যার খবর খোদ লেখকেরই অজানা! ‘রক্ত পলাশ’ নামের একটি বইয়ের নামডাক হলো খুব, অথচ লেখক বিমল মিত্র এ নিয়ে একেবারেই অন্ধকারে! প্রচ্ছদে যাঁর নাম দেখে পাঠকেরা বই কেনেন, সেই লেখক বইয়ের নামটি পর্যন্ত শোনেননি, এমন ঘটনা অবাক হওয়ার মতো নয় কি?
নকল বিমল মিত্র একের পর এক যেসব বই লিখেছিলেন, তাতে আর্থিক ক্ষতি তো আসল বিমল মিত্রের হচ্ছিল, এ বাদে তাঁর দুর্নামই হচ্ছিল বেশি। চতুর্দিক থেকে চিঠি আসা শুরু হলো, ‘এসব কী লিখছেন বিমলবাবু!’
চেন্নাইয়ের বিখ্যাত পরিচালক নানু ঘোষ বিমল মিত্রকে ভয়ংকর অপমান করে বসলেন, সিনেমা করার জন্য পাঠানো তাঁর উপন্যাসকে এককথায় ‘রাবিশ’ বললেন! এতে বিমল মিত্র তো একেবারে হতবাক! কী বলে এসব!তিনি তো কখনো কারও কাছে এ রকম কিছু পাঠাননি। সিনেমা করার জন্য তিনি খামোখা যেচে পরিচালক কে তাঁর লেখা উপন্যাস পাঠাতেই বা যাবেন কেন?! আসলে বিমল মিত্রের নামে উপন্যাস পাঠিয়েছিলেন অন্য আরেকজন। উপন্যাসের সঙ্গে ছিল একটি চিঠিও। যার বক্তব্য ছিল,
“আমি ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর লেখক, আমার লেখা নতুন বই ‘কড়ির চেয়ে দামী’ সিনেমা করার জন্য পাঠাচ্ছি।”
এসব দেখে ও শুনে আসল বিমলের তখন মাথা খারাপ অবস্থা। তাঁর নাম বেচে খায় ভালো কথা, তা বলে নিজেকে ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর লেখক হিসেবে দাবি করবে, এ তো ভয়াবহ ব্যাপার!
কিন্তু এই ভয়াবহ ব্যাপারগুলো কারা ঘটিয়েছিলেন, কারা ছিলেন নকল বিমল মিত্র? আর কোথায়-বা ছিল তাঁদের আঁতুড়ঘর?
বইপত্র ঘেঁটে জানা যাচ্ছে, তৎকালীন সময়ের ছোটখাটো প্রকাশকেরাই তৈরি করেছিলেন ‘নকল’ বিমল মিত্রদের। সে সময় ‘বিমল মিত্রের’ সংখ্যাটা নেহাত কম ছিল না। কারও মতে, এ সংখ্যা বিশ-পঁচিশেক তো হবেই। এঁদের অধিকাংশ নেপথ্যে থাকলেও প্রকাশ্যে এসেছিলেন বা আসতে বাধ্য হয়েছিলেন দু-একজন। ‘রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী’ ছিলেন এই নকল বিমলদের একজন। তিনি লিখতেনও ভালো। প্রায় আসলের কাছাকাছি। ফলে দারুণ বাজার ছিল তাঁর, ছিল বাজারদরও। কিন্তু এই মানুষটির নকল হওয়ার পেছনের গল্পটা একেবারেই অন্য রকম। তাঁর লেখার পাণ্ডুলিপি নিয়ে গিয়েছিলেন প্রকাশকের কাছে। প্রকাশক ফিরিয়ে দিলেন। সঙ্গে অন্য প্রস্তাবও দিলেন, আসল বিমল মিত্রের নামে বই লিখে দিতে হবে! রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীকালে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে নিলেন বিষয়টা। টানা লিখতে শুরু করলেন বিমল মিত্রের নামে। কিন্তু একপর্যায়ে ধরা পড়ে গেলেন।
এবারে আসল বিমল মিত্র গেলেন আইনের কাছে। কিন্তু আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আসলজন ঠকে গেলেন নকলজনের কাছে। প্রকাশক বুদ্ধি করে রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে কাগজপত্রে বানিয়ে ফেললেন বিমল মিত্র। উপরন্তু এই নামে জোগাড় করে ফেললেন পরিচয়পত্র, রেশন কার্ডসহ আরও নানা দলিল-দস্তাবেজ। ফলে নকলজন খালাস! আদালত রায় দিলেন, এক নামে দুই ব্যক্তি তো থাকতেই পারেন। অবশ্য শেষ বয়সে পৌঁছে সব কথা স্বীকার করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। অদ্রীশ বিশ্বাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজ মুখেই সত্য স্বীকার করেছেন তিনি, “বিমল মিত্রের নাম দিয়ে আমি উপন্যাস লিখতাম, রক্ত পলাশ আমারই লেখা।”
একদিন সন্ধেবেলা। আচমকা বেজে উঠল টেলিফোনটা। বিমল মিত্র ফোন ধরলেন। ওপার থেকে ভেসে এল এক নারীকণ্ঠ, ‘‘হ্যালো, বিমল মিত্র আছেন?’’ ‘‘বলছি,’’ মহিলা নিজের নাম বললেন। শুনে বিমল মিত্র বললেন, ‘‘আচ্ছা। বলুন, কী ব্যাপার?’’ ফোনের অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এল, ‘‘আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ পাঠিকা। কিছু বই নিয়ে আলোচনা করতে আপনার বাড়ি যেতে চাই।’’ এ বার আঁতকে উঠলেন বিমল মিত্র, বললেন ‘‘দয়া করে আসবেন না। আপনি এলে বাড়িতে পুলিশ আসবে। লোকজন চড়াও হবে। হামলাও করতে পারে। তার চেয়ে আমিই আপনার কাছে চলে যাব ’খন।’’ নারীকণ্ঠটি ছিল সুচিত্রা সেনের! সময়টা ছিল সত্তরের দশক।
সুচিত্রা সেন তো তাও ফোন করে আসতে চেয়েছিলেন, ফোনের ধার ধারেননি উত্তমকুমার। বিমল মিত্রের বাড়িতে তাঁর আসা একেবারে হঠাৎই। ভাগ্যিস লোকজন টের পায়নি! বাড়িতে এসে বিমল মিত্রের মুখোমুখি হয়ে দু’-চার কথার পরই তাঁর প্রস্তাব ছিল, ‘‘আপনার ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ নিয়ে ছবি করতে চাই।’’ জবাবে বিনীত স্বরে বিমল মিত্র বলেছিলেন, ‘‘আপনি সিনেমা করলে সবাই ওটাই দেখবে। আমার বই আর কেউ পড়বে না। তাই এখন না, কিছু দিন পরে না হয় করবেন।’’ ভাবুন, উত্তমকুমার বাড়ি বয়ে এসে কোনও কাহিনিকারের গল্প নিয়ে সিনেমা করার কথা বলছেন। আর সাহিত্যিক কিনা তাঁর প্রস্তাব উড়িয়েই দিচ্ছেন! ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ অবশ্য সিনেমা হয়েছিল। তখন উত্তমকুমার আর ইহজগতেই নেই। অবশ্য ’৭২ সালে বিমল মিত্রের লেখা নিয়ে যখন ‘স্ত্রী’ হল, সেখানে তিনি তো ছিলেনই, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন।
সুচিত্রা সেনের ‘টেলিফোন গল্প’টার মতো বিমল মিত্রের জীবনে এমন কাহিনী আরও আছে। ‘সাহেব বিবি গোলাম’। মুম্বইয়ের এক বিখ্যাত অভিনেতার কী ভাবে যেন নজরে এসে গিয়েছিল বিমল মিত্রের সেই বিখ্যাত উপন্যাসটি। কলকাতায় সেক্রেটারি মারফত তিনি খবর দিলেন, বিমল যেন একবারটি মুম্বই যান। কিছু কথা আছে। শুনে সেক্রেটারিমশাইকে ফোনেই বিমল সটান বলে বসেছিলেন, ‘‘ওঁর দরকার, উনি আসবেন। আমি যেতে পারব না।’’ কাহিনিকারের প্রতিক্রিয়ার খবর গেল সেই ‘তারকা’ অভিনেতার কাছে। ফের একটা ফোন এল বিমল মিত্রের কাছে। প্রাথমিক সম্ভাষণ শেষে বিমল বললেন, ‘‘হুম, বলুন কী বলতে চান!’’ ঝরঝরে বাংলায় জবাব এল, ‘‘শরীরটা বড্ড খারাপ, যদি দয়া করে বম্বে আসেন।’’ ফোন রেখে বিমল বলেছিলেন, ‘‘ওঁর গলায় কী যেন একটা রয়েছে। আমি ‘না’ করতে পারলাম না। বম্বে যাব।’’ এ বারের কণ্ঠটি ছিল গুরু দত্তের। বিমল মিত্র মুম্বই গিয়েছিলেন। উঠেছিলেন গুরু দত্তেরই পালি হিলের বাড়িতে। সেই প্রথম আলাপ। আলাপ গড়িয়ে শেষে তুমুল বন্ধুতা। দিনে দিনে তার গভীরতা বিমল মিত্রকে কতটা ছুঁয়েছিল, সেটা পরে বুঝতে পারা গিয়েছিল।
হঠাৎ একদিন খবর এল গুরু দত্ত আত্মহত্যা করেছেন, তখন বিমল মিত্র যে কী প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলেন! বারবার বলতেন, ‘‘ও পারে গিয়ে না হয় কথা হবে আমার বন্ধুর সঙ্গে।’’
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতন তিনিও ছিলেন পরলোকে বিশ্বাসী। ঘোর আস্তিক। ২৯/১/১ চেতলা সেন্ট্রাল রোডে তিন তলার যে লালবাড়িটা বিমল মিত্র কিনেছিলেন, তার কাছেই কেওড়াতলা মহাশ্মশান। কে জানে সেখানেও বিমল মিত্রের ওই পরলোক-চিন্তাটা কাজ করেছিল কিনা! কিন্তু শ্মশান পারে বাড়ি হলে যা হয়, খুব অস্বস্তি হত তাঁর পরিবারের। বিশেষ করে তাঁর কন্যার আর পুত্রের। কেবলই ভেসে আসত ডাক, ‘বলো হরি, হরি বোল…’ দিনে তাও এক রকম, রাতে অমন চিৎকার শিরশিরানি ভাব ধরাত শরীরে। একদিন তাঁর কন্যা শ্রীমতী কন্যা শকুন্তলা বসু তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘এমন জায়গায় আর থাকব না।’’ শুনে খানিক চুপ করে বসে ছিলেন বিমল। তার পর শান্ত ভাবে তাঁর কন্যাকে বলেছিলেন, ‘‘অমন করে বলে না, সব সময় জানবে, ওই একটা জায়গাতে আমাদের সবার জীবনের শেষ। এই স্থানটি অবজ্ঞা করার নয়।’’
জীবন বিমল মিত্রকে অনেক কিছু শিখিয়েছিল। তার সঙ্গে ছিল তাঁর মন। দুইয়ে মিলেই ছিল তাঁর যত লেখালেখি। সাহিত্যের জন্য কি করেন নি বিমল!
বিমল মিত্রের গানের গলাটাও ছিল ভারী মিষ্টি। তাঁর গানের রেকর্ডও আছে। বন্ধুরা তাঁর গানের কথা জানতেন। এ নিয়ে তাঁর কলেজবেলার একটা ঘটনার কথা জানা যায়।
তখন তিনি বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র। কলেজে গানের কম্পিটিশন। এ দিকে বিমল কিছুতেই গান গাইবেন না। বন্ধুরাও তাঁকে ছাড়বেন না। গাইতেই হবে। কিছুক্ষণ পরে তাঁরা বুঝলেন, বিমলকে বেশি বুঝিয়ে লাভ নেই। তখন অন্য ফন্দি আঁটলেন সবাই। হঠাৎ মাইকে ঘোষণা হয়ে গেল, ‘‘এ বার সঙ্গীত পরিবেশন করবেন বিমল মিত্র।’’ আর তো উপায় নেই এড়ানোর। ছুটে পালিয়ে যাওয়াটাও লোক হাসানো হয়ে যাবে। ফলে থতমত খেয়ে লাজুক স্বভাবের বিমল খানিক নিমরাজি হয়েই মঞ্চে উঠেছিলেন। গান করেছিলেন। ফলাফল বেরোবার সময় দেখা গিয়েছিল, তিনিই প্রথম হয়েছেন।
এই ঘটনার কিছু কাল বাদের কথা। শঙ্কর ঘোষ লেনের মুখে বাস থেকে সবে নেমেছেন বিমল। হঠাৎ পিছন থেকে ডাক, ‘‘একটু শুনবেন?’’ ঘাড় ঘোরালেন বিমল। একটি ছেলে। মুখ চেনা। কলেজে তাঁর এক ক্লাস সিনিয়র। থলথলে গড়ন। গায়ের রং দুধে-আলতা। সোনালি মুগা রঙা জামা। জরি পাড়ওয়ালা চুনোট করা ধুতি। হরিণ-চামড়ার চটি। হিরের আংটি। এ ছেলে আবার আমায় ডাকে কেন! মনে মনে ভাবলেন বিমল। ছেলেটি এগিয়ে এসে বলল, ‘‘কলেজের বাংলার শিক্ষক পূর্ণচন্দ্র ঘোষ দেখা করতে চান আপনার সঙ্গে। একবার আসবেন আমাদের বা়ড়ি? কাছেই। কলেজের পাশে ব্রাহ্ম মন্দিরের উলটো দিকে।’’ হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটির পরিচয় পাওয়া গেল। নাম, সতু লাহা। বিখ্যাত ধনী পরিবার লাহা বংশের ছেলে। তাঁর সঙ্গে লাহাবাড়ি গেলেন বিমল। বাড়ি ঢুকে মাথা ঘুরে যাওয়ার দাখিল। বাড়ি তো নয়, প্রাসাদ! দারোয়ান, আস্তাবল, বারমহল, অন্দরমহল, ঠাকুরদালান, নাচঘর! বসার ঘরে ছিলেন পূর্ণচন্দ্রবাবু। বিমল সে ঘরে গিয়ে দাঁড়াতে, তিনি বসতে বললেন। তার পরই গান গাওয়ার অনুরোধ। ভয়ে ভয়ে গান ধরলেন বিমল। পরে তিনি জানিয়েছিলেন, সে দিনের সেই ঘরদালান, পরিবেশ, মানুষজনকে দেখেশুনেই ‘সাহেব বিবি গোলাম’ উপন্যাসের প্লটটা মনে মনে এঁকে ফেলেছিলেন তিনি।
বিমলের উপন্যাস লেখা আয়ত্ত করার ব্যাপারটাও বেশ অদ্ভুত। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হল। উস্তাদ আবদুল করিম খান এসেছেন গাইতে। শ্রোতার আসনে বিমল। গান শুরু করলেন উস্তাদ। রাগ ভৈরবী। ‘যমুনা কে তীর…’ তিন-চার ঘণ্টা ধরে একই কথা অসংখ্যবার। সুরের আরোহণ, অবরোহণ শুনতে শুনতে তাঁর মনে হয়েছিল, ‘‘এ গান নয়, যেন কোনও এপিক উপন্যাস পড়ছি।’’
‘এ টেল অফ টু সিটিজ’, বিমলের লেখকজীবনে এই উপন্যাসটি বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। কিছু দিন পরে শুনলেন উস্তাদ ফৈয়াজ খানের পরিবেশনা। তিনি শোনালেন, ‘ঝন ঝন ঝন ঝন পায়েল বাজে’। পরে বিমল লিখেছিলেন, ‘গ্রহণ ও বর্জনের সমন্বয়’। সাহিত্য তথা শিল্প সৃষ্টির এই সার কথাটুকুর হদিশ উনি পেয়েছিলেন ওই দুই আসর থেকেই। একলব্যের মতো তখনই এই দুই উস্তাদের কাছে সাহিত্যিক জীবনের নাড়া বাঁধেন তিনি।
তবে এমন সঙ্গীতপ্রীতি বিমলকে মাঝেসাঝে বিড়ম্বনার মুখেও ফেলেছে। সেও তাঁর মুখ থেকেই জানা যায়। যৌবনের কথা। প্রায় দিনই বিমল বাড়ি ফিরতেন ভোর রাতে। কেন? সৌজন্যে দুই বন্ধু, অনুপম ঘটক এবং পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ। ৬ নম্বর অক্রুর দত্ত লেনে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ডিং মিউজিক্যাল প্রোডাকশন’-এর সঙ্গে তখন অনুপম ঘটক যুক্ত, যিনি পরবর্তী সময়ে ছায়াছবির বিখ্যাত সুরকার। তাঁকে পাকড়াও করে বিমল প্রায়ই যাচ্ছিলেন হাজরা পার্কে। সেখানে সবুজ মাঠের উপরে বসে গান করতেন অনুপম। কখনও বা কলেজ কেটে পান্নালালবাবুকে সঙ্গে নিয়ে ঢুঁ মারতেন বালিগঞ্জ লেকে। আড়বাঁশি শোনাতেন পান্নালাল। মুগ্ধ শ্রোতা বিমল। সেই মুগ্ধতার রেশ চলত ভোর রাত পর্যন্ত। অনেক সময় এমনও হয়েছে, বিমল যখন ১৫ নম্বর সব্জি বাগান লেনের পৈতৃক ভিটেয় ঢুকছেন, তখন তাঁর পিতা সতীশচন্দ্র মিত্র প্রাতঃভ্রমণে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাড়ির এই ছোট ছেলেটির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন সতীশচন্দ্র। ছেলেকে চাটার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট করতে চেয়েছিলেন। এ দিকে ছেলের যে কী মতিগতি, তিনি বুঝতে পারেন নি। বলেন নি কিছু, তবে চিন্তা তো তাঁর হতই! পিতা সতীশচন্দ্রের ইচ্ছেতেই কয়েক দিন চাটার্ডের ক্লাসে গিয়েও ছিলেন বিমল। তার পর তাঁর উপলব্ধি ছিল, এই ‘ব্যালান্স সিট’ বিষয়টি তাঁর জন্য নয়। তখন ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বাংলায় এমএ করতে।
গান শোনার মতো বিমল মিত্রের আরও একটা প্রাণের জিনিস ছিল, বই। চাকরি জীবন শেষে সকালে উঠে একটা কাজ ছিল তাঁর, ঘড়ির কাঁটা ১০টা ছুঁলেই, কোনও রকমে কিছু খেয়ে চলে যেতেন ন্যাশনাল লাইব্রেরি। সেখানে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘরও বরাদ্দ ছিল।সন্ধে হব-হব, এমন সময় তাঁর স্ত্রী আভাদেবী গাড়ি নিয়ে বের হতেন। লাইব্রেরি থেকে বিমলকে সঙ্গে নিয়ে চলে যেতেন ভিক্টোরিয়ায়। ঘাসের উপর বসে দু’জনের চলত প্রাণ খুলে আড্ডা। সাংসারিক কথাবার্তা নয়, সে কথার বেশিটাই জুড়ে থাকত সাহিত্য, দেশ, বিদেশের লেখক ও তাঁদের জীবন। কখনও এমনও হয়েছে আড্ডার টানেই ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে হাঁটতে হাঁটতে হাজরা রোডের মোড় পর্যন্ত চলে গিয়েছেন বিমল। তখন সঙ্গী অনুজ সাহিত্যিক শংকর।
পড়াশোনা শেষ করে বিমল প্রথমে ঢুকেছিলেন রেলের চাকরিতে। সেই চাকরিও বিমলের অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারে অনেক রসদ জুগিয়েছিল। একবারের কথা। ট্রেনে চেপে কোথাও যাচ্ছিলেন বিমল। ট্রেন থামল ঘাটশিলা স্টেশনে। উঠে এলেন এক ভদ্রলোক। তাঁর সঙ্গের স্টেথোস্কোপটি জানান দিচ্ছিল, তিনি একজন ডাক্তার। দু’জনের আলাপ শুরু হল। ভদ্রলোক বললেন, ‘‘আমার দাদার নাম হয়তো জানেন। উনি লেখক।’’ ‘‘কে?’’ ‘‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।’’ ‘‘আরে, তাই নাকি!’’ ভদ্রলোক নিজের নাম বলেছিলেন, নূটবিহারী।
কতবার যে এমন অবাক করা ঘটনার সামনে পড়েছেন বিমল! সবটাই যে এমন মধুর-মধুর, তা হয়তো নয়। তেমনই এক ঘটনা ঘটে বিমলের চাকরিজীবনে। বিমল তখন দুর্নীতি দমন শাখার গোয়েন্দা। গিয়েছেন বিলাসপুরে। বস্তারের মহারানির সঙ্গে বিমলের ছিল ভীষণ খাতির। সেই সূত্রে ছত্তীসগড়ের একটা বড় অংশ বিমল প্রায় অবাধে চষে ফেলতে পেরেছিলেন। বিশেষ করে আদিবাসী জীবন খুব কাছ থেকে দেখার দুর্লভ সুযোগ পান তখনই। আর এই দেখার উপর ভর করেই বিমল লেখেন ‘সরস্বতীয়া’। বহু পরে একটি সর্বভারতীয় পত্রিকায় রচনাটির হিন্দি অনুবাদ বেরোয়, ‘সুরসতিয়া’ নামে। তারপর ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়! কাহিনির বর্ণনায় আছে, আদিবাসীদের মধ্যে ‘পারা’ রোগের প্রকোপ, চিকিৎসা পরিষেবা পেতে গিয়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়ার কথা। ব্যস, প্রচণ্ড খেপে গেল মধ্যপ্রদেশ সরকার। ‘সুরসতিয়া’ নিষিদ্ধ হল। রায়পুরে বিরাট মিছিল বেরিয়েছিল বিমলের বিরুদ্ধে। তবে এই নিষিদ্ধকরণের জন্য প্রতিবাদও হয়েছিল। সে অবশ্য দিল্লীতে। বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রীরা পথে নেমেছিলেন। তখন চাপে পড়ে সরকার বাধ্য হয়েছিল নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে।
তাঁর লেখা নিয়ে এমন তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছিল খোদ কলকাতাতেও। তখন বিমলের লেখা ‘একক দশক শতক’ মঞ্চস্থ হচ্ছে, স্টার থিয়েটারে। সেখানে বিশেষ কিছু রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় নাটক বন্ধ করতে বলেন। তাঁর সেই আদেশনামা নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়। জনসভায় এ নিয়ে প্রচণ্ড সমালোচনা করেন বিরোধী নেতা জ্যোতি বসুও।
এই সব চাপানউতোরের সময়গুলোয় বিমল যে সব সময় খুব অস্থির থাকত, এমন নয়। বরং এক এক সময় মনে হত, একটু বেশিই যেন স্থিতধী! বিমল মিত্রের বাড়ির উলটো দিকে তখন একটা বালির কারখানা ছিল। সে দিকে একদৃষ্টে চেয়ে তিনি বহুবার গুণগুণ করে গান করতেন।
তাঁর ঘরে ইতিউতি ছড়ানো ছিল সোফা। তাতে বইয়ের পাহাড়। তাঁর গেঞ্জিতে গোঁজা থাকত সোনার নিব্ওয়ালা পার্কার পেন। কোলের উপরে ফাইল, নয় বোর্ড। হঠাৎই লিখতে শুরু করতেন। আর সেই যে লিখতে শুরু করলেন, সারা রাত লিখেই গেলেন। পরের দিন সকালেই কোনও না কোনও পত্রিকা দফতর থেকে তাড়া দেবেন কেউ। প্রত্যেককে দু’-তিন পাতা করে লিখে হাতে ধরিয়ে দিতেই হবে। শুধু চিরকুটে কাকে কী দিলেন, সেটা এক লাইনে লেখা থাকত। আবার পরের সংখ্যার জন্য লিখতে হবে, তাই। লিখতে লিখতে যাতে হাতে কড়়া না পড়ে, তাই ভিজে কাপড় জড়িয়ে রাখতেন আঙুলে।
লেখালেখির অবসরে বিমলের একটা অদ্ভুত অভ্যেস ছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘শান্তিনিকেতন’ বইটিকে বুকে আঁকড়ে রাখা। কখনও দেখা যেত, আপন মনেই অনর্গল মুখস্ত বলছেন বইটি থেকে। কখনও বা কাউকে পড়ে শোনাচ্ছেন ভাললাগা কোনও অংশ। শুধু রবীন্দ্র-রচনা নয়, ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের প্রতিও বিমলের যে কী প্রবল আকর্ষণ ছিল, বলে বোঝানোর নয়। এক বার শুনলেন হিন্দুস্তান রেকর্ডিংয়ের স্টুডিয়োয় কবিগুরু এসেছেন আবৃত্তি রেকর্ড করতে। সব কাজ ফেলে ছুটে গিয়েছিলেন সে দিন স্টুডিয়োয়। অথচ অদ্ভুত, রবীন্দ্রনাথের এই ভাবশিষ্য বিমল মিত্র কিনা কবি জীবিত থাকাকালীন কোনও দিন শান্তিনিকেতন যাননি!
জাগতিক ব্যাপারে বিমল মিত্র ছিলেন বরাবরই নির্লিপ্ত। এতটাই যে, বিনা নুনের রান্নাও আনমনে নির্লিপ্তভাবে খেয়ে উঠে গিয়েছেন।
বিমল মিত্রের চলে যাওয়াটা একেবারে হঠাৎই। সালটা ১৯৯১। শেষ দিকে ঘুম আসত না তাঁর, তাই রাতে ঘুমের ওষুধ খাওয়াটা ছিল বাঁধাধরা। সে দিনও তাই। ডিসেম্বরের ১। সকালে উঠে তাঁর স্ত্রী দেখলেন, বিমল তখনও ঘুমোচ্ছেন। ভাবলেন, বুঝি তখনও ঘুমের রেশ কাটেনি। আরও কিছুক্ষণ সময় গড়ালে, তখনও উঠছে না দেখে তিনি এ বার চিন্তিত হয়ে ডাকাডাকি শুরু করলেন। তাতেও কিছু হল না। প্রায় ঘণ্টা তিনেক এ ভাবে চলার পর আর অপেক্ষা না করে নার্সিংহোম। তাতেও অবস্থার কিছুই উন্নতি হল না। সন্ধে ঠিক ৬টা ২৫। বিমল মিত্র চলে গেলেন। তার পর থেকে তাঁর স্ত্রী কেবলই আফসোস করতেন, সকালে কেন তিনি বুঝতে পারেননি। তখনই হয়তো কোমায় চলে গিয়েছিলেন বিমল। একটু আগে বুঝতে পারলে হয়তো মানুষটাকে বাঁচনো যেত! হয়ত তাঁর কন্যাকে বলা তাঁর সেই কথাগুলোই ঠিক,
‘‘সব সময় জানবে, ওই একটা জায়গাতে আমাদের সবার জীবনের শেষ!’’
(তথ্যসূত্র:
১- দেশ পত্রিকা ১৩৮২ সাহিত্য সংখ্যা।
২- বিমল মিত্র শতবার্ষিকী সংকলন, সম্পাদনা: বারিদবরণ ঘোষ।
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ই জুন ২০১৭ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত