ব্রাজিল হেরে গেছে কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের কাছে। কেন হেরেছে, কি করলে জিততো, কে ভালো খেলেছে, কে খারাপ। অনেক কাঁটাছেড়া। চলছে। চলবেও। কিন্তু তাতে বাস্তব পালটাবে না। বিশ্বকাপে আর ব্রাজিল ফিরে আসবে না। অনেকেই দেখি বলছে, লাতিন আমেরিকার ফুটবল শেষ। এখন ইউরোপের ফুটবলের যুগ। তা হবে হয়তো। হয়তো ঠিক। আমি লাতিন আমেরিকায় আসছি না। আমি ব্রাজিলে আসি।ব্রাজিল বেলজিয়ামের কাছে হারার পর রিও দি জেনেইরো শহরের বস্তির অন্ধগলির বাচ্চাটা হাপুস নয়নে কেঁদেছে। কান্না থামার পর সব ভুলে ও আবার ফুটবলার হওয়ারই স্বপ্ন দেখবে। কারণ ওটা ব্রাজিল। ওখানে মানুষ ফুটবলে বাঁচে। ফুটবলেই স্বপ্ন দেখে। বলা হচ্ছে ‘গোল্ডেন জেনারেশন অব বেলজিয়াম’। ‘গোল্ডেন জেনারেশন অব ক্রোয়েশিয়া’। কখনও শুনেছেন কাউকে বলতে গোল্ডেন জেনারেশন অব ব্রাজিল? শুনবেন না। কারণ ব্রাজিলে যে শিশুটা দু’বেলা খেতে পায় না, সেও দিনের শেষে স্বপ্ন দেখে। একদিন বড় ফুটবলার হয়ে সব কষ্ট মুছে ফেলবে। ফুটবলটা ওখানে অনেকটা জল খাওয়ার মতো।বাঁচতে খেলে ফুটবলই খেলতে হবে। বাঁচতে হবে। জীবনযুদ্ধের একমাত্র অবলম্বন। ব্রাজিল ছাড়া আর কোন দেশ নেই যাঁদের কাছে ফুটবলটাই ফার্স্ট প্রাওরিটি।স্ট্রিট ফুটবল। ব্রাজিলে খুব বিখ্যাত। খুব। পিচের রাস্তা, অথবা ইটের। খালি পা। একটা তাপ্পি মারা ফুটবল। আর একঝাঁক স্বপ্নের ডানা মেলা। ব্রাজিলের বিখ্যাত সব ফুটবলাররা উঠে এসেছেন এই স্ট্রিট ফুটবল থেকে। এটা একটা প্রবাহ। নিরন্তর। মারাদোনা চলে যাওয়ার পর আর্জেন্টিনা বারবার মারাদোনাকে খুঁজেছে। যাঁকে আকড়ে ধরে স্বপ্ন দেখবে। বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। পায়নি। বহুদিন পর একটা মেসি পেয়েছিলো আর্জেন্টিনা। আবার একটাজাদুকর। যে একাই জেতাতে পারে। এবার হলো না। তারপর? ভবিষ্যত? পরের মেসি? কবে আসবে? প্রশ্নচিহ্ন।স্পেন। তিকিতাকা। সেই ২০১০। গোল্ডেন জেনারেশন। বিশ্বকাপ। তারপর দু’বার? উত্তর নেই। হঠাৎ করে একটা ইংল্যান্ড, একটা বেলজিয়াম, একটা ক্রোয়েশিয়া। ব্রাজিল কিন্তু তা নয়। ছোটবেলায় ব্রাজিল দেখা শুরু করেছিলাম রোনাল্ডো, রোনাল্ডিনহোকে দেখে। এখন সেটা নেইমার, কুটিনহো। তুলনায় না গেলেও একটা কথা বলাই যায়। শিল্প মরেনি। শিল্প মরতে পারে না। ইউরোপীয় ফুটবলের জয়োল্লাসের দিনেও ব্রাজিল থাকবে ব্রাজিল।নেইমারকে নিয়ে এতো সমালোচনা। ও নাকি শুধু নাটক করে। বিশ্বকাপের পরিসংখ্যান অনেক নামী দামি মহাতারকার থেকে এই বিশ্বকাপে নেইমার অনেক সপ্রতিভ। ছোটবেলা থেকে ব্রাজিল সমর্থক। ব্রাজিল হেরে যাওয়ায় খুব খারাপ লাগছে। কষ্ট হচ্ছে। সঙ্গে ভীষণ গর্বিত। একটা ম্যাচের মতো ম্যাচ উপহার দিয়ে বিদায় নিলো ব্রাজিল। বেলজিয়াম এই বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট। গোটা দ্বিতীয়ার্ধ নিজেদের পেনাল্টি বক্সে খেলে গেলো। কিন্তু ভালো খেলে হেরে যাওয়া অর্থহীন। বা্স্তব বলছে ব্রাজিল বিদায়।অদ্ভুত খুশি হয়েছে কিছু মানুষ। অদ্ভুত উল্লাস। অনেকগুলো পোস্টে কমেন্ট করেও মুছে দিলাম। কারণ বয়স বাড়ছে। আমি জানি কথায় কথা বাড়ে। আর কাউকে কিছু বুঝিয়েও লাভ নেই। ব্রাজিলের হার কারা চাইছে? যাঁরা জানে ব্রাজিল ফুটবল ঘরানা শেষ হবে না। যাঁরা জানে ৭ গোলের খোঁটা হাজারবার দিলেও ব্রাজিলের সাফল্য তাঁদের নেই। যাঁরা জানে ব্রাজিল থামতে জানে না। যাঁরা জানে ব্রাজিল আবার ফিরবেই। যাঁরা জানে প্রতি বিশ্বকাপে কেউ না থাকুক ব্রাজিল ফেভারিট থাকবেই। যাঁরা জানে হাজার হাজার বার বললেও প্রমাণ করা যাবে না ব্রাজিল ফুটবল ঘরানা মরে গেছে। সাম্বার ছন্দ আর মন মাতায় না বলেও যাঁরা ব্রাজিলের খেলা না দেখে থাকতে পারেন না।বিশ্বকাপের এখনও ৮ দিন বাকি। যাঁরা সমালোচনা করছে তাঁরাও জানে ফুটবল বিশ্বের একটা বড় অংশের কাছে বিশ্বকাপ শেষ। কারণ এটা ব্রাজিল। হয় পাগলের মতো সমর্থন করার জন্য। অথবা প্রতি মুহূর্তে হার চাওয়ার জন্য যাঁদের খেলা দেখতেই হয়। হয়তো দারুন খেলা দেখা যাবে। জয় দেখা যাবে। দারুন গোল। কিন্তু তাল, লয়, ছন্দ আর দেখা যাবে না। কারণ শিল্পী বিদায় নিয়েছে বিশ্বকাপ থেকে।যাঁরা ব্রাজিল হারে ভীষণ খুশি তাঁরাও জানে। যাঁরা ভেঙে পড়েছে তাঁরাও জানে। ব্রাজিল ফুটবলের মৃত্যু হয় না। কারণ কোন ঘরানা কখনও মরে না। বেঁচে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্মে। যুগের পর যুগ ধরে তৈরি করে সমর্থক।মুগ্ধ করে নিজের শিল্পশৈলীতে।কাল হারের পর অফিসের ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মাথায় ঘুরছিলো হারটা। তখন একটা লাইন মাথায় এলো। সেই লাইনটা লিখেই শেষ করলাম।‘ব্রাজিল ফুটবল একটা নদীর মতো, যে নদীতে কখনও ভাঁটা আসে না।’