প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এতদিন কেবল দেশবাসী ও বিরোধীদের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল নরেন্দ্র মোদীকে। তবে এবার মার্কিন পত্রিকা ‘টাইম’ তাদের প্রচ্ছদে চৌকিদারের ছবি ছেপে তাঁকে ‘বিভাজনের কান্ডারী’ বলে দেগে দিল। “ইন্ডিয়া’স ডিভাইডার ইন চিফ”- হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি দিয়ে ঠিক এই কথাটিই লেখা হল আন্তর্জাতিক পত্রিকা টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, ভারতের বিভাজনের কান্ডারী।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বর্ষপূর্তিতে নরেন্দ্র মোদীর সাক্ষাৎকার ছেপেছিল মার্কিন পত্রিকা ‘টাইম’। আগামী পাঁচ বছরে বহু স্বপ্নের কথা সেই পত্রিকাকে বলেছিলেন মোদী। ২০১৫-র ১৮ মে সংখ্যার প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল মোদীর পূর্ণাবয়ব ছবি। ভেতরে সেই সাক্ষাৎকার। প্রচ্ছদে ‘টাইম’-এর প্রশ্ন ছিল, ‘ক্যান মোদী ডেলিভার?’ মোদী কি পারবেন? চার বছর পরে ভারতের নির্বাচনের মধ্যে ফের মোদীর মুখচ্ছবি পত্রিকাটির ২০ মে সংখ্যার প্রচ্ছদে। দৃষ্টিতে বিষণ্ণতা, গলায় গেরুয়া চাদর। হেডলাইন— ‘ইন্ডিয়া’জ ডিভাইডার ইন চিফ’।
প্রচ্ছদ নিবন্ধে ভারতে ‘বিষাক্ত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ’ ছড়ানোর অভিযোগ তুলে মোদীকে বিদ্ধ করা হয়েছে। লেখা হয়েছে, ‘পাঁচ বছর আগে ২০১৪-য় উজ্জ্বল ভারত, শক্তিশালী ভারতের স্বপ্নের এক প্রতিভূ হিসাবে উঠে এসেছিলেন মোদী, যেন এক আস্থার দেবদূত— যার এক হাতে হিন্দুর পুনর্জাগরণ, অন্য হাতে দক্ষিণ কোরিয়ার ধাঁচে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মসূচী। এখন শুধুই এক ব্যর্থ রাজনীতিক হিসাবে ভোট চাইতে এসেছেন মোদী, যিনি করে দেখাতে পারেননি। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, সেই স্বপ্ন, সেই আস্থা আজ আর তাঁর সঙ্গে নেই।’
প্রভাবশালী মার্কিন পত্রিকার এই প্রচ্ছদ ও নিবন্ধ নিয়ে যেমন রাজনীতিতে ঝড় উঠেছে, তেতে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়াও। কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা টুইটে বলেন, ‘ভাগ করে শাসন করার নীতি মোদীরও। কংগ্রেস ব্রিটিশ শাসকদের ভাগিয়েছে, এ বার মোদীর শাসনকেও তাড়াবে।’ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘ঠিকই লিখেছে ‘টাইম’ পত্রিকা। গোরক্ষা ছাড়া, দাঙ্গা ছাড়া ওঁর মাথায় কিচ্ছু ঢোকে না।’
শুধু তাই নয়। ‘টাইম’-এর এই সংখ্যা বাজারে আসার পরে নানা মজার মজার মিম ঘোরাফেরা করছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। নেটিজেনদের ট্রোলিংয়ের শিকার হচ্ছেন মোদী। একটা মিমে দেখা যাচ্ছে ৪টি ছবির একটি কোলাজ। যাতে জাপান, ইউরোপ এবং দুবাইয়ের রাস্তার ফুলে ঢাকা ডিভাইডারের পাশে ভারতের ডিভাইডার হিসেবে মোদীর মুখ দেখানো হয়েছে। তবে এতে মোদীভক্ত ‘চৌকিদারেরা’ রে রে করে উঠেছেন। এরই মধ্যে প্রচ্ছদ নিবন্ধের লেখক সাংবাদিক আতিশ তাসিরের উইকিপিডিয়া পেজে হানা দিয়ে তাঁর পেশা হিসেবে ‘কংগ্রেসের জনসংযোগ ম্যানেজার’ লিখে দেওয়া হয়।
‘টাইম’-এর অভিযোগ, মোদী সরকার ৫ বছরে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, উদার নীতি ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যম— ভারতীয় রাষ্ট্রগঠনের তিনটি প্রধান সুরকেই নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তো বটেই, মুক্তমনা, পিছিয়ে পড়া শ্রেণি ও তফসিলিদের পর্যন্ত কোণঠাসা হতে হয়েছে, আক্রমণ নেমে এসেছে তাঁদের ওপর। সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতি সংখ্যালঘুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার ফলে দাঙ্গা, গণধোলাই, হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। নিবন্ধে এ-ও বলা হয়েছে, ‘মোদীর অর্থনৈতিক জাদু শুধু যে কাজ করেনি তাই নয়, ভারতে বিষাক্ত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পরিবেশ ছড়াতে সাহায্য করেছেন তিনি।’
আর পত্রিকাটিতে মোদীর অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে দ্বিতীয় একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বেকার তরুণদের স্বনির্ভরতার স্বপ্ন দেখিয়ে ২০১৪-য় ভোট কুড়িয়েছিলেন মোদী। কিন্তু জানুয়ারিতে সরকারেরই এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছেছে। ভোটের আগে মোদী সরকার যে এই সমীক্ষার ফল চেপে যেতে চেয়েছে, সে কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন তোলা হয়েছে মোদীর ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ স্লোগান বাস্তবায়ন নিয়েও।