ফুটি কিসমত বা ফাটা কপাল শুনেছিলাম, জীবনের প্রথম হাসপাতাল যাপনে প্রত্যক্ষ করলাম। প্রথমবার হাসপাতালে ভর্তি হলাম তাও এতোদিন। হাসপাতালে শুয়ে মোবাইলের ক্যামেরায় এক এক করে গুনেছিলাম সবকটা সেলাই। ৩৪টা সেলাই। ফাটা খুলি জুড়তে এতগুলো স্টিচই প্রয়োজনীয় ছিল।
১৯টা রাত মল্লিকবাজারের ইন্সটিটিউট অফ নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে কাটিয়ে অবশেষে ফিরছি। কাটা দাগ, সেলাই এর দাগ, অবসতা নিয়ে ফিরছি, মনের ক্ষত নিয়ে ফিরছি কিন্তু বেঁচে আছি এটাই তো শিরোনাম৷ প্রতি সকালে চোখ খুলে যেত সূর্য ওঠার ঠিক পরেই। একটু দূরে চেয়ারে সিস্টার বসে, জানালায় প্রথম রোদ এসেছে জানান দিতে আরেকটা নতুন দিন উপহার দেওয়া হলো, কাজে লাগাও!
কতো মানুষ প্রার্থনা করেছে দেখলাম, যে যার মতো পেরেছে পুজো দিয়েছে, প্রার্থনা করেছে, তার ছবি পাঠিয়েছে। অনেককে ব্যক্তিগতভাবে চিনিও না, ফেসবুকে আলাপ, কোমাতে শুনে মেসেজ করেছে, যে কথাগুলো কোনদিন বলতে পারেনি সেই স্বীকারোক্তিগুলো লিখে গেছে৷ হাসপাতালের নিস্তেজ ঘরে শুয়ে ওগুলোই সূর্য ধোয়া প্রশান্তি ছিল আমার। Lacrimal glands এ আঘাত লাগার ফলে অকারণ চোখ দিয়ে কান্নার মতো জল পড়ছে, অনেক মেসেজ পড়ে আঘাত না লাগলেও জল গড়াতো।
শুরুর দুদিন অজ্ঞান ছিলাম। প্রথম চোখ খুলি রাতে কিন্তু স্পষ্ট মনে আছে ITU সিস্টার ঝলমলে হেসে বলেছিল, গুড মর্নিং! নতুন মর্নিংই তো। আরেকবার আশেপাশের রোগীর গোঁয়ানি শোনার, টিক টিক টিক টিক করে যন্ত্র জানান দিচ্ছে বেঁচে থাকার সেই শব্দ শোনার, ফিনাইল আর ডেটলের গন্ধ শোঁকার, প্যারামিটার ওঠানামা করছে সেই গ্রাফ দেখার পুনর্জন্ম।
কাজের কথা সেরে নিই। বাকিদের আশ্বস্ত করে জানাই, আমার চোখ সম্পূর্ণ ঠিক আছে। দুচোখ ভরে নতুন নিশ্বাস নিচ্ছি। হ্যাঁ মুখের ডানদিকে প্যারালিসিস হয়েছিল যেটা সারতে অনেকটা সময় লাগবে তবে আগের চেয়ে অনেকটা ভালো আছি। বাদ বাকি কসমেটিক চেঞ্জ নিয়ে ভাবিত নয়। সময়ের ঘষামাজাতে সেরে উঠবে ওসব দাগ।
এখনও অল্প অল্প করে ইলেকট্রিক শক দিয়ে স্টিমুলেশন পদ্ধতিতে মুখের নার্ভগুলো সতেজ করার কাজ চলছে। পাশাপাশি চলছে ফিজিওথেরাপি। কাজে ফিরতে পারবো সপ্তাহখানেকে তবে নিউরোলজিকাল মনিটরিং চলবে আগামী ছয় মাস। আর হ্যাঁ খুলি আগলে রাখতে হবে! আরেকবার হেড ইনজুরি হলেই পপাত চ, মমার চ!
মল্লিকবাজার নানা ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতির এক অদ্ভুত সামাজিক হাঁড়ি। যখন চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল আর কান খাড়া নানা শব্দ শুনতাম শুয়ে শুয়ে। পাশেই খ্রিস্টান কবরখানা যেদিক থেকে ভোরবেলা আজানের সুর শোনা যেত আর সন্ধে নামলে রোজ স্তোত্রপাঠ। আবার দুপুরে ইনকালাবি বা বন্দেমাতরমের স্লোগান শোনা যেত ওখান থেকেই। জানালা খুললেই শিরাজ হোটেলের মঁ মঁ করা বিরিয়ানির গন্ধ আর তার পিছনেই মল্লিকবাজারের বিখ্যাত গ্যারাজগুলোর মোবিল, ডিজেল, পাবলিক ইউরিনালের পেচ্ছাপের গন্ধ। সারাদিন টুংটাং। বেঁচে আছি জানান দিচ্ছিল ওসব শব্দগুলোই। ২২জানুয়ারির আগে বিরক্তির উদ্রেক করতো।
মিটিং মিছিল, ধর্ম, জিরাফে দিব্বি বেঁচে আমার শহর। সিংহ হৃদয়ের কিছু মানুষের শহর।আরেকবার বুঝলাম। সেই রাতেও বুঝেছিলাম। সুইগির ছেলেগুলো যারা তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিল তারা বুঝিয়েছিল, এতো বন্ধু যারা ছুটে এসেছিল তারা বুঝিয়েছিল৷ পরিবার, দাদা, মামা, জামাইবাবু সেই ভোরবেলা এসে বুঝিয়েছিল। ডাক্তার, হাসপাতালের লোকজন, পুলিশ বুঝিয়েছিল, সাংবাদিক বন্ধুরা, শুভাকাঙ্ক্ষীরা এমনকি মাননীয় রাজ্যপালও।
আমি আজীবন নরনারায়ণ সেবায় বিশ্বাসী। মূর্তিপুজোর চেয়ে মানুষ পুজোয় ব্রতী। এবার হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম, মানুষই শেষ কথা বলে। মানুষের ভালো করে যেতে হবে। সাধারণ মানুষ হয়ে। অর্থ, খ্যাতি, যশ, ক্ষমতা সব ক্ষনিকের সুখ। থেকে যাবে কতোজনের মন ছুঁয়ে যেতে পারলাম সেটুকু। ওইটুকুই নুড়িপাথরের মতো পকেটে রেখে দেওয়া ঝড়না থেকে কুড়িয়ে।
পিছনে অনেকটা অন্ধকার। সামনে আসমুদ্র সম্ভাবনা। তাই সামনেই এগিয়ে চলছি। প্রত্যেক মানুষের জীবনে এরকম একটা করে বাঁক আসে যার শেষে মানুষ আরো শক্ত হতে শেখে৷ আমিও শক্ত হয়েছি। ট্রাস্ট মি!
বিধাতা বলিউডের আব্বাস-মস্তানের চেয়েও দ্বিগুণ টুইস্ট দিয়ে আমার চিত্রনাট্য লিখছে। পুজোর ঠিক পরে বাবার কোলোনে ক্যান্সার ধরা পরলো। স্টেজ দুই। সফলভাবে অস্ত্রোপচার হলো, এখন কেমোথেরাপি চলছে, বাবা সুস্থ আছে। সেই নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম বলে লেখালেখি অনেক কম করে দিয়েছিলাম। মূলত পারিবারিক কারণে ব্যস্ত ছিলাম। এবার জুটলো আমার এই অসুস্থতা। বাড়িতে আসলেও তাই ইনফেকশনের ভয়ে বিশেষ কাউকে আসতে বলছি না। অপেক্ষা করো। আমাদের দেখা হবেই৷ মাঠেই ফিরবো, মনেই ফিরবো, নস্টালজিয়ার সিড়িতে রোজ বসবো, রোদ পোয়াবো ভালোবাসার বারান্দায়। তুমি আরামকেদারায় বসো, আমি মাথা রাখবো কোলে,…