স্কুলে পড়ার সময় দেওয়ালে ভুল বানানে চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, অসীম চ্যাটার্জির সঙ্গে যার নাম লিখেছিলাম সেই মানুষটা গতকাল চলে গেলেন। প্রয়াত হলেন কমরেড সন্তোষ রাণা। দেওয়ালে নাম লিখলেও স্কুল জীবনে আমার মত এলেবেলে কমরেডের সঙ্গে সন্তোষ রাণার দেখা হয়নি। দেখা হল কলেজ জীবনে ছাত্র রাজনীতি করার সময়। স্কটিশ চার্চ কলেজে তখন ছাত্র পরিষদ এবং এসএফআই এর বিকল্প হিসেবে এসএ তৈরি করে ছাত্র ইউনিয়ন দখল করেছিলাম আমরা।
সত্যি বলতে কী সন্তোষদার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অনেকটাই হতাশ হয়েছিলাম। তাকে ঠিক ডেবরা-গোপীবল্লভপুরের সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের বিপ্লবী নায়ক কিংবা প্রেসিডেন্সি কলেজের আগুনখোর ছাত্র নেতা কোনটাই মনে হয়নি আমার। একটা ছোটখাটো চেহারার নিপাট ভালো মানুষ গোছের চেহারার লোকটা আস্তে আস্তে কথা বলেন, কিন্তু যা বলেন তা মনে গেঁথে যায়। ঠিক একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার স্ত্রী নিবেদিতার। ও তখন প্রেসিডেন্সীতে ছাত্র রাজনীতি করে। বারো রাজপুতের তেরো হাঁড়ির মত সিপিআইএমএল তখন বহুধাবিভক্ত। ও করতো আইপিএফ। সন্তোষদার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ওর মনে হয়েছিল একইসঙ্গে মেধাবী ও মাটির মানুষ। সংখ্যা কখনও সন্তোষদার ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করেনি, তাঁর ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে যুক্তি। আজকের সময়ে যা ক্রমশই একটা বিরল ব্যাপার হয়ে উঠেছে। সন্তোষদার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আমাদের কলেজের রঞ্জন সেন। ও কিশোর বয়সে সন্তোষদার সঙ্গে জেলে ছিল। রঞ্জন বলতো, সন্তোষদা ওকে জেলখানায় পড়াতেন।
কৃষক পরিবারের ছেলে সন্তোষদা বরাবর মেধাবী। সেই মেধার বিস্ফোরণ ইদানিং� মানুষ তাঁর লেখালেখির মধ্যে দিয়ে দেখছিলেন। সন্তোষদা কিন্তু বরাবরই বাংলা ও ইংরেজিতে পার্টি মুখপত্র এবং ফ্রন্টিয়ারসহ নকশালবাড়ির রাজনীতি ঘেঁষা বিভিন্ন কাগজে লিখতেন। কোন তাত্ত্বিক নেতা নয়, তিনি ছিলেন মাটি কামড়ে সংগঠন গড়ে তোলা মানুষ, সিপিআইএমএলএর রাজনীতি অনুযায়ী যা যা কাজ করা দরকার তার সবই তিনি করেছেন। আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখাও এর এক মূর্তিমান উদাহরণ ছিলেন তিনি। যে কাজটা তার অনেক আগেই করা উচিৎ ছিল সেই কাজটাই ইদানিং বেশ মন দিয়ে করছিলেন সন্তোষদা, লেখালেখিতে সময় দিচ্ছিলেন। বাংলা প্রবন্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে তাঁর একটা অন্য পরিচিতি তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু সময় তাঁকে লম্বা ইনিংস খেলার সুযোগ দিল না।
সন্তোষদার রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভালমন্দ বিচার করার যোগ্যতা আমার নেই। সামান্য সময় যেটুকু তাকে দেখেছি তাতে তাঁকে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করার, সবার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে চলার মত একজন মানুষ বলে মনে হয়েছে আমার। কাটমানির জমানায় যখন তাঁর মত রাজনীতিবিদদের সামনে আসার বেশি দরকার ছিল সেই সময়ে তিনি আচমকা চলে গেলেন। দেশের জন্য জীবন দিতে চেয়েছিলেন যে মানুষটি, শেষবেলায় তাঁর অন্তত একটা ইচ্ছা পূর্ণ হল। তিনি মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন। ছবিতে দেখছিলাম ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে তাঁর মৃতদেহ মরণোত্তর দেহদান কর্মীরা নিয়ে যাচ্ছেন। আমার মনে হল জীবিত সন্তোষদার মত মৃত সন্তোষদাও মানুষের উপকারেই লাগবেন।
তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে অসংখ্য লোক হাসপাতালে ভিড় করেছে কিংবা তাঁর মৃতদেহ নিয়ে হয়েছে বিরাট কোন শোক মিছিল এমনটা মোটেই নয়। অন্যধারার এই রাজনীতিবিদ ও চিন্তকের লাল পতাকা ঢাকা মৃতদেহ নিয়ে রাস্তা জুড়ে কোন মিছিল হবে, দেওয়া হবে গান স্যালুট, তাও আমরা কেউ ভাবিনি। বন্দুকের আওয়াজই বলুন বা ধোঁয়া সবই তো সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যায়। কিন্তু সন্তোষদার মত মানুষ বেঁচে থাকবেন যাদের জন্য তিনি কাজ করেছেন, যারা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন সেই সব মানুষের মনে। সংখ্যায় হয়তো তারা অল্প কিন্তু তাদের চিন্তা, চেতনা ও কাজে সন্তোষ রাণা বারবার ঠিক চলে আসবেন।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত