কেউ থাকেন সোপিয়ানে। কারও বাড়ি রাজৌরিতে। কেউ আবার উধমপুরে। আবার কেউ অনন্তনাগের। কেউ আবার বারামুলার। বাকিরা বেশিরভাগই জম্মু এবং শ্রীনগরের। এঁদের বেশিরভাগের বয়সই পুলওয়ামাতে সিআরপিএফ জওয়ানদের কনভয়ে বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি নিয়ে ঢুকে যাওয়া আত্মঘাতী জঙ্গি আদিল আহমেদ দারের বয়সের কাছাকাছি।
এঁদের প্রত্যেকেরই চোখে–মুখে কেমন যেন একটা উৎকণ্ঠা। রবিবার বেলায় যুবভারতীর নতুন যুব আবাস ‘নবপ্রজন্ম’র সামনে দাঁড়িয়ে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে থমকে যাওয়া। এই মুহূর্তে কলকাতায় রয়েছে জাতীয় কবাডি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসা জম্মু–কাশ্মীরের দল। প্রথমেই জম্মু–কাশ্মীরের অ্যামেচার কবাডি সংস্থার কোষাধ্যক্ষ সংগ্রাম সিং জানিয়ে দিলেন, জম্মু থেকে যতক্ষণ না ওপরমহলের অনুমতি পাওয়া যাবে ততক্ষণ একজনের সঙ্গেও কথা বলা যাবে না। অগত্যা অপেক্ষা।
আধ ঘণ্টা পরে জম্মু থেকে অনুমতি মেলার পর মহম্মদ আলতাফ, আয়ুষী, সায়া, মহম্মদ ইউসুফ, মহম্মদ জামিল–উল হাসানদের সঙ্গে কথা বলা গেল। সমস্বরে তীব্র নিন্দা ‘আমরা কবাডি দলের পক্ষ থেকে পুলওয়ামা ঘটনার নিন্দা করছি। আমরা রোজ চোখের সামনে দেখি আমাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী কী কী করে। সেই শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।’
না, শেখানো বুলি নয়। কারণ, জম্মু–কাশ্মীরের মহিলা কবাডি দলের অধিনায়ক আয়ুষীর বাবাই তো রয়েছেন বিএসএফে। সেই আয়ুষীর মুখে এমন কথা তো শোভা পাবেই। ‘আমরা সমর্থন করি না এ সব। কাশ্মীরে থাকি বলে হয়তো বেশিরভাগ মানু্য আমাদের সম্পর্কে অন্যরকম ভাবেন। আমরা নিজেরা জানি, দেশের প্রতি আমাদের ভালবাসা কতটা। আমরা দেশ সম্পর্কে কী ভাবি। স্বপ্ন দেখি কবে বিশ্ব কবাডি মঞ্চে দেশের প্রতিনিধিত্ব করব।’ বি–কম প্রথম বর্ষের ছাত্রীর চোখে–মুখে তখন প্রত্যয় ধরা পড়ে।
সোপিয়ানের দরিদ্র পরিবারের ছেলে মহম্মদ আলতাফ। দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া। হতেই পারত অন্যরকম। কারণ, আলতাফের মুখেই শোনা গেল, বাড়ির বাইরে অন্য কারও সঙ্গে কবাডি খেলার সুযোগ নেই। সোপিয়ানে তার মহল্লাটা যে খানিকটা ‘অন্যরকম’। খেলাধূ্লোর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তাই আলতাফকে বাড়িতে একাই অনুশীলন করতে হয়। ভরসা ইউ টিউবে প্রো–কবাডির ম্যাচ। আলতাফের কথায়, ‘আমি খেলতেই চেয়েছিলাম প্রথম থেকে। ক্রিকেট খেলতাম। সুযোগ পাইনি। তারপর কেমন করে ধীরে ধীরে কবাডিতে ঢুকে পড়লাম, নিজেই জানি না। দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই ভবিষ্যতে। ভারতের হয়ে মেডেল আনতে চাই।’
বারামুলা নাম শুনলেই তো মনে হয় বুলেট, গ্রেনেডের শব্দ ভেসে আসছে। সেখান থেকে উঠে আসা সায়া নবম শ্রেণির ছাত্রী। হ্যাঁ, যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করেই কবাডি কোর্টে পৌঁছেছেন। ভারী বুটের শব্দকে অগ্রাহ্য করে বাড়ি থেকেই বেরিয়ে পড়েছে খেলার নেশায়। সায়াও স্বপ্ন দেখে একদিন ভারতের হয়ে এশিয়ান গেমস অথবা অলিম্পিকে খেলার। সায়া মনে করে, ‘খেলাই শান্তি আনতে পারে উপত্যকায়। এই বয়সে সেটা বুঝে গিয়েছি।’ চমকে দেয় সায়ার কথা।
হ্যাঁ, উপত্যকার একদিকের ‘নিয়মে’ যেমন আদিল আহমেদ দারের মতো আত্মঘাতী জঙ্গি তৈরি হয়, ঠিক তেমনই ‘আরেক’ নিয়মে সায়া, আয়ুষী, আলতাফরা সেই উপত্যকাতেই জন্মায়।
(সৌজন্য :- আজকাল)