এক রুদ্ধশ্বাস, ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটল বৃহস্পতিবার রাতে। ভারতীয় সময় রাত দেড়টা থেকে দু’টোর মধ্যে লাল গ্রহ ছুঁল নাসার মহাকাশযান। নামল একটি সর্বাধুনিক ল্যান্ডার ও রোভার ‘পারসিভের্যান্স’। প্রাণের সন্ধানে যা পরে চষে ফেলবে লাল গ্রহের মাটি। তার পর সেই ল্যান্ডার থেকে মঙ্গলের আকাশে ওড়ানো হবে হেলিকপ্টার। ‘ইনজেনুইটি’। আকাশ থেকে মঙ্গলের আরও বড় এলাকাজুড়ে নজরদারি চালাতে এই হেলিকপ্টারটি ওড়ানো হবে। পৃথিবীর পর এই প্রথম অন্য কোনও গ্রহেও হেলিকপ্টার ওড়াতে চলেছে মানব সভ্যতা।
এদিকে এই ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকায় বৃহস্পতিবারই ইতিহাসে ঢুকে গেল ৪ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূতের নাম। যাদের মধ্যে দু’জন আবার বাঙালি। তাঁদের মধ্যে এক জন মহিলা। নাম স্বাতী মোহন। তিনি বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা। ‘পারসিভের্যান্স’-এর গাইডেন্স, নেভিগেশন ও কন্ট্রোলস অপারেশন্স-র প্রধান। বাকি ৩ জনের মধ্যে অন্যতম বেঙ্গালুরুর জে বব বলরাম। অন্য কোনও গ্রহে এ বার প্রথম যে হেলিকপ্টার ওড়াতে চলেছে বিশ্ব, সেই ইনজেনুইটি-র চিফ ইঞ্জিনিয়র।
বাকি দুজন বাঙালি। একজন অনুভব দত্ত। এখন মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যারোডায়নামিক্স ও অ্যারোইলেকট্রিসিটি বিভাগের অধ্যাপক। তিন দশক আগেই লাল গ্রহে হেলিকপ্টার ওড়ানোর স্বপ্নটা দেখতে শুরু করেছিলেন যে মুষ্টিমেয় কয়েক জন, তাঁদের অন্যতম মহিষাদলের অনুভব। আর দ্বিতীয় জন বর্ধমানের সৌম্য দত্ত। ১৫টি মানুষ একে অন্যের উপর দাঁড়ালে যত উচ্চতা হয়, তেমনই একটি দৈত্যাকার প্যারাশুট নির্মাণ প্রকল্পের অন্যতম কারিগর তিনি। ওই প্যারাশুটে চেপেই মঙ্গলের বুকে নেমেছে নাসার ‘মার্স ২০২০ রোভার’ পারসিভের্যান্স আর ল্যান্ডার।
এর আগে লাল গ্রহে এত বড় প্যারাসুট আর কখনও পাঠায়নি নাসা। কারণ, এমন প্যারাশুট না থাকলে মঙ্গলের বুকে নিরাপদে নামানো সম্ভব হত না মার্স ২০২০ রোভার ও ল্যান্ডার। সৌম্যের কথায়, ‘‘এ বার এত বড় আকারের প্যারাশুট বানানোর বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কারণ, ল্যান্ডার ও রোভারকে মঙ্গলের মাটিতে নামাতে কোনও অরবিটার প্রদক্ষিণ করবে না লাল গ্রহের কক্ষপথে। যে রকেটে চাপিয়ে এ বার পাঠানো হয়েছে মার্স ২০২০ ল্যান্ডার ও রোভার, তা পৃথিবী থেকে সরাসরি মঙ্গলে কক্ষপথে ঢুকে পড়বে। তার পর দ্রুত নামতে শুরু করবে লাল গ্রহে।’’
অনুভবের জন্ম পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মহিষাদলের ঘাঘরা গ্রামে। কোনও বায়ুমণ্ডলই নেই যে গ্রহে, সেই মঙ্গলে যে এমন হেলিকপ্টার ওড়ানো সম্ভব, সাড়ে ৩ দশক আগে এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে সেই স্বপ্নটা দেখিয়েছিলেন এই অনুভবই। পরে নাসার এমস রিসার্চ সেন্টারে এ বারের মঙ্গল অভিযানের হেলিকপ্টারের অ্যারোমেকানিক্স সম্পর্কিত যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গেও ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিলেন অনুভব।
পারসিভের্যান্স-এর গাইডেন্স, নেভিগেশন ও কন্ট্রোলস অপারেশন্স-র প্রধান স্বাতীর জন্ম বেঙ্গালুরুতে। জন্মের এক বছর পরেই মা, বাবার সঙ্গে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন স্বাতী। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে। ১৯৮৬-তে। তার পর বেড়ে ওঠা, পড়াশোনার পুরোটাই সেখানে। বড় হয়েছেন উত্তর ভার্জিনিয়া ও ওয়াশিংটন ডিসি-তে। মেকানিক্যাল ও অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব সায়েন্স করার পর স্বাতী অ্যারোনটিক্স ও অ্যাস্ট্রোনটিক্সে মাস্টার্স অব সায়েন্স করেন ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে। সেখান থেকেই পিএইচডি। এর আগে শনিতে পাঠানো নাসার মহাকাশযান ‘ক্যাসিনি’ এবং চাঁদে পাঠানো যান ‘গ্রেল’-এর অভিযানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন স্বাতী।
এছাড়া, হেলিকপ্টার ইনজেনুইটি-র চিফ ইঞ্জিনিয়ার জে বব বলরামের জন্মও বেঙ্গালুরুতে। মাদ্রাজের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে রেনস্লার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে মাস্টার্স এবং পিএইচডি-র পর বলরাম জেপিএল-এ চাকরি করতে ঢোকেন ১৯৮৫ সালে। ওই সময়ের মধ্যেই মঙ্গলে কয়েকটি ল্যান্ডার ও রোভার পাঠানো হয়ে গিয়েছে নাসার। ওই সময় বলরামেরই প্রথম মাথায় আসে ল্যান্ডারে চাপিয়ে মঙ্গলে হেলিকপ্টার পাঠালেই তো কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। সেটা নয়ের দশকের গোড়ার দিক। বলরামের মনে হয়, রোভার যতটা এলাকা ঘুরে দেখতে পারবে, তার চেয়ে অনেক বেশি এলাকার উপর অনেক কম সময়ে নজরদারির কাজটা সেরে ফেলতে পারবে হেলিকপ্টার। প্রথমে তাঁর এই চিন্তা ভাবনা আমল না পেলেও, বিজ্ঞান যত উন্নত হয়েছে, ততই বেড়েছে বলরামের কদর। আর এভাবেই ধীরে ধীরে নাসার সদ্য মঙ্গলাভিযানে জড়িয়ে গেল ৪ ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানীর নাম।