রাজনৈতিক তরজায় তপ্ত রাজ্য। টেলিভিশনে যদি এই শিরোণামটি দেখেন, আমি নিশ্চিত আপনি বিচলিত হবেন না। আজকাল চন্ডীপাঠ থেকে জুতো সেলাই – যে কোনও ইস্যুতে রাজ্য রাজনীতি তপ্ত হয়ে যায়। তবে, আজ সংবাদ শিরোণামে এই হেডলাইনের তাৎপর্য যথেষ্ট। কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে বাংলার গরিমা, অস্মিতা ও ভবিষ্যৎ।
আমরা সকলেই জানি ২০১৬ আগস্ট মাসে রাজ্য মন্ত্রিসভা একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাল্টে বাংলা (ইংরেজিতে বেঙ্গল ও হিন্দিতে বঙ্গাল) করার সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে বিধানসভাতেও সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাশ হয় এবং কেন্দ্রের কাছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। কেন্দ্রের তরফে জানানো হয় যে তিন ভাষায় তিনটে নাম না রেখে একটি নাম চয়ন করে পাঠানো হোক। তখন বিধানসভা আবার সিদ্ধান্ত নেয় সব ভাষাতেই বাংলা হোক রাজ্যের নাম। দীর্ঘ ৩ বছর আগে এই প্রস্তাব পাঠানোও হয় কেন্দ্রের কাছে।
এত দীর্ঘসূত্রিতার পর এখন শোনা যাচ্ছে কেন্দ্র নাকি এই নাম পরিবর্তনে সম্মত নয়, কারণ বাংলাদেশের সাথে নামের সাদৃশ্য। একটি হাস্যকর যুক্তি খাঁড়া করেছেন দিল্লির বাবুরা। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ তো একই ভূখণ্ডের অংশ ছিল। ইতিহাসের করুণ পরিহাসে এখন দুটি আলাদা রাষ্ট্রে অবস্থান এই দুই জায়গার। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতিও অনেকাংশে এক। বাংলার নামে একটা দেশ আছে বলে ভারতবর্ষে সেই নামে প্রদেশ থাকতে পারে না? পাকিস্তানেও তো পঞ্জাব, হায়দরাবাদ আছে। সেই নিয়ে কোনওদিন আপত্তি ওঠেনি কেন? যত বঞ্চনা বাংলার প্রতি?
অতীতে অনেক রাজ্য বা শহরের নাম পরিবর্তন হয়েছে। উড়িষ্যা হয়েছে ওড়িশা। বম্বে হয়েছে মুম্বই, মাদ্রাজ হয়েছে চেন্নাই, ইত্যাদি। সেই সময় তো কেউ আপত্তি করে নি। এত বছর অপেক্ষাও করতে হয়নি। বাংলার ক্ষেত্রে বিমাতৃসুলভ আচরণ কেন? উপরন্তু, রাজ্যের বিধানসভা যেখানে সর্বসম্মতিক্রমে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেখানে কেন্দ্রীয় সরকার কেন সেই সিদ্ধান্তকে মান্যতা দেবে না? যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোয় তো এমনটা হওয়ার কথা নয়। নিজের রাজ্যের নাম পাল্টাতে কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী কেন হতে হবে রাজ্যকে?
ওদিকে, বিজেপির রাজ্য সভাপতি তো হুমকিই দিয়ে বসলেন, রাজ্যের নাম বদলাতে দেবেন না। নাম বদল করে নাকি কোনও কাজের কাজ হয় না। মাননীয় রাজ্য সভাপতিকে অনুরোধ করব ওনার দলের যে শাখা উত্তর প্রদেশে আছে তাদের জিজ্ঞাসা করতে তবে মুঘলসরাই, ফৈজাবাদ, এলাহাবাদের নাম পরিবর্তন হল কেন? নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করতে এক বছরে ২৫টি শহরের নাম বদল করেছে যে বিজেপি, তাদের কাছে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
আরেক শ্রেণীর বাঙালি প্রশ্ন করছে, বাংলা কেন? পশ্চিমবঙ্গ থেকে পশ্চিম মুছে দিয়ে ইতিহাস ভোলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি তাদের বলতে চাই, না – এই নাম পরিবর্তনের ফলে ইতিহাস আরও গেঁথে যাবে আমাদের মননে। লর্ড ক্লাইভের ষড়যন্ত্রের ফলে দেশভাগের যে অধ্যায় ১৯০৫ সালে শুরু হয়েছিল, তা পূর্ণতা পায় ১৯৪৭ এ। ১৯৫৪ সাল অবধি স্বশাসিত প্রদেশ ছিল পূর্ববঙ্গ। ১৯৫৫য়ে পাকিস্তানের পূর্বপ্রদেশ হিসেবে গণ্য হয়। তারা। এরপর মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও শেষমেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৭১ সালে। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেল বাংলাদেশ। যদি পূর্ববঙ্গ না থাকে তাহলে পশ্চিমের থাকার যৌক্তিকতা কোথায়?
অনেকেই, যারা ইতিহাস-বিস্মৃত এবং একটি রাজনৈতিক ভাবধারায় বিশ্বাসী, তাদের মতে এই নামকরণ নাকি ভবিষ্যতে বৃহত্তর বাংলাদেশ গড়ার এক ষড়যন্ত্র। এই ছেঁদো যুক্তি শুনে বাংলার বাচ্চারাও হাসবে। রবীন্দ্রনাথ যখন লিখেছিলেন, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ তিনি কি বাংলাদেশের কথা লিখেছিলেন নাকি পশ্চিমবঙ্গের? ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানটা শুনে কি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের গায়ে কাঁটা দেয় না? জীবনানন্দই বা কোন বাংলার মুখ দেখেছিলেন? নজরুল কি বাংলদেশী কবি? মাস্টারদা কোন দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছিলেন?
পরিশেষে, পাঠকদের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন রইল। জার্মানি যদি বার্লিন এর দেওয়াল ভেঙে ফেলতে পারে, পশ্চিমবঙ্গ কেন পারবে না ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়কে জন্ম দিয়ে বাংলা হিসেবে যাত্রা শুরু করার?
জয়তু বাংলা।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)