‘‘গৌরীকে দেখাবেন? আমার গৌরী! একটি বার শুধু দেখা করিয়ে দিন!’’
প্রথম স্ত্রী গৌরীর মৃত্যুর পর শোকে ভেঙে পড়ে বিভূতিভূষণ এমন আকুতিই করেছেন দিনের পর দিন!
স্ত্রীর মৃত্যুর কিছু দিন পর বোন মণিও মারা যান। ব্যারাকপুরের বাড়িতে পর পর দুটি আঘাতে পাগল হয়ে যাওয়ার দশা হয় বিভূতির। কলেজের বন্ধুরা একরকম জোর করে তাঁকে কলকাতা নিয়ে আসে।
একদিন টালিগঞ্জের দিকে একলা ঘুরতে ঘুরতে তাঁর দেখা হয় এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে। তিনিই বিভূতিকে অশরীরী আত্মার বিচরণ সম্পর্কে ব্রহ্মসূত্রের কথা বলেন। বিভূতি অবাক হয়ে শোনেন, বৃহদারণ্যকে জনকসভায় মহর্ষি আত্মা-তত্ত্বের কী ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
সেই শুরু।
সারা জীবন বিভূতিভূষণ বিশ্বাস করে এসেছেন আত্মা-চর্চায়। আত্মাকে ডাকলে তাকে পাওয়া যায়। শুধু ডাকার মতো ডাকতে জানা চাই।
মৃত গৌরীকে দেখতে চেয়ে সন্ন্যাসীর কাছেই শিখেছিলেন ‘মণ্ডল’। অর্থাৎ প্ল্যানচেটে আত্মাকে ডাকা।
যেখানেই গিয়েছেন, আমৃত্যু সেই সাধনা করেছেন। দরজা-জানলা বন্ধ করে, ধূপ-ধুনো জ্বালিয়ে ডেকেছেন গৌরীকে। কথা বলেছেন একা একা গভীর নিশীথে। কান্নায় প্রিয়তমার শোকে আকুল হয়েছেন।
সন্ন্যাসীর কাছ থেকে আত্মা-আবাহনের কৌশলটি রপ্ত করার পর কয়েক দিন তুমুল মেতেছিলেন তিনি। বিস্তৃত এই পরলোকচর্চার স্বাদ পেয়ে, নাম লিখিয়েছিলেন কলেজ স্কোয়ারের থিওসফিক্যাল সোসাইটিতেও। এক সময় যার সভাপতি ছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। তিনিও স্ত্রীর মৃত্যুর পর মেতে উঠেছিলেন আত্মার সঙ্গে নিভৃত সংলাপে।
সোসাইটির সদস্য হয়ে বিভূতি যেন নতুন দিগন্তের সন্ধান পেলেন। জানা হল চক্রাধিবেশন। ধীরে ধীরে জানলেন, তাঁর কল্পলোকের দেবতা রবিঠাকুরও প্ল্যানচেট করেছেন। এও জানলেন, বিদ্যাসাগর যে দিন চলে যান, বৃন্দাবনের আকাশে তাঁর আত্মা দেখেছিলেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী! শুনলেন, স্বামী বিবেকানন্দকে কোনও আত্মা এসে তাঁর পিণ্ড দানের অনুরোধ করেন।
বিভূতির সেই সময়ের প্রিয় বন্ধু নীরদ সি চৌধুরী লিখেছেন, বিভূতিভূষণের পরলোকচর্চার মতিগতি।
নীরদ মনে করতেন, বিভূতির পরলোকে বিশ্বাস ঠিক ‘বিশ্বাস’ নয়, কুসংস্কার হয়ে উঠেছিল।
নিছক তাই কি?
পরলোক নিয়ে এত অগাধ পড়াশোনার পর সেও কি সম্ভব! কেন না, বিভূতি তো ঘোর বাস্তববাদী ছিলেন।
চর্চা এখানেই থেমে রইল না।
জাঙ্গিপাড়া দ্বারকানাথ হাইস্কুলে যখন পড়াতে গেলেন, তাঁকে ঘিরে কয়েকজন ঠিক জুটে গেল পরলোকচর্চায়।
অন্ধকার ঘরে টেবিল পেতে তাঁরা মোমবাতি জ্বালিয়ে বসলেনও।
বিভূতি এক একদিন ডেকে আনতেন পরলোক থেকে প্রিয়দের। কিন্তু এই প্রেতচর্চাই কাল হল তাঁর।
জাঙ্গিপাড়ার হাওয়ায় নানা কথা রটল।
স্কুলবাড়িতে মাস্টার প্রেত নামায়, কথাটা অভিভাবকরা ভালভাবে নিলেন না। ছাত্র কমতে লাগল। বিপদ বুঝে, স্কুল কমিটি বিভূতিকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিল। তবু সরে আসেননি বিভূতি প্রেতচর্চা থেকে।
হরিনাভি-রাজপুরে যখন অ্যাংলো স্যানসক্রিট ইনস্টিটিউশনে পড়াতে গেলেন, সেখানেও অল্প বিস্তর জানাজানি হয় তাঁর পরলোকচর্চার খবর।
ক্রমশ পরলোক নিয়ে তাঁর বিশ্বাসও ঢুকে পড়ে লেখা গল্পে, উপন্যাসে। কখনও সখনও তা নিয়ে সচেতন হয়ে ছেঁটেও ফেলেছেন মূল লেখা থেকে সেই আধি-ভৌতিক প্রসঙ্গ। তবু শেষ রক্ষে হয়নি!
বিভূতিভূষণের দ্বিতীয় স্ত্রী কল্যাণীদেবীর বাবা ষোড়শীকান্ত তান্ত্রিক ছিলেন। দীক্ষাও নিয়েছিলেন এক ভৈরবীর কাছে। তাঁকে নিয়েই বিভূতি ‘তারানাথ তান্ত্রিক’ লিখেছিলেন।
জামাইয়ের পরলোক নিয়ে অতি উৎসাহে অবাকই হতেন ষোড়শীকান্ত। জীবনের শেষ পর্বে যখন ব্যারাকপুরে রয়েছেন দেখা মিলল এক ভৈরবীর। বিভূতি মেতেও উঠেছিলেন তাঁর সঙ্গে।
ভৈরবী শবসাধনা করতে এসেছে জেনে, বিভূতিও নিত্য যাতায়াত বাড়ায়। রেগে যেতেন কল্যাণী। তবু কী এক মায়ায় নাছোড় বিভূতিকে আগলে রাখতে পারতেন না! রাতভর সাধনায় মেতে থাকতেন স্ত্রী-সংসার ভুলে।
তাঁর দিনলিপির পাতায় পাতায় পরলোক নিয়ে বিশ্বাসের কথা রয়েছে। তারই সংশ্লেষ ‘দেবযান’ উপন্যাস।
মৃত্যুর পর আত্মার উপস্থিতি নিয়ে বিভূতির বিশ্বাস যেন প্লটের বাঁকে বাঁকে।
মৃত্যুর পর কোথায় থাকে আত্মা?
শবের কাছেই কি দাঁড়িয়ে থাকে?
কী ভাবে উড়ে যায়?
ফিরে আসে কি?
সব উত্তর যেন মিলে যায় যতীন চরিত্রটিকে নিয়ে এই লেখায়। তাঁর জীবনীকার কিশলয় ঠাকুর জানিয়েছিলেন, ‘‘যে সময় ‘দেবযান’ প্রকাশ হচ্ছে, তার বহু আগে থেকেই বনগাঁর বীরেশ্বর মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ান। তিনিও পুত্রশোকে কাতর ছিলেন। দুঃখ ভুলতে প্ল্যানচেটে ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন। বীরেশ্বরবাবুর সংগ্রহে ছিল পরলোকচর্চার নানা বই। সে সব বইতে বিভূতি ডুবে থাকতেন। পাতায় পাতায় নিজের নোটও লিখে রাখতেন।’’
বিভূতিভূষণের পরলোকচর্চার বিষয়টি সে সময় লেখকদের অনেকেই খবর রাখতেন। বিভূতির জীবনকথা জানাচ্ছে, প্রমথনাথ বিশীর ছোট ভাই মারা গেলে, শোক-সন্তপ্ত গোটা পরিবার বিভূতির কাছে এসেছিল। বিভূতি শ্লেটে দাগ টেনে মৃত ব্যক্তির আত্মার গতিপথ দেখিয়েছিলেন। তাঁদের এও বুঝিয়েছিলেন, আত্মার জন্য শোক করতে নেই! তাতে আত্মার দহন বাড়ে!
দিন যত ফুরিয়ে এসেছে, পরলোকে বিশ্বাস যেন তত বেড়েছে বিভূতির।
শেষবেলায় ছেলে তারাদাস অসুস্থ হয়ে পড়লে, একদিন স্নান সেরে ফিরে নাকি দেখেছিলেন, ছেলের মাথার কাছে বসে রয়েছে কেউ। বিভূতি বুকে জড়িয়ে নেন তারাদাসকে। বলেন, ‘‘ওকে দেব না।’’
সেই বিদেহী আগন্তুক তখন নাকি বলে ওঠে, ‘‘তোমার ছেলের আয়ু নেই। ওকে যেতে দাও আমার সঙ্গে।’’
বিভূতি সন্তানকে আঁকড়ে বলেন, ‘‘আমার আয়ু দিচ্ছি। তুমি চলে যাও।’’
শেষবার যখন ঘাটশিলা গেলেন, এক সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে নিজের মৃত্যুর ইঙ্গিত দিলেন যেন!
মনে করতেন, মানুষের সংবর্ধনা মানেই সময় ফুরিয়ে এসেছে। তার আগেই ‘শেষ লেখা’ গল্পে সেই দেবযান-এর সুর।
পরলোকে বিশ্বাসের শিকড় ক্রমশ এত গভীরে গাঁথা পড়েছিল, সর্বক্ষণ মরণের কথা ভেবে গিয়েছেন শেষের দিনগুলোয়।
বিভূতিভূষণের ভাই নুটুর স্ত্রী যমুনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উপল ব্যথিত গতি’-তে বিভূতির শেষ সময়ের একটি বিশেষ ঘটনার কথা মেলে।
যমুনা লিখেছেন, ঘাটশিলায় মৃত্যুর কয়েক দিন আগে ফুলডুংরি ঘুরতে গেলেন। সঙ্গে অনেকেই। দল থেকে আলাদা হয়ে একটি জায়গায় নাকি দেখেন ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো ছড়িয়ে। খান কয়েক পাথর সাজানো। একটি শববাহী খাট ওল্টানো। আর একটি খাটিয়ায় মৃতদেহ ঢাকা দেওয়া। বনের মধ্যে, বিভূতিভূষণ গিয়ে টান মেরে ঢাকা সরিয়ে ফেলেন!
তার পরেই তাঁর আর্ত চিৎকার!
এ কার শরীর!
ধড়ের উপর যে মুখটি, সেটি অবিকল তাঁর!
অবশ্য বিভূতিভূষণ একা নন, বিখ্যাত বাঙালির পরলোকচর্চার ইতিহাসটি বেশ পুরানো। এতে জড়িয়ে রয়েছে আরও কিছু নাম, ইতিহাস ও ঘটনা।
হুতোমের নকশায় প্রেতচর্চাকে ‘বুজরুকি’ বলে গাল পেড়েছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ!
এ দিকে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু রীতিমতো ‘মিডিয়াম’ নিয়ে বসাতেন প্রেতবৈঠক। তাঁর আসরে ‘দেখা’ দিয়েছিল সুকুমার রায়ের আত্মাও।
অবনঠাকুরের জামাতা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছাপাখানাটি ছিল ‘আত্মা’ নামানোর বিখ্যাত ঠিকানা।
বাঙালির প্রেতবৈঠকের ইতিহাস রুদ্ধশ্বাস রোমহর্যক কাহিনিকেও হার মানায়।
তখন চলছে আলিপুর বোমা মামলা।
প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ডকে মারার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অনেকের সঙ্গেই ধরা পড়েছেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষরা। অভিযুক্তদের হয়ে মামলা লড়ছেন ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী। মামলা শুনছেন বিচারপতি বিচক্রফ্ট।
ও দিকে, সে সময় ভূতপ্রেত নিয়ে মেতে আছেন আর এক ব্যারিস্টার, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। কখনও পুরুলিয়ায়, কখনও কলকাতায় তাঁর রসা রোডের বাড়িতে বসছে আত্মা-আনয়ন চক্রের বৈঠক।
নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়ও সাধারণত থাকেন সেই সব বৈঠকে। বন্ধ দরজার ভিতর দিয়ে বাড়ির ছোটরা পরলোক থেকে নেমে আসা অশরীরীদের আভাস পাওয়ার চেষ্টা করে।
আলিপুর মামলা নিয়ে কিছু আলোচনার জন্য একদিন ব্রাহ্মবান্ধবের আত্মাকে ডেকে আনলেন দেশবন্ধু। আত্মা পেন্সিল দিয়ে বারবার লিখে দিল, ‘‘ইউ মাস্ট ডিফেন্ড অরবিন্দ।’’
কিছু দিনের মধ্যে আলিপুর বোমা মামলা চলে এল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের হাতে।
এবারে যাওয়া যাক বরোদা। উনিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিক। ভাই বারীনের সঙ্গে আত্মা ডেকে আনার আসর বসাতেন অরবিন্দ ঘোষ।
পণ্ডিচেরিতে শ্রীঅরবিন্দ এক সময় নিয়মিত বসতেন ‘সেঅন্স’ অর্থাৎ আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের বৈঠকে। তেমনই কয়েকটা আসরে, প্রায় সাত-আট দিন লিখে তিনি ইংরেজিতে শেষ করলেন একটি বই। নাম দিলেন ‘যোগিক সাধন’।
নিজে লিখলেও বইয়ে নিজের নাম ছাপতে দিলেন না ঋষি অরবিন্দ। কেন?
বললেন, তাঁর হাত দিয়ে আসলে অন্য কেউ এসে লিখে গেছেন সেই বই। প্রেত-তাত্ত্বিকরা একেই বলবেন ‘স্বয়ং-লিখন’।
লেখালেখির পাশাপাশি, পেশায় আইনজীবী সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় তখন বন্ধুদের নিয়ে মেতে আছেন প্রেতচর্চায়। হীরেন্দ্রনাথ দত্ত আর সৌরীন্দ্রের মেজকাকা রাজেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায় সেই সময় সম্পাদনা করেন ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’র পত্রিকা ‘পন্থা’।
তিন পায়া টেবিলকে ঘিরে ধরে আত্মা নামানোর চক্র বসাতেন সৌরীন্দ্রমোহন, যার চলতি নাম ছিল ‘টেবল টার্নিং’। আত্মা এলে কেঁপে উঠত টেবিলের পায়া। পায়া কতবার পা ঠুকল মাটিতে, সেই অনুযায়ী ধরা হত আত্মার উত্তর।
‘‘রহিম সাহেবের জজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি?’’ প্রেতচক্রে এই প্রশ্নের উত্তরে টেবিলের পায়া একবার শব্দ করল। তাতেই স্পষ্ট হল জবাব,
‘‘হ্যাঁ।’’ পরে এই ‘হ্যাঁ’টা মিলেও যায়। ওঁদের প্রেতচক্রে আর একবার এল স্বয়ং ছত্রপতি শিবাজির আত্মা।
তাকে নাকি প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভারত কোনও দিন স্বাধীন হবে কি না। আবার এক বার পায়ার ঠোক্কর মাটিতে। অতএব— ‘‘হবে।’’
তখন প্রশ্ন করা হয়, কত দিন পর?
টেবিলের পায়া ঠক ঠক ঠক করে চলল—চল্লিশবার। উপস্থিত চক্রীদের কেউ সে দিন বিশ্বাস করেননি, চল্লিশ বছরের মধ্যেই সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়ে যাবে ভারতবর্ষ।
এবারে ঠাকুরবাড়ি, যেখানে রবীন্দ্রনাথের দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদনা করতেন মাসিক পত্র ‘ভারতী’।
হঠাৎ তাঁর স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল মারা গেলেন। এর পর যাবতীয় কাজকম্ম যেন স্বর্ণকুমারীর কাছে ভার হয়ে দাঁড়াল। সমস্ত কিছু থেকে অব্যাহতি চেয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলেন তিনি।
তখন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে প্রেতবৈঠক বসে। সেখানে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ডাকলেন জানকীনাথের আত্মাকে। কৌতূহলী প্রেতচক্রীদের প্রশ্ন— এর পর ‘ভারতী’র কী হবে?
জানকীনাথের আত্মা জানিয়েছিল, একদিন সৌরীন্দ্রনাথ আর মণিলাল দ্বায়িত্ব নেবেন ‘ভারতী’র। সে-কথাটাও মিলে ছিল অক্ষরে অক্ষরে। ‘ভারতী’র সম্পাদক হয়েছিলেন ওই দুজনে।
বড় ছেলে মারা গেলে, বউয়ের আবদারে, প্ল্যানচেটে বসলেন সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী। তখন মনে কিন্তু শুধুই অবিশ্বাস আর সন্দেহ। কিছু দিন যেতেই সেই সতীশচন্দ্রই ‘বুঝলেন’, ভাল মন নিয়ে ডাকলে আত্মারা আসে।
আরও বুঝলেন, ঐহিক বিষয় নিয়ে জ্বালাতন আত্মারা পছন্দ করে না। আত্মাদের সঙ্গে নিজের কথাবার্তা বারবার পড়ে তিনি এতটাই খুশি হয়ে পড়তেন যে, এক বার লিখেছিলেন, যেন ‘‘ধর্মপুস্তক পাঠ করিবার পবিত্র আনন্দ উপভোগ করি।’’
সতীশচন্দ্রের আত্মাচর্চা প্রেতচক্রের গল্পে আত্মার ভোজন-পর্বের কথাও এসে পড়ে। অবাক করা সে সব কাহিনির দু’-একটা নমুনা দেওয়া যাক।
দেখা যাচ্ছে, মৃত পুত্র পরিতোষের আত্মা এসে একবার সতীশচন্দ্রকে জানাচ্ছে, ‘‘মৃত্যুর পূর্বে ডাব খাইতে চাহিয়াছিলাম।’’
সতীশচন্দ্র বিলক্ষণ জানতেন, জীবদ্দশায় পরিতোষ চমচম ভালবাসত। ছেলের আত্মাকে বাবা বললেন, ইদানীং স্পঞ্জ রসগোল্লা পাওয়া যাচ্ছে, যা পরিতোষের মৃত্যুর সময় বাজারে ছিল না।
পরিতোষের আত্মাকে সতীশচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলেন, স্বর্গে ‘‘তুমি কি স্পঞ্জ রসগোল্লার আস্বাদ পাইবে?’’
উত্তর এল, ‘‘না। সাধারণ রসগোল্লার তৃপ্তি পাইব।’’
প্রেত অধিবেশনের শেষে সতীশচন্দ্র লিখে রাখলেন অভ্রান্ত উপসংহার, ‘‘বুঝিলাম আত্মারা স্মৃতির সাহায্যে আস্বাদজনিত তৃপ্তি পাইয়া থাকে।’’
এর পরের আরেক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে অন্য এক জায়গায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, সতীশচন্দ্রের প্রেতচক্রে নয় জন বিদেহী আত্মা ডাব ও আম দিয়ে ভোজ সারছেন। আর ছেলের উদ্দেশে নিবেদিত চমচম, অনাহুত আত্মা নিঃশেষ করে দিলে, ছেলের আত্মা প্রেতচক্রে ধরা দিয়ে বলছে, ‘‘তারা শালা সব নষ্ট করিয়াছে।’’
শুধু তাই নয়, আকস্মিক মৃত্যুর পর প্রেতচক্রে একবার নেমে এলেন পাড়ায় ‘ছোড়দি’ বলে পরিচিত জনৈক হেডমাস্টারের ভ্রাতুষ্পুত্রী। চক্রে তিনি এমন ‘চপলতা’ প্রকাশ করলেন যে, সতীশ্চন্দ্রের ঠোঁট স্পর্শ করে ফেলল আবির্ভূত মহিলার কান।
বিব্রত সতীশচন্দ্র বলে উঠলেন, ‘‘ছি: ছোড়দি!’’
হাসতে হাসতে হাততালি দিয়ে সেই আত্মা বলল, ‘‘এখন আপনি বকুন আর মারুন, কিছুতেই আমার আপত্তি নাই। আমি আমার কাজ হাসিল করিয়া লইয়াছি!’’
হালের বাঙালির স্মৃতির দরজায় টোকা দিলেই আজও বেরিয়ে পড়ে রাশি রাশি এমনই সব আশ্চর্য বিশ্বাসের কাহিনি।
আঠেরো শতকের শেষ তিন দশক থেকে উনিশ শতকের পাঁচের দশক পর্যন্ত প্রবলভাবে বহু বাঙালি মেতেছিলেন পরলোক আর প্রেতচর্চায়। তাকে ইংরেজিতে কেউ বলেছেন প্ল্যানচেট, ফরাসিতে সেটাই আবার ‘সেঅন্স’। এরই অন্য নাম— ‘চক্র’, ‘সার্কল’ অথবা ‘পিঠাসন’।
ডাক্তার, গৃহবধু, সন্ন্যাসী, ব্যারিস্টার, বিচারপতি, বিপ্লবী, সাহিত্যিক, কবি, শিক্ষক, সাংবাদিক, প্রকাশক, সমাজসংস্কারক— কে নেই সেই কৌতূহলী, অনুসন্ধিৎসু প্রেতপিয়াসী বাঙালির তালিকায়! অনেক সময়, বিদেহী আত্মাকে মর্তে ডেকে আনতে প্রেতচক্রে সহায়ক হতেন প্রেত-আহ্বায়ক অর্থাৎ ‘মিডিয়াম’। তাঁর গলায় কখনও ভেসে আসত বিদেহী আত্মার পরিচিত কণ্ঠস্বর, অদৃশ্য হাতে কখনও বেজে উঠত পিয়ানো। কখনও আভির্ভূত হত প্রয়াত মানুষের ছায়ামূর্তি। কখনও অধিবেশনে উপস্থিত জনদের প্রশ্নের উত্তরে ‘স্বয়ং-লিখন’-এ ফুটে উঠত বিদেহী আত্মার উত্তর। কখনও অনুভব করা যেত বিদেহী আত্মার হাতের ছোঁওয়া অথবা অযাচিত স্নেহের অত্যাচার। চক্র চলার সময় বহু ‘মিডিয়াম’ মূর্চ্ছা যেতেন, অথবা থাকতেন তন্দ্রাচ্ছন্ন। অধিবেশনের মধ্যে তাঁদের অনেকের আচরণ চলে যেত নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কখনও ভয়ংকর অসুখ, কখনও মৃত্যু তাড়া করত তাঁদের। মদ্যপ কেউ চক্রে বসার অনুমতি পেতেন না। জানা যায়, সূক্ষ দেহ ধারণ করা আত্মারা মর্ত্যবাসীদের সূক্ষ দেহই দেখতে পেত শুধু।
তান্ত্রিক সাধনার বাইরে, অবিভক্ত বাংলায় ঠিক কবে থেকে প্রেতচর্চা শুরু হল, নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে বহু বইপত্র, বিজ্ঞাপন, সংবাদপত্র থেকে বাঙালির প্রেতচর্চার মোটের উপর একটা ছবি ভেসে আসে।
১৮৭৯ সালে প্রকাশিত তেমনই একটি বই হল ‘ইহলোক পরলোক’। সেখানে নির্দিষ্ট করে বলা রয়েছে রাস্তা বা গলি থেকে দূরে, কেমন হবে চক্রকক্ষের পরিবেশ অথবা তার মাপ। ক্ষমতাশালী মিডিয়াম না হলে বড় ঘরে চক্র না বসানোর, চক্রে দু’একজন মহিলা বা কোমল প্রকৃতির মানুষকে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আগ্রহীদের ইংল্যান্ড আর আমেরিকায় গিয়ে কিছু দিন প্রেতবিদ্যা চর্চা করার উৎসাহ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘‘তথায় ছয় মাসে আমরা যা শিখিব ও দেখিব তাহা এদেশে দশ বৎসরেও সম্ভব হইবেনা।’’
জানা যায়, রাজা দিগম্বর মিত্র ছিলেন পরলোকবাদী। কেশবচন্দ্র সেনও আমেরিকায় গিয়ে পরলোকবাদীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন।
১৯২৭-এ প্রকাশিত হয়েছিল কেশবচন্দ্র সেনের বই ‘পরলোকের সন্ধানে’।
‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষের আট ভাইয়ের একজন, হীরালাল, আত্মহত্যা করে মারা গেলেন ১৮৬৫-তে।
তখন তাঁদের বিদ্ধস্ত মা, বড় ছেলেকে বললেন, যদি পৃথিবী থেকে পরলোকে যাওয়া মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সম্ভাবনা নাই থাকে, তবে সকলকে হয়তো হীরালালের মতো আত্মহত্যার পথেই যেতে হবে। শিশিরকুমারও খুঁজে বেড়ালেন মায়ের কষ্টের কারণ। তাঁর মনে হল, কাছের বন্ধু আর আত্মীয়েরা যখন দূরদেশে যায়, সেই চলে যাওয়ায় মৃত্যুর মতো এত প্রবল শোকের উদয় হয় না এই ভেবে যে, দূরে যাওয়া মানুষ এক সময় ঠিক ফিরে আসবেন।
শিশিরকুমার ভাবলেন, পরলোকে যাওয়া মানুষের বিষয়েও ঠিক তেমনই একটা আশ্বাস পাওয়া গেলে হয়তো মৃত্যুশোক কমানো যাবে। মৃত্যু সহজ মনে হবে। মৃত্যুভয়ও আর থাকবে না।
সেই আলোর খোঁজে শিশিরকুমার যখন ইংল্যান্ড অথবা আমেরিকার যাওয়ার কথা ভাবছেন, তখনই তাঁর দেখা হল অধ্যাত্মবাদীদের একজন— প্যারীচাঁদ মিত্রের সঙ্গে। পরপর বেশ কিছু শোক পেয়ে প্যারীচাঁদ যখন পরলোকচিন্তায় ডুবে আছেন, কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক হিসেবে তাঁর হাতে এসেছিল পাশ্চাত্যে পরলোকচর্চার বেশ কিছু বইপত্র।
অস্ট্রেলিয়া থেকে কলকাতায় আসা এক ফরাসি হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের বাড়িতে প্রেতচক্রের আসরে যেতেন প্যারীচাঁদ। তাঁর বউ আর ছেলেদের ‘মিডিয়াম’ করেও চলত প্রেত-আহ্বানের অধিবেশন।
প্যারীচাঁদ আর তাঁর কয়েক জন সমমনস্ক বন্ধু মিলে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইউনাইটেড অ্যাসোসিয়েশন অব স্পিরিচুয়ালিজম’।
এ দিকে ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’-র উদ্যোগে প্রকাশিত হতে থাকে সমিতির মুখপত্র ‘দ্য থিওজফিস্ট’।
প্যারীচাঁদের প্রভাবে কলকাতায় বসেই প্রেত-আহ্বানে উৎসাহী হন শিশিরকুমার ঘোষ। পরলোকতাত্বিকদের অন্যতম হীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখছেন, ১৮৮১ সাল থেকে শুরু করে ডাক্তার পিবলস, এগলিনটনের মতো বিখ্যাত প্রেততাত্ত্বিকেরা কলকাতায় এসে আশ্চর্য সব কাণ্ড দেখিয়েছিলেন। লিখছেন, ‘‘স্বনামধন্য প্যারীচাঁদ মিত্র, মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, দেশপূজ্য শিশিরকুমার ঘোষ প্রভৃতি ঐ সকল ঘটনার প্রত্যক্ষকারী। অতএব ঐ ঐ ঘটনা ভোজবাজি বলিয়া উড়াইয়া দিবার সম্ভাবনা নাই।’’
১৯৩৩-এই, লেড বিটারের বই ‘অন দ্য আদার সাইড অব ডেথ’ হীরেন্দ্রনাথ দত্তের অনুপ্রেরণায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন হরিদাস বিদ্যাবিনোদ।
নারী আর পুরুষের ‘আনন্দের সম্বন্ধ’’ আর ‘মিলনের আকাঙ্ক্ষা’ পরলোকেও কি দেখা যায়? নিজস্ব প্রেতচক্রে একবার মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মার কাছে জানতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্ল্যানচেটের রীতিমতো চল ছিল। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য ঘটনাবলির মধ্যে দুটি চিঠির উল্লেখ করা যায়।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিষয়ে কিছু মনে আছে কি না, জানতে চাওয়ায় প্রমথনাথ বিশিকে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘আমি তাঁকে দেখিনি, একবার প্রেতবাণী চক্রযানে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সেটা আদালতে সাক্ষ্যরূপে গ্রাহ্য হবে না।’’
১৯২৯-এ রানি মহলানবিশকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘‘সেদিন বুলা এসেছিল। হঠাৎ কথায় কথায় প্রকাশ পেল তার হাতে প্রেতাত্মা ভর করে, পেন্সিল চালিয়ে কথা কইতে পারে। বলা বাহুল্য শুনে মনে মনে হাসলাম. বললুম— আচ্ছা দেখা যাক।’’
সে বছরেরই শেষের দিকে শান্তিনিকেতনের উদয়ন আর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রায় দু’মাস, ধারাবাহিকভাবে তাঁর বিদেহী প্রিয় বন্ধু ও আত্মীয়দের ডেকে এনে কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
নানা সময় তাঁর সঙ্গে থাকতেন অবনীন্দ্রনাথ, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, অজিতকুমার চক্রবর্তী ও অন্য কেউ কেউ।
বন্ধু মোহিতচন্দ্র সেনের কবি ও সুন্দরী কন্যা উমা ছিলেন সেই সব অতীন্দ্রিয় অধিবেশনের ‘মিডিয়াম’। যার ডাক নাম ছিল বুলা। মাত্র সাতাশ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
নতুন বৌঠান কাদম্বরী, স্ত্রী মৃণালিনী, পুত্র শমী, কন্যা মাধুরীলতা, নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মতোই প্রেত-অধিবেশনে একদিন এলেন বিদেহী সুকুমার রায়। তাঁর গানের সমঝদার সুকুমারের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ধরলেন ‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়…’। মাঝপথে থেমে গেলেন গানটার কথা ভুলে! সুকুমারের আত্মা রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করে বসল, ‘‘আমার ছেলেকে আপনার আশ্রমে নিতে পারেন?’’
সুকুমারের এই ইচ্ছের কথা তাঁর স্ত্রী সুপ্রভাকে জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। এই কথা শুনে কিছু দিন ছেলেকে নিয়ে কবির শান্তিনিকেতনে কাটিয়েও যান সুপ্রভা। কিন্তু সদ্য বাবা-হারানো ছেলেকে কী ভাবে আর একা ছেড়ে আসেন সেখানে! কিন্তু এর ঠিক দশটা বছর পর দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের আশ্রমে সত্যজিৎকে পড়তে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সুপ্রভা রায়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম স্ত্রী মোহিনীর মৃত্যুর পর বিয়ে করেন রাজলক্ষ্মীকে। পরিণত জীৱনে তিনিই দেখতেন প্রথম স্ত্রীর ছায়া। আত্মীয় সুরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে বলতেন, ‘‘তোর সেজদিকে দেখেছি রে… আমিও এবার তার কাছেই যাব।’’
শাশুড়ির মৃত্যুর পর প্ল্যানচেট শুরু করা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে চিঠিতে বিভূতিভূষণ লিখলেন, বৃহদারণ্যক ও ঈশোপনিষদের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন পৃথিবীর বহু উপরে বহু স্তরের অস্তিত্ব রয়েছে। আর প্রেতলোকের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ করার কিছু নেই।
স্বামী বিবেকানন্দের উৎসাহে স্বামী অভেদানন্দ, আঠেরো শতকের শেষে পাশ্চাত্যে গিয়েছিলেন বেদান্ত দর্শন প্রচার করার জন্য। আমেরিকার প্রথম সারির প্রেততাত্ত্বিকের সঙ্গে তাঁর ভাবনার আদানপ্রদান হয়। প্রায় দুই দশকের প্রবাসজীবনে পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত পরলোকচর্চার কেন্দ্রগুলোতে দেওয়া তাঁর বক্তৃতা সমাদৃত হয়েছিল। মরণের পরে আত্মা কোথায় যায়, এই প্রশ্নের উত্তরে সাংখ্যকার কপিল আর অন্যান্য হিন্দুদার্শনিকদের সুরেই একবার অভেদানন্দ বলেছিলেন, মৃত্যুর পর পঞ্চপ্রাণ, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির মতো সতেরোটা উপাদানে তৈরি সূক্ষ্মদেহ ধারণ করে আত্মা যায় স্বপ্নলোকের মতোই মনলোকে।
মালদহের ইংরেজবাজারের কলাতলা। সেখানে শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের মেজদা অসুস্থ। সেবা চলছে পালা করে। সজনীকান্তকে ঘুম থেকে তুলে দাদার পাশে বসিয়ে বাবা গেলেন ছাদে আর গিয়েই বললেন, ‘‘আজই সব শেষ হয়ে যাবে।’’ শেষ রাতে ছেলের মাথার কাছে লাল আলো দেখলেন বাবা। বিছানায় উঠে বসে ছেলে বলল, ‘‘আমি যাচ্ছি।’’ তারপরই উধাও সেই লাল আলো। পরদিন দুপুরের আগেই মারা গেলেন মেজদাদা।
আচার্য ব্রজেন্দ্রলাল শীল মৃত্যুর পর জরুরি কাগজপত্র খুঁজে পেয়েছিলেন প্রয়াত স্ত্রীর স্বপ্নে দেখানো ঠিকানায়। জ্যোতিষশাস্ত্রের মতোই প্ল্যানচেটে আস্থা রেখেছিলেন সাহিত্যিক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৮৭৫-এ আমেরিকায় ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন হেলেনা পেত্রোভনা ব্লাভাৎস্কি, কর্নেল হেনরি স্টিল অলকট-এর মতো কয়েকজন পরলোকবাদী। ১৮৭৮-এ ব্লাভাৎস্কি আর অলকট চলে আসেন বম্বেতে। সেখান থেকেই নানা দেশে ছড়িয়ে দেন এই সমিতির শাখা।
প্রতিষ্ঠার সময় সমিতির প্রচারিত লক্ষ্যের অন্যতম ছিল, ব্যাখ্যার অতীত প্রাকৃতিক নিয়ম আর মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তি খুঁজে বের করা।
ব্লাভাৎস্কি আর অলকট মারা যাওয়ার পর ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’-র সভাপতি হন অ্যানি বেশান্ত। ১৮৮২-তে কলকাতায় গড়ে ওঠে তার শাখা। এই সমিতির পরিচালনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর আর দিদি স্বর্ণকুমারী।
এই সমিতির সদস্যরা বিশ্বাস করতেন আত্মা অমর এবং অবিনশ্বর। বিশ্বাস করতেন, পার্থিব জন্মে আত্মা বাসা বাঁধে স্থূলদেহের ভিতর। মৃত্যুর পর কখনও ক্ষণস্থায়ী, কখনও দীর্ঘ মৃত্যু-মূর্ছার শেষে আত্মা চলে যায় সূক্ষ্মলোকে, দিব্যজীবন লাভের চেষ্টায়।
প্রেতচক্রে আগ্রহ থাকা বাঙালিদের অনেকেরই পরলোক নিয়ে বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল সনাতন ভারতের তন্ত্রসাধনা, জ্যোতিষশাস্ত্র, সাহিত্য, দর্শন আর আধ্যাত্মিক চিন্তাকে ভিত্তি করে। সেই উৎসাহে প্রশ্রয় দিয়েছিল ‘থিওসফিকাল সোসাইটি’ প্রচারিত পশ্চিমি দুনিয়ার নানা অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব আর ঘটনার বিচিত্র সব বিবরণ।
শুধু নিভৃত প্রেতসাধনায় থেমে না থেকে প্রেতচর্চার তত্ত্ব আর অভিজ্ঞতার কথা লিখে গিয়েছিলেন অনেকেই। প্রেতচর্চার দৌলতে বাংলায় তৈরি হয়ে গিয়েছিল কিছু পরিভাষাও।
২০ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ছিল অবনীন্দ্রনাথের জামাই, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন ছাপাখানা। ‘কান্তিক প্রেস’। তার দোতলার ঘরে বসত প্ল্যানচেটের আসর। থাকতেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সাহিত্যিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
একদিন সেখানেই প্রেত-অধিবেশনে এল রবীন্দ্রনাথের প্রিয়, শান্তিনিকেতন আশ্রমবিদ্যালয়ের অকালপ্রয়াত শিক্ষক সতীশচন্দ্র রায়ের আত্মা।
আত্মা জানাল, আসরে উপস্থিত সকলের মধ্যে স্বল্পায়ু অজিতকুমার চক্রবর্তী মারা যাবেন সকলের আগে।
সত্যিই অজিতের মৃত্যু হয়েছিল অকালেই। ইনফ্লুয়েঞ্জায়। কলকাতা শহরে।
প্রেতচর্চার বিষয়ে ‘কান্তিক প্রেস’ থেকে ছাপা মণিলালের বই ‘ভুতুড়ে কাণ্ড’ তুমুল জনপ্রিয় হয়।
আত্মারা মানুষের ডাকাডাকিতে উত্যক্ত হয় জানিয়ে মণিলালের চক্রে হাজির হওয়া এক আত্মা বলেছিল, ‘‘দেখো, আজ তোমরা প্রেতাত্মা লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছ, অনেককে তোমরা শাস্তির ভাগী করিতেছ; যখন তোমাদের মৃত্যু হইবে,—তখন সেই সব আত্মা তোমাদের উত্যক্ত করিবে, — তোমাদের লইয়া ছেঁড়াছিঁড়ি করিবে।’’
অকালে মেয়ে রমাকে হারিয়ে প্রেতচর্চায় হাতপাকানো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুরেন্দ্রনাথ মিত্র লিখে ফেলেছিলেন তাঁর নিজের বই— ‘লোকান্তর’। ১৯৪৪-এ প্রকাশিত সেই বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, সত্যি সত্যি চোখে দেখতে না পেলেও প্রতিদিনের অধিবেশনে যেন মেয়ের সত্যিকারের রূপই দেখেছেন তিনি। যেন শুনেছেন একেবারে নিজের মেয়ের কথাই।— ‘‘যেন পাশাপাশি বসেই আমরা তোমার সঙ্গে কথা কয়েছি।’’
এক সময় অনির্দিষ্ট, অমীমাংসিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, বাঙালির প্রেত-বৈঠক কখন যেন হয়ে উঠেছিল অসহায়, স্বল্পায়ু, স্থূলদেহী জীবন আর অচেনা পরলোকের সেতু। এটাই কিন্তু চেয়েছিলেন থিওসফিস্টরা।
১৯৪৫। পরলোকে উৎসাহী রাজেন্দ্রলাল ভট্টাচার্য প্ল্যানচেটে ডেকে আনলেন রবীন্দ্রনাথের আত্মাকে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ নাকি জানিয়েছিলেন, জনাকয়েক অবাঙালির হাত ধরে পরলোকে কুয়াশাচ্ছন্ন, অন্ধকার এক এলাকা থেকে ক্রমশ এসেছেন তীব্র আলোয় ধুয়ে যাওয়া স্থানে। দিলীপকুমার রায় আর রজনীকান্ত নতুন গান লিখে কবিকে পরলোকে স্বাগত জানিয়েছেন। দেখা হয়েছে বাবা মহর্ষিদেবের সঙ্গেও। চারপাশে আশ্চর্য সুন্দর সব ফুল আর পাখি। রাজেন্দ্রলাল পরলোক নিয়ে বই লিখবেন শুনে রবীন্দ্রনাথের আত্মা বলছিল, ‘‘তুমি তোমার বইতে লিখে রেখো যে এইখানে ভয় পাবার কিছুমাত্র নেই।’’
তারপরও আরও কথা, ‘‘অবশ্য আমি যে স্তরে আছি নিজের সুকৃতির ফলেই লোক সেখানে আসতে পারে।’’ রবীন্দ্রনাথের আত্মা চলে যাওয়ার সময় তেপায়া নড়ে ওঠে। রাজেন্দ্রলালের এই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে ছাপা হয়েছিল তাঁর বই, ‘মৃত্যুর পরপারে’।
প্রেতচক্রে আগ্রহীদের অনেকেই বিশ্বাস করতেন ইহলোক আর পরলোকে আছে অস্তিত্বের সাতটি করে স্তর।
১৯৫৩-য় প্রকাশিত ‘পরলোক সমীক্ষণ’-এ ‘চক্রপতি’ ফণিভূষণের নানা অধিবেশনের বর্ণনায়, এক আত্মা জানাচ্ছে, নিম্নস্তরের আত্মারা খেতে পায় না, আর অস্তিত্বের পঞ্চম স্তরে মেলে জলের দেখা।
প্ল্যানচেট-এ ‘সত্য বিবরণ’ নিবেদন করে ফণিভূষণ লিখছেন, ‘‘ইহাতে পরলোকবাসীর অদ্ভুত ক্রিয়া দেখিয়া চক্র করিবার আকাঙ্খা হইবে এবং চক্র করিলে দেখিতে পাইবেন ইহা কত সত্য।’’
প্রেতবৈঠকের আসরে যেমন শোনা যেত পরিচিত, মৃত মানুষের কণ্ঠস্বর, তেমনই পরিচিত পোশাকেও দেখা যেত কাউকে কাউকে। আত্মারা মর্ত্যে এসে এঁকে যেত ছবি, গেয়ে যেত গান।
প্রেতচক্রীদের কেউ কেউ দেখেছিলেন, জীবদ্দশায় সৃজনে অতৃপ্ত আত্মাদের নিজেদের প্রকাশ করার প্রবণতা ছিল বেশি। দেখা যায় প্রেতচক্রে ধরা দেওয়া আত্মারা পৃথিবীতে থাকতে চাইছে না বেশিক্ষণ। তাদের মুখে শুধুই যেন ‘যাই আর যাই’!
প্রেত-আহ্বায়করা বিদেহী আত্মাদের কাছে যেমন জানতে চাইতেন পরলোকের কথা, কঠিন রোগের ওষুধ, হারানো সম্পত্তির হদিশ, তেমনই চাইতেন অনির্দিষ্ট মর্ত্য জীবনের ভবিষ্যৎ পথ নির্দেশ।
ধর্ম নির্বিশেষে ধরা দিত আত্মারা, যদিও ‘হিন্দুচক্র’ জাতীয় প্রেতবৈঠকের উল্লেখও পাওয়া যায়। পদ্ধতিগতভাবে বৈচিত্রময় হলেও প্রেতবৈঠকের মূল ভাবনা ছিল পরলোক আর অবিনশ্বর আত্মায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখে একসঙ্গে কোথাও মিলিত হয়ে মনঃসংযোগের মাধ্যমে বিদেহী আত্মাকে মর্ত্যে ডেকে আনা। অগণিত বিশ্বাসীরা প্রেতচর্চায় আস্থা রেখেছিলেন।
তবে এইসব অভ্যাসকে ‘বুজরুকি’ অথবা ‘ভূত নাবানো’ আখ্যা দিয়ে বিদ্রুপ করতে ছাড়েননি কালীপ্রসন্ন সিংহের মতো লেখক তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য়।
অথচ প্রেতচর্চার টান এক সময় কী যে প্রবল ছিল! তার ছোট্ট একটা নমুনা এই রকম— স্ত্রী-পুত্রের মৃত্যুর পর পরলোকের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন শার্লক হোমসের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল। ইংল্যান্ডে British College of Psychic Science -এর কাছেই একটা ঘরে তাঁর সঙ্গেই কয়েকটা প্রেতবৈঠক করে এসেছিলেন এক প্রেততাত্ত্বিক বাঙালি।
তবে পরলোক-উৎসাহীদের উদ্দেশে মোক্ষম প্রশ্নটা কিন্তু রেখে গিয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির এক খাজাঞ্চি কৈলাস মুখুজ্জেই।
‘জীবনস্মৃতি’- তে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, পরলোকের ব্যবস্থা কেমন, গুরুজনেরা প্ল্যানচেটযোগে একবার স্বভাব-রসিক কৈলাসকে এই প্রশ্ন করলে উত্তর এসেছিল, ‘‘আমি মরিয়া যাহা জানিয়াছি আপনারা বাঁচিয়াই তাহা ফাঁকি দিয়া জানিতে চান? সেটি হইবে না।’’
প্ল্যানচেট কিন্তু আসলে ছিল প্রেতচক্রে ব্যবহার করা এক যন্ত্র। ১৯০৮ সালে ছাপা, সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য তাঁর বই ‘প্রেত-তত্ত্ব’-য় প্ল্যানচেট যন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে : ‘প্ল্যানচেটের আকার পানের ন্যায়। এক খানি কাষ্ঠনির্মিত সিকি ইঞ্চি বেধবিশিষ্ট তক্তাদ্বারা নির্মিত। তক্তার একদিকে একটি শিসক পেন্সিল সংলগ্ন থাকে, অপর দুইদিকে বোতামের ন্যায় দুইখানি হাড়ের চাকা এমন কৌশলের সহিত সংলগ্ন থাকে যে, ঐ যন্ত্র যে দিকে ইচ্ছা অনায়াসে নড়িতে পারে।’
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, কলকাতার পঞ্জিকায় পাতা-জোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে ফকিরচাঁদ চক্রবর্তী লেনের এফ.সি সরকার মাশুল-সমেত তিন টাকায় বিক্রি করতেন ‘প্ল্যানচেট বা অতি আশ্চর্য্য ভৌতিক যন্ত্র’।
বাংলা তেরোশো পঁচিশ সনের ছয় অগ্রহায়ণ।
প্রথমা স্ত্রী গৌরী দেবী ও শাশুড়ি কামিনী দেবী ইনফ্লুয়েঞ্জার আক্রমণে একই রাত্রে প্রয়াত হলেন। কিছুদিন পরেই বিভূতিভূষণের ছোট বোন মণি সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা গেলেন। বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থার মধ্যে বিভূতিভূষণ এক সন্ন্যাসীর দেখা পেলেন। কথায় কথায় সন্ন্যাসী জিজ্ঞেস করলেন তিনি মৃতা স্ত্রীকে দেখতে চান কিনা। সন্ন্যাসীর শাস্ত্রজ্ঞান দেখে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। কয়েকদিন যাতায়াতের পর গৌরীকে দেখার ইচ্ছে সন্ন্যাসীর কাছে প্রকাশ করলেন। সন্ন্যাসীই তাঁকে মণ্ডল – অর্থাৎ প্ল্যানচেটের – পদ্ধতি শিখিয়ে দিলেন।
কিছুদিনের মধ্যেই প্ল্যানচেট নিয়ে মেতে উঠলেন বিভূতিভূষণ। কিন্তু পরে সেই সন্ন্যাসীকে আর খুঁজে পেলেন না। লোকের কাছে শুনলেন তিনি তীর্থভ্রমণে গিয়েছেন। অগত্যা নিজের উৎসাহে তিনি খুঁজে বের করলেন অন্য এক আস্তানা – কলেজ স্কোয়ারের থিওসফিকাল সোসাইটি। সেখানকার সভ্য হিসেবে নাম লেখালেন তিনি। আত্মা ও পরলোক বিষয়ক দেশবিদেশের বিভিন্ন বই, পত্রপত্রিকার নাগাল পেলেন সেখানে। রবীন্দ্রনাথ থেকে দীনবন্ধু মিত্র, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শিশিরকুমার ঘোষের প্ল্যানচেটচর্চার খবর জানতে পারলেন। সেখানকার প্ল্যানচেটের আসরেও যোগ দিলেন। টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘অন দি সোল’ বইখানাকে মনে হল মৃত্যু আঁধারে এক জ্যোতিশিখা।
প্ল্যানচেটের উৎসাহের সঙ্গেই আত্মার পরমতত্ত্ব জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন বিভূতিভূষণ। নতুন এক জগতের দরজা খুলে যাচ্ছে তাঁর সামনে। কিন্তু সাংসারিক বাধ্যতা তো এড়ানোর উপায় নেই। হুগলীর জাঙ্গিপাড়া গ্রামে দ্বারকানাথ হাইস্কুলে সহকারী প্রধানশিক্ষকের চাকরি নিয়ে যেতে হল তাঁকে। তাঁর মুখে প্ল্যানচেটের কথা শুনে সেখানেও স্থানীয় কিছু মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠলেন। স্কুলবাড়িটা ভিড়ের বাইরে। অতএব সূর্যাস্তের পর সেখানেই আসর বসতে শুরু করল। বিভূতিভূষণের বন্ধু ইস্কুলের অস্থায়ী প্রধানশিক্ষক বৃন্দাবন সিংহরায়ও সেই আসরে যোগ দিলেন।
কিন্তু গ্রামের একটা শিবিরে এই নিয়ে বিক্ষোভ দেখা দিল। তাদের আর্জি পৌঁছল শ্রীরামপুরের সাব-ডিভিশনাল অফিসারের কাছে। ব্যাপার খতিয়ে দেখতে এক সরকারি কর্তা এলেন। বিভূতিভূষণের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর তাঁর বিশ্বাসকে একরকম চ্যালেঞ্জই জানালেন এই পরিদর্শক – প্ল্যানচেটে বসবেন তিনিও, আত্মা আনতে পারবেন কি বিভূতিভূষণ? বিভূতিভূষণের পিছিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। আসর বসল। মিডিয়ামের হাতে নড়ে উঠল পেনসিল। হার মানলেন পরিদর্শক।
‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ এবং ‘দেবযানে’র লেখক পরলোক এবং জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। জীবনের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী তাঁর হয়তো অবিশ্বাস করার উপায়ও ছিল ন । প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’-র প্রকাশের সময় (পরে এই অংশটি বাদ যায়) তার মধ্যেও ছিল সেই অপার্থিবের ছায়া – ‘এ আমি কাকে দেখলুম বলব? আমাদের এই পৃথিবীর জীবনের বহু ঊর্ধ্বে যে অজ্ঞাত রাজ্যে অনন্তের পথের যাত্রীরা আবার বাসা বাঁধবে, হয়তো সে দেশের আকাশটা রঙে রঙে রঙিন, যার বাতাসে কত সুর, কত গন্ধ, কত সৌন্দর্য, কত মহিমা, ক্ষীণ জ্যোৎস্না দিয়ে গড়া কত সুন্দরী তরুণীরা যে দেশের পুষ্পসম্ভার-সমৃদ্ধ বনে উপবনে ফুলের গায়ে বসন্তের হাওয়ার মতো তাদের ক্ষীণ দেহের পরশ দিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই অপার্থিব দিব্য সৌন্দর্যের দেশে গিয়ে আমাদের এই পৃথিবীর মা-বোনেরা যে দেহ ধারণ করে বেড়াবেন – এ যেন তাঁদের সেই সুদূর ভবিষ্যৎ রূপেরই একটা আভাস আমার বউদিদিতে দেখতে পেলুম।’
স্বভাব-উদাসীন এই মানুষটি নিজের লেখার বিরূপ সমালোচনা নির্লিপ্তভাবেই নিতেন, কিন্তু অতিলোকচিন্তা নিয়ে তর্ক উঠলে নিজের অভিজ্ঞতায় ভর করে সোচ্চার হয়ে উঠতেন। সজনীকান্ত দাস তাঁর আত্মস্মৃতিতে বলেছেন – “আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, আচারে ব্যবহারে কালাপাহাড় বলে অখ্যাতিও আছে।” পরলোকচর্চার জন্য বিভূতিভূষণকে তীব্র ব্যঙ্গ করতেন জানিয়ে তিনি আরো বলেছেন – “পথভ্রষ্ট(?) বৈজ্ঞানিকদের আলোচনায়ও দেখিয়াছি এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে অনেক তত্ত্ব জানিয়াছি। বিভূতিকে বাহির হইতে কখনও আমল দিই নাই, ঠাট্টা করিয়া তাহার দৃঢ় বিশ্বাসকে উড়াইয়া দিয়াছি ; কিন্তু ভিতরে ভিতরে ফল্গু ধারার মতো মৃত্যু পরপারের এই টুকরা রহস্যটি আমাকে বরাবরই প্রভাবিত করিয়াছে আর বিভূতিকে স্বীকার করিয়াছি।” এই ‘টুকরা রহস্য’ বলতে যে ঘটনা, তা ঠিক প্ল্যানচেটের ব্যাপার না হলেও এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া যায়। সজনীকান্তের মেজদার মৃত্যুর আগে তাঁর বাবা রুগ্ন পুত্রের শিয়রে জেগে ছিলেন। শেষ প্রহরে দেখলেন একটা অস্বাভাবিক লাল আলোয় ঘর ভরে গেল আর মুমূর্ষু পুত্র উঠে বসে কাকে যেন বলল – এই যে আমি যাচ্ছি। এই ধরণের অভিজ্ঞতা সজনীকান্তের বাবার জীবনে প্রথম নয়। তিনি বুঝলেন তাঁর অজু চলে যাচ্ছে। এবং তাই হল। কিন্তু তার পরদিন দুপুরে যা ঘটল, সজনীকান্তের বিবরণে – “হঠাৎ বাবা কী দেখিয়া মাকে ডাকিলেন – আমরাও তাকাইলাম, আমরা সকলেই বিস্ময়ে বিমূঢ় হইয়া দেখিলাম, মেঝের ঠিক মাঝখানে রক্ষিত একটি চেয়ারে একটা লাল আলোয়ান গায়ে জীর্ণ শীর্ণ মেজদাদা আসিয়া বসিয়াছেন। মা – ‘বাবা আমার’ বলিয়া মূর্ছিত হইয়া পড়িলেন, পরক্ষণেই দেখি সে অন্তর্ধান হইয়াছে।”
প্ল্যানচেট ছাড়া আরো অনেক ঘটনায় বিভূতিভূষণ পরলোকের ছায়া দেখেছিলেন। পুত্র তারাদাস যখন আড়াই বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হল, তখন তিনি দেখেছিলেন আদরের বাবলুকে কে যেন নিয়ে যেতে এসেছে। নিজের আয়ুর বিনিময়ে পুত্রের প্রাণ চেয়ে নিয়েছিলেন তিনি। নিজের মৃত্যুর আগে ধারাগিরিতে বেড়াতে গিয়ে একদিন একটি মড়ার খাটিয়া দেখতে পান, শবের মুখের কাপড় সরিয়ে নিজেরই মৃতদেহ প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
তবে প্ল্যানচেটকে তার প্রাপ্য গুরুত্বের বেশি দিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর শাশুড়ির মৃত্যুর পর প্ল্যানচেট শুরু করেন। সেই সময় এক চিঠিতে বিভূতিভূষণ তাঁকে লেখেন – “প্রেতলোকের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ করবার কিছু নেই। পৃথিবীর ঊর্ধ্বে বহু স্তর বিদ্যমান, বিশ্বে বহু লোক, বহু স্তর, বহু গ্রহ, মৃত্যুর পর যেখানে জীবনে গতি হয়। এই সব ‘সুপারমানডেইন ওয়ার্ল্ডসে’ আছে এবং ঋষিরা প্রাচীন যুগে তাদের অস্তিত্ব জেনেছিলেন। বৃহদারণ্যক ও ঈশোপনিষদে এদের কথা আছে। এগুলির আকর্ষণ অতি তীব্র – পৃথিবীর জীবনের পরে যখন এই সব লোকে গতি হয় তখন পৃথিবীর আনন্দ এদের আনন্দের কাছে তুচ্ছ বলে মনে হয় বটে, কিন্তু সেই আসক্তি বা কামনাই পুনর্জন্মের বীজ বপন করে।
প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে এই সব বিভিন্ন লোকালোকের আসক্তি ও মায়া কাটিয়ে সর্বলোকাতীত বিশ্বসত্তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার চেষ্টা। ভগবানকে পাওয়া এরই নাম। ধর্মজীবনের আরম্ভ তখনই হবে যখন আমাদের মন নিরাসক্ত হবে জাগতিক রসাকাঙ্ক্ষায়। তাঁকে জানলেই সব জানা হল । নতুবা প্রেতলোকের আবিষ্কারের আর নতুন একটা দ্বীপ আবিষ্কারের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। দুটোর কোনটাই আধ্যাত্মিক ঘটনা নয় ।”
বিভূতিভূষণ, প্রকৃতপক্ষে, এই আধ্যাত্মিক জীবনের সন্ধানী ছিলেন।
বিভূতিভূষণের পরলোকচর্চা নিয়ে সবচেয়ে রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছিল শিবরাম চক্রবর্তী’র।
সেবারও বেজায় টাকার টানটানি। শেষে কাবুলিওলার থেকে ধার করবেন কি না ভাবছেন। খবর পেলেন বিভূতিভূষণ।
তখনও দুইজনের মধ্যে তেমন ভাল পরিচয়ও নেই। তবু বিভূতি নিজেই সেধে বললেন, ‘‘কেন ভাই কাবুলির থেকে ধার করবেন? কত টাকা চাই আপনার?’’
শিবরাম অম্লানবদনে বললেন, ‘‘এই ধরুন টাকা পঞ্চাশেক পেলেই আপাতত চলে যাবে।’’
‘‘এই নিন টাকা, ওসব কাবুলির থেকে নিতে হবে না। ওদের বড্ড চড়া সুদ,’’ বলে বিভূতিভূষণ পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বার করে দিয়ে দিলেন।
সলজ্জ শিবরাম বললেন, ‘‘আপনার এই ঋণ আমি জীবনে শুধতে পারব না।’’
যথারীতি শুধতে পারেনওনি। মানে কখনও ইচ্ছে থাকলেও উপায় আর উপায় থাকলেও ইচ্ছে হয়নি আর কি! দু’জনে দেখা হলে বিভূতিভূষণ তার প্রাপ্য টাকার কথা তো কখনই তুলতেন না। শিবরাম যদিও বা কখনও বলতেন, ‘‘দাদা আপনার ওই টাকাটা এখনও বাকি…।’’
বিভূতি বলে দিতেন, ‘‘আরে থাক থাক সেসব কথা। পরে দেবেন।’’
‘‘বেশ তাহলে সুদটাই নিন। বলে টাকার বদলে দু’চার পয়সার তেলে ভাজা কিংবা চিনেবাদাম তুলে দিতেন বিভূতিভূষণের হাতে।’’ বিভূতি তাতেই খুশি।
আসলে টাকা পয়সার ব্যাপারে চিরকালই বিভূতিভূষণ ছিলেন বেজায় উদাসীন। খানিকটা শিবরাম গোছের, আবার খানিকটা একেবারেই অন্য ধারার।
টাকা হাতে পাওয়ার আগ্রহ যথেষ্ট, কিন্তু সে-টাকা একবার হাতে এসে গেলে সেগুলো যে খরচও করতে হয় কিংবা সঠিকভাবে জমানো, তার ব্যাপারে কোনই আগ্রহ ছিল না বিভূতিভূষণের। আর এখানেই শিবরামের সঙ্গে তাঁর চূড়ান্ত অমিল।
আধ্যাত্মিকতা, পরলোকচর্চায় খুবই আগ্রহ ছিল বিভূতিভুষণের। ‘দেবযান’ উপন্যাস নিয়েও তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল শিবরামের। পুনর্জন্মে খুব বিশ্বাস করতেন।
শিবরামকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি তো আর বিয়েথা করলে না। তোমার ছেলে মেয়ে নেই। আর সেই জন্যই তোমার পূর্বপুরুষরাও পূনর্জন্ম নিতে পারছেন না। আর তাদের পূনর্জন্ম না হলে তোমারও নতুন জন্ম নেওয়ার সুযোগ নেই। সবাই পর পর লাইনে আছেন কিনা। তাই তুমি বে থা না করে নিজে তো বটেই, তোমার আগের সাতপুরুষও বায়ূভূত হয়ে ঘুরবে। আমি বিয়ে করব এবার। ফিরতি বার্থ রিজার্ভেশন করে রাখা চাই বুঝলে ভায়া।’’
‘‘সে কি দাদা আপনি এই বয়েসে বিয়ে!’’
‘‘কেন সামান্য চল্লিশ বছর তো বয়স আমার।’’
শিব্রাম কিন্তু বিলক্ষণ জানতেন তখন বিভূতিভূষণের বয়স চল্লিশের অনেক বেশি।
বিয়ে করলেন বিভূতিভুষণ। তারপর অনেক দিন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ নেই শিবরামের। একবার দুর্গাপুজোর সময় শিবরাম গেলেন বিভূতিভুষণের ঘাটশিলার বাড়ি। পুজোর ছুটি ওখানেই কাটাবেন এমন ইচ্ছে।
গিয়ে দেখেন বেশ স্বাস্থ্যবান একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বিভূতিভুষণ বাগানে ঘুরছেন। শিবরাম বুঝলেন, শিশুটি বিভূতিরই। জিজ্ঞসা করলেন, ‘‘তা আপনার ঘাড়ে কি সেই ফেরবার টিকিট?’’
‘‘একদম ঠিক ধরেছ। ওর নাম দিয়েছি কাজল। ওর মাধ্যমেই তো আবার আমাকে ফিরতে হবে।’’
বিভূতিভুষণের সেই পারলৌকিক বিশ্বাস যে কতটা তীব্র ছিল, বারেবারে টের পেয়েছেন শিবরাম নিজে। মৃত্যুর কিছু দিন আগে এক শ্মশানে নিজের মৃতদেহকে নাকি নিজের চোখে দেখতে পেয়েছিলেন বিভূতিভুষণ। সে-ঘটনাও জানতেন শিবরাম। আর মৃত্যুর পর? সে এক অদ্ভুত ব্যাপার!
একদিন রিপন কলেজের বেশ কিছু ছেলে এসে শিবরামকে জানালেন, ‘‘আমরা এই বছর বিভূতিভূষণের জন্মদিন পালন করব, আপনাকে সভাপতি হতে হবে।’’
‘‘বেশ হব। কিন্তু অতিথি সৎকারের ব্যবস্থা থাকবে তো? মানে একটু ভাল মন্দ।’’
‘‘হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। স্বয়ং বিভূতিবাবুও আসবেন ওইদিন।’’
‘‘মানে? উনি আবার কী করে আসবেন? উনি তো পরপারে।’’ শিবরাম অবাক!
‘‘আজ্ঞে উনি আমাদের ত্রিকোণ চক্রে মাঝেমাঝেই আসেন। আমরা প্ল্যানচেট করে ডেকে আনি তাঁকে। কথাবার্তাও হয়।’’
‘‘বলো কি! তা জীবিত আর কাকে কাকে ডাকছ ওইদিন?’’
ছেলেরা বলল, ‘‘ভেবেছিলাম অনেককেই ডাকব, কিন্তু শেষ প্ল্যানচেটে বিভূতিবাবুই বললেন যাকেই ডাকো, কেউই আসবেন না।’’
‘‘তার মানে পরলোকে গিয়ে উনি তাঁর লেখকবন্ধুদের ভালমতই চিনেছেন। বেশ বেশ।’’
‘‘সেইজন্যই আমরা আপনার কাছে এলাম। আপনি অন্তত যাবেন আশা করি।’’
‘‘হ্যাঁ যাব বইকী। খাবার দাবারের ব্যবস্থা রাখবে বলছ যখন!’’
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওইদিন সেখানে গিয়েও যাননি শিবরাম। বাড়ির দরজা পর্যন্ত পৌঁছে ফিরে এসেছিলেন। এই বিষয়ে শিবরামের যুক্তি ছিল, বিভূতিবাবু যখন ভেবেই নিয়েছেন তাঁর জন্মদিনে কোনও বন্ধু আসবেন না, তখন তাঁর সেই বিশ্বাসে আঘাত করা ঠিক নয়। আর দ্বিতীয়ত সেই যে পঞ্চাশ টাকা ধার রয়ে গিয়েছিল সেটা এখন যদি তার অনুগত ভক্তদের মধ্যে বলে ফেলেন, সে ভারী লজ্জার ব্যাপার হবে।
তাই বিদেহী বিভূতিবাবুর সঙ্গে দেখা করার চেয়ে স্বদেহে ফিরে আসাটাই ঢের ভাল বলে মনে করলেন শিবরাম!
(তথ্যসূত্র:
১- মরণের পরে, স্বামী অভেদানন্দ।
২- পরলোক ও প্রেততত্ত্ব, স্বামী দিব্যানন্দ।
৩- অনন্তের লুকোচুরি, সুভাষ ঘোষাল।
৪- পথের কবি, কিশলয় ঠাকুর।
৫- Theosophy and the Theosophical Society, Annie Besant।
৬- প্ল্যানচেটে পরলোকের কথা, সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী।
৭- পরলোকের কথা, মৃণালকান্তি ঘোষ।
৮- মানুষ চিত্তরঞ্জন, অপর্ণা দেবী।
৯- রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা, অমিতাভ চৌধুরী।
১০- পরলোকবিচিত্রা, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ও অসিত পাল।
১১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৬ সাল।
১২- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮শে নভেম্বর ২০১৫ সাল।
১৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ই জুলাই ২০১৬ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত