জিও বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরার শিরোপা ঘিরে প্রশ্ন উঠেছিল। এবার প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে রাফালে যুদ্ধবিমান তৈরিতে আনকোরা রিলায়েন্সকে নেওয়ায় নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণের সুর আরও চড়া করল কংগ্রেস।
কংগ্রেসের দাবি, প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্স সফরে গিয়ে রাফাল চুক্তি ঘোষণার মাত্র ১২ দিন আগে তৈরি করা হয়েছিল অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেড। সেদিন পর্যন্ত তাদের হাতে যুদ্ধবিমান তৈরির লাইসেন্সও ছিল না। অথচ, সরকারি সংস্থা ‘হিন্দুস্থান অ্যারোনেটিক্স লিমিটেড’কে বাতিল করে রাতারাতি রিলায়েন্সকেই ৩০ হাজার কোটির চুক্তি পাইয়ে দিয়েছে মোদি সরকার।
রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রীকে ‘টার্গেট’ করে টুইটে ব্যঙ্গের সুরে বলেছেন, ‘একটা স্যুট পরা উচিত। ৪৫ হাজার কোটি ঋণ হওয়া উচিত। ১০ দিনের পুরনো কোম্পানি হওয়া উচিত। জীবনে কোনওদিন একটিও বিমান তৈরি করেননি। যদি আপনি এইসব মানদণ্ড পূরণ করেন, তাহলে ‘অফসেট চুক্তি’–তে ৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পুরস্কার পাবেন।’ এরপর আবার টুইট করে রাহুল বলেছেন, এরসঙ্গে লাইফ সার্কল চুক্তি যোগ করলে অঙ্কটা দাঁড়াবে ২০ বিলিয়ন ডলারে।
রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, আগামী লোকসভা নির্বাচনে প্রচারের ময়দানে রাজীব গান্ধী জমানার ‘বোফর্স’ কামানকে হার মানাবে মোদি জমানার ‘রাফালে’ যুদ্ধবিমান বিতর্ক।
বিতর্ক উঠতেই অবশ্য রিলায়েন্স কর্ণধার অনিল আম্বানি আগেই চিঠি দিয়ে কংগ্রেস সভাপতিকে জানান, ‘রিলায়েন্স রাফাল যুদ্ধবিমান তৈরি করতে সক্ষম। আরও অনেক ক্ষেত্রে আমরা অন্য কোম্পানির থেকে এগিয়ে। রিলায়েন্স ডিফেন্সের কাছে গুজরাটের পিপিবাওতে সবচেয়ে বড় বেসরকারি শিপইয়ার্ড আছে। যা আমেরিকান নৌবিভাগের প্রশংসা পেয়েছে। এটা দুটি কোম্পানির মধ্যে চুক্তি। এতে সরকারের কোনও ভূমিকা নেই।’
কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরজেওয়ালার দাবি, ৪টি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রথম বিষয়, ডসল্ট অ্যাভিয়েশন কোম্পানি ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ ভারতের হিন্দুস্থান অ্যারোনেটিক্স লিমিটেডএর সঙ্গে ৩০ হাজার কোটির ‘ডিফেন্স অফসেট কন্ট্রাক্ট’ স্বাক্ষর করে। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের ১০ এপ্রিল ফ্রান্সে গিয়ে যখন ৩৬টি বিমান কেনার কথা ঘোষণা করলেন, ঠিক সেদিনই এইচএএল–কে এই চুক্তি থেকে বের করে দেওয়া হল।
প্রশ্ন দুই, ‘ডিফেন্স অফসেট কন্ট্রাক্ট’ দেওয়া হয়েছে রিলায়েন্স গোষ্ঠীকে। যাদের বিমান তৈরির অভিজ্ঞতা শূন্য। সেই ‘রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেড’ তৈরি করা হয়েছে ২০১৫ সালের ২৮ মার্চ। অর্থাৎ, ফ্রান্সে প্রধানমন্ত্রীর রাফাল ঘোষণার মাত্র ১২ দিন আগে। প্রশ্ন তিন, রিলায়েন্স গোষ্ঠীর আর একটি কোম্পানি রিলায়েন্স এয়ারোস্ট্রাকচার লিমিটেডকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক যুদ্ধবিমান তৈরির লাইসেন্স দিয়েছে। কিন্তু, আবেদনের আগে ও পরে ওই কোম্পানির কোনও বিল্ডিং বা জমি পর্যন্ত ছিল না। আশ্চর্যের বিষয় হল, মোদি ফ্রান্সে ৩৬টি যুদ্ধবিমান কেনার কথা ঘোষণার ১৪ দিন পর, ২৪ এপ্রিল এই কোম্পানি তৈরি হয়েছে। ফলে, যোগসাজশ বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
কংগ্রেসের চতুর্থ অভিযোগ হল, তথ্য ও প্রমাণ বলছে, ৩০ হাজার কোটির ‘ডিফেন্স অফসেট কন্ট্রাক্ট’ সরকারি সংস্থার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে রিলায়েন্স গোষ্ঠীকে দেওয়ার বিষয়টি ‘প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো’তে না দেওয়া নিয়ে মিথ্যা কথা বলেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারমন। শুধু তাই নয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পক্ষ থেকে ‘ডিফেন্স অফসেট কন্ট্রাক্ট’ মার্গ দর্শিকা জারি করা হয়েছিল। রীতিমতো যার গাইডলাইন ও নিয়মাবলি তৈরি করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, ‘ডিফেন্স অফসেট কন্ট্রাক্ট’ স্বাক্ষর করার ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অনুমতি জরুরি ছিল। মন্ত্রকের অ্যাকুইজিশন ম্যানেজারের সই থাকাও জরুরি ছিল। এবং ওই চুক্তির বার্ষিক রিপোর্ট ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন কাউন্সিলের সামনে পেশ করা জরুরি। প্রতি ছ’মাসে ওই কোম্পানির অডিট করাও বাধ্যতামূলক। অডিট না হলে, কোম্পানির অর্থদণ্ড করার কথা বলা হয়েছে। এইসব নিয়মের কথা উল্লেখ আছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে। যদিও সেইসব নিয়মের কোনও তোয়াক্কা করেনি মোদি সরকার। ‘পুঁজিবাদী বন্ধুত্ব’র এর থেকে বড় উদাহরণ আর কিই–বা হতে পারে!
সুরজেওয়ালার আরও অভিযোগ, মোদি সরকার সবমিলিয়ে ১,৩০,০০০ কোটি টাকা নিয়ে মিথ্যা কথা বলে চলেছে। তা হল, ৩০ হাজার কোটি ‘ডিফেন্স অফসেট কন্ট্রাক্ট’, এবং এক লক্ষ কোটির যুদ্ধবিমানের ‘লাইফ সাইকেল কস্ট কন্ট্রাক্ট’। কীভাবে সম্ভব?
২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেড এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে তারা ৩০ হাজার কোটির চুক্তি পাওয়ার কথা ঘোষণা করে। বলা হয়, ভারত ও ফ্রান্স ৩৬টি যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ৩৬টি বিমানের মোট মূল্য ৭.৮৭ বিলিয়ন ডলার। ভারতীয় টাকায় যা ৬০ হাজার কোটি। যার অর্ধেক ৩০ হাজার কোটির চুক্তি পেয়েছে রিলায়েন্স। বলেছে, চুক্তির ‘লাইফ সাইকেল’ মূল্য এক লক্ষ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, রিলায়েন্স যুদ্ধবিমান কেনার দাম জেনেছে। এবং প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছে। কিন্তু, সংসদে সেই তথ্য জানাতে অস্বীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী! ‘ডসল্ট অ্যাভিয়েশন’–ও তাদের ওয়েবসাইটে রিলায়েন্সের সঙ্গে এই চুক্তির কথা জানিয়েছে। এত কিছুর পরেও ৭ ফেব্রুয়ারি পিআইবি–তে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, কোনও বেসরকারি সংস্থাকে যুদ্ধবিমান তৈরির চুক্তি দেওয়া হয়নি। এখন স্বাভাবিক প্রশ্ন, কেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিথ্যা কথা বলছেন? এবার কি প্রধানমন্ত্রী সব তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরবেন, কেন তিনি রিলায়েন্সকে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং সারা জীবনের জন্য এক লক্ষ কোটি টাকার যুদ্ধবিমান তৈরির বরাত দিয়েছেন?
লোকসভা ভোটের প্রচারে তো বটেই, সংসদে চলতি অধিবেশনেও যে কংগ্রেস সহ বিরোধীদের বিজেপিকে আক্রমণের অন্যতম হাতিয়ার হতে চলেছে রাফালে, তা স্পষ্ট।