ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জোরপূর্বক দেশের ইতিহাসের খোলনলচে বদলে দিতে উদ্যত হয়েছে মোদী সরকার। শিক্ষাক্রম থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে মুঘল ইতিহাস। এপ্রিল মাসে ন্যাশানাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং বা এনসিইআরটি জানায়, তাদের দ্বাদশ শ্রেণির বই থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে গোটা মুঘল সাম্রাজ্যই। সেই নিয়ে শোরগোল পড়ে যায় দেশজুড়ে। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই ফের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে কেন্দ্র। শুক্রবার দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল শুক্রবার জানায়, স্নাতক স্তরের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়তে চলেছে উর্দু কবি মহম্মদ ইকবালের জীবনী। উল্লেখ্য, দেশাত্মবোধক গানগুলির অন্যতম হল ‘সারে জঁহা সে অচ্ছা, হিন্দুস্থাঁ হামারা…’। আর এই গানে, সৃষ্টি হয়েছিল কবি ইকবালের কলমেই। ফলত দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম থেকে ইকবালের জীবনী বাদ পড়ায় বিতর্ক মাথাচাড়া দিল আরও একবার। আর মোদী সরকারের এহেন নতুন ইতিহাস রচনার চেষ্টা নিয়ে একটি সর্বভারতীয় নিউজ পোর্টালে নিবন্ধ লিখেছেন প্রবীণ ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব। তাঁর মতে, আরএসএস এবং তাদের সমমনোভাবাপন্ন দলগুলি (যারা তাদের ছদ্ম-জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত) মনে করে তাদের সহ নাগরিকদের একটি অংশ বিদেশি। তাদের বিভিন্ন সময় মধ্যযুগের মুসলিম শাসকদের বংশধর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্ধ-শিক্ষিত এই প্রচারকদের কাছে ভারতীয় মুসলমানদের ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায় বলে মনে করেন হাবিব।
প্রবীণ ইতিহাসবিদের মতে, কেবল নির্বাচনে ফায়দা তোলার জন্য শুধু ধর্মের নামে দেশে ধর্মীয় মেরুকরণ এবং অতীত নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। যার ফলে দৈনন্দিন জীবনের দুর্দশার কথা ভুলে একটি অংশের মানুষ কেবল ধর্মীয় বিষয়গুলিকে নিয়ে মেতে রয়েছে। বিগত কয়েক বছরে, ভারতের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মূলত হোয়াটসঅ্যাপ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে, ইতিহাস সম্পর্কে মিথ্যা ছড়ানোর মাধ্যমে ঘৃণার বাতাবরণ তৈরির একটি কৌশল অবলম্বন করছে। মধ্যযুগীয় অতীতকে নিছক হিন্দু-মুসলিম বিরোধের ক্ষেত্রে পরিণত করে দেখানোর চেষ্টা চলছে। এমনকী স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়-সহ বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসও নতুন করে লেখা হচ্ছে। যা জাতীয় নেতাদের মধ্যে মতবিরোধের উপর বেশি জোর দেয়, যেমন – জওহরলাল নেহেরু বনাম সর্দার প্যাটেল, সুভাষ বোস বনাম গান্ধী। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাদের সম্মিলিত সংগ্রাম-আন্দোলন সম্পর্কে সেরকমভাবে উল্লেখ করা হচ্ছে না। অথচ, গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ এবং অন্যান্যরা হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য একত্রিত হয়েছিলেন। এনসিইআরটি একাদশ শ্রেণির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বইয়ে উল্লিখিত রাষ্ট্র নেতাদের তালিকা থেকে মৌলানা আজাদকে বাদ দিয়েছে। তিনি বিভক্ত মানসিকতার শিকার হয়েছিলেন। এমন নেতিবাচক সঙ্গে তিনি সারাজীবন লড়াই করেছিলেন। বর্তমানে নতুন প্রজন্মের কিছু অতি ডানপন্থী ইতিহাসবিদরা এমন একটি ইতিহাস তৈরি করতে চাইছেন, যা বিজেপির রাজনৈতিক প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রশিক্ষিত ইতিহাসবিদও নন। এমনকী একজন অর্থনীতিবিদও ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চটজলদি ইতিহাস লিখে ফেলছেন। এখানে সত্য, তথ্য এবং দক্ষতার দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ, এনসিইআরটি বা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ (আইসিএইচআর)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলির হস্তক্ষেপকে অবশ্যই অতি-ডানপন্থী মতাদর্শ দ্বারা চালিত বলেই মনে করছেন ইরফান হাবিব।