ভীষণ উত্তেজনার একটা সন্ধ্যা। কচিকাঁচাদের পড়াশোনায় মন নেই বিন্দুমাত্র। রান্নাঘর থেকে শোনা যাচ্ছে ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দ। সবাই অপেক্ষা করছে কখন আসবে সেই বহু প্রতীক্ষিত খাবারটি…
কনকনে ঠাণ্ডার পৌষের সন্ধ্যায় পিঠেপুলি তৈরি হওয়ার দৃশ্য কমবেশি প্রায় সব বাড়িতেই একই ছিল। দুপুর থেকে চলত প্রস্তুতি। মা-ঠাকুমারা চালগুঁড়ি, নারকোল কোরা, চিনি গুঁড়ো ইত্যাদি নিয়ে গুছিয়ে বসতেন উনুনের ধারে। প্রথমে মাটির সরাটিকে আগুনে খানিকটা পুড়িয়ে নেওয়া হত। তারপর হাতের চাপে তৈরি হত ভাপা পিঠের ছাঁচ। সেগুলি সরাতে দিয়ে সেদ্ধ করলেই তৈরি হয়ে যেত ভাপা পিঠে বা সরা পিঠে, আর তারপর নতুন গুড় দিয়ে গরমাগরম পিঠে, কচিকাঁচাদের অপেক্ষার পালা শেষ হত। তাঁদের পেট এবং মন দুইই খুশ।
শুধু ভাপা পিঠে কেন, পিঠের আসরে অন্যতম রত্ন হল পাটিসাপটা। চালের গুঁড়োতে পরিমাণ মত অল্প জল এবং চিনি দিয়ে মিশ্রণ বানিয়ে হাতায় করে পাত্রের ওপর দিয়ে তার মধ্যে নারকোল কিংবা খোয়া ক্ষীরের পুর দিয়ে মুড়ে হাল্কা সেঁকে নিয়ে চিনির রসে ফেলার পর, যা তৈরি হত তার থেকে মুখ ফেরানোর সাধ্য ছিল কই? এখন দিন বদলে গিয়ে নারকোল বা ক্ষীরের পুরের বদলে সন্দেশ দেওয়া হয়, চিনির সিরাতেও ফেলা হয়না অনেক জায়গাতে তবু বাঙালি পাটিসাপটা নিয়ে আজও তার সাবেকিয়ানাতেই মজে।
তেলেভাজা বড়াকে মিষ্টি রসে ফেলে এক স্বর্গীয় স্বাদের খাবারে পরিণত করা সেই কবে ঠাকুমা-দিদিমারা শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। ছোটবেলাতে পিঠেপুলির উৎসবের এই সময়ে চুরি করে রসবড়া খাওয়া একটা অন্য মজা বহন করত।
ঠাকুমা- দিদিমার হাতে তৈরি পিঠে খাওয়ার আনন্দটাই আলাদা ছিল। ওই স্বাদের মধ্যে যে আন্তরিকতা ছিল তা আর কোথাওই পাওয়া যায় না। তারপর আস্তে আস্তে দিন বদলাল, বদলে গেল সময় এবং রীতি-অভ্যাস ইত্যাদি সব কিছুরই। উনুন থেকে গ্যাস এল, গ্যাস থেকে ইন্ডাকশন, মাইক্রোওভেন আর যন্ত্রের যুগ মানুষকে চটজলদি রান্নাতে অভস্ত্য করে তুলল আর ফলে হারিয়ে যেতে লাগল পিঠেপুলিরা। এখন বিভিন্ন মেলাতে বা দোকানে পাটিসাপটা, ভাপা পিঠে, চশির পায়েস পাওয়া গেলেও সেই স্বাদ থাকে কই? যুগের বদলে আন্তরিকতাও যে হারিয়ে যায়।