এক সময় ‘বাংলা গানের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর’ বলা হত ‘জগন্ময় মিত্র’, ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়’ আর ‘ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য’কে। তাঁদের তিন জনের বন্ধুত্বও ছিল দেখার মতো। একসঙ্গে তাঁরা কোন জলসায় গেলে এতই গল্পে মশগুল থাকতেন যে, তাঁদের স্টেজে তোলাই তখন দায় হয়ে দাঁড়াত উদ্যোক্তাদের। এমনই এক বার কর্তাব্যক্তিরা বেশি জোরাজুরি করাতে ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়’ বলে দিয়েছিলেন, ‘‘শুনুন, আপনাদের কোনও চিন্তা করতে হবে না। যাঁরা গান শুনতে এসেছেন, তাঁরা আমাদের গান না শুনে যাবেন না। আমাদের আরেকটু না হয় আড্ডা দিতে দিন।’’ কিন্তু তাঁদের বন্ধুত্ব যাই-ই থাকুক, তাঁদের ভক্তদের মধ্যে ভাগাভাগি ছিল। কিন্তু ঘুণাক্ষরে তার রেশ কোনও দিন তাঁদের সম্পর্কে আঁচড়টুকুও ফেলতে পারেনি। ‘পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়’ তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’তে এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘‘যদি কেউ চাটুকারি প্রবৃত্তি নিয়ে ওঁকে (ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য) বলতেন, আপনার ‘যদি ভুলে যাও মোরে’ কিংবা ‘রাধে ভুল করে তুই’ গানটা কি হেমন্ত গাইতে পারতেন? ভীষণ রেগে চেঁচিয়ে বলতেন, ‘কথা কয়ো নাকো শুধু শোনো’ কিংবা ‘কিৎনা দুখ ভুলায়ে’ও আমি গাইতে পারব না। হেমন্তবাবু হেমন্তবাবুই।’’ ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের’ প্রতি তাঁর এতটাই শ্রদ্ধা ও মুগ্ধতা ছিল। তিনি বারবার বলতেন, গানের জন্য জীবনে দু’জনকে ‘ঈর্ষা’ করে থাকেন, তাঁদের একজন ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়’। আর দ্বিতীয় জন তাঁর ছোট ভাই ‘পান্নালাল ভট্টাচার্য’। তাঁর ভাই যেন ছিলেন তাঁর ‘বুকের পাঁজর’! ‘পান্নালাল’ যখন সাত মাসের মাতৃগর্ভে ছিলেন, তখন তাঁদের পিতা ‘সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য’ মারা গিয়েছিলেন। আজন্ম ভাইকে আগলে রেখেছিলেন ‘তাঁর মেজদা’ ধনঞ্জয়। তাঁকে ‘এইচএমভি’-তে নিয়ে যাওয়া, ‘জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের’ কাছে ‘উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম’ দেওয়ানো, বড় ভাই ‘প্রফুল্ল ভট্টাচার্য’কে দিয়ে ‘মেগাফোনের জেএন ঘোষের’ কাছে পাঠানো, সবই করেছিলেন তিনি। ধনঞ্জয় বুঝেছিলেন, পঞ্চাশের দশকে ‘কে মল্লিক’, ‘ভবানী দাস’ কী ‘মৃণালকান্তি ঘোষের’ পরে ‘ভক্তিগীতি’তে একটা ভাটা এসেছে। সেখানেই তাঁর ভাই ‘পানু’ কিছু করতে পারবেন। যে জন্য নিজে পরের পর ছবিতে অসংখ্য হিট গান গাওয়ার পর, হাজার অনুরোধেও ‘ভক্তিগীতি’ গাইতে চাইতেন না। বলতেন, ‘‘ওটা পানুর জায়গা। আমার নয়।’’ তিনি যা কিছু ভক্তিগীতি গেয়েছিলেন, সেগুলোর সবই ছিল তাঁর ভাইয়ের অকাল মৃত্যুর পরে। আর উল্টো দিকে তাঁর ভাই? ‘পান্নালাল ভট্টাচার্য’ দাদা বলতে ছিলেন অজ্ঞান। তার প্রকাশ যে কী তীব্র ছিল, তা নিয়ে বড়সড় উপন্যাস লেখা যায়। এক টুকরো বলা যেতে পারে। ’৬৬ সালের কথা। ‘পান্নালাল ভট্টাচার্য’ রেকর্ড করেছিলেন ‘‘অপার সংসার, নাহি পারাপার’’। বাড়িতে ফেরার পরে ‘ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের স্ত্রী’ তাঁর স্বামীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘কেমন গাইল পানু?’’ ধনঞ্জয় বলেছিলেন, ‘‘বাঁদরটার কাছে যা চেয়েছিলাম, তার ষাট ভাগ পেলাম।’’ সে’কথা শুনে পান্নালাল বলেছিলেন, ‘‘শোনো মেজদা, তুমি যেটা চেয়েছিলে, সেটা যদি পেতে, তা হলে আমি হতাম ধনঞ্জয়, তুমি হতে পান্না।’’ সেই ‘পান্না’ এক দিন তাঁর বুক খালি করে চলে গিয়েছিলেন চিরদিনের জন্য। ‘সন্তানহারা পিতার মতন’ দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল তাঁর জীবনটা। আস্ত একটা ‘মহীরুহ’ প্রলয় ঝড়ে নুয়ে পড়েছিল যেন! সব শোক সামাল দিয়ে ধনঞ্জয় তাও ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু ’৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে আবার ধাক্কা খেয়েছিলেন। সেবারে তাঁর স্ত্রী ‘রেখাদেবী’ চলে গিয়েছিলেন। এরপরে তাঁর জীবন জুড়ে ছিল শুধু ‘অবসাদ’ আর ‘অবসাদ’। তাঁর ‘হারমোনিয়াম’ একলা পড়ে থাকত। ‘তানপুরা’য় ধুলো জমে গিয়েছিল। কেবল ছাত্রছাত্রীরা এলে তিনি গান নিয়ে বসতেন। আর ক্কচিৎকদাচিৎ জলসায় যেতেন। তাঁর বাকি সময়ের বেশিটাই কাটত ঠাকুরঘরে। তিনি গেয়েছিলেন –
‘‘এ মাটি ছিনিয়ে নিতে কত বার ঝড় এসেছে
এ মাটি ভাসিয়ে দিতে কত বার বান ডেকেছে …।’’
‘তিন ছেলে’, ‘পুত্রবধূ কঙ্কনা’, ‘নাতনি দীপাঙ্কনা’কে নিয়ে ছিল তাঁর ভরাট সংসার। তবু ভিড়ের মধ্যেও তিনি যেন ছিলেন একা, নিঃসঙ্গ। তাঁর জীবনের খাঁ খাঁ করা প্রান্তরে একমাত্র ‘মরূদ্যান’ তিনি পেতেন তাঁর নাতনিকে কাছে পেলে। এক এক সময় বিছানা নিতেন। শিয়রে বসে তাঁর সেবা করতেন ‘পুত্রবধূ’। অস্ফুটে বলতেন ধনঞ্জয় তাঁকে বলতেন, ‘‘আর জন্মে তুমি বোধ হয় আমার মা ছিলে গো!’’ ’৯২ সালের মার্চ মাসে ধনঞ্জয় ‘শ্রীরামপুর’ গিয়েছিলেন এক ভক্তিমূলক গানের আসরে। সেটাই ছিল তাঁর শেষ বারের জন্য কোন আসরে যাওয়া। ‘ডায়াবেটিক নেপ্রোপ্যাথি’ তাঁকে ভিতর থেকে কুরে কুরে খেয়ে নিচ্ছিল। সেই বছরের ১৮ই ডিসেম্বর শেষ বারের মতো ‘কলেজ স্ট্রিটের বাড়ি’ ছেড়ে ধনঞ্জয় ভর্তি হয়েছিলেন উত্তর কলকাতার এক নার্সিংহোমে। আর তাঁর বাড়িতে ফেরা হয়নি। ২৭শে ডিসেম্বর নিভে গিয়েছিল তাঁর জীবন প্রদীপ, শেষ হয়েছিল বাংলা গানের একটা অধ্যায়ের।
১৯২২ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর, রবিবার, ‘হাওড়ার বারেন্দ্রপাড়া’য় জন্ম হয়েছিল ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের। আঁতুড়ে মা ‘অন্নপূর্ণা’র কোলে সদ্যোজাত ধনঞ্জয়কে দেখে তাঁর দাদামশাই বলেছিলেন, ‘‘জাতকের মুখাবয়বে অনেক সুলক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। যদি বাঁচে, একদিন স্বনামধন্য কৃতী পুরুষ হবে।’’ ভট্টাচার্য পরিবারের আদিবাস ছিল হাওড়ায়। তাঁরা ছিলেন ‘পায়রাটুঙ্গির জমিদার’। পূর্বপুরুষের প্রচুর সম্পত্তি ‘বংশানুক্রমে’ পেয়েছিলেন ধনঞ্জয়ের বাবা ‘সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য’। এরপরে সম্পত্তি নিয়ে শুরু হয়েছিল জ্ঞাতি-কুটুম্বদের সঙ্গে অশান্তি। সেই অশান্তির জন্য ‘সুরেন্দ্রনাথ’ সেখানকার পাট গুটিয়ে চলে গিয়েছিলেন ‘হাওড়ার আমতা’য়। উঠেছিলেন ভাড়াবাড়িতে। পরে তিনি ‘বালির বাগানতলার বারেন্দ্রপাড়া’য় জমি কিনেছিলেন। ‘সুরেন্দ্রনাথ’ চাকরি করতেন ‘বিএনআর’ অর্থাৎ ‘বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে’-তে। তাঁর বড় ছেলে ‘লক্ষ্মীকান্ত’ও সেখানেই চাকরি করতেন। দু’জনেই ‘এস্রাজ’ বাজাতেন। একদিন তাঁদের চোখ এড়িয়ে দুপুরবেলা ‘এস্রাজে’ হাত পাকাতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন ধনঞ্জয়। তখন বয়স কতই’বা, সবে পাঁচ। তাঁর ‘এস্রাজ’ বাজানোর পাট সেদিনই চুকে গিয়েছিল। কিন্তু গলা থাকতে গান নেবে কে? ‘মাঝিমাল্লার গান’, ‘বাউল-বোষ্টমের গান’, ‘কীর্তন’, ‘পালার গান’, ‘তরজা’, ‘পাঁচালি’ যখন যা পেতেন সেটাই গাইতেন। আর তাঁর সঙ্গী ছিল মা ‘অন্নপূর্ণা’র মিঠে গলার ‘ঘুমপাড়ানি’, ‘ছেলেভুলানো’ যত গান। কিন্তু জীবন কখনও সমানভাবে যায় না। মাত্র চার মাসের তফাতে ‘সুরেন্দ্রনাথ-লক্ষীকান্ত’ দু’জনেরই অকালমৃত্যু হয়েছিল। ‘অন্নপূর্ণা’র তখন জেরবার দশা। সংসারে ‘এগারোটি সন্তান’। ‘একমাত্ৰ সম্বল’ বলতে বালির জমিটা। ধনঞ্জয় তখন সাত বছরের বালক। আর ‘পান্নালাল’ তখন সাত মাসের মাতৃগর্ভে। এক-এক দিন এমনও যেত, ঘরে খাবার-আনাজপাতি বলতে কিছু থাকত না। মাঠঘাট থেকে গাছগাছালি কুড়িয়ে ‘অন্নপূর্ণা’ সেগুলোই ফুটিয়ে খেতে দিতেন ছেলেমেয়েদের। আর নিজে সেই ফোটানো জলটুকু মুখে দিতেন। ধনঞ্জয় ছিলেন মা বলতে অজ্ঞান। মা একাদশী করবেন, উপোসি থাকবেন, তা’ও তার সইত না। ওই সাত বছর থেকে মায়ের সঙ্গে ছেলেরও ‘একাদশী’ শুরু হয়েছিল। তিনি পড়াশুনো করতেন ‘রিভার্স টমসন স্কুলে’। পরে যার নাম হয়েছিল ‘শান্তিরাম স্কুল’। ‘মেধাবী ছাত্র’ ছিলেন। পরীক্ষায় বরাবর প্রথম, না হয় দ্বিতীয় হতেন। কিন্তু টাকাপয়সার তখন এমন টানাটানি শুরু হয়েছিল যে, তাঁর পড়া বন্ধ হয়ে যায় আরকী! তাঁর মাস্টারমশাইদের মধ্যে তাঁকে খুব ভালবাসতেন ‘সুধাংশু স্যার’। তাঁর চেষ্টায় ধনঞ্জয়ের স্কুলের মাইনে মকুব হয়েছিল। এরপরে যখন ‘ম্যাট্রিক পরীক্ষা’, তখন আবার তাঁর ফি দেওয়ার পয়সা ছিল না। স্কুলের শিক্ষকরাই চাঁদা তুলে ধনঞ্জয়ের ফি দিয়ে দিয়েছিলেন। ‘সুধাংশু স্যারের’ই উদ্যোগে প্রথম গান শিখতে যেতে শুরু করেছিলেন ধনঞ্জয়। স্যার সাইকেলে চাপিয়ে ছাত্রকে নিয়ে গান শেখাতে যেতেন ‘উত্তরপাড়া’য়। এরপরে একে একে ধনঞ্জয়ের গানজীবনে শিক্ষক হয়ে এসেছিলেন অনেকে। কিন্তু ‘গানের প্রথম গুরু কে’, জিজ্ঞেস করলেই বলতেন, ‘‘বাড়ির সামনে গান গেয়ে ভিক্ষা করছিল এক ভিক্ষুক। ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। ওই আমার প্রথম শিক্ষাগুরু। অনেক পরে ‘ক্ষুদিরাম’ ছবিতে গেয়েছিলাম ওই গান। অনেক প্রশংসা পেয়েছি। অর্থ পেয়েছি। কিন্তু গুরুকে আমার কিছুই দেওয়া হয়নি।’’ ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘গানের মালঞ্চে’ ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল ফুটেছিল। তার মোহে কে না কে মুগ্ধ হয়েছিলেন! তা’ও সে কোন কাল থেকে! ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ দিয়ে তা শুরু হয়েছিল। সেটা তাঁর জীবনের ‘স্কুলবেলার ঘটনা’। ‘বালির রিভার্স টমসন স্কুলে’ ক্লাসে ‘টিফিনের সময়’ বন্ধুদের চাপাচাপিতে তাঁকে গান করতে হত। এক দিন গাইছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে’র বিখ্যাত গান ‘‘স্বপন যদি মধুর এমন’’। সেই গানের রেশ পৌঁছেছিল মাস্টারমশাইদের কানে। এর পর থেকে তাঁরাই উদ্যোগ নিয়ে এক-দু’ জায়গায় ধনঞ্জয়কে গাইবার ব্যবস্থা করে দিতে শুরু করেছিলেন। দেখতে দেখতে এসেছিল স্কুলেরই ‘বার্ষিক অনুষ্ঠান’। সেখানে ‘একক’ গেয়েছিলেন ছোট্ট ধনঞ্জয় – ‘‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’ আর ‘‘ভাইয়ের দোরে ভাই কেঁদে যায়’’। দর্শকের আসনে বসেছিলেন ‘কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র’। গান শুনে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। গান শেষে তিনি আসন ছেড়ে উঠে এসে আশীর্বাদ করেছিলেন গায়ক-বালককে। তাঁর হাতে দিয়েছিলেন পাঁচ টাকার একখানি নোট। এর পরে জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছিলেন ধনঞ্জয়। কিন্তু সেই আশীর্বাদকে আমৃত্যু ‘জীবনের শ্রেষ্ঠ’ বলে স্বীকার করেছিলেন।
’৪৫ সালে ধনঞ্জয় বিয়ে করেছিলেন ‘রেখাদেবী’কে। তাঁর শ্বশুরমশাইয়ের ছিল ‘হোটেলের ব্যবসা’। ‘কলেজ স্ট্রিটের’ কাছে ছিল সেই হোটেল। এক সময় সেই হোটেলরই দেখাশোনা করতে ‘রেখাদেবী’কে চলে আসতে হয়েছিল কলকাতায়। সঙ্গে ধনঞ্জয়কেও। ’৪৮ থেকেই শুরু হয়েছিল ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘কলকাতা-জীবন’।
‘জেদ’, ‘শক্তপোক্ত শিরদাঁড়া’ আর ‘সম্মানবোধ’ – জীবন জুড়ে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁর গানের মতোই এ সব যত্নে বয়ে বেড়িয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ‘শচীনদেব বর্মনের’ হৃদ্যতার শুরু হয়েছিল অনেকটা এই স্বভাবের কারণেই। ‘‘বাংলা গান গাইতাছ, দরদ নাই ক্যান? বাংলা গান গাইবার কায়দাই শিখো নাই।’’ প্রথম সাক্ষাতে ‘শচীনকর্তা’র মুখে এমন কথা শুনে খুব ভেঙে পড়েছিলেন সদ্য যুবক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। ছোটবেলা থেকে তাঁকেই যে ‘ধ্রুবতারা’ মানতেন! তখন তিনি ডাক পেয়েছিলেন ‘জীবনসঙ্গিনী’ ছবির ‘প্লে-ব্যাকের জন্য’। সেই ছবির ‘সঙ্গীত পরিচালক’ ছিলেন ‘হিমাংশু দত্ত’। ঠিক হয়েছিল সেই ছবির ‘টাইটেল মিউজিকে’ থাকবেন তিন জন – ‘শচীনদেব বর্মন’, ‘সুপ্রভা সরকার’ (তখন ঘোষ), এবং সতেরো বছরের তরুণ ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। ‘শচীনদেব’ সে সময় ছিলেন খ্যাতির শীর্ষে। ‘সুপ্রভা’কে বলা হত ‘বাংলার আশা ভোঁসলে’। তরুণ ছেলেটির গান পছন্দ হয়নি ‘কর্তার’। আর সেটা মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছিলেন। ধনঞ্জয় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। এর আগে ‘হিন্দুস্থান কোম্পানির অডিশন’ দিতে গিয়েছিলেন ধনঞ্জয়। সেখানেও ‘কুন্দনলাল সায়গল’ আর ‘কমল দাশগুপ্ত’ তাঁকে খারিজ করে দিয়েছিলেন। ধনঞ্জয় কষ্ট তখনও পেয়েছিলেন। কিন্তু ‘শচীনকর্তা’র বেলায় সেটা যেন পুরনো সব ক্ষতকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। সেদিনই মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলেন তিনি, এক দিন না এক দিন ‘কর্তা’কে মুগ্ধ করবেনই তিনি। এর বছর কয়েক বাদের ঘটনা। তত দিনে তাঁর ‘প্রথম বেসিক গানের রেকর্ড’ বেরিয়ে গিয়েছিল – ‘‘যদি ভুলে যাও মোরে জানাবো না অভিমান।’’ তাঁর গাওয়া সেই গান শুনে সারা বাংলা ধন্য-ধন্য করেছিল। সে সময়ই ‘ইউনিভার্সিটি হলে’ গানের আসর বসেছিল। ‘শচীনকর্তা’ও শিল্পী হিসেবে সেই আসরে গাইবেন বলে ঠিক ছিল। শিল্পী হিসেবে ধনঞ্জয়ও ছিলেন। তখনও তিনি কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন না। আসতেন ‘বালি’ থেকে। কর্মকর্তারা বার বার তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন মঞ্চে উঠতে। তিনি কিছুতেই উঠতে রাজি হন নি। কারণ ‘শচীনকর্তা’ তখনও আসেন নি, আর ‘শচীনকর্তা’ না এলে গাইতেই বসবেন না বলে জেদ ধরেছিলেন। তাঁকে শোনানোর জন্যই তো ধনঞ্জয় সেই আসরে গিয়েছিলেন। ওদিকে রাত বাড়ছিল। কিন্তু ‘কর্তা’র দেখা ছিল না। ধনঞ্জয়কে ফিরতে হত ‘বালি’তে। বাড়িতে তাঁর মা না খেয়েদেয়ে ছেলের অপেক্ষায় রোজ বসে থাকতেন। ফলে আর দেরি করা চলে না। শেষে তাঁকে মঞ্চে উঠতেই হয়েছিল। চোখ বুজে সেই অতিপরিচিত ভঙ্গিতে গাইতে গাইতে এক সময় তন্ময় হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ শোরগোল কানে এসেছিল তাঁর। একটু চাইতেই দেখেছিলেন দলবল নিয়ে কর্তা ঢুকছেন। সে দিন যে কী ভর করেছিল তাঁর গলায়! রত্নভাঁড়ারের সব ক’টি দরজা খুলে যেন গাইতে বসেছিলেন ধনঞ্জয়। মঞ্চের পাশ দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ‘গ্রিনরুমে’ যেতে গিয়ে ‘শচীনদেব’ থমকে গিয়েছিলেন। পর পর ছ’টি গান গেয়েছিলেন ধনঞ্জয়। আর সেই সময়টাতে সিঁড়ির কাঠের রেলিঙে হাত রেখে স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ‘কর্তা’। তারপরে গান থামলে জড়িয়ে ধরেছিলেন ধনঞ্জয়কে। তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘‘গলাডারে রাইখ্যো ধনঞ্জয়, গলাটারে রাইখ্যো।’’ এর পর শচীনকর্তার সঙ্গে তাঁর এতটাই ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল যে, ‘মুম্বাই’ থেকে কলকাতায় এলে ধনঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা না করলে ‘কর্তা’র চলত না। দু’জনেরই ছিল ‘মাছ ধরার শখ’। তার জন্য কোথায় না কোথায় চলে যেতেন তাঁরা। আর ‘শচীনদেব’ তাঁকে মাঝে মাঝেই বলতেন, ‘‘বোম্বে চইল্যা আয় ধনা। পকেট ভইরা টাকা দিমু। অগো দ্যাখাইতে লাগে ভার্সেটাইল ভয়েস কারে কয়!’’ আর ধনঞ্জয় প্রতিবারই এক উত্তর দিতেন তাঁকে, ‘‘বাংলা মায়ের আঁচল ছেড়ে পাদমেকং ন গচ্ছামি।’’
তবে একবারই তাঁকে মুম্বাই যেতে হয়েছিল। আর সেটাও ‘পাকেচক্রে’ পড়ে। এমনকি সেখানে তাঁকে গাইতেও হয়েছিল। সেটা ’৫২ সালের কথা। ‘সুরকার রাইচাঁদ বড়াল’ তখন ‘প্রকাশ পিকচার্সের’ হিন্দি ছবি ‘মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’র সুর করছিলেন। তখনই হঠাৎ তাঁর ‘টেলিগ্রাম’ এসেছিল ‘কলেজ স্ট্রিটে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সিসিল হোটেলের বাড়ি’তে – ‘‘ধনু প্লিজ কাম।’’ ‘টেলিগ্রাম’ পেয়ে ধনঞ্জয় প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। ‘রাইচাঁদ’কে তিনি পিতৃবৎ শ্রদ্ধা করতেন। ভেবেছিলেন, ‘‘নিশ্চয়ই কোনও বিপদ রাইদার।’’ সে দিনই রওনা দিয়েছিলেন ট্রেনে। গিয়ে শুনেছিলেন আসল ব্যাপারটা! সেই ছবিতে ছবিতে দুটি ‘কীর্তনাঙ্গের গান’ ছিল। ও দুটি তাঁকে গাইতে হবে। একটা ‘একক’। অন্যটা তিনজনে – ‘মহম্মদ রফি’, ‘লতা মঙ্গেশকরের’ সঙ্গে। এ দিকে যে তিনি মনে মনে ‘প্রতিজ্ঞা’ করে বসে ছিলেন, ওখানে তিনি গাইবেন না! কিন্তু ‘রাইদা’-কে সে কথা বলবেন কী করে! শেষে অনেক ‘কুণ্ঠা’, ‘দ্বিধা’ নিয়ে বলেই ফেলেছিলেন, ‘‘আমি গাইতে পারব না, রাইদা। আমায় ফিরিয়ে দিন কলকাতা।’’ প্রাণপ্রিয় ধনঞ্জয়ের কাছ থেকে এমন প্রত্যাখ্যান স্বপ্নেও কল্পনা করেননি ‘রাইচাঁদ’। ‘রাগে’, ‘অভিমানে’, ‘কষ্টে’ তিনি বলেছিলেন, ‘‘বেশ, তাই হোক।’’ কিন্তু ‘রাইচাঁদের’ চোখমুখের তখন যা অবস্থা হয়েছিল, সেটা দেখে নরম হয়েছিলেন ধনঞ্জয়। বলেছিলেন, ‘‘ঠিক আছে, গাইছি। কিন্তু এই প্রথম, এই শেষ বার।’’ গেয়েছিলেন। গান তোলাতেও হয়েছিল ‘লতা’, ‘আশা’, ‘মুকেশ’, ‘রফি’, ‘তালাত মামুদ’ আর ‘গীতা দত্ত’কে। দু’মাস তাঁকে মুম্বাইতে থাকতে হয়েছিল শুধু ওই কাজের জন্য। সেই প্রথম, সেই শেষ। সেই সময় বালির বাড়ি থেকে তাঁর স্ত্রী চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘ওঁরা যখন এত করে চাইছেন, তখন তো থেকে যেতে পারো বোম্বেতে।’’ ধনঞ্জয় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, থাকতেই পারি। অনেক টাকা পাব। অঢেল স্বাচ্ছন্দ্য, ভোগ, বিলাস। রোজ গভীর রাতে বাড়ি ফিরব। উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করব। এমন কি তুমি চাও? হ্যাঁ, কি না জানাও।’’ এরপরে তাঁর স্ত্রী চিঠির পুরো পাতা জুড়ে বড় বড় অক্ষরে একটা শব্দই লিখে পাঠিয়েছিলেন – ‘‘না।’’
চল্লিশের দশকে, ধনঞ্জয় মুম্বাই যাওয়ার প্রথম অফার পেয়েছিলেন তখনকার বিখ্যাত প্রযোজক ‘কারদার প্রোডাকশন’ থেকে। বলা হয়েছিল – ‘পাঁচশো টাকা মাসোহারা’, সঙ্গে গাড়ি, বাড়ি সব কিছু। নির্দ্বিধায় সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ধনঞ্জয়। এর পর একে একে কারা তাঁকে বলেননি মুম্বাই যেতে! ‘মহম্মদ রফি’ বলেছিলেন। ‘সলিল চৌধুরী’কে দিয়ে ‘লতা মঙ্গেশকর’ অনুরোধ পাঠিয়েছিলেন, ‘‘উনকো লে আইয়ে না দাদা।’’ এমনকি সামনাসামনি দেখা হলেও তাঁকে বারবার বলেছিলেন। কিন্তু ধনঞ্জয় কারও কথায় ‘কর্ণপাত’ করেননি। ‘সলিল’ নিজে তাঁকে বহুবার বলেছিলেন। তাতেও না করেছিলেন ধনঞ্জয়। ‘সলিল চৌধুরী’ তাঁর ‘জীবন উজ্জীবন’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘‘তিন দশক ধরে বোম্বাই প্রবাসী থেকে তখন যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন। এক দিন ধনাদা বললেন, আমাকে দু’খানা গান করে দিতে হবে। আমি ধন্য হলাম। দু’খানা গান দু’জাতের করব, তখন থেকেই মাথায় ছিল। একটা হবে রাগাশ্রয়ী। অন্যটা কাব্যগীতি। তাঁর অসাধারণ কণ্ঠগুণে এবং রসবোধে গান দুটি যেন নতুন জন্ম পেল – ‘ঝনন ঝনন বাজে’, ‘অন্তবিহীন এই অন্ধরাতের শেষ’।’’ ‘সলিল’ আরও জানিয়েছিলেন, ‘‘ধনুদা মহম্মদ রফি, তালাত মামুদের সমান, কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়েও বড়। তা সত্ত্বেও মানুষটা নিজেকে নির্বাসিত করে রাখলেন বাংলায়। আর বাংলা ওঁকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারল না।’’
যাটের দশকে হঠাৎ এক দিন মুম্বাই থেকে ‘রাহুলদেব বর্মণ’ ফোন করে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘বাবার চারটে গান পুজোয় করব। তুমি কিন্তু না করতে পারবে না।’’ ‘রাহুল’কে যে তিনি সে দিন চিনেছিলেন, এমন নয়। ছোট্ট ‘পঞ্চম’ এক গাদা মাদুলি পরে বাবার হাত ধরে যখন তাঁর বাড়িতে আসতেন, তখন থেকে তিনি তাঁর বড় সোহাগের ছিলেন। সম্পর্কটা ছিল অত দিনের! অত নৈকট্যের! তবু সেই ‘পঞ্চমের আব্দারে’ও তিনি একই কথা বলেছিলেন – ‘‘বম্বে যেতে পারব না কিন্তু। এইচএমভি স্টুডিয়োতে কর। আমি আছি।’’ ‘পঞ্চম’ জানিয়েছিলেন – ‘‘আচ্ছা, ঠিক আছে। ভালই হবে। যে ক’দিন রেকর্ডিং চলবে, তোমার হাতের রান্না খেতে পারব।’’ কিন্তু ব্যস্ততার দরুন সে বার আর কলকাতায় আসা হয়নি ‘রাহুলদেবের’। ফলে রেকর্ডিংও হয়নি। ‘রাহুলদেব-ধনঞ্জয় যুগলবন্দি’ অধরা স্বপ্ন হয়েই থেকে গিয়েছিল।
ধনঞ্জয় মুম্বই যেতে চাননি। কিন্তু বাংলায়? ‘পঙ্কজ মল্লিক’ যখন ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ছবির কাজ করেছিলরন, তখন সুরকার ছিলেন তিনিই। ‘নিউ থিয়েটার্সের কর্ণধার বিএন সরকারের’ ডাক পেয়েছিলেন ধনঞ্জয়। গান তুলে দিচ্ছিলেন ‘সহকারী সঙ্গীত পরিচালক বীরেন বল’। ধনঞ্জয়ের অনুরোধে গানটি বার কয়েক গেয়ে শুনিয়েছিলেন ‘পঙ্কজকুমার মল্লিক’ নিজে। রেকর্ডিং হয়েছিল। ‘পূর্ণ সিনেমা হলে’ কোম্পানির কর্তাদের উপস্থিতিতে সেই রেকর্ড বাজানোও হয়েছিল। সেই গান শুনে স্তম্ভিত হয়েছিলেন ‘পঙ্কজ মল্লিক’, বলেছিলেন – ‘‘এ কী! এ যে হুবহু আমারই গলা!’’ ‘দিলীপকুমার রায়ের’ ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ‘মাথুর’ ছবির গানের রেকর্ডিং হয়েছিল ‘এমপি স্টুডিয়ো’য়। ছবির সঙ্গীত পরিচালক ‘দিলীপকুমার রায়’ তখন কলকাতায় ছিলেন না, ‘পণ্ডিচেরি’ গিয়েছিলেন। তাঁর সহকারী গান তুলিয়ে দিয়েছিলেন। সেই রেকর্ড শুনে চমকে উঠেছিলেন ‘সঙ্গীতসাধক দিলীপকুমার’। বলেছিলেন, এ যে একেবারে তাঁর নিজস্ব গায়কি! ‘কাননদেবী’ – তাঁরই নিজস্ব কোম্পানি ছিল ‘শ্রীমতী পিকচার্স’। সেই কোম্পানির প্রায় সব ছবিতেই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গান ব্যবহার করা হয়েছিল। সে বার ‘মেজদিদি’ ছবির গানের রেকর্ডিং চলছিল। গানটা ছিল – ‘‘জনম মরণ পা ফেলা আর’’। আচমকাই ফ্লোরে ঢুকেছিলেন ‘কাননদেবী’। ‘কালীপদ সেন’ ছিলেন সেই ছবির সঙ্গীত পরিচালক। রেকর্ডিং হয়েছিল। ‘কালীপদ’বাবু জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘সব ঠিক আছে তো দিদি?’’ ‘কাননদেবী’ কিছু বলেন নি। এরপরে ‘স্কোরিং’-এ বসে থেকে থেকে ধনঞ্জয়ও উঠে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কোনও অসুবিধে হল কি?’’ জীবনে এই মানুষটিকে কোনদিন ‘রি-টেক’ দিতে হয়নি। যাঁর গান শুনে একবার ‘সুরকার সুবল দাশগুপ্ত’ বলেছিলেন, ‘‘যে দিন তোমাকে একটা গান রেকর্ডিং করতে দ্বিতীয় বার গাইতে হচ্ছে দেখবে, জানবে শেষ হয়ে গেছো।’’ সেই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে সে দিন ‘কাননদেবী’ বলেছিলেন, ‘‘আরেক বার যদি গাওয়া যেত …।’’ কোনও কথা না বলে দ্বিতীয় বার গেয়েছিলেন ধনঞ্জয়। সেই গান শুনে ‘কাননদেবী’ যেন আকাশ থেকে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘আগের বারও ভাল হয়েছিল। ভাবলাম, যদি দ্বিতীয় বারে উনিশ-বিশ আরও ভাল হয়। কোথায় কী! এ বারেও এক্কেবারে এক।’’
তবে শুধু আধুনিক জগতের মানুষজন নন, ‘ধ্রুপদী শিল্পীরা’ও একসময় ছিলেন ধনঞ্জয়ের একনিষ্ঠ ভক্ত। ‘পণ্ডিত রবিশঙ্কর’ একবার কলকাতায় এসেছিলেন। ‘খিদিরপুরে’ একটা সন্ধের জলসা ছিল। তিনি ছিলেন। ‘উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি’ ছিলেন। ছিলেন ‘উস্তাদ আল্লারাখা’ও। অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে রবিশঙ্করের’ সঙ্গে দেখা হয়েছিল ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর। ‘পণ্ডিতজি’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আমি আপনার গানের খুব ভক্ত, জানেন!’’ তাঁর গায়কি, তাঁর মার্গ সঙ্গীতের অনায়াস যাতায়াতে মুগ্ধ ছিলেন অনেকেই। ‘চিন্ময় লাহিড়ী’, ‘এ কানন’ দেখা হলেই তাঁকে বলতেন, ‘‘তোমাকে দেখে আমাদের খুব রাগ হয়। কেন যে তুমি আমাদের ছেড়ে আধুনিকে গেলে!’’ ‘উস্তাদ বিলায়েৎ খানের’ সঙ্গে তাঁর ছিল অনেক কালের বন্ধুত্ব। ‘বিলায়েত’কে যখন তাঁর বাবা কলকাতায় রেখে গিয়েছিলেন, তখন থেকেই তাঁর কাছে তিনি যাতায়াত করতেন। কলকাতার জলসায় ‘বিলায়েৎ খান’ বাজাচ্ছেন, আর দর্শক-আসনে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য নেই, এ ছিল বড়ই বিরল দৃশ্য। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর ‘ধ্রুপদের’ ওপর দখল যে কী প্রচণ্ড অনায়াস ছিল! ‘তানসেন’ ছবি তৈরির সময়কার গল্প। ছবির সুরকার ছিলেন ‘রবীন চট্টোপাধ্যায়’। ‘ধামারে’ একটি গান বেঁধেছিলেন তিনি। ‘পণ্ডিত ভীমসেন যোশী’কে ডেকে সেই গান গাওয়ানো হয়েছিল। কিন্তু পছন্দ হয় নি ‘রবীন’বাবুর। এরপরে সেই গান ‘বিষ্ণুপুর ঘরানার’ বিখ্যাত শিল্পী ‘রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায়’ গেয়েছিলেন। তাতেও সন্তুষ্ট হন নি ‘রবীন চট্টোপাধ্যায়’। এরপরে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর ডাক পড়েছিল। দিন কয়েকের অনুশীলন। তার পর রেকর্ডিং। সেই গান শুনে ধনঞ্জয়কে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন সুরকার। ‘রাগরাগিণী’র মধ্যে কোনটি তাঁর প্রিয়, জানতে চাইলে ধনঞ্জয় বলতেন, ‘‘ভৈরবী।’’ তিনি নিজের ‘ধ্রুপদ গান’ নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারে অদ্ভুত গল্প শুনিয়েছিলেন এক বার – ‘‘সুন্দরবনে শিকারি বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি। জ্যোৎস্না রাতে দরবারী কানাড়ায় গান ধরেছি। নৌকোর সামনে হরিণের দল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারা জানে এটা শিকারিদের নৌকো। এখনই গুলি আসতে পারে। তবু তারা গান শুনে দাঁড়িয়েছিল, না দাঁড়িয়ে পারেনি বলে। আমি বন্ধুদের অনুরোধ করলাম অন্তত সে রাতে যেন কোনও পশু বধ না করা হয়। মনটা এমনই অভিভূত হয়েছিল।’’
সঙ্গীতকার ‘সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়’ ছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর বিশেষ বন্ধু। তিনি তাঁর এক ছাত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর কাছে। তখন সকাল এগারোটা-সাড়ে এগারোটা হয়েছিল। গরমকাল। ফ্রক পরা একরত্তি সেই মেয়েটির গলায় ছিল মাফলার। তাঁর ‘মাম্পস্’ হয়েছিল। ‘সুশীলবাবু’ ধনঞ্জয়ের সাথে তাঁর আলাপ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ওর নাম আরতি। এ বারে মারফি রেডিয়োর প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে। তোমায় প্রণাম করবে। আশীর্বাদ করো। তোমায় গানও শোনাতে চায়।’’ সেই প্রথম ‘আরতি মুখোপাধ্যায়’ ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যকে কাছ থেকে দেখেছিলেন। ধনঞ্জয় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘তুমি গান গাইতে পারবে? গলায় যে ব্যথা!’’ ক্ষীণ ‘আরতি’ গলায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘পারব।’’ তখন ‘মামলার ফল’ ছায়াছবির কাজ চলছিল। পরের পর দিন ছিল রেকর্ডিং। ধনঞ্জয় তখনই ফোন করেছিলেন ছবির সঙ্গীত পরিচালককে, বলেছিলেন, ‘‘আমার সঙ্গে একটি বাচ্চা মেয়ে ডুয়েট গাইবে। আপনি পরিচালক-প্রযোজকের সঙ্গে কথা বলে জানান।’’ পরক্ষণেই পরিচালকের ফোন এসেছিল, ‘‘কী ব্যাপার দাদা?’’ ধনঞ্জয় তাঁকে সব জানিয়েছিলেন। উত্তর এসেছিল, ‘‘কিন্তু ছবিতে এমন কোনও সিচ্যুয়েশন নেই যে!’’ ধনঞ্জয় বলেছিলেন, ‘‘নেই তো কী হয়েছে! তৈরি করে নিন।’’ ওই এক কথাতেই স্ক্রিপ্ট পাল্টে গিয়েছিল। বাবার গলায় গেয়েছিলেন ধনঞ্জয়। তাঁর বাচ্চা ছেলের লিপে গেয়েছিলেন ‘আরতি মুখোপাধ্যায়’। ‘আরতি’ তখন এতই ছোট ছিলেন যে, রেকর্ডিং-এর সময় টেবিলের ওপর তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল মাইকের সামনে মুখ ধরতে। সেটাই ছিল ‘আরতি মুখোপাধ্যায়ের’ প্রথম সিনেমায় গান করতে যাওয়া।
‘বিদ্যাপতি’ ছবির কাজ হচ্ছিল। ‘ভি বালসারা’ ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য গাইছিলেন। ঠিক হয়েছিল ‘লতা মঙ্গেশকর’ও গাইবেন। এক রেকর্ডিং-এর দিন ধনঞ্জয় গান গেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। তার দু’দিন পরে এসেছিল একটা টেলিফোন। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে এক ‘পুরুষকণ্ঠ’ নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। দিদি আপনার কাছে যাবে দাদা।’’ পর দিনই ‘লতা মঙ্গেশকর’ এসেছিলেন। ‘বালসারার অ্যাসিসটেন্ট’ গাড়ি করে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন। ধনঞ্জয় আগে থেকেই বাড়িতে বলে রেখেছিলেন যে, কেউ যেন লতাকে গান গাইতে না বলেন। লতা এসেছিলেন। ঘরে বসে এ কথা, সে কথা চলছিল। কিছুক্ষণ বাদে ‘ধনঞ্জয়-জায়া রেখাদেবী’ অন্য সবার জোরাজুরিতে তাঁকে বলে ফেলেছিলেন, ‘‘বহিনজি, তুমি আমার বাড়িতে এলে অথচ গান শুনব না!’’ ‘লতা’ হেসে বলেছিলেন, ‘‘আমার যে গানের বই লাগবে।’’ ‘রেখাদেবী’ বলেছিলেন, ‘‘বই তো নেই। তুমি তো শুনেছি ঠাকুরের কাছে রোজ গান গাইতে বসো। সে-গানই করো না।’’ তাই-ই শুনিয়েছিলেন ‘লতা মঙ্গেশকর’। আর তাঁর পাশে বসে হারমোনিয়ামে সঙ্গত করেছিলেন ধনঞ্জয়। সেদিন ঘণ্টা দুই থেকে চলে গিয়েছিলেন ‘লতা মঙ্গেশকর’।
‘মীরাবাঈ’ ছবির গানের রেকর্ডিং চলছিল ভারতলক্ষ্মী ‘স্টুডিয়োয়’। রেকর্ডিং শেষে ‘স্টুডিয়োর কর্ণধার বাবুলাল চুখানি’কে ধনঞ্জয় বলেছিলেন, ‘‘আমার টাকা চাই না। আপনার দেওয়ালে ওই যে মদনমোহনের (গোপাল) ছবিটি টাঙানো আছে, ওটি আমায় দিয়ে দিন।’’ ‘বাবুলাল’ কিছুতেই রাজি হননি সেই ছবি দিতে। ওদিকে ধনঞ্জয়ও ছিলেন নাছোড়। এক সময় তাঁর চোখে জল চলে এসেছিল। টাকা না নিয়েই তিনি স্টুডিয়ো ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। সেদিন সন্ধের দিকে ঝমঝমে বৃষ্টি নেমেছিল কলকাতায়। তখন রাত আটটা কী ন’টা বাজে। ‘বাবুলাল’ হঠাৎ তাঁর ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন, ‘‘জগদীশ, তুমি ছবিটা খুলে ওঁকে দিয়ে এসো। আমি ওঁর ভক্তির কাছে হার মেনেছি। পাগলটা ছবি না পেলে আজ সারা রাত হয়তো জেগেই বসে থাকবে।’’ ‘জগদীশ’ গিয়েছিলেন ধনঞ্জয়ের বাড়ি। ‘মদনমোহনের সেই ছবি’ হাতে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন ধনঞ্জয়, যেন সেটা ‘সাত রাজার ধন মানিক’! তারপরে বলেছিলেন, ‘‘জানো জগদীশ, আমি জানতাম, এ ছবি আমি পাবই।’’
’৪৬ কী ’৪৭ সাল। স্থান ‘পূর্ব পাকিস্তান’। ‘যশোরে’ একটা অনুষ্ঠান ছিল। যে জায়গায় অনুষ্ঠানটি হচ্ছিল সেখানে লঞ্চে করে অনেকটা গিয়ে, তবে গাড়িতে যেতে হত। ‘যশোরের’ ঠিক আগে কোত্থেকে এক দল ছাত্র এসে ধুপধাপ করে লঞ্চ দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেছিল। তাঁরা যেন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিল না। হঠাৎ ধনঞ্জয় শুনেছিলেন, তাঁদেরই কেউ বলছে, ‘‘এই লঞ্চেই আইতাসে। খুঁজ খুঁজ। দ্যাখ কেডার ডাইন হাতে ঘড়ি, গালে পান।’’ ধনঞ্জয়ের আর বুঝতে বাকি রয় নি, তাঁরা কাকে খুঁজছে। ডান হাতে ঘড়ি, গালে পান যে তারই ‘ট্রেডমার্ক’ ছিল। তিনি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, কী করবে এরা! মেরে ফেলবে না তো? ঘড়ি ডান থেকে বাঁ হাতে পরে নিয়েছিলেন। গালের পান ফেলে দিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ বাদে ‘যশোর’ চলে এসেছিল। তাঁকে হোটেলে নিয়ে উঠিয়েছিলেন সেখানকার লোকজন। যত্নের কোনও ত্রুটি ছিলনা। তাঁর ভয়-আশঙ্কা তখন দূর হয়েছিল। সন্ধেয় ছিল সেই অনুষ্ঠান। পরের দিন তাঁর ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। তাঁর স্ত্রী তখন ‘সন্তানসম্ভবা’ ছিলেন। তাঁর জন্য তিনি চিন্তায় ছিলেন। এ দিকে দুপুর থেকে শুরু হয়েছিল বৃষ্টি। এত বৃষ্টি যে সে দিন অনুষ্ঠান হতেই পারেনি। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘‘দাদা কাইল থাইক্যা, প্রোগ্রাম কইরা পরশু যান।’’ কিন্তু সে কী করে সম্ভব! ওদিকে তাঁর বাড়ির ওই অবস্থা। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আপনারা টাকা ফেরত নিন। আমায় যেতে দিন।’’ কর্মকর্তারা তাতে রাজি হননি। এরপরে সেই ছাত্রর দল হোটেলে চড়াও হয়ে বলেছিল – ‘‘আপনের তো খুব জেদ দ্যাখতাসি। প্রোগ্রাম করবেন না, ট্যাকাও ফিরত দিয়া দিবেন! দেখি আপনার যাওয়া কী কইরা হয়! আমরা শুইয়া পড়ুম রাস্তায়। যাইতে হইলে আমাগো পাড়াইয়া যাইতে হইব।’’ শেষে বাধ্য হয়েছিলেন ধনঞ্জয়। টাকা নিয়ে তবে ছাড় পেয়েছিলেন। যখন লঞ্চে উঠছিলেন, তখন দেখেছিলেন সেই ছাত্রর দল একটু দূরেই দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছিল। তাঁরও চোখও ভেসে গিয়েছিল জলে!
একবার ধনঞ্জয় উদ্যোক্তাদের সটান বলে দিয়েছিলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর চিঠি না পেলে আমি গাইতে যাব না।’’ ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য’ বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল কলকাতায়। বাংলার প্রায় সব নামী শিল্পী সেখানে থাকবেন বলে জানিয়েছিলেন, আর সেখানেই যেতে অমনই এক ‘শর্ত’ দিয়ে বসেছিলেন তিনি। তাঁর পরিষ্কার বক্তব্য ছিল, অনুষ্ঠান যখন প্রধানমন্ত্রীর নামে, তাঁকেই অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠাতে হবে। উদ্যোক্তাদের তখন মাথায় হাত পড়েছিল। কারণ, তখন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য বলতে গেলে বাংলা গানের জগতে ‘উল্কা’ ছিলেন। তাঁকে ছাড়া কোনও অনুষ্ঠান ভাবা যেত না। কিন্তু তাই বলে একেবারে ‘প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর চিঠি’? সেটা পাওয়াও তো দুঃসাধ্য ব্যাপার! তাহলে উপায়? শেষে খবর গিয়েছিল ‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের’ কাছে। ধনঞ্জয়ের গানের ভক্ত ছিলেন তিনিও। ধনঞ্জয়ের সাথে দেখা হলেই তিনি বলতেন, ‘‘তোমার গয়াগঙ্গা প্রভাসাদি গানটা গাও তো।’’ তাঁর শেষ জীবনে তিনি এক বার ধনঞ্জয়কে গাইতে ডেকেছিলেন বাড়িতে। কিন্তু ছেলের অসুখের জন্য সেদিন যেতে পারেননি ধনঞ্জয়। আর অদ্ভুত ব্যাপার, সে দিনই তিনি খবর পেয়েছিলেন যে, ‘ডা. বিধানচন্দ্র রায়’ আর নেই! সেই আফশোস তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিল। সেদিন ধনঞ্জয় ‘প্রধানমন্ত্রীর চিঠি’ চেয়েছেন শুনে ‘বিধান রায়’ অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের বলেছিলেন, ‘‘এ ছেলের গাট্স আছে! বাঙালির এই চরিত্রটারই বড় অভাব। ওকে বলো গান গাইতে। আমি জওহরলালের চিঠি আনিয়ে দেব।’’ তাই হয়েছিল। কথা রেখেছিলেন ‘বিধানচন্দ্র রায়’। আর গানও গেয়েছিলেন ধনঞ্জয়।
গান ছাড়া, জবরদস্ত রান্না করতেন ধনঞ্জয়। ‘মটন কষা’, ‘সরষে ইলিশ’, ‘পুঁই শাক-কাঁকড়া’ থেকে ‘চিঁড়ের পোলাও’, ‘চিতল মাছ’। সে কালে সঙ্গীত মহলের প্রায় সবাই সে সবের স্বাদ পেয়েছিলেন। এছাড়া ধনঞ্জয় ছিলেন ছিলেন পাঁড় ‘মোহনবাগানি’। মোহনবাগানের খেলা থাকলে তিনি মাঠে যেতেনই। ‘মোহন-ইস্ট ম্যাচের দিন’ অনুষ্ঠান থাকলে উদ্যোক্তারা প্রার্থনা করতেন, যেন ‘মোহনবাগান’ জেতে, নইলে ধনঞ্জয় যে কী করবেন বলা মুশকিল! ‘ময়দানে’ও তাঁর ভক্ত কম ছিল না। ‘পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘চুনী গোস্বামী’ কে না তাঁর ভক্ত ছিলেন! জানা যায়, ‘কোচিং’ করার সময় মাঠ থেকে টেন্টে ফিরে নিজের ঘরে বসে নিজেকে হাল্কা করতে ‘পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়’ প্রায়ই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যর গান ভাঁজতেন। ‘মোহনবাগানের ধীরেন দে’ এক বার তাঁকে ‘মোহনবাগান ক্লাবের ফুটবল-সচিব’ করবেন বলে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তাতে অবশ্য রাজি হননি ধনঞ্জয়। তখনকার উঠতি অভিনেতা ‘বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়’ তখন ‘হাতিবাগানের থিয়েটারে’ ‘এক্সট্রার’ রোল করতেন, আর থাকতেন ‘মির্জাপুরের মেসে’ (যে মেসে ‘জহর রায়’ও থাকতেন)। ‘ময়দানে’ খেলা দেখতে গেলে ‘বিশ্বজিৎ’ ফিরতেন ধনঞ্জয়ের গাড়িতেই। তাঁর সঙ্গে ধনঞ্জয়ের সম্পর্ক ছিল ‘দাদা-ভাইয়ের মতো’। ‘বিশ্বজিৎ’ যখন ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’ (তাঁর পুত্র ‘প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের’ প্রথম ছবি) করবেন বলে মনস্থির করেছিলেন, তাঁর স্ত্রী ‘রত্নাদেবী’ কলকাতায় এসে এক বার শুধু বলেছিলেন, ‘‘দাদা আপনাকে কিন্তু গাইতে হবে।’’ এক কথায় ‘‘হ্যাঁ’’ বলেছিলেন ধনঞ্জয়।
যাঁর শুরু আছে, তাঁর শেষও আছে। তাই ১৯৯২ সালের ২৭শে ডিসেম্বর নিথর কলকাতা নতজানু হয়ে তাঁর শেষযাত্রায় গিয়েছিল,
‘‘… মাটিতে জন্ম নিলাম, মাটি তাই রক্তে মিশেছে
এ মাটির গান গেয়ে ভাই জীবন কেটেছে
আকাশের অঝোর ধারে বনানীর শ্যামল ভারে
অরুণের সোনার রঙে আমার মাটি আজ সেজেছে …’’
(তথ্যসূত্র:
১- অনন্য ধনঞ্জয়, নিতাই মুখোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৫)।
২- কথায় কথায় রাত হয়ে যায়, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
৩- জীবন উজ্জীবন, সলিল চৌধুরী।
২- ১২ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত তিনটি প্রবন্ধ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত