নিজের ‘আশিতম জন্মদিনে’ তিনি বলেছিলেন, ‘‘আশি বছর বয়সে এসে এমন কোনও কাজ করতে ইচ্ছে করে যেগুলো আগে করা হয়ে ওঠেনি … মূর্তি গড়ার ইচ্ছেটা আমার খুব হয়, গান গাইতে ইচ্ছে করে।’’ তাঁর গানের গলা ছিল ভাল, কিন্তু গান নিয়ে তাঁকে কেউ জিজ্ঞেস করলেই তিনি বলতেন, ‘‘গলা ভাল, কিন্তু গানের জন্য তৈরি গলা তো নয়।’’ একটি সাক্ষাৎকারে ‘কবি ও সাহিত্যিক শ্রীজাত’ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘… ‘বেলাশেষে’ শব্দটার অনেক রকম মানে হয়। শব্দটা আপনার জীবনে কি কোনও দ্যোতনা নিয়ে আসে?’’ সৌমিত্র উত্তরে বলেছিলেন, ‘‘বেলাশেষে মানে তো জীবন ফুরিয়ে এল। আমি কিন্তু বেলাশেষে নিয়ে ভাবি না। জীবন একটা নিরবচ্ছিন্ন স্রোতের মতো। সত্যি কথা বলতে কি একদম শুরু, একদম শেষ কোনওটাই আমাদের জানা নেই। আমার নতুন ছবিতে এক দম্পতি বিয়ের পঞ্চাশ বছর পরে নিজেদের পুনরাবিষ্কার করতে চায়, সেই থেকে ছবির নাম ‘বেলাশেষে’।’’ একবার একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন – তাঁর ‘আগামী জীবন’ বা ‘ভবিষ্যৎ’টা মোটামুটি জানা হয়ে গিয়েছে, এই জেনে ফেলাটা কি তাঁকে কোনও অস্বস্তিতে ফেলেছিল? তাঁর উত্তর ছিল, ‘‘না, অস্বস্তিতে যে ফেলে তাও নয়। আবার পুরোটা যে উপভোগ করি তাও নয়। এখন শরীর খারাপ হয়, ওষুধ-নির্ভর জীবন – এই ব্যাপারগুলো তো আর উপভোগ করা যায় না। তবে বাই অ্যান্ড লার্জ আমি জীবনটাকে উপভোগ করি কাজের মধ্যে দিয়ে। কর্মহীন থাকলেই ডিপ্রেশন হয়। এই অবসাদের মধ্যে হতাশা থাকে, আশ্বাসহীনতা থাকে। মাসে প্রায় দুটো একটা করে মৃত্যুর খবর জমা হতে থাকে। ভাল লাগে না। এই তো ক’দিন হল আমার এক ভায়রাভাই, খুব বন্ধু ছিল আমার, চলে গেল। আমি আর মৃত্যু নিতে পারি না। মৃতের বাড়িতে যাইও না। মনের জোরে কুলায় না। জীবন-মৃত্যু সাধারণ ঘটনা বুদ্ধিগত ভাবে জানি কিন্তু মনের জোরে গ্রহণ করতে পারি না।’’
তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি নৈর্ব্যক্তিক এই সব কষ্টের মধ্যে যেতে চাই না। যাঁকে চিনি না, জানি না তার জন্য কেন কষ্ট হবে?’’ ‘ক্রিকেটার মার্টিন ক্রো’-র মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসাও চলেছিল। কিন্তু সাড়ে তিন মাস আগে তিনি ঠিক করেছিলেন আর চিকিৎসা নয়। জীবন যেমন ভাবে আসবে সে ভাবেই গ্রহণ করবেন। ‘কবি ও সাহিত্যিক শ্রীজাত’ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘এই মার্টিন ক্রো-দের জন্য এই বয়সে এসে কষ্ট হয়?’’ সৌমিত্রের জবাব ছিল, ‘‘মার্টিন ক্রোয়ের ঘটনাটায় আমার এক মেসোমশাইয়ের কথা মনে পড়ল। তিনি জমিদার মানুষ ছিলেন। খুব সিগারেট খেতেন। যখন লাং ক্যানসার ধরা পড়ল তখনও সিগারেট খাওয়া ছাড়লেন না। বলেছিলেন, ‘যে ভাবে বেঁচেছি সে ভাবেই মরব।’ এগুলো তো ব্যক্তিগত স্ট্যান্ড। যে যে ভাবে জীবনটাকে দেখে।’’
যত বয়স বাড়ে তত চারপাশের নিকট-বন্ধু কমে যায়। সেই কষ্ট কি পেয়েছিলেন সৌমিত্র? তাঁর ‘অকপট স্বীকারোক্তি’ ছিল, ‘‘আগে হত। এখন আর হয় না। সমস্ত বিচ্ছেদকে অনিবার্য বলে মেনে নিতে শিখেছি। সিনেমা জগতের বাইরের বন্ধুরা এখনও কেউ কেউ বেঁচে আছেন। কিন্তু সিনেমা জগতে অনেকেই নেই। অনুপকমার নেই, রবি ঘোষ নেই। এরা আমার বন্ধু ছিল। নির্মলকুমার আছে। কিন্তু কাজের মধ্যে নেই। আমার সমসাময়িকদের মধ্যে যে এখনও কাজ করে যাচ্ছে সে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। আমার খুব বন্ধু।’’
সৌমিত্র কি সত্যি ‘ঈশ্বর’ মানতেন না? তাঁর জবাব ছিল, ‘‘প্রাতিষ্ঠানিক ঈশ্বর মানি না। তবে অজানিত, অবাঙমনসগোচর কিছু থাকলেও থাকতে পারে এটা আমি মানি। তা না হলে এত বড় সৃষ্টি কোথা থেকে হল?’’
নিজের অভিনয় জীবনের পাওয়া, না-পাওয়া নিয়ে তিনি একদা বলেছিলেন – ‘‘আমি পাওয়া, না-পাওয়ার অত হিসেবে নিকেশ করি না। তবে এইটুকু বলতে পারি অনেকটাই পূর্ণ। আমার কাজের মূল্যায়ন হিসেবে দেশবাসীর কাছে যা পেয়েছি সেটা অনেক। আমার থেকে অনেক গুণী মানুষ আছেন যাঁরা উপযুক্ত মর্যাদা পাননি। এ দেশে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ছাড়া আরও কত মানুষ আছেন যাঁদের একশো বছর, দেড়শো বছর হচ্ছে কিন্তু তাঁদের আমরা ভুলে আছি। সুতরাং তৃতীয় বিশ্বে জন্মে নিজের পুরোপুরি মূল্যায়ন হবে এটা আশা করাও ভুল। যা হয়েছে তাই যথেষ্ট।’’
জীবনের বয়সের হিসেবে আশির কোঠায় উপনীত হয়েও সৌমিত্র যে রকম ব্যস্ত থাকতেন তা প্রায় তুলনাবিহীন। কেউই সহজে তাঁর ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’ পেতেন না। সেই সময়টাকে ‘বেলাশেষে’ না বলে ‘বেলাশুরু’ বলা যেতে পারে। আর তাঁর জীবনের সেই ‘বেলাশুরু’ নিয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘বলাই যায়। জীবন প্রত্যেক দিনই নতুন করে শুরু হয়। আর আপনাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা সবাই প্রার্থনা করুন যাতে আমি এই রকম ব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিতে পারি।’’
জীবন নদীর মতো। বাঙালির নানা মনে নানা ভাবে ছিলেন তিনি, আছেন আর ভবিষ্যতেও থাকবেন। ‘অপু’ বা ‘ফেলুদা’ নয়, কোন একদিন কলকাতা শহরের কোনও এক অবাঙালি মহিলা সৌমিত্রকে চিনেছিলেন ‘ওহ বেলাশেষে-র হিরো’ বলে! সত্যি তো, ‘বেলাশেষের নায়ক’ তিনি। যে কোনও রাস্তা থেকে বেলা শুরু করতে পারেছিলেন সুস্থ থাকার শেষ দিন পর্যন্ত! আজ তিনি থেমে গেলেন চিরদিনের মতন। আর নতুন রাস্তা খুঁজবেন না সৌমিত্র। শেষ বলে কিছু নেই! ‘শেষের কবিতা’ হয় না। তবুও একদিন কালের যাত্রার ধ্বনির ডাক দিয়েছিলেন সৌমিত্র। অমোঘ কালের কাছে তাঁর মিনতি ছিল, ‘‘মোর লাগি করিও না শোক’’। তিনি ‘কবিতার বৃত্তে’ ঘুরেছিলেন। তাঁর রথের চাকায় ‘অভিনেতা সৌমিত্র’, ‘লেখক সৌমিত্র’, ‘নাট্যকার সৌমিত্র’, ‘কবি সৌমিত্র’, ‘গায়ক সৌমিত্র’, ‘একলা ঘরে নিজের সঙ্গে কথা বলার সৌমিত্র’, জীবনের ধুলোবালিতে ঘুরেছিলেন। কালের রক্তস্রোতে তিনি বারে বারেই ‘প্রথম’ ছিলেন, আছেন ও থাকবেন।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত