এদেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ও আত্মহত্যার ওপর কতটা প্রভাব ফেলেছে কোভিড–১৯ অতিমারী? গত ২৮শে অক্টোবর প্রকাশিত হওয়া ২০২০ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) রিপোর্ট এই প্রশ্নকে আরও উসকে দিয়েছে। একদিকে যেমন পথ দুর্ঘটনা ও সেই সংক্রান্ত মৃত্যু কমতে দেখা গিয়েছে, সেখানে আত্মহত্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছ। যারা আত্মহত্যা করেছে তাদের মধ্যে পড়ুয়া ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, কারণ করোনা অতিমারীর অতিরিক্ত চাপ এরা বহন করতে পারেনি। বার্ষিক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু এবং আত্মহত্যা (এডিএসআই) রিপোর্ট, যা এনসিআরবি দ্বারা প্রকাশিত হয় (এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে), ভারতে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যার কারণে দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর সংখ্যার পরিসংখ্যানের সরকারী উৎস হিসাবে কাজ করে।
২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী (জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর) দেখা গিয়েছে, আত্মহত্যায় মৃত্যুর ঘটনা তীব্রভাবে বেড়েছে। সংখ্যায় যদি বলা হয় তবে এই সময়ের মধ্যে ১৫৩,০৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে আত্মহত্যায়। যা ১৯৬৭ সালের পর সর্বোচ্চ সংখ্যা। ২০১৯ সালের চেয়ে এই সংখ্যাটি ১০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৬৭ সালের পর এই সংখ্যাটি ক্রমশ লাফ দিয়ে বেড়ে বেড়ে সর্বোচ্চ চতুর্থে চলে গিয়েছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জনসংখ্যার অংশ হিসেবে এ ধরনের মৃত্যুর হার নজিরবিহীন নয়। আত্মহত্যায় মৃত্যুর সংখ্যা, যখন প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যার দ্বারা সামঞ্জস্য করা হয়, দেখা গিয়েছে ২০২০ সালে এটা ১১.৩ ছিল, যা গত দশ বছরে সর্বোচ্চ, কারণ ২০১০ সালে এই অনুপাত ছিল ১১.৪।
পাশাপাশি, লকডাউনের কারণে কিছুটা হলেও আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়েছে। কারণ আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বলছে পড়ুয়া ও পেশাদার লোকেরাই আত্মহত্যার পথ বেছেছে। করোনা অতিমারীর সবচেয়ে বড় সমান্তরাল ক্ষতির মধ্যে হল শিক্ষা, গত বছরের মার্চে শুরু হওয়া মহামারির জেরে দীর্ঘ ৬৮ দিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার পরও তা আজও খোলেনি। শিক্ষা মন্ত্রকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে ২ কোটি ৯০ লক্ষ পড়ুয়ার অনলাইনে শিক্ষার জন্য ডিজিটাল ডিভাইস নেই। অনলাইনে পড়াশোনা না চালিয়ে যাওয়ার অক্ষমতার জন্য মন্ত্রকের কাছে একাধিক পড়ুয়ার আত্মহত্যার খবর রিপোর্ট হয়েছে। এডিএসআই রিপোর্টে বলা হয়েছে, এগুলি কোনও কাল্পনিক হিসাব নয়। প্রত্যেক বছর ভারতে ৭-৮ শতাংশ পড়ুয়া আত্মহত্যার পথে হাঁটে, যা ২০২০ সালে ২১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপর রয়েছে বিভিন্ন পেশার মানুষ, যার মধ্যে পেশাদার বা বেতনভুক্ত ব্যক্তিদের আত্মহত্যার সংখ্যা ১৬.৫ শতাংশ ও দৈনিক মজুরদের আত্মহত্যা বেড়েছে ১৫.৭ শতাংশ।
উল্লেখ্য, রিপোর্টে এও দেখা গিয়েছে যে বেতনভুক্ত ব্যক্তিদের তুলনায় অতিমারী বেশি প্রভাব ফেলেছে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ওপর। বিক্রেতা এবং ব্যবসায়ীদের আত্মহত্যার ফলে মৃত্যু যথাক্রমে ২৬.১% এবং ৪৯.৯% বৃদ্ধি পেয়েছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিক্রেতা এবং ব্যবসায়ীরা স্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিদের একটি উপ-শ্রেণি, যারা সামগ্রিকভাবে শুধুমাত্র ৭.৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সমস্ত সংখ্যাগুলি সুপারিশ করে যে মহামারির কারণে অবিরত শিক্ষার অসুবিধা এবং আর্থিক ক্ষতি ভারতে একটি বিশাল ব্যয় বহন করছে। আত্মহত্যার কারণ মৃত্যুর কারণ-ভিত্তিক বিশ্লেষণ এই ধরনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে দরিদ্র (৬৯ শতাংশ) ও বেকারত্ব (২৪ শতাংশ)-দের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাদকাসক্ত বা নেশা করে এমন ব্যক্তিদের আত্মহত্যার সংখ্যাও বেড়েছে (১৭ শতাংশ)। এছাড়াও অসুস্থ (১৬ শতাংশ) ও পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত এমন মানুষদের (১৪ শতাংশ) আত্মঘাতী হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। তবে ৬৮ দিনের দীর্ঘ লকডাউনের কারণে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা। ২০২০ সালে তীব্রভাবে পতন ঘটেছে পথ দুর্ঘটনা ও সংক্রান্ত মৃত্যুর। দুর্ঘটনায় মৃত্যু যেখানে ৪০ শতাংশ ছিল, তা ২০২০ সালে ১১ শতাংশ কমেছে। ২০২০ সালে ৩৭৪,৩৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে পথ দুর্ঘটনায়। ২০০৯ সালের পর এটাই সর্বনিম্ন সংখ্যা। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৫৭,০২১। ২০১৯ সালের তুলনায়, এই ধরনের মৃত্যু ১১.১% কমেছে।