ঋতু পরবর্তী যুগে ঋজু মানে সৃজিত নিজেকে যে জায়গায় নিয়ে গেছে, কাল যদি আদিদাস বলে কোন মুচি যে প্রথমে হাজরার মোড়ে বসতো এবং পরে নিজ পরিশ্রমে স্নিকারস ও খেলার জুতো বানিয়ে বিশ্বসেরা হয়, বিদেশিরা আদিদাস নাম উচ্চারণ করতে পারেনি তাই নাম হলো Adidas গোছের কোন ফিলিম ও বানায়, পাবলিক হেব্বি খাবে শুধু নয় কাঁটা বেছে খাবে আর খাওয়াবে।
না গুমনামি এরকম কোন আষাঢ়ে গল্প না। এটা রীতিমতো গবেষণা করে স্থাপন করা এক থিয়োরি যেটা খন্ডন করা যায় অথচ খচখচানিটা থেকে যায়। মানে ওই রাহুল গান্ধী আসলে রাউল ভিঞ্চি গ্যান্ডি এবং সে খৃষ্টান বা চৈতন্যদেবের নীলাচলে গমন আসলে মেরে ভাসিয়ে দেওয়া কিংবা তাজ মহল আসলে এক মন্দির ছিল যেখানে মসজিদের কাঠামো যোগ করা হয়।
‘গুমনামী’ এসবের মতোই এক থিয়োরি যার সত্যতা থাকতেই পারে। যে ভাবে রাম ঐতিহাসিক চরিত্র ছিল বলে অনেকে মানে এবং সুপ্রিম কোর্টে তাই নিয়ে রোজ শুনানি চলে।
সিনেমাটি ঘোষণা হওয়ার দিন থেকে আমি এই প্রোজেক্ট নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। পরিচালককে সেই আশংকার কথা মেসেজ ও করি। দীর্ঘ সময় এই নিয়ে আলাপ চলে অনুজ ধর ও সৃজিত মুখার্জির সাথে। মাঝে নেতাজি কন্যার সাক্ষাৎকার নিই যেখানে সে বলে গুমনামী আর যাই হোক আমার বাবা হতে পারে না।
ছবিটা দেখার পরে আমি মেনে নিচ্ছি মুখুজ্জে মশাই এ যাত্রায় ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করিয়াছেন এবং এক লহমায় মিশন নেতাজী ও তার কাজ কারবার বাঙালির কাছে সেলিং লাইক হট কাচৌরিস।
বাঙালি নিজের ঐতিহ্যকে নিয়ে আজন্মকাল রক্ষণশীল। তাকে আগলে রাখার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তারা পালন করে কিন্তু বিকটভাবে। এই ধরুন প্রাণাধিক প্রিয় শহরটাকে সে বড্ড ভালোবাসে কিন্তু সেটিকেই দূষণের দিক থেকে এক নম্বরে পৌঁছে দেওয়াতে ও এগিয়ে। আবার ধরুন বাঙালি বাঙালি হেব্বি বুক বাজাই কিন্তু আমাদের চারপাশে আমাদের যে ঐতিহ্যগুলো অনাদরে পরে আছে তাদের নিয়ে জানার কোন ইচ্ছে আমাদের নেই। কলকাতার রাস্তাগুলো যাদের নামে তাদের সম্বন্ধে কতটাই বা জানি আমরা?
নেতাজি ঠিক সেরকম এক চরিত্র। পাঁচমাথার মোড়ে আছে, স্বাধীনতা দিবসে আছে, মননে আছে কিন্তু আদপে কি আছে? আমরা কতজন আই.এন.এ. বা কোন কোন দেশে সুভাষ গেছিল তার সম্বন্ধে জানি?
সৃজিত মুখার্জি, অনুজ ধর, চন্দ্রচূড় ঘোষ সচেতনভাবে বাঙালির ওই জমিদারিতে থাবা বসিয়েছে। নেতাজি আমার, নেতাজি তোমার, নেতাজি কারো বাপের নয়। আর নয় বলেই এবার আমাদের সব কটা দিক শুনতে হবে সে যতই আষাঢ়ে মনে হোক৷ শুনতে হবে কারণ যাদের জানানোটা কাজ ছিল ৭০বছর ধরে তারা নেতাজিকে নিয়ে বেসাতি করেছে।
আমরা মহানায়ক-পুজনে বিশ্বাসী মানুষজন। আমরা বিশ্বাস করি রবীন্দ্রনাথের সারা শরীরে চলকানি হতে পারে না, লেনিনকে পিছন পরিস্কার করিয়ে দেওয়ার আয়ার দরকার হয়না, নেতাজি ঘোড়ায় চেপে থাকে। কিন্তু সেই নেতাজিই যদি লুকিয়ে নিজের দেশে ফিরে উত্তর প্রদেশে কোন বাবা হিসেবে জীবনযাপন করে, পাবলিকের ঝটকা লাগে৷
কিন্তু এই ঝটকা তো নেতাজিকে কেন্দ্র করে যতগুলো রহস্য আছে সেগুলোতে আরো বেশী। আপনি কোনদিন ১৯৪৪ থেকে নেতাজি সম্বন্ধে কিছু পড়েছেন? পড়ে মনে হয়নি যে এটা কিরকম পচা বাংলা ছবির ক্লাইম্যাক্স হলো?
সৃজিত মুখার্জি সেই vacuum টাকে কাজে লাগিয়ে একটা ছবি করেছেন। যে দুটো জিনিসের জন্য বারবার বহুবার ওর ছবিকে ভূষিত করা উচিৎ সেই স্মার্ট সংলাপ আর দারুণ গান এই ছবিতে ও আছে। প্রসেনজিৎ, অনির্বাণ গোটা ছবিটা টেনে নিয়ে গেছে। তনুশ্রীর যেটুকু করার ছিল তাই করেছে। কিন্তু ওই ওল্ড মংক রাম গুমনামী বাবার নামে বানানো সেটা বোগাস তথ্য। প্লেন ক্র্যাশের মতোই।
সৃজিত মুখার্জি নিজে একটা দল করতেই পারেন। কিছু মানুষ এনার ফ্যানক্লাবে আছে যারা কাল ‘আদিদাস- একটি বাঙালি মুচির গল্প’ বানালে ও সেটা হিট করিয়ে দেওয়ার পবিত্র দ্বায়িত্ব হিসেবে নেবে। কিন্তু গুমনামী দেখতে দেখতে চারপাশে দেখলাম ওই ফ্যান ক্লাবের বাইরে ও অনেক অনেক মানুষ অশ্রু সজল চোখে তিন ঘন্টা দেখলো। হ্যাঁ সত্যি দাঁড়িয়ে হাততালি দিলো। প্লেন ক্র্যাশের মতো বানানো সিন না।
গুমনামী যদি সত্যি নেতাজি হয়, বিজেপি আরো অক্সিজেন পাবে। কংগ্রেস নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। গুমনামী বিজেপির প্লান্ট ও হতে পারে। কিংবা গুমনামী হয়তো সত্যি এক পড়াশোনা জানা বাঙালি বাবা যে জালিয়াত ছাড়া কোন জী হওয়ার যোগ্য না। কিন্তু এই গল্পটা ও শুনতে হবে।
যার মৃত্যু কিভাবে হলো সেটা জানার জন্য যে রাজ্যকে স্তব্ধ করে দেওয়া উচিত ছিল, যে রাজ্যের সাংসদদের দিনের পর দিন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ দেখানো উচিত ছিল ডিএনএ টেস্টের দাবি জানিয়ে তারা ৭০ বছর ছেলে ভোলানো খেলে গেছে আমাদের সাথে। আজ গুমনামীকে নেতাজি মানতে যদি অসুবিধা হয় তবে এটা ও মানুন যে আপনি নেতাজিকে নিয়ে কিচ্ছুটি করেননি। যারা করেছিল তাদের উন্মাদ ধান্দাবাজ বা কুচক্রী বলে দেগে দিয়েছিলেন।
নেতাজি War Criminal ছিল। ভারতে নিজের পরিচয়ে আসা সম্ভব ছিল না হয়তো। সুতরাং সে যদি বেঁচেই থাকে স্বাধীনতার পরে তবে এ ভাবেই হয়তো তাকে থাকতে হতো। খারাপ লাগে বা গায়ে কাঁটা দেয় এটা ভাবলে যে সরযুর ঘাটে ভারতের বীর সন্তানের শেষ কৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল ১৩টি লোকের মাঝে।
আমরা সুভাষকে তার যোগ্য সম্মান দিতে পারিনি। এখন একটি সাধুকে সুভাষ বলে চালানোর চেষ্টা হলে ও Deal with it. প্রায়শ্চিত্ত করুন। জনপ্রিয় পরিচালকের একটা ছবির জন্য অন্তত বাঙালি একটা মাস নেতাজি নিয়ে কৌতুহলী হলো নয়তো ফের পাকিস্তানের মাথায় বোমা মারা, রানু মন্ডল, ভাগাড়ের মাংস, মন্দির, মসজিদ, লাভ জিহাদে ব্যস্ত হয়ে যেত দেশ। সে দেশ সুভাষ চায়নি।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত