‘হুমায়ুন আজাদ’ লিখেছিলেন যে, বাংলা সাহিত্যে ‘পাঁচজন আদিম দেবতা’ রয়েছেন। তাঁর কথাকেই ধার করে বলতে হয়, আমাদের বাংলা গানেও রয়েছেন ‘পাঁচজন আদিম দেবতা’। এই পাঁচ দেবতা তাঁদের যাদুময় স্পর্শ দিয়ে বাংলা গানকে মুক্ত করেছেন ঘেরাটোপের ঘনায়মান অন্ধকার থেকে। ক্ষীণ ধারায় বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনীতে বর্ষার বাদল ঢেলেছেন তাঁরা অকাতরে। আর এর মাধ্যমে নদীতে যৌবনের স্পর্ধিত কল-কল্লোল এনেছেন তাঁরা। তারপর সেই যৌবনোমত্ত তটিনীকে তরঙ্গায়িত করে মিশিয়েছেন উত্তাল উর্মিমালাময় অশান্ত সাগরের সাথে। এই পাঁচজন আদিম দেবতা হচ্ছেন ‘দ্বিজেন্দ্রলাল’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘অতুলপ্রসাদ’, ‘রজনীকান্ত’ এবং ‘নজরুল’। রজনীকান্ত সেন সেই ‘পঞ্চকবি’দেরই একজন, অথচ সাহিত্য সাধনায়, আরাধনামূলক অসাধারণ সঙ্গীত সৃষ্টি এবং দেশাত্মবোধক আন্দোলন সংগ্রামে মুখর এই কবির আলোচনা, প্রচারণা নিতান্তই অপ্রতুল।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অসংখ্য গান তো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’ কিংবা অতুল প্রসাদের ‘মোদের গরব মোদের আশা/ আ-মরি বাংলা ভাষা’ ইত্যাদি গান ভুবনমোহন হয়ে উঠলেও, রজনীকান্তের অসংখ্য গান ও কবিতাই রয়ে গেছে অশ্রুত কিংবা স্বল্পশ্রুত। অথচ রজনীকান্তের গানে বাণী ও ছন্দের যে মেলবন্ধন, সুরের যে অপূর্ব লয়, সর্বোপরি ভাবের যে গভীরতা, তা এককথায় অতুলনীয়। তার রচিত একটি কবিতার দুটো চরণ উদ্ধৃত করলে হয়তোবা তাকে চিনতে পারবেন সবাই। ছোটবেলায় পড়া ‘স্বাধীনতার সুখ’ নামের এ কবিতাটি বহুলপাঠ্য ছিলো একসময়-
‘‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই-
কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই?’’
সমকালীন কবিদের মতো তিনি হাজারখানেক গান লেখেননি। অথচ কথা ও সুরের সারল্যের জন্য তাঁর সঙ্গীত রসিক শ্রোতার মন ছুঁয়ে যায়। মাত্র ৪৫ বছরের জীবনে দেখেছিলেন মৃত্যুর মিছিল। সেই শোক আর স্বজন বিয়োগের যন্ত্রণাকে সঙ্গী করেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সঙ্গীত সৃষ্টিতে মগ্ন ছিলেন তিনি।
রজনীকান্ত সেনের জন্ম হয়েছিল ১২৭২ বঙ্গাব্দের ১২ই শ্রাবণ, বুধবার ভোররাতে (২৬শে জুলাই, ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের চার বছরের ছোট। অর্থাৎ তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরও সমসাময়িক কবি তিনি। রজনীকান্তের জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমাতে। তাঁর মা ‘মনমোহিনী দেবী’ সঙ্গীতানুরাগী ছিলেন। পিতা ‘গুরুপ্রসাদ সেন’ পেশায় ছিলেন আইনজীবী। রজনীকান্তের বাবা গুরুপ্রসাদ সেন পেশায় ছিলেন ঢাকার মুন্সেফ পরে বরিশালের সাব-জজ হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্য পরিচয় হল তিনিও কবি ছিলেন। তিনি বৈষ্ণব ব্রজবুলি ভাষায় রচিত প্রায় ৪০০টি বৈষ্ণব পদাবলির একটি সংকলন প্রকাশ করেন ‘পদচিন্তামণিমালা’ নামে। এই ‘ব্রজবুলি’ নামের মিষ্টি কৃত্রিম কবি ভাষাটি মিথিলার কবি বিদ্যাপতি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে উদ্ভাবন করেন। কিন্তু, বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগে এসে সেই ভাষা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য তাঁর বিখ্যাত ‘ভানু-সিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ গ্রন্থে ব্রজবুলি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন।
ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি রজনীকান্তের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। ছোটবেলায় একটি বাঁশিতেই চলত তাঁর সঙ্গীতের অনুশীলন।
ছেলেবেলায় বেশ ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন রজনী। সারাদিনের দুরন্তপনা শেষে পড়াশুনার ফুরসতই মিলত না তাঁর। অসম্ভব মেধার কারণে বরাবরই পরীক্ষায় ভালো ফল করতেন রজনীকান্ত। এ ব্যাপারে তাঁর নিজের ডায়েরিতে লেখা ভাষ্যমতে,
“আমি কখনও বইপ্রেমী ছিলাম না। অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্যে ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।’’
ছোটবেলায় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে (তৎকালীন বোয়ালিয়া জেলা স্কুল) ভর্তি হন। কুচবিহার জেনকিন্স স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা, রাজশাহী কলেজ থেকে এফএ, কলকাতার সিটি কলেজ থেকে ১৮৯১ সালে ‘বিএ’ ও ‘বিএল’ (‘ব্যাচেলর ইন ল’) পাস করেন।
এক সময় প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলেও হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাওয়ায় জীবনটা ছিল তাঁর কাছে একটা বড় পরীক্ষা। আর সব বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে তিনি এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
রজনীকান্তের পিতা আইনজীবী হওয়ায় সংসারে স্বচ্ছলতা ছিল। কিন্তু সাব-জজ পদে অধিষ্ঠিত হবার অল্প দিনের মাথাতেই অসুস্থতাজনিত কারণে অবসর নিতে বাধ্য হন গুরুপ্রসাদ সেন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারে নেমে আসে দারিদ্র্যের কষাঘাত। ‘বিএল’ পাশ করে রজনীকান্তও পিতার মতো আইন ব্যাবসায় নামেন। ইতোমধ্যেই তাঁর কাকা আইনজীবী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। ওকালতি পেশায় কাকার সুনাম আর গান-বাদ্যে নিজের নামযশের কারণে মক্কেল যোগাতে রজনীকান্তের বেগ পেতে হত না। হিন্দু হস্টেল থেকে পড়াশুনা করার সময় তিনি স্বরচিত গান খঞ্জনী বাজিয়ে গেয়ে পথ পরিক্রমা করতেন। পড়াশুনার শেষে রজনীকান্ত রাজশাহি শহরে ওকালতি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তবে তাতে তিনি মনোনিবেশ করতে পারেননি। এক দিকে চলতে থাকে ওকালতি অন্য দিকে গান ও কবিতা রচনা। কিন্তু ক্রমেই তিনি গানে এতটা নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে, মক্কেলদেরকে তিনি সময় দিতে পারতেন না। ফলে, আইন ব্যবসায় তিনি আর খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারেননি। সে কথাও তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন, বলেছেন, “আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু ব্যবসায় করিতে পারি নাই।”
রজনীকান্তের মা-বাবা দুজনই ছিলেন সঙ্গীতে যথেষ্ট দক্ষ। মা-বাবার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই হয়তো বা ছেলেবেলা থেকেই গান-পাগল হয়ে ওঠেন তিনি। চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর বন্ধু ‘তারকেশ্বর চক্রবর্তী’র। তারকেশ্বর ভাল গান গাইতে পারতেন আর সেই কারণেই যেন গানের প্রতি রজনীকান্তের অনুরাগ বেড়ে গিয়েছিল। ‘রজনীকান্তের কন্যা’ ‘শান্তিলতা দেবী’র একটি লেখা থেকে জানা যায়, ‘‘এক অর্থে এই তারকেশ্বর চক্রবর্তীই হলেন রজনীকান্তের সঙ্গীতগুরু – যদিও ঠিক নিয়ম মেনে প্রথাগত সঙ্গীতাভ্যাস রজনীকান্ত করেননি।’’ তবু জানা যায় তিনি নিজেও সুগায়ক ছিলেন। রাজশাহিতে তিনি বিভিন্ন সাহিত্যসভা, মজলিশ এবং অনুষ্ঠানে তিনি স্বরচিত গান গেয়ে আসর মাত করে দিতেন। সেখান থেকেই গানের প্রতি নেশাটা একেবারে হৃদয়ে গেঁথে যায় তাঁর। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘কালীসঙ্গীত’ রচনা করে সংগীত সত্ত্বার পরিচয় দেন।
‘প্রমথনাথ বিশী’ তাঁকে ‘উৎসবরাজ’ বলে অভিহিত করেছেন। ১৯০২-এ তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বাণী’ প্রকাশিত হয়। শোনা যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েও ‘সুরেশচন্দ্র সমাজপতি’র ভয়ে তিনি এই বইটি ছাপতে চাননি। পরে ‘জলধর সেনের’ কলকাতার বাড়িতে ‘সুরেশচন্দ্র সমাজপতি’ তাঁর গান শুনে সেগুলি গ্রন্থাকারে ছাপাতে বলেন। এর পরে ১৯০৫-এ তাঁর দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কল্যাণী’ প্রকাশিত হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনটি এবং মৃত্যুর পরে পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।
১২৯৭ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে প্রকাশিত ‘আশালতা’ নামের মাসিক একটি পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয় রজনীকান্ত সেনের কবিতা। গান রচনায় অস্বাভাবিক দ্রুত গতিসম্পন্ন ছিলেন রজনীকান্ত। কলেজের কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন হলে পরে রজনীকান্তের ডাক পড়ত। রজনীকান্ত অনুষ্ঠানস্থলে এসে অনুষ্ঠান চলাকালীনই গান রচনা ও তাতে সুর সংযোজন করে তা গেয়ে আসর জমাতেন। তাঁর বিখ্যাত সব গানের বেশির ভাগই খুবই অল্প সময়ের মধ্যে রচিত। বিশিষ্ট সাংবাদিক ‘জলধর সেন’ এরূপ একটি ঘটনার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন যে, রাজশাহী গ্রন্থাগারে একদিন বিকেল চারটের সময় এক সভার আয়োজন করা হয়েছিল। তিনটের সময় রজনীকে অনুরোধ করা হয়েছিল গান লিখতে। রজনীকান্ত জলধর সেনকে অবাক করে দিয়ে অস্বাভাবিক দ্রুততায় একটি গান লিখে ফেলেছিলেন। সেটি ছিল তাঁর অসামান্য জনপ্রিয় বিখ্যাত একটি দেশাত্মবোধক গান –
‘‘তব, চরণ নিম্নে, উৎসবময়ী শ্যাম-ধরনী সরসা,
ঊর্দ্ধে চাহ অগণিত-মনি-রঞ্জিত নভো-নীলাঞ্চলা
সৌম্য-মধুর-দিব্যাঙ্গনা শান্ত-কুশল-দরশা৷’’
রজনীকান্ত ‘স্বদেশি আন্দোলনের যুগের কবি’। ১৯০৫ সালে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন স্থায়ী করতে যাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রজনীকান্ত। সেই সময় দিকে দিকে যখন রব উঠেছিল বিদেশি বস্ত্র বর্জন করার। সে আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের মতো রজনীকান্তও সমর্থন দেন। বিভিন্ন দেশীয় কাপড়ের কলগুলি মোটা কাপড় তৈরি করতে লাগল। সেই সময় রজনীকান্ত গেয়ে উঠেছিলেন সেই বিখ্যাত গানটি –
“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই;
দীন দুখিনি মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।।’’
রজনীকান্তের এই গান বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। তবে এই গানটি রচনার নেপথ্যে একটি কাহিনী রয়েছে। রজনীকান্তের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল ‘অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়’র। রজনীকান্ত কলকাতায় এসে তখন একটি মেসে থাকতেন, সেখানে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসতেন অক্ষয়কুমার। এক বার সেখানেই সকলে মিলে গান করার জন্য অনুরোধ করলেন রজনীকান্তকে। তখন তিনি নতুন রচিত ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গানটি ধরলেন। সবেমাত্র অন্তরার অংশটুকু রচনা করে গেয়েছেন, অক্ষয়কুমার এমন সময় রজনীকান্তকে সোজা নিয়ে এলেন বউবাজারে বসুমতীর অফিসে তৎকালীন সম্পাদক জলধর সেনের দফতরে। বললেন সেই গানের কথা। অসমাপ্ত সেই গানটি পড়ে জলধর বললেন বাকিটুকু রচনা করে দিতে। সেখানে বসেই রজনীকান্ত গানের বাকি অংশটুকু রচনা করেছিলেন।
তাঁর এই গানটি গণ-আন্দোলনে প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জোয়ার সৃষ্ট করে। এর মাধ্যমেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন এবং ‘কান্তকবি’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
তিনি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখার দারুণ ভক্ত ছিলেন। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ্য। ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রায়’ যখন রাজশাহিতে এসেছিলেন তখন রজনীকান্তের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানে মুগ্ধ রজনীকান্ত এর পর থেকে হাসির গান লিখতে শুরু করেছিলেন। তবু গবেষকদের মতো রজনীকান্তের হাসির গানের ধরণ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাসির গানের থেকে আলাদা। এ প্রসঙ্গে ‘প্রমথনাথ বিশী’ বলেছিলেন – ‘‘দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান যদি শুক্ল শীতের বাতাস হয়, রজনীকান্তের হাসির গান বর্ষায় জলভারাক্রান্ত পূবের বাতাস।’’ একসময় রজনীকান্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমপর্যায়ভুক্ত লেখা লিখতে শুরু করেন।
এমনকি ডি. এল. রায়ের হাসির কবিতাগুলোও তাঁকে হাস্য রসাত্মক কবিতা ও গান রচনায় আগ্রহী করে তোলে। তাঁর ‘পুরাতত্ত্ববিৎ’ রচনায় লেখা একটি দেখতে পাওয়া যায়,
‘‘রাজা অশোকের কটা ছিল হাতি
টোডরমলের কটা ছিল নাতি,
কালাপাহাড়ের কটা ছিল ছাতি,
এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির
আকবর শাহ কাছা দিত কিনা,
নূরজাহানের কটা ছিল বীণা,
মন্থরা ছিলেন ক্ষীণা কিম্বা পীনা,
এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির।’’
নীতিকবিতা রচনাতেও তাঁর জুড়ি নেই। জীবনের শেষ দিকে এসে অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ সঞ্চয়ে তিনি লিখে রেখে গেছেন নীত-আদর্শ সম্বলিত এই মহান নীতি কবিতাগুলো। বহুল পরিচিত দুটি উদ্ধৃত করা যাক:
“শৈশবে সদুপদেশ যাহার না রোচে,
জীবনে তাহার কভু মূর্খতা না ঘোচে।”
এবং,
“নদী কভু নাহি করে নিজ জলপান
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ, দগ্ধ হয়ে, করে পরে অন্নদান।”
রজনীকান্ত সঙ্গীতের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর ‘ঈশ্বর-ভক্তিমূলক গান’গুলোর জন্যই। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর অগাধ প্রেম, বিশ্বাস ও আস্থা তাঁর গানগুলোতে প্রতিভাত হয়ে বাংলা গানকে গভীর দর্শন চিন্তায় স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। জীবনের সমস্ত আনন্দগুলোতে তিনি ঈশ্বরকে স্মরণ করেছেন। গভীর সংকটে যখন তিনি নিপতিত হয়েছেন, একে ঈশ্বরদত্ত আশীষ হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবার উদ্দেশ্যে বিনয়ের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে বারবারই নিজেকে দীন-হীন ভাবে উপস্থাপন করেছেন রজনীকান্ত। তাই, তাঁর রচিত ভক্তিমূলক নানা গান প্রার্থনারূপে উপাসনালয়গুলোতে আজও গীত হয়।
সে কালে রজনীকান্তের গান রেকর্ড করেছিলেন ‘ইন্দুবালা’, ‘কে মল্লিক’-এর মতো শিল্পীরা। পরবর্তী কালে বহু বিখ্যাত শিল্পী তাঁর গান রেকর্ড করেছিলেন। এমনকী, তাঁর গান বহু চলচ্চিত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে।
মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন রজনীকান্ত। ছোটবেলাতেই তাঁর বড় ভাই ও বড় বোনের অকাল প্রয়াণ ঘটে। ছোট ভাই জননীকান্তও ‘জলাতঙ্ক’ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই সকল মৃত্যু তাঁকে গভীর জীবনবোধে উজ্জীবিত করতে ভূমিকা রাখে।
ব্যক্তিগত জীবনে রজনীকান্ত সেনের সাথে ‘হিরন্ময়ী দেবী’র বিয়ে হয়েছিল। তাঁদের সংসারে ছিল চার পুত্র ও দুই কন্যা। কিন্তু তাঁর পুত্র ‘ভূপেন্দ্র’ খুব অল্প বয়সেই মারা যান। এই মৃত্যুতে রজনীকান্ত গভীর ব্যথায় আহত হয়েছিলেন, কিন্তু হতাশ হননি। বরং ঈশ্বরের উপর অগাধ বিশ্বাসে রচনা করেছিলেন –
“তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ,
তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব৷
তোমারি দুনয়নে তোমারি শোক-বারি,
তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব৷”
কন্যা ‘শতদলবাসিনী’র মৃত্যুতেও তাঁর আক্ষেপ জাগেনি, জাগেনি এতটুকু অভিমান। ঈশ্বরের প্রতি প্রশস্তি জ্ঞাপন করে লিখেছিলেন বিখ্যাত সেই গান –
“আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু
কম করে মোরে দাওনি;
যা দিয়েছ, তারি অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তা কিছু নাওনি।।”
পরম বিনয়ের গুণে নিজের সমস্ত আরাধনা-উপাসনাকে তিনি সর্বদাই অপ্রতুল মনে করতেন রজনীকান্ত। তাই তাঁর পরম প্রার্থনা ছিল-
“তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে;
তব পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক, মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে।।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে প্রথম পরিচয়েই রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভা উপলব্ধি করতে পারেন। পরে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে তাঁর বাড়িতে বেরিয়েও আসেন একদিন রজনীকান্ত। উল্লেখ্য, রজনীকান্তের জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ কবি মহলে যথেষ্ট ‘নিন্দিত’ ও ‘তিরস্কৃত’ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিলেন রজনীকান্তের মৃত্যুর কয়েক বছর পর। ‘গৌরবহীন’ সেই রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত কদর রজনীকান্ত যথার্থতার সাথেই করতেন। রবীন্দ্রনাথও রজনীকান্তের প্রতিভায় ছিলেন অভিভূত।
স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ‘দেশাত্মবোধক গান’ রচনা এবং অসাধারণ সব ‘প্রার্থনাসঙ্গীত’ রচনা করে আর জলসায় জলসায় গান গেয়ে যখন রজনীকান্ত পরিচতি পেতে লাগলেন, কিছুটা নাম-যশ পেয়ে উঠলেন, তখনই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাঁর ‘কণ্ঠনালীতে প্রদাহ’ দেখা দেয়। পরে চিকিৎসকেরা তাঁর কণ্ঠনালীতে ‘ল্যারিঙ্কস্ ক্যানসার’ শনাক্ত করেন।
এত বড় অভিঘাতেও তিনি সামান্য বিচলিত হননি। পরম প্রিয় ঈশ্বরের কাছে জানিয়েছিলেন সুস্থতার আবেদন। কিন্তু সে আবেদন গ্রাহ্য না হলেও তাঁর এতটুকু খেদ ছিলনা বিধাতার প্রতি। তাঁর বরং মনে হয়েছিল, এই সব দুঃখ বেদনার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর তাঁকে পরিশুদ্ধ করছেন।
রজনীকান্ত কখনওই সরকারি মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তেমনই সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হননি। আবার শুধু স্বদেশি গান লিখে কিংবা গেয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি। প্রয়োজনে ছুটে গিয়েছিলেন গ্রামে গঞ্জে। সেখানে সাধারণ মানুষকে ‘স্বদেশি অন্দোলনের তৎপর্য’ বুঝিয়েছিলেন।
ক্যান্সার গুরুতর আকার ধারণ করায় চিকিৎসাতে কোন কাজ হচ্ছিল না। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, বিলেত থেকে ‘রেডিয়াম’ এনে থেরাপি প্রয়োগ করলে তবেই সুফল পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ হওয়ায় সেই পদ্ধতি অবলম্বন করা সম্ভব হয়নি। আরোগ্যের আশায় দুটি বইয়ের সত্ব বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে তাঁর কণ্ঠনালীতে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি, বরং অবস্থা জটিল হয়ে চিরতরে বাকশক্তি হারিয়েছিলেন এই কবি। জীবনের শেষ দিনগুলোতে নিদারুণ কষ্ট ও শোকের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করেছিলেন রজনী। তবে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেলেও তিনি নির্বাক অবস্থায় ক্রমাগত লিখে গিয়েছিলেন নানান ‘নীতি কাব্যগাথা’ আর ‘ভক্তিমূলক সংগীত’।
তিনি এ সময় রবীন্দ্রনাথকে একবার দেখতে চান। হাসপাতালের বাজে পরিবেশে রবীন্দ্রনাথের ছিল চরম অস্বস্তি। তা সত্ত্বেও, রজনীকান্তের অনুরোধ জানতে পেরে তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান রবীন্দ্রনাথ। রোগশয্যায় তাঁর পাশে বসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্য পরিচয় খুঁজে পেয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গে পরে লিখেছিলেন, ‘‘…শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাই।’’ সেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজে হারমোনিয়াম বাজান আর গান ধরেন রজনীকান্তের সন্তান ‘ক্ষিতীন্দ্র’ ও ‘শান্তিবালা’। রবীন্দ্রনাথের বিদায়ের পরে এই অনুভূতির প্রেক্ষিতেই তিনি রচনা করেন,
“আমায় সকল রকমে কাঙ্গাল করেছে, গর্ব করিতে চুর,
তাই যশ ও অর্থ, মান ও স্বাস্থ্য, সকলি করেছে দূর।
ঐগুলো সব মায়াময় রূপে, ফেলেছিল মোরে অহমিকা-কূপে,
তাই সব বাধা সরায়ে দয়াল করেছে দীন আতুর।”
রজনীকান্তের এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের বোলপুরের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ আপ্লুত হয়েছিলেন গানটির বাণী পড়ে। চিঠির প্রতি-উত্তর দিয়ে দীর্ঘ পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন –
“প্রীতিপূর্বক নমস্কারপূর্বক নিবেদন, সেদিন আপনার রোগশয্যার পাশে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাইণ্ড পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই। আপনি যে গানটি পাঠাইয়াছেন, তাহা শিরোধার্য করিয়া লইলাম।”
১৩ই সেপ্টেম্বর, ১৯১০ সালে (১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৮শে ভাদ্র) মাত্র ৪৫ বছর বয়সে কলকাতা মেডিকেল কলেজের কটেজ ওয়ার্ডেই এই মহান কবি পরলোকগমন করেন। তাঁর মহাপ্রয়াণের পরও তাঁর বংশধরেরা পূর্ববঙ্গেই দীর্ঘদিন বসবাস করেন। কবির নাতনি ‘রমা সেন’ ভারতে চলে যান এবং ‘সুচিত্রা সেন’ নাম নিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক শক্তিমতী অভিনেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন।
রজনীকান্তের জীবদ্দশায় তাঁর তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছিল – ‘বাণি’, ‘কল্যাণী’, ‘অমৃত’। আর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় পাঁচটি গ্রন্থ- ‘অভয়া’, ‘আনন্দময়ী’, ‘বিশ্রাম’, ‘সদ্ভাবকুসুম’ ও ‘শেষদান’। এসব গ্রন্থে প্রকাশিত তাঁর গানগুলোকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় – ‘দেশাত্মবোধক’, ‘ভক্তিমূলক’, ‘প্রীতিমূলক’ ও ‘হাস্যরসাত্মক’ গান।
তাঁর কন্যা ‘শান্তিবালা দেবী’র দেওয়া তথ্যানুসারে, তাঁর মোট গানের সংখ্যা ২৯০টি। তবে তাঁর অসংখ্য গান হারিয়ে গেছে বলেই জানা যায়। রজনীকান্ত সেন গান লিখে উদাসীনভাবে সেগুলো ফেলে রাখতেন। কিন্তু যখন গাইবার দরকার পড়তো, তখন সেগুলো খুঁজে পেতেন না। এজন্য তাঁর সহধর্মিনী ‘হিরন্ময়ী দেবী’ এগুলো যখনই এখানে সেখানে পেতেন, সেগুলো যথাসম্ভব গুছিয়ে রাখতেন। কিন্তু সব তো আর পাওয়া যায়নি। তাই, তাঁর রচিত গানের প্রকৃত সংখ্যা আসলে কত, তা ঠিক আঁচ করা যায় না।
কর্কট রোগের মত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েও ঈশ্বরের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে যেসব অশ্রুতপূর্ব গান রচনা, সেগুলোই ছিলো তাঁর শেষ দিনগুলোর অনিঃশেষ প্রাণশক্তির উৎস। তাঁর গান, তাঁর কাব্য, তাঁর নীতিকবিতাগুলো পাঠে প্রতিটি বাঙালি পাঠকই এক অনিঃশেষ প্রাণশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠেন।
বিংশ শতকের বাংলা গানের যে সকল পথিকৃৎদের নাম আজও উচ্চারিত হয় তাঁদের মধ্যে অবিস্মরণীয় রজনীকান্ত।
(তথ্যসূত্র:
১- কান্তকবি রজনীকান্ত, অশোককুমার রায়, পাতাবাহার।
২- সাধক-কবি রজনীকান্ত সেন, মোহাম্মদ জুলফিকার, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ।
৩- রজনীকান্ত, ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়, পত্র ভারতী।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত