শহিদ শব্দটার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে গিয়েছিল স্কুলে পড়ার বয়স থেকে। অল্প বয়সেই জড়িয়ে গিয়েছিলাম অতিবাম আন্দোলনের সঙ্গে। কোন কমরেড শহিদ হলে দেওয়ালে তার নাম লিখে লাল সেলাম দিতাম আমরা। দেওয়ালে লিখতাম কান্নাকে ক্রোধ, শোককে ঘৃণায় পরিণত কর এসব কথা। স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে শুরু করে নকশাল আন্দোলন পর্যন্ত� শহিদদের স্মরণে লেখা গানগুলি আমরা ছাত্রাবস্থায় গাইতাম। একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, মুক্তির মন্দির সোপান তলে, দেশের বন্ধু শহিদ ঝড় বাদল রাতে, জালিয়ানওয়ালাবাগের জালালাবাদের এসেছে আদেশ, শহিদ তোমায় ভুলিনি মোরা, শত শহিদে রক্তে রাঙা পতাকা এমন কত গান কমরেডদের সঙ্গে মিলে গাইতাম। আমার মত স্বভাবভীরু মানুষেরও মনে কেমন একটা উত্তেজনা হত। ছোটবেলায় স্বাধীনতা সংগ্রামে শহিদদের কথা পড়েছি ইতিহাস বইতে, কলেজ জীবনে দেখেছি তাদের নিয়ে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি ছবি।

পরবর্তীকালে সাংবাদিকতায় এসে কংগ্রেস, সিপিএম, এসইউসির শহিদ দিবস পালন দেখেছি। তাতে সবকিছুই থাকে কিন্তু কেমন যেন একটা ধরাবাঁধা ব্যাপার। শহিদ বেদীতে মালা দেওয়া আর বক্তৃতা এবং পার্টি পত্রিকায় শহিদ হওয়া মানুষটিকে নিয়ে লেখাতেই তা যেন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের ২১শে জুলাইয়ের শহিদ স্মরণের উষ্ণতা তাতে নেই। দেশের আর কোন রাজনৈতিক দল একটি আন্দোলনের এতজন শহিদকে নিয়ে এতবড় একটি বাৎসরিক সমাবেশ করে বলে আমার জানা নেই। প্রতিটি আন্দোলন বেঁচে থাকে তার শহিদদের মধ্যে দিয়ে। ২১শে জুলাইও তাই। এই দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৩জন শহিদের স্মৃতি। এই দিনটি এলেই আমার মনে পড়ে বন্ধন, বিশ্বনাথ, মুরারি, রতন, কল্যাণ, অসীম, কেশব, শ্রীকান্ত, দিলীপ, রঞ্জিত, প্রদীপ, খালেক আর ইনুর কথা।
আমি নিজে ভিতু মানুষ, সবসময় সবকিছুর যে বিরাট কোন প্রতিবাদ করে উঠতে পারি তা মোটেই নয়। শহীদদের কথা মনে রেখে এই অক্ষমতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি। ভাবি, মনে কতটা জোর থাকলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মৃত্যু বরণ করা যায়। ২৬ বছর আগে ১৯৯৩ সালে ২১শে জুলাই আমার ধর্মতলা চত্বরে তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্ষোভ সমাবেশ কভার করার ডিউটি ছিল। তখন আমি সরকার বাড়ির কাগজে কাজ করি। ১৩জন শহিদের বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন আমার চোখের সামনে। সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় গুলি চালানো হয়েছিল তাদের ওপর। ২১শে জুলাইয়ের আগে আমি কোনদিনও চোখের সামনে এতজন রাজনৈতিক কর্মীর পুলিশের গুলিতে শহিদ হওয়ার ঘটনা দেখিনি। আদর্শবাদী এই রাজনৈতিক কর্মীরা যে কোন দলের সম্পদ। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের কথা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না।
এবারের ২১শে জুলাইয়ের আওয়াজ ইভিএম নয়, ব্যালট চাই। একটু লক্ষ্য করলেই বুঝবেন এও সেই মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করার দাবি। ইভিএম জালিয়াতির মাধ্যমে লুঠ করা হচ্ছে মানুষের ভোট। তাই ইভিএমের বদলে ব্যালট ফিরিয়ে আনার ডাক দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯৩ সাল থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের পরিণতিতে রাজ্যের তৎকালীন শাসকরা বিদায় নিলেও ইভিএম জালিয়াতি করে দিল্লিতে এবার যারা শাসন ক্ষমতায় এসেছেন তারা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর নতুন করে নামিয়ে আনছেন দমন-পীড়ন।� গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইকে আরও জোরদার করাই এবারের ২১শে জুলাইয়ের শপথ।
বন্ধন, বিশ্বনাথ, মুরারিদের রোল মডেল হিসেবে ভাবা তরুণ তৃণমূল কর্মীরা এবারের শহীদ স্মরণ সমাবেশে আসবেন তৃণমূল নেত্রীর এই আওয়াজকে বাস্তবায়িত করার শপথ নিতে। এখন লড়াই আরও কঠিন। কারণ বিজেপি নামক যে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক শক্তি এখন ক্ষমতায় এসেছে তারা বিভেদপন্থার বিষ ছড়িয়ে দেশের মানুষের মনটাকেই বিষিয়ে দিতে চায়। এ বড় বিপজ্জনক শত্রু-মিত্র গুলিয়ে দেওয়া রাজনীতি। প্রকৃত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার বদলে মানুষ লড়াই শুরু করে অন্য ধর্মের নিরীহ মানুষদের সঙ্গে। মনুষ্যত্ব নয়, ধর্মই হয়ে ওঠে মানুষকে বিচার করার একমাত্র মাপকাঠি। ভারতবর্ষের এই নতুন শাসকরা গোটা দেশে গণতন্ত্রকে অস্বীকার করার একটা সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চাইছে। সবকা সাথ, সবকা বিশ্বাস, সবকা বিকাশের কথা বললেও তাদের লক্ষ্য দেশে একটি দলের শাসন, একটি সম্প্রদায়ের শাসন, একটি ধর্মের শাসন কায়েম করা। এটা একটা বিপজ্জনক ঝোঁক। ২১শে জুলাইয়ের শহিদরা আমাদের গণতন্ত্রের এই শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি দিক।
২১শে জুলাই আমাকে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দেয়। জীবনকে কতটা ভালবাসলে এভাবে পুলিশের গুলি ও চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করা যায় তা দেখিয়ে দিয়েছেন তারা। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, বিভেদপন্থার বিষবাস্প যখন আমাদের চারপাশকে গ্রাস করছে, তখন ২১শে জুলাই আমাদের জাগিয়ে রাখুক।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত