একুশের ভোটে মমতার পর তিনিই ছিলেন দলের দ্বিতীয় তারকা প্রচারক। জেলায় জেলায় ঘুরে প্রচার করেছেন। ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোরকে দলের নিয়ে আসার সিদ্ধান্তও ছিল তাঁরই। তাঁর সেই পরিশ্রম এবং সিদ্ধান্তের ফল পেয়েছে তৃণমূল। আর তারই পুরষ্কার স্বরূপ শনিবার তৃণমূলের যুবনেতার পদ থেকে সরাসরি জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পণ করলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার খাতায়কলমে না হলেও তিনিই ছিলেন তৃণমূলের দ্বিতীয় শীর্ষ পদাধিকারী। তবে শনিবার আক্ষরিক অর্থেই দলের দু’নম্বর পদে বসলেন অভিষেক। দলে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেকের মাথার ওপর এখন শুধুই একজন— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রসঙ্গত, এই মুহূর্তে অভিষেকের বয়স মাত্র ৩৩। ঠিক ১০ বছর আগে রাজনীতি যোগের পরে উল্কার গতিতেই রাজনৈতিক উত্থান ঘটে তাঁর। আর তা দেখেই এতদিন অভিষেকের সমালোচকরা মনে করতেন, সাফল্য তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে সেই সমালোচনা সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা ভোটে সপাটে মাঠের বাইরে করে দিয়েছেন তিনি। বিধানসভা ভোটে একেবারে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সরাসরি মোকাবিলা করেছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির। পরিণত রাজনীতিকের মতো ব্যবহার করেছেন। বক্তৃতা করেছেন তুখড়।
১৯৮৭ সালের ৭ নভেম্বর কলকাতায় জন্ম অভিষেকের। বাবা অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, মা লতা। মমতার আট ভাইপো-ভাইঝির মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনিই। পড়াশোনা প্রথমে নব নালন্দা হাইস্কুলে। পরে কলকাতারই এম পি বিড়লা ফাউন্ডেশন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে দ্বাদশ উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর মানব সম্পদ এবং বিপণন সংক্রান্ত পড়াশোনা করতে দিল্লী চলে যান। ২০০৯ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট থেকে এমবিএ করেন অভিষেক। তার পরেও দিল্লীতেই ছিলেন। ২০১১ সালে তাঁকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনেন মমতা।
এই ২০১১ সালেই বাংলায় ৩৪ বছরের বামশাসনকে উপড়ে ফেলে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। প্রথমবারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন মমতা। অভিষেকের রাজনৈতিক অভিষেক সে বছরেই। ‘তৃণমূল যুবা’ নামে দলের একটি নতুন যুব শাখার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন তিনি। এবং মমতার ছত্রছায়ায় ধীরে ধীরে রাজনীতির পাঠ শুরু করেন। এরপর ২০১৪ সালে সোমেন মিত্র তৃণমূল ছেড়ে বেরিয়ে গেলে ডায়মণ্ড হারবার লোকসভা কেন্দ্রে অভিষেককে প্রার্থী করে তৃণমূল। মাত্র ২৬ বছর বয়সেই সিপিআইএম-এর আব্দুল হাসনত খানকে হারিয়ে লোকসভার কনিষ্ঠতম সাংসদ হন তিনি।
সেই শুরু। তার পর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি অভিষেককে। দলে শুধুই উত্থান হয়েছে তাঁর। এরই মধ্যে ‘তৃণমূল যুবা’ মিশে যায় যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে। যার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় অভিষেকেরই কাঁধে। দলের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে প্রথম সারির তৃণমূল নেতাদের পাশাপাশি দেখা যেতে থাকে তাঁকে। দলের অন্দরে বাড়তে শুরু করে তাঁর প্রভাব। তবে মমতার ভাইপোর এ হেন উত্থান মেনে নিতে কষ্ট হয় তৃণমূলের কিছু হেভিওয়েট নেতার। তাঁদের মধ্যে এক নম্বরে মুকুল রায়। ২০১৭ সালে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন তিনি।
পরের বছর, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হয় অভিষেককে। আর তাতে বিপুল ভোটে জেতে তৃণমূল। এরপর ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির উত্থানের পর ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে আসেন অভিষেক। একুশের ভোটযুদ্ধে অভিষেক-পিকে জুটিই ছিল তৃণমূলের অন্যতম চালিকাশক্তি। প্রাথী নির্বাচনেও তাঁর ভূমিকা ছিল বড়সড়। আর তাই একুশে দলের সাফল্যের অন্যতম কারিগর যে তিনি, তা বলাই বাহুল্য। নতুন দায়িত্ব নেওয়ার পর আপাতত তাঁর পাখির চোখ— ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন। জাতীয় রাজনীতিতে মোদী-বিরোধী প্রধান বিরোধী মুখ হিসেবে ক্রমশই প্রকট হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। অভিষেকের দায়িত্ব, জাতীয় স্তরে বিভিন্ন রাজ্যে তৃণমূলের ভিত প্রতিষ্ঠা করা। মমতার বার্তা পৌঁছে দেওয়া।