তখন সদ্যই দিল্লীর মসনদে বসেছেন তিনি। সেসময় তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম দফায় ২০০৪ সালে মুম্বইয়ের একটি অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদী হঠাতই বলে বসলেন, আমাদের দেশ এক সময় কী ছিল, তা নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের দুনিয়ায় আমরা গর্ব করতে পারি। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী সে দিন যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী কর্ণের জন্ম মায়ের গর্ভে হয়নি। এর অর্থ হল সেই সময়েই জেনেটিক সায়েন্স ছিল। সে কারণেই তো কর্ণের জন্ম মায়ের গর্ভ ছাড়াই হয়ে থাকবে।’ তাঁর যুক্তির পক্ষে আরও প্রমাণ খাড়া করতে তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘আমরা গণেশের পুজো করি। কেউ তো প্লাস্টিক সার্জেন ছিলেন সেই জমানায়, যিনি মানুষের শরীরে হাতির মাথা জুড়ে প্লাস্টিক সার্জারি শুরু করেছিলেন।’ বিজ্ঞানের সঙ্গে রাজনৈতিক মতাদর্শ জড়িয়ে ফেললে বোধ হয় এমন কাণ্ডই ঘটে। আর বিজ্ঞানের সঙ্গে যদি রাজনৈতিক চমক দেওয়ার লক্ষ্য জড়িয়ে যায়? তা হলে বোধ হয় সওয়া এক বছরের কাজ পাঁচ সপ্তাহে সেরে ফেলে করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের নির্দেশ জারি হয়।
প্রসঙ্গত, মার্কিন মুলুকে এখন ঘোর আতঙ্ক ছড়িয়েছে। করোনাভাইরাসের ভয় তো ছিলই। তার সঙ্গে নতুন আতঙ্ক হল, ডোনাল্ড ট্রাম্প বছরের শেষে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই করোনার টিকা বাজারে আনার জন্য সে দেশের এফডিএ বা ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এ চাপ তৈরি করতে পারেন। অতিমারির জরুরি পরিস্থিতি দেখিয়ে তাতে ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হতে পারে। তাতে হিতে বিপরীত হবে কি না, আতঙ্ক সে নিয়েই। একই অবস্থা এখন ভারতবাসীরও। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সামনে না হয় ফের ভোটে জিতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার তাগিদ রয়েছে। কিন্তু এ দেশে হঠাৎ ১৫ আগস্টের মধ্যেই টিকা আবিষ্কারের নির্দেশ জারি করা হল কেন, তার কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি। বিরোধীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে করোনার টিকা আবিষ্কারের ঘোষণা করে দিয়ে গোটা দুনিয়াকে চমকে দিতে চান। আর সেই কারণেই আইসিএমআর হায়দ্রাবাদের ‘ভারত বায়োটেক’ সংস্থাকে নির্দেশ পাঠিয়েছে, যেভাবেই হোক আগামী পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে মানবদেহে পরীক্ষা শেষ করে ১৫ অগস্টের মধ্যে বাজারে টিকা ছাড়তে হবে।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই আইসিএমআর এই চিঠি পাঠিয়েছিল। তার ঠিক দু’দিন আগে, ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই করোনার টিকাকরণের প্রস্তুতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, স্বাস্থ্যকর্মী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে যাঁদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি, তাঁদের আগে টিকা দিতে হবে। তার পরে দেশের যে কোনও প্রান্তে, যে কোনও মানুষের কাছে যাতে করোনার টিকা পৌঁছে যায়, তার পরিকল্পনা করতে হবে। দেখতে হবে, এই টিকা যেন আমজনতার সাধ্যের মধ্যে থাকে। অনেকের মনে সে দিনই প্রশ্ন জেগেছিল, এখনও তো টিকাই আবিষ্কার হল না। তার আগেই এত পরিকল্পনা! কবে বাজারে টিকা আসবে, কোনও দেশই এখনও তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। এ দেশে তা হলে সাজো-সাজো রব কেন? দু’দিন পরে আইসিএমআর-এর চিঠি দেখে সমালোচকরা প্রশ্ন তোলেন, টিকা আবিষ্কারের কাজও কি লালকেল্লা থেকে চমকে দেওয়ার চিত্রনাট্য মেনে এগোচ্ছে?তবে সমালোচকরা এ-ও মানছেন, নিছক চমক নয়। মোদীজি আসলে রাজনৈতিক গিমিক পছন্দ করেন।
যেমন, নরেন্দ্র মোদী যখন আফগানিস্তান থেকে ফেরার পথে আচমকাই পাকিস্তানে গিয়ে নওয়াজ শরিফের প্রাসাদে হাজির হয়েছিলেন, তখনও তিনি কূটনৈতিক রীতি-নীতির তোয়াক্কা করেননি। তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ তখন দিল্লীতে। তাঁর বদলে মোদী নিজেই পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তৈরির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আবার নোটবন্দীর সময়ও একই কাণ্ড। অর্থমন্ত্রীর বদলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই কালো টাকা দূর করার ভার নিলেন। সে সময় তাঁর অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বা সরকারের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন আগেভাগে নোট বাতিলের পরিকল্পনার বিন্দুবিসর্গ জানতেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। তবে এ সবের মধ্যে চমক হয়ত ছিল। কিন্তু আচমকা পাকিস্তানে গিয়ে বা নোটবন্দী করে কোনও লাভ হয়েছে কি না, বা তার আদৌ দরকার ছিল কি না, সে প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। অর্থাৎ শেষপর্যন্ত তা কেবল রাজনৈতিক গিমিক হয়েই রয়ে গিয়েছে। এবার করোনার টিকা নিয়েও সেই একই ব্যাপার ঘটে কিনা, সেটাই এখন দেখার।