রক্তপাতের রাজনীতি যে কোন মূল্যে বন্ধ করতে হবে, গণতন্ত্রে এই রাজনীতি অচল। ভোট একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যে কোন গণতান্ত্রিক দেশেই চন্দ্র-সূর্য ওঠার মত তা হয়ে থাকে। কিন্তু আমার যে জিনিসটা মাথায় ঢোকেনা তা হল এমন একটা স্বাভাবিক ঘটনাকে ঘিরে এত লাগাতার হিংসা ও অশান্তির ঘটনা ঘটবে কেন? তাহলে কী ধরে নিতে হবে আমরা গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এই উৎসবটি পালন করার যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি? এবারের সাধারণ নির্বাচনের আগে ও পরে রাজ্যে যে ধারাবাহিক খুন, জখম ও হিংসার ঘটনা ঘটে চলেছে তা গণতন্ত্রের পক্ষে একটা লজ্জাজনক ব্যাপার। আমাদের সবার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধই এই অবস্থাটাকে বদলাতে পারে।
আমার মনে হয়, সন্ত্রাস ও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে চলা এলাকাগুলিতে খুনের রাজনীতি বন্ধ করার দাবিতে এই মুহূর্তে এলাকাভিত্তিক সর্বদলীয় মিছিল করা দরকার। শহরে বুদ্ধিজীবীরা দলমত নির্বিশেষে রক্তপাতের রাজনীতি বন্ধ করার আওয়াজ তুলে মিছিল কিংবা প্রতিবাদ সভা করতে পারেন। কে ডাকলেন, কে ডাকলেন না, কে এলেন, কে এলেন না এসব প্রশ্ন এখানে অবান্তর।
হিংসা ও সন্ত্রাস গুরুত্ব পেলে রাজনীতি পিছনে চলে যায়, দাপট বাড়ে সমাজবিরোধীদের। এটা সব দলের পক্ষেই বিপজ্জনক। আরও একটা জিনিস আমার মনে হয়, গণমাধ্যমের বিশেষকরে খবরের কাগজের ভূমিকা এখানে আরেকটু দায়িত্বশীল হওয়া উচিৎ। কাগজ খুললেই দেখছি, অমুক গ্রামে শ্মশানের শান্তি বিরাজ করছে, তমুক গ্রামে জ্বলছে আক্রান্ত মানুষদের চিতা মার্কা হেডিং। এর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে দলীয় কর্মীর ঝুলন্ত দেহ, বিধ্বস্ত বাড়িঘর, মারমুখী জনতা কিংবা নিহত ব্যক্তির কাছাপরা ছেলে ও ক্রন্দনরত স্ত্রীর ছবি। এসব ছবি হিংসাকে বাড়িয়ে দেয়, এগুলো না ছাপলেই ভালো। বিভিন্ন চ্যানেলের সান্ধ্য তর্জাতে সেজেগুজে যারা সব বিষয়ে নিজস্ব মতামত দেন তারা যদি হিংসা নিয়ে আলোচনা শুধু টিভিতেই সীমাবদ্ধ না রেখে হিংসার কারণ অনুসন্ধান ও তা সমাধানের জন্য ঘটনাস্থলগুলিতে গিয়ে সেখানকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে কোন অনুষ্ঠান করতেন তবে সেটা অনেক বেশি কার্যকর হত। এই আলোচনায় চেনা বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে বিষয়টি নিয়ে যারা কাজ করছেন তেমন কিছু সিরিয়াস চিন্তাবিদ এবং গ্রামগঞ্জে বা শহর, মফস্বলে হিংসার আঁচ গায়ে লাগা মানুষদেরও আনা যেতে পারে।
আমি মনে করি এই ব্যাপক হিংসার দায় কোন রাজনৈতিক দলই এড়িয়ে যেতে পারে না, এবং এখনই মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ না করলে হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীরা কিছুদিন পরেই আমাদের মাথায় উঠে নৃত্য করবে। এটাও খুব লজ্জাস্কর ব্যাপার যে রাজনীতি সচেতন পশ্চিমবঙ্গে এ ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। ভোটের আগে ও পরে এখানে হিংসা ও অশান্তি অব্যাহত। সমাজবিরোধীরা নিজেদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য নিজেদের মধ্যেকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের গায়ে লাগিয়ে দিচ্ছে রাজনৈতিক রঙ এবং দলগুলি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে তাতে জড়িয়ে পড়ছে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে ২০১১তে সিপিএম পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক তখত্ থেকে চলে যাওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিলেন রাজ্যে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে ঘটনা ঘটতে দেননি। জেতার পর মহারাষ্ট্র নিবাসের দলের কর্মীসভায় তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন বদলা নয়, বদল চাই। প্রতিহিংসার রাজনীতিতে দল বিশ্বাসী নয়। সেবার কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কোন রাজনৈতিক হিংসা ছড়ায়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গালিগালাজ না করে যারা জলস্পর্শ করেন না তারাও একথা স্বীকার করবেন। সেই ব্যাপারটাই এবারে দেখছি না। নিজেরাও ভাবতে পারেননি এমন ফল করে ফেলার পর বিজেপির ছোট, বড়, ন, মেজ সব রাজ্য নেতাই কথায় ও আচরণে যেন হাতে মাথা কাটছেন।
অন্যরা যে ধোয়া তুলসীপাতা তা বলা যাবে না। লাগাতার কুকথা, প্ররোচনামূলক মন্তব্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় উস্কানি ইত্যাদির মাধ্যমে তারা এই হিংসায় বাতাস দিচ্ছেন। নাগরিক সমাজ গোটা ঘটনাটায় একেবারে নিশ্চুপ, ফলে হিংসা বাড়ছে। তথাগত রায়ের মত� দায়িত্বশীল পদে আসীন মানুষেরাও এমন মন্তব্য করছেন যা থেকে ব্যাপক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এবং তা ঘটলে তার দায় তাকেই নিতে হবে। আচার আচরণে সংযত হওয়ার ব্যাপারটাই যেন ভদ্রলোক বলে বিজ্ঞাপিত বাঙালিদের জীবন থেকে চলে গেছে।
আমার খুব অবাক লাগে কিছুদিন আগে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী সফর কভার করার সূত্রে আমি তাকে ঘিরে মানুষের যে উদ্দীপনা ও উৎসাহ দেখেছিলাম সেই মানুষগুলো আজ কোথায়? তারা কেন এই হিংসার প্রতিবাদ করছেন না? কেন গড়ে তুলছেন না সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ? একটা কথা মনে রাখবেন সমাজবিরোধীদের কিন্তু কোন দল হয়না। তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে সব দলেই সুবিধামত ঢুকে পড়ে। এদেরকে রাজনীতি থেকে আলাদা করাই নাগরিক সমাজের কাজ। আজ যারা নিজেদের আখের গোছানোর জন্য দলে এদের স্বাগত জানাচ্ছেন তারা মাথায় রাখুন এরা তাদেরই সবথেকে আগে দল থেকে বিদায় করবে।
সত্যি বলতে কি এই হিংসা ও খুন জখমের ঘটনা রাজনীতি নামক ব্যাপারটা সম্পর্কেই লোকের অশ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিচ্ছে। নতুন প্রজন্ম ভাবছে রাজনীতি মানেই� একটা গণ্ডগোলের ব্যাপার। রাজনীতি, রাজনীতিবিদ, রাজনীতির গুরুত্ব ও প্রয়োজনের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারাচ্ছে। এ বড় বিপজ্জনক প্রবণতা। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ছাড়া এই প্রবণতাকে রোখার কোন রাস্তা আজ আর আমাদের হাতের কাছে নেই।
একশ্রেণীর আদর্শহীন পার্টি ম্যানেজাররা এখন সব রাজনৈতিক দলেরই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। রক্তপাতের রাজনীতি এদের সামনে হাজির করেছে এক খোলা ময়দান। এদের দাপটে আদর্শের রাজনীতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আদর্শবাদীরা চলে যাচ্ছেন পিছনে, বাহুবলীরা আসছে সামনে। আদর্শবাদীদের জায়গা নিচ্ছে করিৎকর্মা পার্টি ম্যানেজাররা। আগে আদর্শের পিছনে মানুষ ছুটতো এখন আমাকে একটু দ্যাখো বলতে বলতে আদর্শ ছুটছে মানুষের পিছনে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত