আজ তাঁর মৃত্যুর শততম বর্ষ হল। ১৯২০ থেকে ২০২০, এই একশো বছর পার করে এসে আজও যে প্রশ্নটা জনমানসে জাগে, সেটা হল, তাঁর কী এমন শক্তি ছিল, যার জন্য তাঁর এই প্রভাব প্রতিপত্তি? এর উত্তর একটাই – ‘অপার মাতৃস্নেহ’। এ এক ‘শাশ্বত মাতৃপ্রেম’। তিনি ‘সকলেরই মা’। এক বার জয়রামবাটিতে দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষুধার্তদের গরম খিচুড়ি বিতরণ করার সময় (তখন মা সারদার অল্প বয়স) তাঁর মধ্যে প্রকৃত জনসেবা করার রূপটি ফুটে উঠেছিল। ওই গরিব মানুষদের পাশে বসে হাতপাখায় তাঁদের বাতাস করে দিয়েছিলেন। ওই মানুষগুলো তখন মায়ের পরম স্নেহ পেয়ে আনন্দে মত্ত হয়ে উঠেছিল। অভাব, জ্বালা, যন্ত্রণা ভুলে সকলেই একাত্ম হয়েছিল সে দিন। আর মা সারদার এমন আচরণের নজির নানা উপলক্ষে রয়েছে একাধিক।
এই প্রসঙ্গে তাঁর এক ভক্ত ‘আমজাদের কথা’ স্মরণ করা যেতে পারে। নিজের হাতে তাঁকে খেতে দিয়েছিলেন, এমনকী খাওয়া শেষে এঁটো থালা পরিষ্কার করতেও তাঁর কোনও দ্বিধা ছিল না। আমজাদের পরিচয় সম্পর্কে তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমার শরৎ যেমন ছেলে, ওই আমজাদও তেমন ছেলে’। ‘শরৎ’, অর্থাৎ পরবর্তী কালে ‘স্বামী সারদানন্দ মহারাজ’। এই সামান্য ঘটনাটির তাৎপর্য মোটেও সাধারণ নয়। আজকের এই জটিল আর্থ-সামাজিক পৃথিবীতে, যেখানে ‘অসহিষ্ণুতা’র একটা বিষময় বাতাবরণ, সেখানে মা সারদার এই সহজ অভিব্যক্তিটা খুব বেশি প্রাসঙ্গিক। আজও আমরা সর্বস্তরে জাতপাতের সীমানা লঙ্ঘন করতে পারিনি। আমরা সবাই ‘এক’ এবং ‘অভিন্ন’, এই ‘শাশ্বত বোধ’ আমাদের সবার মধ্যে আসেনি। অথচ কত বছর আগে ‘প্রকৃত সমাজসেবী’ হিসেবে শ্রীশ্রীমা এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন, ‘আমরা ওরা’র বন্ধন।
তাঁর ‘অপার মাতৃস্নেহে’ কত জন কত ভাবে ধন্য হয়েছিলেন তার অজস্র ঘটনা ছড়িয়ে রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে বিপথগামী সেই ভয়ঙ্কর ডাকাতের কথা। অন্ধকার বিপদসঙ্কুল পথে মা হেঁটে চলেছিলেন, হঠাৎ সেই ডাকাত তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘কে তুমি’? প্রচণ্ড সাহসিনী মা সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমি তোমার মেয়ে সারদা’। এর পরের কাহিনী আজ সবার জানা। এ রকম শুধু একজন বা দু’জন ডাকাত বা বিপথগামী মানুষ নয়, আরও কত শত মানুষকে তিনি ‘জীবনের মূল স্রোতে’ ফিরিয়ে এনেছিলেন। এ কারণেই তিনি ‘বিশ্বজননী’।
তাঁর মধ্যে যে ‘নম্রতার পরিচয়’ জানা যায় সেটাও কম নয়। এই বৈশিষ্ট্য তাঁকে ‘ঘোষণা’ করতে হয়নি, তাঁর আচার-আচরণেই সেটা ফুটে উঠেছিল বার বার। তিনি তাঁর সহজ সরল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, এক কথায় সবার কাছেই হয়ে উঠেছিলেন ‘একান্ত আপনজন’। সকলের উদ্দেশেই তিনি বলতেন, ‘পরের দোষ দেখো না, দোষ দেখবে নিজের’। সমাজের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের জন্য তাঁর এই শাশ্বত কথাটি বিশেষ প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখের কথা, এখানেও আমরা ঠিক উল্টো পথে হাঁটছি। কারণে অকারণে আমরা কমবেশি সকলেই নিজের দোষ ভাবার চেয়ে অন্যের দোষ খুঁজে বেড়াই বেশি। আজকের দিনে দেশে, সমাজে এবং নিজের নিজের পরিবারে প্রতিনিয়ত যে সব সঙ্কট দেখা দিচ্ছে, সেখানে ওই প্রবণতা বিশেষ কার্যকর হচ্ছে। এর ফলে পরিবারের সমাজের সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক অস্থিরতা বাড়ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ লীলাসঙ্গিনী হিসাবে সারদা দেবীর বিশেষ পরিচয় আমরা কমবেশি সকলেই জানি। শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, তাঁর সাধনপথে যথাযথ সহযোগিতা করেছিলেন মা সারদা। সংসারের মধ্যে তাঁকে (রামকৃষ্ণদেবকে) আবদ্ধ করে রাখতে তিনি আসেননি, বরং ‘যত মত তত পথ’-এর প্রবক্তা ঠাকুরকে সাধনভজনের চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে মা সারদা ছিলেন সদা নিবেদিতপ্রাণ। ভক্তদের উদ্দেশে তিনি বলতেন, ‘আমি আর কী উপদেশ দেব। ঠাকুরের কথা সব বইয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। তাঁর একটা কথা ধারণা করে যদি চলতে পার, তো সব হয়ে যাবে।’
কিন্তু ঠাকুরের প্রতি তাঁর অসীম শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ভালবাসা থাকলেও কোনও কোনও ক্ষেত্রে, অবশ্যই বৃহত্তর স্বার্থে, তিনি প্রতিবাদও করেছিলেন। রামকৃষ্ণকে রাতের বেলায় খাবার মা সারদা নিজের হাতেই দিতেন। এক দিন জনৈক স্বভাবচরিত্রে দুষ্ট মহিলা শ্রী রামকৃষ্ণের পবিত্র সংস্পর্শে আসার বাসনায় তাঁকে বলেছিলেন, ‘মা, দিন, আজ আমি ঠাকুরকে খাবার থালাটা পৌঁছে দিয়ে আসি।’ মা সারদা সবই জানতেন তবু সেই মহিলার হাতেই হাসিমুখে ঠাকুরের খাবার থালাটা তুলে দিয়েছিলেন। এই ঘটনায় শ্রী রামকৃষ্ণ সামান্য অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। পরে তিনি সারদা দেবীকে বলেছিলেন, ‘জান, ওই মেয়েটার স্বভাব চরিত্রে দোষ আছে। ওর হাতে আমাকে খেতে দিলে?’ এ কথা শুনে মা সারদা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘তোমার খাবার আমি নিজেই নিয়ে আসব, কিন্তু আমায় মা বলে চাইলে আমি থাকতে পারব না।’
এমনই ছিলেন তিনি। ভক্তের ডাকে কখনওই সাড়া না দিয়ে থাকেননি। সন্তানস্নেহে ভক্তদের আপন করে নিতেন। প্রতিটি মানুষকে নিজের মধ্যে দেবতাজ্ঞানে গ্রহণ করতেন। তিনি সাড়া দিয়েছিলেন সবার ডাকে, এমনকী পশুপাখিদেরও সন্তানস্নেহে আপ্লুত করেছিলেন। সারদার কৃপালাভের জন্য মানুষ যখন ব্যাকুল, তাঁকে দেবী ভাবে পুজো দিতে আকুল, তিনি তখনও আর পাঁচ জন সাধারণের মতো নিজেকে ভাবতেন। সব সময় নিজেকে আড়াল করে রাখতেন। যেন অতি সাধারণ এক পল্লিবালা। এক বার এক সহজ সরল ভক্ত নিজেকে সংযত করে রাখতে না পেরে তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, মা, আপনি কি সাক্ষাৎ মা কালী? একেবারে চমকে উঠেছিলেন তিনি। এটা ওটা নানা কথা বলে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেয়েছিলেন। ও দিকে ভক্ত নাছোড় ছিলেন। অনেকের মুখে এ প্রসঙ্গটি তিনি শুনেছিলেন, তাই এ বার সরাসরি মাকে বলেই জানতে চেয়েছিলেন তার সত্যাসত্য। তিনি শেষ পর্যন্ত ধরা দিয়েছিলেন। তবে সেখানেও নিজেকে একটু রহস্যে ঢেকেছিলেন। ভক্তের ডাকে, সন্তানের প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিরুত্তর থাকবেন, তা কী হয়? অবশেষে বলেছিলেন, ‘ওই, লোকে বলে কালী’! এ কথা বলেই দ্রুত প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছিলেন।
নিজের গর্ভজাত সন্তান না থাকায় স্বামী শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তিনি মৃদু অভিযোগও করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে জানিয়েছিলেন, কালে কালান্তরে, বহু ‘ছেলে’র ‘মা’ ডাক শুনে ক্লান্ত হতে হবে তাঁকে। পালন করতে হবে মাতৃত্বের প্রভূত দায়িত্ব। মহাসমাধির আগে শ্রীরামকৃষ্ণ উদ্যানবাটীর জানলা দিয়ে কলকাতার দিকে অঙ্গুলিসংকেত করে সমস্যায় ‘কিলবিল’ করা মানুষের দেখভালের ভার অর্পণ করেছিলেন সারদামণির উপর। ১৮৭২ সালে, জ্যৈষ্ঠ অমাবস্যার কালীপুজোর রাতে সারদাকে ষোড়শী রূপে পুজো করে, তাঁর মধ্যের শক্তির জাগরণ ঘটিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর কাজে, মননে-চিন্তনে সেই শক্তিরই প্রকাশ ঘটেছিল।
সেই রূপ প্রচ্ছন্ন রেখেছিলেন সারদা। এক বার মাত্র বলেছিলেন, ‘লোকে বলে কালী’; নিরুপায় হয়েই মৃদু স্বরে স্বরূপ ব্যক্ত করেছিলেন। এই শক্তিই তাঁকে ‘লোকজননী’, ‘সঙ্ঘজননী’, ‘দেশজননী’, ‘বিশ্বজননী’ করেছিল। অথচ তিনি সহজ সরল মাটির কন্যা। শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় ‘রূপ ঢেকে আসা’।
মানুষের কষ্ট তাঁকে পীড়া দিত। জমিদারের পীড়নের বিরুদ্ধে চাষির মেয়েদের প্রতিরোধ গড়তে প্রেরণা দিয়েছিলেন। খরাক্লিষ্ট গ্রামবাসীদের তীব্র দুঃখ তাঁকে জর্জরিত করেছিল, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর প্রাত্যহিক জীবন-ছন্দ। সন্তান অভুক্ত থাকলে ‘মা’ কি খেতে পারেন? শ্রীরামকৃষ্ণের ‘মাতৃভাব’-এর দীপ্ত প্রকাশ ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। সঙ্ঘজননী রূপেও শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তাঁর প্রার্থনা ছিল – ‘তোমার নামে যাঁরা বেরুবে তাঁদের মোটা ভাত-কাপড়ের অভাব যেন না হয়।’ সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার পর ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ বলেছিলেন, ‘শ্রীশ্রীমা আমাদের শুধুই গুরুপত্নী নন ভাই, তিনিই রক্ষাকর্ত্রী, পালনকারিণী, সঙ্ঘজননী।’ ত্যাগীদের শৃঙ্খলায়-সংযমে-নির্দিষ্ট লক্ষ্য উত্তরণে নিয়মিত দৃষ্টি দিয়ে তিনি উৎসাহিত করেছিলেন। সতর্ক ও শাসন করেছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশে ‘বারাণসী’ ও ‘কঙ্খলে’ সেবার উদ্দেশ্যে হাসপাতাল হওয়ার সময় সন্ন্যাসীর সেবাদর্শ নিয়ে দ্বন্দ্ব হলে শ্রীমা সেবাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। মায়াবতী আশ্রমে সাধনা নিয়ে দ্বন্দ্বের নিরসন করে, ‘অদ্বৈত ভাবের সাধনা’কে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ‘সঙ্ঘজননী’ রূপে বেলুড় মঠকে রক্ষা করেছিলেন। তিনিই ‘কারমাইকেলের’ কাছে ‘সারদানন্দ’ ও ‘জোসেফিন ম্যাকলাউড’কে পাঠিয়েছিলেন, যাতে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিষ্ঠান গণ্য করে ‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করা হয়। সারদাদেবী জানিয়েছিলেন, ‘মা’ বলে যাঁরা আসে তাঁদের সকলকেই তিনি আশ্রয় দেন। কে স্বদেশি, কে বিদেশি: তা তাঁর জানা নেই।
স্বামী বিবেকানন্দের পাশ্চাত্যে ভাবপ্রচারের সূত্রে ‘মার্গারেট নোবল’, ‘জোসেফিন ম্যাকলাউড’, ‘সারা ওলি বুল’, ‘সিস্টার ক্রিস্টিন’ সহ অগণন ভক্ত মাতৃসমীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা এ দেশের সংস্কৃতির পরিচয় তাঁর কাছে পেয়েছিলেন, তাঁর প্রেরণাতেই সমাজশিক্ষায় এগিয়েছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, ‘মাতৃভাব সবচেয়ে শুদ্ধভাব।’ সারদাদেবী সেই মাতৃভাবের প্রতিমূর্তি। সন্তানের জন্ম দিলেই জননী হওয়া যায় না। ‘জননী’ হয়ে উঠতে হয় সত্তার নানা স্তর পেরিয়ে। সন্তানের সার্বিক কল্যাণে শ্রীমা ছিলেন সদাতৎপর। ভক্ত সন্তানদের পথশ্রমের শ্রান্তি লাঘবের জন্য চান চা-পান করাতেন, তাই গ্রাম ঘুরে ঘুরে দুধ সংগ্রহ করতেন। পছন্দ মনে রেখে সামান্য আয়োজনেই তৈরি করতেন খাবার, ভ্রাতৃবধূর আঁতুড়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন অতি যত্নে রান্না করা বলকারক ঝোল। দূরের ভক্তদের পথের খাবার বেঁধে দিয়েছিলেন, সঙ্গে দিয়েছিলেন খরচ বাঁচিয়ে জমানো চার পয়সা। রক্তের সম্পর্কে নয়, মাতৃভাবের টানেই সবাই আপন ছিল তাঁর কাছে।
সহনশীলতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘যে সয়, সেই রয়/ যে না সয়, সে নাশ হয়।’ অভিভাবকসুলভ দূরদর্শিতায় ভক্তকে সামান্য মিথ্যে বলার মনস্তাপে চাকরি ছাড়তে না করেছিলেন, কারণ তখন তাঁকে অভাবের তাড়নায় আরও বড় মিথ্যার আশ্রয় নিতে হতে পারে। দক্ষ পরিচালন শক্তি নিয়ে বলেছিলেন, ‘যখন যেমন, তখন তেমন, যাঁকে যেমন, তাঁকে তেমন।’ শুনতে সহজ হলেও এ ভাবনা সোজা নয়।
আজ ভোগসর্বস্বতায় আমরা জীবনের ‘প্রচুর ভাঁড়ার’ খুঁজে ফিরছি, ত্যাগে, সহজ সারল্যে যে আনন্দ, তাকে ভুলতে বসেছি। হতাশা-বিষণ্ণতায় অস্থির হয়ে ত্যাগ করছি সদ্যোজাত সন্তানকে, কখনও বা উদ্দাম ভোগলালসায় অভ্যস্ত করে তাঁকে ছুঁড়ে দিচ্ছি নির্মম পৃথিবীতে।
সারদাদেবী নির্বাসনার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘জগতের কেউ পর নয়।’ এই সকলের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখা, আপন করে নেওয়াই প্রকৃত শিক্ষা। অদ্বৈতবাদের এই ধারণার মধ্য দিয়েই শিখিয়েছিলেন জাতপাত ও অর্থের ভেদবৈষম্যের ঊর্ধ্বে ওঠা সম্ভব। ‘অপরের দোষ নয়, দোষ দেখবে নিজের’ – নিজ স্বভাবের মূল্যায়ন ও পরিমার্জনাই আত্মগত সংকট থেকে আমাদের নিস্তার দিতে পারে। মা সারদা তাঁর ঐশীবোধ, অপার জ্ঞান ও অতলান্ত ভালবাসা ছড়িয়ে দিয়ে যে পথে সন্তানদের এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, আজও তা অনুসরণ ছাড়া আমাদের মুক্তি নেই।
দক্ষিণেশ্বর নহবতের ছোট্ট ঘরটিতে থাকার সময় তিনি যেমন জপধ্যান করেছিলেন, তেমনই শাশুড়ি চন্দ্রমণিদেবীর সেবা করেছিলেন পরম নিষ্ঠাভরে। আবার শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য জিওল মাছের ব্যবস্থাও রেখেছিলেন। কাজ হয়ে যাওয়ার পর ‘ঝাঁটা’টিকেও সযত্নে রাখতে হয়। এর মধ্যেও সেই চিরন্তন দর্শন, ‘যাকে রাখো, সেই রাখে।’ ফলমূল পুজোর ভোগের জন্য নিয়ে যাওয়ার পর ছোট চুপড়িটিকেও সযত্ন ধুয়ে রাখতেন তিনি, যাতে অন্য কাজে ব্যবহার করা যায়। অন্যদেরও পরামর্শ দিতেন তা ফেলে না দিতে।
আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত সারদা জটিল সামাজিক পারিবারিক জীবনে মানুষের সার্বিক উন্নতির কথা ভেবে প্রাধান্য দিয়েছিলেন কর্মযোগকে। কাজকর্ম বন্ধ করে শুধু জপধ্যান, পুজোপাঠ, সাধন ভজনের পক্ষে তিনি ছিলেন না। এ সব তো ‘আত্মনো মোক্ষর্থম্’। ‘জগদ্ধিতায় চ’ কাজ কে করবে? মানুষ বড় কাঁদছে। তাঁর কান্না থামাতে হবে। আর সেই লক্ষ্যেই কাজ করতে হবে। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য তাঁর দুটি জরুরি অভিমত –
ক) ‘কাজ করবে না তো দিনরাত কী নিয়ে থাকবে? চব্বিশ ঘণ্টা কি ধ্যানজপ করা যায়?’
খ) ‘কাজ করা চাই বইকি। কর্ম করতে করতে কর্মের বন্ধন কেটে যায়। তবে নিষ্কাম ভাব আসে। একদণ্ডও কাজ ছেড়ে থাকা উচিত নয়।’
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন, সারদা মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীরা এবং এই ভাবধারার সংশ্লিষ্ট মানুষজন জপধ্যান পুজোপাঠ অপেক্ষা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, লাইব্রেরি-সংস্কৃতিকেন্দ্র-হাসপাতাল-দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালনা, দুর্গত মানুষের সেবা-ত্রাণ ইত্যাদি কাজকে প্রাধান্য দেন। রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের নির্দেশ ছিল এই কর্মযোগের সাধনার প্রতি। সারদা প্রখর বাস্তবতা আর আধুনিক দৃষ্টির সমন্বয়ে যে প্রজ্ঞা ও চৈতন্যের সন্ধান পেয়েছিলেন, তাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
বিরুদ্ধ পরিবেশকে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসা, তার সঙ্গে মানিয়ে চলার যে নমনীয়তা, তা সহজেই দেখতে পাওয়া যায় সারদা দেবীর মধ্যে। ‘স্বামী প্রকাশানন্দ’ যখন সান ফ্রান্সিসকো কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন তখন আমেরিকার সমাজ-পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তামগ্ন তাঁর প্রতি মাতৃ-আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছিল এই ভাবে – ‘যেখানে যেমন, সেখানে তেমন,’ ‘যখন যেমন তখন তেমন, যে যেমন তাকে তেমন।’ আমাদের শিক্ষা, তা সে পুঁথিগতই হোক কিংবা ব্যবহারিক, তার লক্ষ্যও কিন্তু সব পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া মানিয়ে চলা।
এই প্রসঙ্গে অনিবার্য ভাবেই এসে পড়ে সহনশীলতার কথাও। ভারতের চিরায়ত ধর্ম যে ‘গ্রহিষ্ণুতা’, ‘সহিষ্ণুতা’ এবং ‘আত্তীকরণের কথা’ বলে, রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দ তাকে বিশেষ ভাবে প্রাধান্য দিতেন। সাম্প্রতিক কালে বহু ক্ষেত্রে এর বড় অভাব যখন লক্ষ্য করা যায়, তখন ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-দর্শন বিঘ্নিত হওয়ায় মনে পড়ে না কি – ‘যে সয়, সে রয়, যে না সয় সে নাশ হয়।’ রামকৃষ্ণ-সারদার এই সাবধানবাণীকে আমরা কি মান্যতা দেব না?
আমাদের মনের গতি বিচিত্র। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। তা আমাদের লক্ষ্যের দিকে পৌঁছতে দেয় না। তাই শ্রীমার পরামর্শ – বিশ্বাসের জায়গাটিকে ধীরে ধীরে পোক্ত করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে নিজের। কিন্তু সমাজ সংসারে যাঁদের সঙ্গে থাকা, ওঠা-বসা তাঁদের যথাযথ মান দিয়ে ধৈর্য্যের সঙ্গে তাঁদের কথাও শুনতে হবে। আধুনিক জীবনে এ সবকেই আমরা ‘স্পেস’ দেওয়া বলে থাকি। সে কালেও তিনি একটু ‘আলগা দিয়ে’ সব দিক দূর থেকে লক্ষ করার কথা বলেছিলেন। যাঁর যাঁর স্বাধীনতা অধিকার তাঁকে তা দিতেই হবে, এটি ছিল তাঁর প্রবল অভিব্যক্তি।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৪-এ আমেরিকা থেকে সতীর্থ স্বামী শিবানন্দকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন,
‘‘মা ঠাকরুন কি বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেহই পার না, ক্রমে পারবে। … রামকৃষ্ণ পরমহংস বরং যান, আমি ভীত নই। মা ঠাকুরানী গেলে সর্বনাশ। … দাদা, জ্যান্ত দুর্গার পূজা দেখাব, তবে আমার নাম। তুমি জমি কিনে জ্যান্ত জ্যান্ত দুর্গা মাকে যে দিন বসিয়ে দেবে, সেই দিন হাঁপ ছাড়ব।’’
আসলে শ্রীমা সারদা ছিলেন বিবেকানন্দের ধ্রুবমন্দির শক্তি, প্রেরণা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আশ্রয়-বিশ্বাসের উৎসস্থল। স্বামীজি এই সত্য বুঝেছিলেন গভীর ভাবে, নিঃসংশয়ে। তাই শিশুর সারল্যে, অগ্নিময় বিশ্বাসে, অপরিমেয় আস্থায় মাতৃসমীপে ছুটে গিয়েছিলেন বারংবার। তিনি নিজেকে মনে করতেন শ্রীমায়ের চরণাশ্রিত ‘দাস’। ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় শ্রীমার তিরোধানের পরে এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে, নেপথ্যে শ্রীমা সারদা না-থাকলে শ্রীরামকৃষ্ণ ‘রামকৃষ্ণ পরমহংস’ হতেন না। শ্রীমা সারদা জীবন-সাধনায় শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনসঙ্গী রূপে ত্যাগে-তিতিক্ষায়, দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে, উত্তরজীবনে কঠিন দারিদ্রে, বারেবারে ঠাঁই-নাড়া জীবনে অপরিসীম সহনশীলতায়, কঠিন তপশ্চর্যায় আবর্তিত হয়েছিলেন। তাই রম্যা রঁল্যা ‘ত্যাগে মহত্তমা’য় তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে পারেন, আর সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণন বলতে পারেন হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী তাঁর (শ্রীমায়ের) জীবন ও আদর্শ থেকে মানুষ জেনে নিতে পারে শান্তির শিল্পকলা আত্মীকরণের কথা।
শ্রীরামকৃষ্ণ বাছবিচার করে দীক্ষা দিতেন, এমনকী খাদ্যাখাদ্যে ছোঁয়াস্পর্শও বিচার করতেন। শ্রীমা সারদা ছিলেন ঠিক এর বিপরীতে। হাজারো সমস্যায় ‘কিলবিল করা’ মানুষজনের দেখভালের পরিপূর্ণ দায়িত্ব যিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, যিনি লোকজননী, তাঁর দুয়ার সকলের জন্য খোলা থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। যুক্তিবোধের আলোয় নরেন্দ্রনাথকে পাশ্চাত্যে পাড়ির অনুমতি দিয়েছিলেন, প্রত্যাবর্তনে সাদর গ্রহণ করেছিলেন। মার্গারেট নোবল, মিসেস ওলি বুল প্রমুখ সকলের সঙ্গে একাসনে বসে আহার করেছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে ভারতবর্ষে নারী জাগরণ ঘটবেই এটি স্বামীজির আকাঙ্ক্ষা শুধু নয়, কালের প্রেক্ষায় অবশ্যম্ভাবী।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনা শেক্সপিয়র ক্লাবে প্রদত্ত বক্তৃতায় স্বামীজি শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির পরে ঘরবাড়ি-পরিজন ছেড়ে আসা বারো জন তরুণের অসহায়তার কথা জানিয়ে তাঁদের একমাত্র ভরসাস্থল যে শ্রীমা, সে কথা মেলে ধরেছিলেন এভাবে –
‘‘সে কী হৃদয়যন্ত্রণা, সেই যন্ত্রণার তীব্রতা ছিল অসহনীয়। … সে দিন আমাকে সহানুভূতি দেখানোর কেউ ছিল না। … শুধু এক জন ছাড়া। … আমাদের গুরুদেবের সহধর্মিণী। কিন্তু তিনি ছিলেন নিঃসহায়। আমাদের চেয়েও তিনি ছিলেন দরিদ্র।’’
তিন বছরের বালিকা সারদার সঙ্গে এক গানের আসরে প্রথম দেখা হয়েছিল রামকৃষ্ণের। নবীন গায়ক দলের দিকে সারদার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘তুমি কাকে বিয়ে করতে চাও’। বালিকা তাঁর ছোট্ট তর্জনী অন্য দিকে রামকৃষ্ণের দিকে নির্দেশ করে বলেছিল – এঁকে। এরপর পাঁচ বছরের বালিকা সারদার বিবাহ হয়েছিল চব্বিশ বছরের যুবক রামকৃষ্ণের সঙ্গে। রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালীর মন্দিরের পূজারি।
এ ধরনের বাল্যবিবাহ সেকালে প্রচলিত ছিল। তবে, একে বলা উচিত বাগ্দান। কারণ, কন্যা দেহে-মনে সাবালিকা হওয়ার পরই তাঁকে শ্বশুরগৃহে পাঠানো হত। কিন্তু ঠাকুর ও শ্রীমায়ের বিবাহ ছিল এক আধ্যাত্মিক বন্ধন। রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর থেকে কামারপুকুরে যখন আসেন, মা-কে তাঁর পিতৃগৃহ জয়রামবাটী থেকে আনানো হয়। ঠাকুর তাঁকে নিজের হাতে একটু একটু করে তাঁর আধ্যাত্মিক সঙ্গিনী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি জানতেন, রামকৃষ্ণ মিশনের দায়িত্ব একদিন নিতে হবে সারদাকে। ঠাকুর নিজেকেও পরীক্ষা করেছিলেন, সারদা অন্তরে অতি পবিত্র, সারদার সঙ্গ কখনও তাঁর মনে সাধারণ মানুষের কাম-ভাব জাগ্রত করে না।
রামকৃষ্ণ ঈশ্বরকে সাধনা করেছিলেন শক্তিরূপিণী মাতৃমূর্তিতে। সারদা তাঁর কাছে ছিলেন জীবন্ত ভগবতী। সাত বছর বয়সে, নয় বছর বয়সে, চোদ্দো বছর বয়সে সারদা বার বার রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। রামকৃষ্ণের হাতে তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা চলেছিল অনুক্ষণ।
সারদার বয়স যখন আঠারো, তখন তিনি পদব্রজে জয়রামবাটী থেকে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর রামকৃষ্ণের কাছে পৌঁছেছিলেন। পথকষ্টে শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল। অসুস্থ অবস্থায় এসে পৌঁছেছিলেন। রামকৃষ্ণ প্রাণ দিয়ে স্ত্রীর শুশ্রূষা করেছিলেন, পথ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ভাল করে তুলেছিলেন। সেই সময় ঘটেছিল তাঁদের যুগ্ম আধ্যাত্মিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁর স্ত্রীকে জগজ্জননী রূপে পূজা করেছিলেন। এর অন্তর্নিহিত মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। চেতনানন্দ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। সারা জীবন ঠাকুর ঈশ্বরকে মাতৃরূপে আরাধনা করেছিলেন। সেই মাতৃরূপিণী শক্তিকে তিনি সারদাতে আরোপিত করেছিলেন, তারপর তাঁর পদপ্রান্তে নিজের সব সাধনা উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। ফলহারিণী কালীপূজার পুণ্যদিনে ঠাকুর এই ষোড়শী পূজা করেছিলেন। সারদা তখন ষোড়শী নন, অষ্টাদশী।
শক্তিরূপিণী মায়ের এক নাম ষোড়শী। ষোড়শী অবশ্য রাজরাজেশ্বরী এবং ত্রিপুরসুন্দরী নামেও পরিচিত। ঠাকুরের এই ষোড়শী পূজা, নিজের স্ত্রীকে জগজ্জননী রূপে আরাধনা অধ্যাত্মজগতে এক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। চেতনানন্দ বলছেন, কোনও কোনও অবতার বিবাহ করেছেন, যেমন – রামচন্দ্র, রামকৃষ্ণ। কোনও কোনও অবতার স্ত্রীকে পরিত্যাগ করেছেন, যেমন – বুদ্ধ, চৈতন্য। রামকৃষ্ণ স্ত্রীকে পরিত্যাগ করলেন না, তাঁকে শক্তি রূপে আরাধনা করলেন। এ এক বিরল, ব্যতিক্রমী ঘটনা।
বিবেকানন্দের মতো ঠাকুর-অন্ত প্রাণ ভক্ত বার বার বলেছিলেন, মায়ের স্থান ঠাকুরেরও উপরে। হঠাৎ একটু খটকা লাগতে পারে। রামকৃষ্ণের আদর্শ সারা পৃথিবীতে প্রচার করার ভার যে বিবেকানন্দের উপর ঠাকুর দিয়ে গিয়েছেন, তাঁর মুখে এ কী কথা? কিন্তু বিবেকানন্দ উপলব্ধি করেছিলেন, মায়ের মাধ্যমে ঠাকুর স্বয়ং নির্দেশ দিচ্ছেন। বিবেকানন্দ তাই গুরুভাইদের ডেকে ডেকে বলেছিলেন, ওরে, তোরা এখনও মাকে চিনলি না।
বিবেকানন্দ বিশ্বজয় করে ফিরে এসেছিলেন দেশে। পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়নে তাঁর বক্তৃতা সকল শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছিল। ফিরে আসার পর মায়ের সঙ্গে তাঁর একটি সুন্দর সাক্ষাৎকারের বিবরণ আছে। স্বামীজি সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেছিলেন মায়ের পায়ে। কত দিন পরে তাঁকে দেখে মায়ের চোখে ছিল পুত্রস্নেহ। উপস্থিত সকলে এক অপূর্ব স্বর্গীয় পরিবেশ উপলব্ধি করেছিলেন।
পাশ্চাত্যের রমণীদের সঙ্গে মায়ের সখ্যের উপর আছে কৌতূহলজনক আলোচনা। গ্রামের মেয়ে সারদা, এক বর্ণ ইংরেজি জানতেন না। কিন্তু চমৎকার আলাপচারিতা চালিয়ে গিয়েছিলেন ‘সারা বুল’, ‘মিস ম্যাকলয়েড’ বা ‘সিস্টার নিবেদিতা’র সঙ্গে। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে, কিন্তু আহার করতেন এঁদের সকলের সঙ্গে। ‘সিস্টার নিবেদিতা’ বলেছিলেন, মা, তুমি আমাদের কালী। মা বলেছিলেন, না না, তবে তো আমাকে জিভ বার করে রাখতে হবে। নিবেদিতা বলেছিলেন, তার কোনও দরকার নেই। তবু তুমি আমাদের কালী, আর ঠাকুর হলেন স্বয়ং শিব। মা মেনে নিয়েছিলেন। নিজ হাতে রঙিন উলের ঝালর দেওয়া হাতপাখা বানিয়ে দিয়েছিলেন নিবেদিতাকে। নিবেদিতা পরম আনন্দ পেয়েছিলেন এমন উপহার পেয়ে, সকলের মাথায় হাতপাখা ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন। মা বলেছিলেন, মেয়েটা বড় সরল। আর বিবেকানন্দের প্রতি আনুগত্য দেখবার মতো। নিজের দেশ ছেড়ে এসেছে গুরুর দেশের কাজে লাগবে বলে। নিবেদিতার ভারতপ্রেম অতুলনীয়।
শ্রীমা সারদা ‘রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের সঙ্ঘজননী’। সেই সূত্রেই তিনি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের শেষ কথা। তাঁর এই স্থানটি সর্বসমক্ষে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। ১৮৯৭ সালের ১লা মে অপরাহ্ণে ‘বলরাম বসুর বাড়িতে’ রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার দিন তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন,
‘‘আমাদের এই যে সঙ্ঘ হতে চলেছে, তিনি তার রক্ষাকর্ত্রী, পালনকারিণী, তিনি আমাদের সঙ্ঘজননী।’’
তাই বেলুড় মঠের জন্য ক্রীত জমি কলকাতার প্লেগের ত্রাণের অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে স্বামীজি যখন বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন, তখন বাধা দিয়েছিলেন শ্রীমা। আরও বিস্তৃত পরিসরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয়’ এবং আধুনিক পৃথিবীর নতুন তীর্থ। ‘মিস হেনরিয়েটা মুলার’ প্রদত্ত ৩৯,০০০ টাকায় মঠের জন্য জমি কেনার পরে স্বামীজি অশক্ত শরীরের সারদা দেবীকে চেয়ারে বসিয়ে সমস্ত জমি প্রদক্ষিণ করিয়েছিলেন শক্তির স্পর্শে শুদ্ধিকরণের লক্ষ্যে। ১৯০১ সালের যখন স্বামীজি বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো প্রবর্তন করেন, তখন মা’কেও দুর্গামূর্তির পাশে বসিয়ে শ্রীচরণে অঞ্জলি দেন। তাঁর ‘জ্যান্ত দুর্গা’ পুজোর অভীপ্সা সে দিন সার্থক হয়েছিল।
স্বামীজি প্রথম বার পাশ্চাত্য জয় করে ফেরার পরে সাষ্টাঙ্গে শ্রীমাকে প্রণাম করে জানিয়েছিলেন, এই সাফল্য শুধু মায়ের আশীর্বাদেই। অসুস্থ হয়ে পড়লে মা যখন তাঁকে দেখতে এসেছিলেন, তখন গঙ্গার পলিতে আটকে যাওয়া মায়ের নৌকাটি নিজে সতীর্থদের সঙ্গে নিয়ে ঠেলে দিয়েছিলেন ফেরার সময়ে। মৃত্যুর আগে এক দিন শ্রীমাকে প্রণাম করে স্বামীজি বিনীত ভাবে নিবেদন করেছিলেন তাঁর শেষ ও শাশ্বত উচ্চারণ,
‘‘মা, এইটুকু জানি, তোমার আশীর্বাদে আমার মতো তোমার অনেক নরেনের উদ্ভব হবে, শত শত বিবেকানন্দ উদ্ভূত হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে আরো জানি, তোমার মতো মা জগতে এই একটিই, আর দ্বিতীয় নেই।’’
বিবেকানন্দের আত্মসংবিৎ, আত্মোপলব্ধি থেকে উৎসারিত এই বাণী তাঁর ‘ধ্রুবমন্দির’ শ্রীমা সারদার অবস্থানকে যুগ-যুগান্তে পরিব্যাপ্ত-সমৃদ্ধ করে চলেছে ‘সত্যিকারের মা’, ‘চিরায়ত জননী’ রূপে।
ছোট একটি ঘটনার বর্ণনায় ঠাকুরের মানবিকতা ফুটিয়ে তুলেছেন স্বামী চেতনানন্দ। মা চন্দ্রমণির মৃত্যুসংবাদে ঠাকুর হাউহাউ করে কাঁদছিলেন দেখে, ভাগ্নে হৃদয় বলল শ্লেষের স্বরে বলেছিলেন – আপনি না সন্ন্যাসী, এত বিচলিত হওয়া আপনাকে সাজে! রেগে উঠে ঠাকুর বলেছিলেন, হৃদে, তুই চুপ কর। সন্ন্যাসী হয়েছি বলে তো আর হৃদয়হীন পশু হয়ে যাইনি।
মা সারদা ও তাঁর লীলার কথা অথবা রামকৃষ্ণ-সারদার সম্পর্কের কাহিনি সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন, সাংসারিক মানুষের কাছে ব্যাখ্যার অতীত। বিশ্বাস ও উপলব্ধির কথা। ভক্ত বলতে পারেন – আমি মানি তাই মানি, আমার অন্তরে তাঁর বাঁশরি শুনেছি তাই বঁধু আমি মানি।
আজও যেখানে অনেক মন্দিরে মেয়েদের প্রবেশাধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে হয়, সেই পশ্চাৎপটে এক ব্যক্তিত্বময়ী চরিত্র মা সারদা। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন এক কঠিন সময়ে, এই রমণীর পায়ে মাথা নত করতেন বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দ, ঈশ্বরীর আসনে বসিয়ে পূজা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, এমনই এক প্রেরণাময়ী নারীচরিত্র শ্রীমা সারদা দেবী।
আজ বাস্তবের রক্ততটে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ নিরসনে শ্রীমা সারদা যে জগৎপ্লাবী নিদান দিয়ে গিয়েছিলেন, তা এ কাল, ভাবীকাল এবং চিরকালের জন্য অমোঘ সত্য – ‘‘যদি শান্তি চাও তবে কারুর দোষ দেখো না … দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপনার করে নিতে শেখো। কেউ পর নয় … জগৎ তোমার।’’
(তথ্যসূত্র:
১- শতরূপে সারদা, পোদ্দার বুকস্ ইন্টারন্যাশনাল।
২- সেকালের সারদা মা একালের স্নেহময়ী মা, সুভাষ চন্দ্র সোম, ছায়া পাবলিকেশন।
৩- মমতাময়ী শ্রী শ্রীমা সারদা, অঞ্জনকুমার রায়, বুলবুল প্রকাশন।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত