বাংলার রাজনীতির আঙিনায় বরাবরই তাৎপর্যপূর্ণ মতুয়া সম্প্রদায়। রাজ্যের ৮০টি বিধানসভা কেন্দ্র এবং ১২টি লোকসভা কেন্দ্রে ছড়িয়ে রয়েছে তাদের ভোট ব্যাঙ্ক। বনগাঁ, রানাঘাট ও মালদা উত্তর লোকসভা কেন্দ্র এবং বনগাঁ মহকুমা, রানাঘাট মহকুমা চাঁচল মহকুমা সহ রাজ্যের প্রায় ২৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে মতুয়াদের ভোটই কোনো রাজনৈতিক দলের জয়-পরাজয়ের হিসাব নির্ধারণ করে দেয়। সেই মতুয়া ভোটব্যাঙ্ককে নিজেদের দিকে একসময় টেনে এনেছিল তৃণমূল। কিন্তু মতুয়াদের মূল দাবি ছিল নাগরিকত্ব প্রদান। সেটির আশ্বাস দিয়ে তাঁদেরকে আবার নিজেদের দিকে টেনে এনেছিল গেরুয়াশিবির। ঊনিশের লোকসভা ও একুশের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত তা কার্যত অটুট ছিল। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম দিকে রাজ্যের শতাধিক পুরসভায় যখন ভোট হয়েছিল তার ফলাফল কার্যত বলে দিচ্ছে মতুয়ারা আর একচেটিয়া ভাবে বিজেপিকে ভোট দিচ্ছে না। আর কয়েক মাসের মধ্যেই রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন হতে চলেছে। তার আগে রাজ্যের মতুয়া প্রভাবিত এলাকাগুলিতে তৃণমূল বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার করছে। প্রশ্ন তুলছে, “কী পেলেন বিজেপিকে ভোট দিয়ে?” পাশাপাশি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মতুয়াদের জন্য কী কী করেছে আর আগামী দিনে আরও কী কী করবে, সে সম্বন্ধে তাদের ওয়াকিবহাল করছে তারা।
স্বভাবতই খানিকটা ব্যাকফুটে পদ্মশিবির। কারণ, তারা জোর গলায় বলতেও পারছে না যে নরেন্দ্র মোদীর সরকার মতুয়াদের জন্য ঠিক কী কী করেছে। তাঁদের কাছে তুলে ধরার মতো মাত্র দুটি বিষয় আছে। যা শুধু বিতর্কিতই নয়, কার্যত কুমিরছানার আখ্যানে পরিণত হয়েছে। এনআরসি আর সিএএ, ভোট এলেই এই দুটি বিলকে মতুয়াদের সামনে তুলে ধরছে বিজেপি। নাগরিকত্ব প্রদানের আশ্বাস দেখিয়ে চলছে মতুয়াদের ভোট ধরে রাখার চেষ্টা। তৃণমূল কর্মীরা মতুয়াদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মতুয়াদের জন্য কী কী করেছে, আর কী কী করতে চায়, সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরছেন। মতুয়া সমাজের উন্নয়নের জন্য বছর দুই আগেই মতুয়া ওয়েলফেয়ার বোর্ড তৈরি করেন মুখ্যমন্ত্রী। এই পর্ষদের মাধ্যমে গত দেড় বছরে মতুয়া অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে খরচ করা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা। আগামী মার্চের মধ্যে আরও ৪ কোটি টাকা খরচের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। কোন কোন খাতে সেই খরচ হয়েছে আর কোন কোন খাতে আরও খরচ করা হবে, সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরছে তৃণমূল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মতুয়াদের জন্য কিছুই করেনি’ – তা একেবারেই বলতে পারছেন না বিজেপির নেতা থেকে মতুয়া নেতারাও। কারণ, রাজ্য সরকারের প্রকল্পের হাত ধরে দুঃস্থ মতুয়া পরিবারগুলি মাথার ওপর পাকা ছাদ পেয়েছে। সেই সঙ্গে মতুয়া অধ্যুষিত এলাকায় তৈরি হচ্ছে রাস্তা এবং আলোর পরিকাঠামো। তৈরি হয়েছে প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের নামে কলেজ, হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামে বিশ্ববিদ্যালয় ও বাগদার আইটি কলেজ। ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়িতে নির্মিত হয়েছে দুটি গেট। ঠাকুরবাড়ির কামনাসাগর পুকুরের সংস্কার এবং মেলাপ্রাঙ্গণের সৌন্দর্যায়নের কাজও আগেই করেছে রাজ্য সরকার। এছাড়া ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে রাস্তা, জল ও আলোর মতো নানাবিধ পরিকাঠামো গড়া হয়েছে। মতুয়া ওয়েলফেয়ার বোর্ডের উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন দুই ২৪ পরগনা, নদিয়া, হুগলি, পূর্ব বর্ধমান, মালদহ প্রভৃতির জেলার মতুয়া সমাজের মানুষেরা। এলাকাভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ, শৌচাগার, রাস্তা ও নলকূপ তৈরি হয়েছে। উন্নত হয়েছে শতাধিক স্থানের ছোট ছোট হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ মন্দিরের পরিকাঠামো। হয়েছে সচেতনতার ক্যাম্পও। সরকারের তরফে বিতরণ করা হয়েছে গামছা ও ডঙ্কা। রাজ্য সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স দেওয়ার বিষয়টিও। আর এই সব কাজের খতিয়ান দেখিয়েই তৃণমূলের নেতা থেকে কর্মীরা মতুয়াদের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন যে বিজেপির কাছ থেকে তাঁরা প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কী কী পেয়েছে? ইতিমধ্যেই যা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে গেরুয়া-নেতৃত্বের।