৩১শে জুলাই আর ২৪শে ডিসেম্বর সকাল থেকে রেডিওর নানা এফএম চ্যানেল আর টেলিভিশনের নানা চ্যানেলে এখনও বাজে রফির গান। তাঁর সেই রাজকীয়, অনন্য কণ্ঠস্বরের অবিরাম মণিমুক্তো বর্ষণেও চাপা থাকে না কত শ্রোতার হৃদয় ফুঁড়ে উঠে-আসা মাত্র ৫৫ বছর বয়েসে অকালে তাঁকে হারানোর বেদনার হাহাকার। মিউজিক হোক কিংবা নিউজ চ্যানেল – তাঁর জন্মদিবস আর প্রয়াণদিবসে সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত মহম্মদ রফির জাদুকণ্ঠের স্বর্ণালি গানের সম্ভার একটিই কি বার্তা বয়ে আনে না তাঁর শ্রোতাদের কাছে? চলে যাওয়ার ৪০ বছরেও একদা বলিউডের ভরসা মহম্মদ রফি কী ভাবে ডটকম শাসিত এই একুশ শতকেও জীবন্ত থাকেন তাঁর শ্রোতাদের মননে, স্মৃতিতে, ফেলে আসা দিনে? মস্তি চ্যানেলের ‘গোল্ডেন এরা উইথ অন্নু কপূর’-এর অনুষ্ঠান হোক কিংবা ‘লভ কাল আজ ঔর কাল’ অনুষ্ঠান। অথবা মিউজিক ইন্ডিয়া বা সোনি মিক্সের মতো চ্যানেলে ঘুরে ফিরে প্রতিদিনই নিয়ম করে নানা সিনেমার দৃশ্যে শোনানো হয় রফির গান। আজও যে-কোনও রিয়্যালিটি শো-এ তাঁর গান ঘুরেফিরে উঠে আসে প্রতিযোগীদের কণ্ঠে। কত বড় গায়ক ছিলেন মহম্মদ রফি? মান্না দে লিখেছিলেন, ‘‘দু’জন শিল্পীর প্রতি কেন জানি না ভীষণ দুর্বল আমি। একজন রফি সাহাব। আরেকজন শচীন কর্তা। … বড় হয়ে, গানের তালিম নিয়ে, পড়া শেষ করে গেলাম মুম্বই। কারণ, বাংলা আমায় তখন পাত্তা দিত না। মুম্বইতেও অবশ্য তখন এক সে বড়কর এক শিল্পী। হেমন্ত কুমার, মহম্মদ রফি, তালাত মেহমুদ, কিশোর কুমার…। আমি সেখানে টিমটিম করে জ্বলছি। এতজনের মধ্যে আমায় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত রফি সাহাবের গলা। গলায় যেন কোকিল পুষে রেখেছেন! যেমন মিষ্টি তেমনি নেশা ধরানো। একবার শুনলে মনে হয় বারবার শুনি। … ১৯৬৩-তে সুযোগ মিলল রফি সাহাবের সঙ্গে কাজ করার। তারদেও-র ফেমাস ষ্টুডিওতে। সঙ্গী আরো দুই শিল্পী, তালাত মেহমুদ, ভুপিন্দর সিং। মদন মোহনের সুরে, কইফি আজমির লেখা ‘হোকে মজবুর মুঝে’ রেকর্ডিং হচ্ছে। আমি গানের একটি লাইন ‘জুলফে গিরকে’ গেয়ে উঠতেই হঠাৎ চোখে পড়ল রফি সাহাব জল ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। ইনস্ট্যান্ট এনার্জি পেয়ে গেলাম। গানটা যেন আরও খোলতাই হল। রেকর্ডিং শেষ। রুমে পিন ড্রপ সাইলেন্স। তারপরেই হাততালিতে ভরে গেল রেকর্ডিং রুম। তালাত্জি বললেন, ‘কী গাইলেন দাদা!’ রফিজি উঠে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘লা জবাব মান্না দা! এই জন্যেই আমি বারেবারে আপনার গান শুনি।’ এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম সেদিন যে জানাতে পারিনি আমি যদি কাউকে ঈর্ষা করি তিনি মহম্মদ রফি। আর কেউ না!’’ মান্না দে আরও লিখেছিলেন,‘‘তিনি সকলের চেয়ে সেরা গায়ক ছিলেন। রফি এবং আমি সকল স্তরের গানই গেতে পারি এবং তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন ভদ্রলোক। তিনি আমার চেয়েও সেরা গায়ক ছিলেন এবং আমি অবশ্যই বলবো যে, কেউই তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না। তিনি যখনই যা চেয়েছেন, তা-ই করতে পেরেছেন। আমরা সকলেই একবাক্যে ও কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্বীকার করি।’’ একদা অভিনেতা শাম্মী কাপুর তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘আমি রফিকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। আমি যখনই গান রেকর্ড করতে যাই, তখনই মোহাম্মদ রফি’কে খুঁজে পাই। এছাড়াও পর্দায় গানকে কিভাবে উপস্থাপন করতে হবে এ বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে পরামর্শ নিতাম। ফলে, তিনিও গানে আমার অংশগ্রহণকে বেশ পছন্দ করতেন।’’ হিন্দি চলচ্চিত্রের চির নবীন অভিনেতা দেবানন্দ চিরকাল কিশোর কুমারের ভক্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁর অভিনীত অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ‘গাইড’ মুক্তি পাবার পরে সাংবাদিকরা যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, ‘গাইড’-এ কেন কিশোরকুমারের ‘গাতা রহে মেরা দিল’ ছাড়া বাকি সব গানেই মহম্মদ রফি? তখন তিনি হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি চেয়েছিলাম, সব গানই কিশোরকে দিয়ে গাওয়াতে। কিন্তু সুরকার (শচীন দেববর্মন) অন্য রকম ভেবেছিলেন। উনি জানতেন ‘গাইড’-এর জন্য যেমন ধরনের সুর করেছেন, তা সার্থকতা পাবে রফির কণ্ঠেই।” কবিতা কৃষ্ণমূর্তি’র কথায়, ‘‘রফিসাব এমন একজন গায়ক, যাঁর গানকে স্বরলিপি দিয়ে ধরা যায় না। ওঁর গলায় সাঙ্ঘাতিক একটা রেঞ্জ। তার সঙ্গে মসৃণ একটা ধাঁচ। গানে কোনও অনভূতি প্রকাশ করার সময়, যখন এক নোট থেকে আর এক নোটে যেতেন, মনে হত, তাঁর কণ্ঠ যেন ভেসে চলে যাচ্ছে। ধরুন, ‘হাম দোনো’ ছবির ‘কভি খুদপে’ গানটার কথা। কেউ যদি রাগাশ্রয়ী গানে পারদর্শী হন তিনি বড়জোর স্বরলিপি করতে পারবেন। কিন্তু গায়কির মধ্যে কোন সময়ে ইনফ্লেকশন আর গ্রেস নোট ব্যবহার করতে হবে, সেটা বোঝাটা খুব মুশকিল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পারদর্শী হলেও একজন গায়কের যদি রোম্যান্টিক অনভূতি এবং রফি সাবের মতো গলার সূক্ষ্ম আন্দাজ না থাকে, সে শুধুমাত্র ভাসা-ভাসা ভাবে গান পরিবেশন করতে পারবে। গানের আসল নির্যাসটা তাতে প্রকাশ পাবে না।” বাংলার আর এক গায়ক রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “কিশোরকুমার শুধু গায়ক নন। তিনি নায়ক-গায়ক-সুরকার সব। তাঁর বহুমুখী এবং বিস্ময়কর প্রতিভা। কিন্তু মহম্মদ রফি আউট অ্যান্ড আউট একজন গায়ক। রাগাশ্রয়ী গানে তিনি অনবদ্য। তাঁকে আমি গায়কের গায়ক বলব। কিশোরের গান জেনারেল। রফি তালিম নেওয়া একজন গায়ক। ফলে তাঁর গাওয়া গানের জন্য যে সুর, তাল, ছন্দের দরকার হয়, সেটা রীতিমতো চর্চা না করলে গাওয়া সম্ভব নয়।” তাই কিশোর-কণ্ঠী পাওয়া যায় অসংখ্য, কিন্তু রফি-কণ্ঠী সংখ্যা হাতে গোনা।
অথচ হিন্দি সিনেমায় সেরা গায়কের বিতর্কে রফি বনাম কিশোরকুমারকে নিয়ে চায়ের কাপে তুফান তুলে দেবে বাঙালি। রফির তুলনায় কিশোরের কণ্ঠ অনেক গমগমে, অনেক তাজা। ‘ফ্ল্যামবয়ান্ট’ গায়ককে নিয়ে বেশির ভাগ বাঙালি গর্বিত। যদিও তাঁর জন্ম খান্ডোয়ায়, বাংলা লিখতে পড়তে জানতেন না। কিন্তু তিনি তো ভাত-মাছ-রসগোল্লা খাওয়া বাঙালি। হিন্দি সিনেমার গানে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব এবং দক্ষতা নিয়ে কোনও চ্যালেঞ্জের মুখেই পড়তে চায় না এই জাতি। কিশোরকুমারের সঙ্গে তুলনায় রফি? এক কথায় খারিজ হয়ে যাবেন। রফি বাঙালির চোখে বহু যোজন দূরে। সবাই জানেন বলিউডের স্বর্ণযুগে মুকেশ ছিলেন রাজ কপূরের প্রিয় গায়ক। মনোজকুমারের প্রথম পছন্দের গায়কও তিনি। তার পরে মহেন্দ্র কপূর। দেব আনন্দের যেমন কিশোর। কিন্তু ১৯৪৮-৬৮, এই কুড়ি বছরে রফি ছিলেন বাকি নায়কদের সাফল্যের টেক্কা। রাজু ভারতনের মতো হিন্দি সিনেমার গানের বিশেষজ্ঞের মতে, রফি ছিলেন ‘‘মোস্ট কমপ্লিট সিঙ্গার’’। রাগাশ্রয়ী থেকে ভজন, রোম্যান্টিক থেকে গজল, হিপহপ থেকে রক-অ্যান্ড-রোল থেকে কাওয়ালি বা ডিস্কো। এবং আরও অনেক কিছু।
বর্তমান সময়ের নিরিখে ৪০ বছর হয়ে গেছে তিনি নেই। নেই তাঁর সময়ের বহু শ্রোতা–অনুরাগী। যে দুটি প্রজন্মকে পাঁচ থেকে আটের দশকের শুরু পর্যন্ত সুরের নেশায় বুঁদ করে রেখেছিলেন তিনি, তারও পরে এসেছে নতুন জমানা। নতুন যুগের নতুন বিনোদনে তাঁরাও সাবালক হয়েছেন দু’দশক আগে। তবুও বদল হয়নি ভারতীয় সঙ্গীত শাহেনশার মুকুটটির উত্তরাধিকার। না–হলে মাত্র বছর পাঁচেক আগে সিএনএন–আইবিএন সমীক্ষায় কীভাবে উঠে আসে, এখনও এই উপমহাদেশে জনপ্রিয়তম গায়কটির নাম মহম্মদ রফি? কীভাবেই–বা বিখ্যাত আন্তর্জাতিক এক বাণিজ্যিক সংস্থা ও স্টারডাস্ট পত্রিকা ঘোষণা করতে পারে – সহস্রাব্দের সেরা কণ্ঠশিল্পী হলেন মহম্মদ রফি? প্রয়াণের এত বছর পরেও রফির এমন জনপ্রিয়তা কপালে ভাঁজ ফেলে হাল আমলের গাইয়েদের। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যাঁদের বহু শিরোপাধারী গানও হারিয়ে যায় স্মৃতির ডাস্টবিনে! অথচ রফি, মুকেশ, কিশোরদের গান শুনতে গিয়ে সেই প্রবীণ এমনকি নবীন শ্রোতাকুলও ভুলে যান সময়ের পাকদণ্ডী! ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে একসময় সমগ্র উপমহাদেশে কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ছিলেন মহম্মদ রফি। প্রায় চল্লিশ বছর সময়কাল ধরে সঙ্গীত জগতে থাকাকালীন তিনি ছাব্বিশ হাজারেরও অধিক চলচ্চিত্রের গানে নেপথ্য গায়ক হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন মহম্মদ রফি। সঙ্গীত কলায় অসামান্য অবদান রাখায় শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় পদক এবং ৬-বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন মোহাম্মদ রফি। তিনি বহুবিধ গানে অংশ নেয়ার বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তন্মধ্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, বিরহ-বিচ্ছেদ, উচ্চ মার্গের প্রেম-ভালবাসা, কাওয়ালী, ভজন, গজল-সহ বিভিন্ন গোত্রের গানে দক্ষতা ও পারদর্শীতা দেখিয়েছেন সমানভাবে। বিশেষ করে হিন্দী এবং উর্দু ভাষায় সমান দক্ষতা থাকায় তাঁর গানগুলোতে বৈচিত্র্যতা এসেছে সমধিক।
১৯২৪ সালের ২৪শে ডিসেম্বর তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব এলাকার অমৃতসর গ্রামের কাছাকাছি কোটলার সুলতান সিংয়ে জন্ম গ্রহণ করেন মহম্মদ রফি। সঙ্গীত শিল্পী মহম্মদ রফি’র ডাক নাম ছিল ‘ফিকো’। তাঁর পিতার নাম হাজী আলী মহম্মদ। অমৃতসর গ্রামের সুলতান সিংয়ের অধিবাসী হাজী আলী মহম্মদের ৬ষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন মহম্মদ রফি। ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে একসময় সমগ্র উপমহাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি সঙ্গীত ভুবনে সুদীর্ঘ চার দশক সময়কাল অতিবাহিত করেন। মহম্মদ রফি তাঁর নিজ গ্রামে এক ফকিরের ভজন গানকে অনুকরণ করে গান গাওয়া শুরু করেন। জীবিকার সন্ধানে তার বাবা হাজী আলী মহম্মদ ১৯২০ সালে লাহোরে চলে যান এবং ভাট্টি গেটের নূর মহল্লায় একটি স্যালুনের মালিক হন। তার বড় ভাই মোহাম্মদ দ্বীনের বন্ধু আবদুল হামিদ লাহোরে অবস্থানকালীন সময়ে রফি’র প্রতিভা দেখে তাকে গান গাইতে সাহস জুগিয়েছিলেন। ১৩ বছর বয়সে রফি লাহোরের প্রথিতযশা শিল্পী কে. এল. সাইগলের (কুন্দনলাল সায়গল) সাথে জীবনের প্রথম দর্শক-শ্রোতাদের মুখোমুখি হয়ে কনসার্টে গান পরিবেশন করেন। ১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের পরিচালনায় গুল বালোচ ছবির মাধ্যমে সঙ্গীতে পেশাগতভাবে অভিষেক ঘটান রফি। পরের বছর বোম্বের চলচ্চিত্র গাও কি গৌরী ছবিতে নৈপথ্য গায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটান। ১৯৪৪ সালে মহম্মদ রফি বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) চলে আসেন। সেখানে তিনি উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান, উস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খান, পণ্ডিত জীবনলাল মোত্তো এবং ফিরোজ নিজামী’র মতো প্রথিতযশা শিল্পীদের কাছ থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন।
১৩ বছর বয়সে রফি লাহোরের প্রথিতযশা শিল্পী কে. এল. সাইগলের সাথে জীবনের প্রথম দর্শক-শ্রোতাদের মুখোমুখি হয়ে কনসার্টে গান পরিবেশন করেন। ১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের নির্দেশনায় লাহোরে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নিজেকে অভিষেক ঘটান। পাঞ্জাবী ভাষায় নির্মিত গুল বালুচ (১৯৪৪ সালে মুক্তি পায়) চলচ্চিত্রে জিনাত বেগমের সঙ্গে দ্বৈত সঙ্গীত ‘‘সোনিয়ে নি, হেরিয়ে নি’’ গানটি গান। একই বছরে মহম্মদ রফি অল ইন্ডিয়া রেডিও’র লাহোর সম্প্রচার কেন্দ্রে গান পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ পান। ১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের পরিচালনায় গুল বালোচ ছবির মাধ্যমে সঙ্গীতে পেশাগতভাবে অভিষেক ঘটান রফি। পরের বছর বোম্বের চলচ্চিত্র গাও কি গৌরী ছবিতে নৈপথ্য গায়ক হিসেবে অভিষেক ঘটান। এছাড়াও রফি লায়লা-মজনু (১৯৪৫) এবং জুগনু চলচ্চিত্রে সংক্ষিপ্তভাবে, অতিথি শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। লায়লা-মজনু চলচ্চিত্রে ‘‘তেরা জ্বালা’’ কোরাস গানে তাঁকে অন্যান্য শিল্পীদের সাথে গাইতে দেখা যায়। ১৯৪৪ সালে মহম্মদ রফি বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) চলে আসেন। তাঁর শ্যালক সেখানে তাঁকে ভেন্দী বাজারের মতো ব্যস্ততম এলাকায় দশ ফুট বাই দশ ফুট কক্ষে থাকার ব্যবস্থা করেন। সেখানে তানভীর নাকভী নামীয় একজন কবি – আবদুর রশীদ কারদার, মেহবুব খান এবং অভিনেতা-পরিচালক নাজিরের মতো চলচ্চিত্র পরিচালকের সাথে রফিকে পরিচয় করে দেন। শ্যাম সুন্দর তখন মুম্বাইয়ে অবস্থান করছিলেন। তিনি রফিকে আবারো জিএম দুররানী’র সাথে দ্বৈত সঙ্গীতে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। শ্যাম সুন্দরের গাঁও কি গোরী চলচ্চিত্রের আজি দিল হো কাবু মে তো দিলদার কি এ্যায়সী তাঈসী গানের মাধ্যমে মহম্মদ রফি হিন্দী চলচ্চিত্রে প্রথম গান রেকর্ড করেন। ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধী নিহত হবার পর হুসনলাল ভগতরাম-রাজেন্দ্র কৃষাণ-রফি ত্রয়ী একরাত্রিতেই কালজয়ী শুনো শুনো এই দুনিয়াওয়ালো, বাপুজী কি অমর কাহিনী গান রচনা করে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এরপর তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু’র আমন্ত্রণে গানটি পুণরায় পরিবেশন করে উপস্থিত সকলকে শোনান। ১৯৪৮ সালে ভারতের স্বাধীনতা দিবসে নেহরু’র কাছ থেকে রৌপ্য পদক গ্রহণ করেন মহম্মদ রফি। ১৯৪৯ সালে নওশাদ (চাঁদনী রাত, দিল্লাগী, দুলারী); শ্যাম সুন্দর (বাজার); হুসনলাল ভগতরামের (মীনা বাজার) প্রমূখ সঙ্গীত পরিচালকদের নির্দেশনায় একক সঙ্গীতে অংশ নেন। নওশাদের নির্দেশনায় শ্যাম কুমার, আলাউদ্দীন এবং অন্যান্যদের সঙ্গে রফি’র প্রথম গান ছিল ১৯৪৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পেহলে আপ ছবির হিন্দুস্তান কি হাম হ্যায় গানটি। এভাবেই তিনি হিন্দি ভাষায় তার প্রথম গান রেকর্ড করেন। এছাড়াও রফি দু’টি হিন্দী ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৪৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত লায়লা মজনু চলচ্চিত্রের তেরা জ্বালা জিস নে দেখা গানের দৃশ্যে অতিথি শিল্পী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি নওশাদের সহযোগিতায় অনেকগুলো গান গেয়েছেন। ১৯৪৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শাহজাহান চলচ্চিত্রে কুন্দন লাল সায়গলের সাথে মেরে স্বপ্ন কি রানি, রুহী রুহী নামের কোরাসে অংশ নেন। মেহবুব খানের আনমল ঘড়ি (১৯৪৬)-তে তেরা খিলোনা তোতা বালক এবং জুগনু (১৯৪৭) চলচ্চিত্রে ইয়াহান বাদলা ওয়াফা কা গানে নূর জাহানের সাথে দ্বৈত সঙ্গীতে কণ্ঠ দেন। ভারত বিভাজনের সময় মহম্মদ রফি ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তাঁর পরিবারও বোম্বেতে চলে আসে। কিন্তু ঐসময়কার অন্যতম জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী নূরজাহান পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হবার সিদ্ধান্ত নেন। নূরজাহান সেখানে আহমেদ রুশদী’র সাথে নতুন করে সঙ্গীত জুটি বাঁধেন। রফি ঐ সময়ের জনপ্রিয় সঙ্গীতকার হিসেবে কুন্দন লাল সায়গল, তালাত মেহমুদের গানগুলো গভীরভাবে অনুসরণ করেন। তবে সবচেয়ে বেশী অনুরক্ত ও প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন জি. এম. দূররাণী’র প্রতি, যাঁর গানগুলোকে নিজের গানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি তাঁর আদর্শকে ধারণ করতে গিয়ে ১৯৫৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হাম সব চোর হ্যায় ছবিতে হামকো হাসতে দেখ জামানা জ্বলতা হ্যায় এবং ১৯৫০ সালে বেকসুর ছবিতে খবর কিসি কো নাহিন, ও কিধার দেখতে-এর মতো গানে প্রভাব ফেলেছিলেন।
মুম্বই আসার পরে শুরু হয়েছিল তাঁর অগ্নিপরীক্ষা। বান্দ্রার ভেন্ডি বাজার থেকে রোজ সকালে হেঁটে চলে আসতেন দাদারে। তার পরে এক দিন কারদার স্টুডিয়োয় প্রবাদপ্রতিম সুরকার নৌশাদের দেখা পেলেন। লম্বা রেসের ঘোড়াটিকে চিনতে ভুল হয়নি কিংবদন্তি সুরকারের। ‘পহলে আপ’ ছবিতে ‘হিন্দুস্তান কে হম হ্যায়’ গান দিয়ে তাঁর কদম কদম চলা শুরু হয়েছিল স্বপ্ননগরীতে। ‘আনমোল ঘড়ি’ ছবিতে রফির গাওয়া ‘তেরা খিলোনা টুটা বালক’ তাঁকে জায়গা করে দিয়েছিল বলিউডে। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৪৮-এ ‘দুলারি’ ছবিতে রফি গাইলেন এমন এক গান যা আজও আধুনিক, আজও অমলিন। ‘সুহানি রাত ঢল চুকি, না জানে তুম কব আওগি’। মনে আছে নায়কের নাম? গীতিকারের নাম? সেই প্রথম এক জন গায়কের অলরাউন্ড দক্ষতা সম্পর্কে আভাস পেল বলিউড। অনুভব করল, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুরের উপরে সেই গায়কের বিস্ময়কর নিয়ন্ত্রণ। “ওর মধ্যে আগুন ছিল, ধৈর্য ছিল, ছিল নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ”, একবার মন্তব্য করেছিলেন নৌশাদ। যা সার্থকতা পেয়েছিল ১৯৬৩ সালে লন্ডনের স্কালা থিয়েটারে জলসার পরে। রফির গানের অনুষ্ঠান শেষে এক অন্ধ শ্রোতা এসে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘যত দিন আমার কান শুনতে পাবে আপনার গান, তত দিন এ জগতে আমার চোখের প্রয়োজন হবে না।’’
মহম্মদ রফিকে ‘তানসেন’ বলে ডাকতেন রবীন্দ্র জৈন। নৌশাদই তাঁকে তানসেন তৈরি করেছিলেন। ‘বৈজু বাওরা’ ছবির পরে সব সুরকারের প্রথম পছন্দের তালিকায় শীর্ষস্থানে মহম্মদ রফি। রফি-নৌশাদ রাগাশ্রয়ী গানে একে অপরের পরিপূরক। ‘উড়ন খটোলা’ ছবিতে “ও দূরকে মুসাফির’’ গানটি বার-কুড়ি রিহার্সাল দেওয়ার পরেও ফাইনাল টেকের আগে আরও এক দিন সমানে ঝালিয়ে নিলেন। কারণ ওই গানটিই ছিল দিলীপকুমারের ওই হিট ছবির প্রাণভোমরা। তার পর কী হয়েছিল শ্রোতারা জানেন। রফি-নৌশাদ যুগলবন্দিতে বলিউড পেয়েছে ১৭৯টি চিরকালীন গান। তাই বারবার শুনলেও কখনও পুরনো হবে না ‘বৈজু বাওরা’ ছবির দরবারি রাগে গাওয়া ‘‘ও দুনিয়া কে রখওয়ালে’’ (এমন হাই স্কেলের গান কে কবে গেয়েছেন বলিউডে), মালকোষে হরিভক্তদের আপ্লুত করে দেওয়া ‘‘মন তড়পত হরি দর্শন কো আজ’’। “রফি ছিল আমার আত্মা’, মন্তব্য করেছিলেন নৌশাদ। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে রফি ছুটতেন। বড় পর্দার জন্য মোট ৪৭০০টি গান গেয়েছিলেন তিনি। শুধু নৌশাদই নন, শঙ্কর-জয়কিষেণ বা ও পি নায়ারের সেরা অস্ত্রের নামও ছিল মহম্মদ রফি। এস-জে জুটির সুরে রফি গেয়েছেন মোট ৩৭৩টি গান। প্রায় সব গান শুধু হিট তা-ই নয়, চিরসবুজ এ সব গানের কোনও ‘এক্সপায়ারি ডেট’ নেই। বলিউডে লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল জুটিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তাঁর ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠ। ‘পরশমণি’ বা ‘দোস্তি’ ছবির সাফল্যের পিছনে ছিল কেবলই রফির গান। এই জুটির সুরে তিনি গেয়েছিলেন ৩৪৬টি গান।
দেব আনন্দের ছবির জন্য ১৯৪৭-৫৬ রফি ডাক পাননি শচীনকর্তার কাছ থেকে। দেব আনন্দের ছবি ওই সময় কিশোরময়। তার আগে বর্ষীয়ান সুরকার রফিকে সুযোগ দিয়েছিলেন গুরু দত্তের ‘কাগজ কে ফুল’ এবং ‘পিয়াসা’ ছবিতে। গোল্ডি আনন্দের অনুরোধে ‘নও দো গ্যায়ারা’ ছবিতে রফিকে ডাক দিলেন শচিনকর্তা। রফি এলেন এবং জয় করলেন দেবভক্তদের হৃদয়। দেবের ঠোঁটে কিশোরের কণ্ঠে গান শুনতে অভ্যস্ত শ্রোতারা শুনলেন অসম্ভব এক মিষ্টি গান – ‘‘ও আজা পঞ্ছি অকেলা হ্যায়’’। আর কী আশ্চর্য রফির জন্যই কিনা কে জানে, কিশোরও ওই ছবিতে দুরন্ত – ‘‘আঁচলে মে কেয়া জি’’, অসম্ভব মেলোডিয়াস। এর পরে দেব আনন্দের ‘কালাপানি’, ‘কালা বাজার’, বোম্বাই কা বাবু’ ‘তিন দেবিয়াঁ এবং ‘গাইড’ ছবিতে রফির জাদুকণ্ঠ এমন এমন সব গান শ্রোতাদের উপহার দিল, যা আজ কেবলই ইতিহাস। ‘‘চলে গয়ে হম বেখুদি মে তুম কো পুকারে’’, ‘‘খোয়া খোয়া চাঁদ’’, ‘‘সাথী না কোই না কোই মঞ্জিল’’ ‘‘কেয়া সে কেয়া খো গয়া’’, ‘‘দিন ঢল জায়ে হ্যায়’’ – এ সব গান চিরকালীন আসন পেয়েছে বলিউডের স্বর্ণযুগের আর্কাইভে।
তখন সেল ফোন, কম্পিউটার কেবলমাত্র কল্পবিজ্ঞানে। রফির যুগ মানেই চিঠি লেখার যুগ, রেডিয়োর যুগ। সেরা বিনোদন বলতে ছায়াছবি। সেই যুগে নায়িকার জন্য বিরহী নায়কদের যাবতীয় দুঃখকষ্ট গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে, শ্রোতা এবং দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করার মতো এমন গায়কি অন্য কোনও গায়ক দেখাতে পেরেছেন কি? দিনের পর দিন? বছরের পর বছর? রফিসাবকে অনন্য গায়ক বলতে কি এর পরেও দ্বিধা থাকবে? প্রশ্ন তোলেন তাঁর ভক্তরা।
‘আরাধনা’ পরবর্তী যুগে কিশোরকুমার-আর ডি বর্মনের দাপটে রফি যখন বেশ কোণঠাসা, তখনও থেমে থাকেনি রফির কণ্ঠ। তাঁকে গানভিক্ষা করতে হয়নি কখনও কোনও সুরকারের দরজায়। কিশোরকুমারের সেরা দিনেও রফি বলিউডে আবার ফিরে এলেন উষা খন্নার সুরে ‘হাওয়াজ’ ছবির ‘‘তেরে গলিয়োঁ মে না রাখেঙ্গে কদম আজ কে বাদ’’ গানের মাধ্যমে। তার পরে আবার হিটের পর হিট। ‘‘কেয়া হুয়া তেরা ওয়াদা’’, বা ‘‘পর্দা হ্যায় পর্দা হ্যায়’’-এর মতো ধুঁয়াধার সব গান গেয়েছেন এই সময়ে। শুধু নায়কই নন, গায়কের জন্যও গান করেছেন রফি, ‘শরারত’ আর ‘রাগিনী’ ছবিতে তিনি গান গেয়েছেন কিশোরের ঠোঁটে। রাগিনী ছবির রাগাশ্রয়ী ‘‘মন মোরা বাওরে” গাইতে হয়েছিল রফিকেই।
রফি এবং আব্দুল হামিদ বোম্বেতে অবস্থানকালীন চল্লিশের দশকে দুই বোনকে বিয়ে করেন। রফি পূর্বে বিয়ে করেছিলেন। স্ত্রীর নাম ছিল বশিরা। কিন্তু অভিবাসন আইনের দরুন তাঁকে ভারতে আনতে পারেননি। দেশ বিভক্তির ফলে তাঁর স্ত্রী পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থান করেন। প্রথম সংসারে তার একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। বোম্বেতে অবস্থানকালীন তিনি বিলকিস নাম্নী এক রমণীকে ২য় বারের মতো বিয়ে করেন। তাদের ২য় সংসারে ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা আছে। তিনি মদ্যপান করতেন না। একজন ধার্মিক ও বিনয়ী ব্যক্তি হিসেবে সর্বত্র সকলের কাছে পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আদ্যন্ত পারিবারিক ছিলেন রফি। সঙ্গীত, সাত সন্তান আর স্ত্রীর বাইরে তাঁর অন্য কোনও জগৎ ছিল না। সপ্তাহান্তে লোনাভালায় তাঁর বাগানবাড়িতে চলে যেতেন সপরিবার। সেখানে সুইমিং পুলে সাঁতার কেটে, ব্যাডমিন্টন খেলে, ঘুড়ি উড়িয়ে গোটা দিন কাটিয়ে দিতেন। আর বিদেশ ভ্রমণ করতেন। গানের জলসার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা দুনিয়া। রেকর্ডিং রুম থেকে বাড়ীতে এবং বাড়ী থেকে রেকর্ডিং রুমে আসা-যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর জীবন। চলচ্চিত্রের যে-কোন ধরণের জলসায় তাঁকে কখনো অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এছাড়াও, ধূমপান কিংবা মদ্যপান করতেন না রফি। তিনি ভোর ৩টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ও একাধারে সঙ্গীতের রেওয়াজ বা সঙ্গীত চর্চ্চা করতেন। আদ্যন্ত মার্জিত, অজাতশত্রু রফি ছিলেন সবার প্রিয়। প্রিয় বন্ধু মুকেশের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে অসুস্থ শরীরে হাসপাতালে শুয়ে থাকা রফি দৌড় দিয়েছিলেন শশ্মানঘাটের দিকে। চাননি তাঁর সন্তানেরা গান নিয়ে মাতামাতি করুক। তিনি জানতেন এই দুনিয়ায় সফল হওয়া সবচেয়ে কঠিন কাজ। মেজ ছেলে শহিদের গায়ক হওয়ার বাসনায় তিনি জল ঢেলে দিয়েছিলেন। সবাইকে ব্যবসাবাণিজ্যে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ঠিকই করেছিলেন। না হলে ছেলেদের হয়তো সারা জীবন বাবার সঙ্গে তুলনার পিছিয়ে থাকার সমালোচনায় সংকুচিত হয়ে থাকতে হত!
মান্না দে-কে ফোন করে মহম্মদ রফির মৃত্যুসংবাদ জানিয়েছিলেন সুরকার নৌশাদ। বলেছিলেন “আজ সাত সুর সে এক সুর চলা গয়া।” গায়ক হিসেবে সারা জীবনে মান্না দে-র ওই একটাই আফসোস। যদি মহম্মদ রফির মতো গানটা গাইতে পারতাম। বারবার বলেছেন, বলিউডে রফি এক নম্বরে, কিশোর দু’নম্বরে আর তিনি তিন নম্বরে। “যখনই মহম্মদ রফির গান শুনি, তখনই মনে হয় ওর থেকে সর্বোত্তম গায়ক আর হয় না। যে-কোনও দিন ও সবার থেকে আগে।” এক সাক্ষাৎকারে এমন স্বীকারোক্তি করতে দু’মিনিট ভাবেননি মান্না দে। যিনি নিজে ‘‘সুর না সাজে’’ বা ‘‘পুঁছো না ক্যায়সে ম্যায়নে রয়েন বিতাই’’র মতো গান গেয়েছিলেন।
রফি কেন কালোত্তীর্ণ? বেশ কয়েক বছর আগে একটি সর্বভারতীয় পত্রিকা একটা সার্ভে করেছিল। গত ৭৫ বছরে বলিউডে সেরা ৩০টি গান। এই কঠিন কাজটির দায়িত্বে ছিলেন প্রায় ৩০ জন নামকরা গায়ক-সুরকার-গীতিকার এবং সঙ্গীত সমালোচক। সেরা গান হিসেবে বাছা হয়েছিল, ‘চিত্রলেখা’ ছবিতে রোশনের সুরে রফির গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটি – ‘‘মন রে তু কাহে না ধীর ধারে’’। মনে আছে? আর দ্বিতীয় সেরা গান হিসেবে ‘গাইড’ ছবির ‘‘তেরে মেরে সপ্নে আব এক হি রং হ্যায়’’। ভাবা যায়? এর পরেও তাঁকে কালোত্তীর্ণ, বলিউডের সর্বকালের সেরা বলতে দ্বিধা করবেন? ২০০১-এ ‘ঘোস্ট ওয়ার্ল্ড’ ছবির সাউন্ডট্র্যাকে ব্যবহার করা হয়েছিল ‘গুমনাম’-এর সেই বিখ্যাত গানটি ‘‘জান পহেচান হো’’। গায়কের নাম? মহম্মদ রফি। ‘মনসুন ওয়েডিং’ ব্যবহার করেছিল ‘লোফার’ ছবিতে রফির গাওয়া ‘‘ও আজ মওসম বড়া বেইমান হ্যায়’’ গানটি। মনে আছে ‘পিয়াসা’ ছবির সেই বিখ্যাত গান – ‘‘ইয়ে দুনিয়া অগর মিল ভি জায়ে তো কেয়া হ্যায়’’? ২০০৯-এ ‘গুলাল’ ছবির থিম সং হিসেবে রফির এই গানটি রিমিক্স করে ব্যবহার করা হয়েছিল। শুধু এই-ই নয়, রফির গাওয়া ১৬টি গান নিয়ে ‘সিটি অব বার্মিংহাম সিমফনি অর্কেস্ট্রা’ রিলিজ করেছিল একটা ডাবল সিডি। রফি অনুরাগী সোনু নিগম নতুন করে গানগুলো গেয়েছিলেন। সংস্থার প্রোমোশনাল ট্যুরে অংশ নিয়ে সোনু গিয়েছিলেন লন্ডনের ন্যাশনাল অপেরা, ম্যাঞ্চেস্টারের অ্যাপোলো থিয়েটারে আর বার্মিংহামের সিম্ফনি হলে। রফির শেষযাত্রার আসল ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল একটি হিন্দি ছবির দৃশ্যে। বান্দ্রা এবং পুণের রাস্তার নামকরণ হয়েছে রফিসাবের স্মরণে।
জীবনে এমন কী পুরস্কার নেই, যা রফি পাননি? এক জীবনে এক জন গায়ক যদি পাঁচ বার জাতীয় পুরস্কার পেয়ে থাকেন, তো তাঁর আর চাইবার কী-ই বা থাকতে পারে?
“রফি সাব একলা চলে যাননি, সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন তাঁর গোটা স্কুলটি, সঙ্গীত জগতের রফি ঘরানাও তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই বিদায় নিয়েছে”, এমনই মন্তব্য করেছিলেন মান্না দে। রফিসাবের মৃত্যুর পরে। আজ মান্না দে’ও চলে গিয়েছেন, থেকে গিয়েছে তাঁর মন্তব্য। রফিসাহেবের অন্ধ ভক্ত কিশোরকুমার বলতেন, একটা গান আমি গাইতে পারি শুধুমাত্র সঙ্গীত পরিচালকের দেখিয়ে দেওয়া পথেই। আর রফি অবলীলায় সেই গান গাইতে পারেন একশো রকম ভাবে। মান্না দে স্বীকার করতেন, ধ্রুপদী গান আমি গাইলে ধ্রুপদী গানের শ্রোতারাই তা শোনেন। কিন্তু সেই গান রফি গাইলে, তা হয়ে ওঠে আপামর জনতার মুগ্ধতা।
তাই সেই মুগ্ধতাই শিল্পীর প্রয়াণের ৩৬ বছর পরেও এক প্রতিবাদ–মঞ্চে শামিল করতে পেরেছিল তাঁর কোটি কোটি অনুরাগীকে। কারণ, ২০১৬–তে একটি কদর্য বাজারি হিন্দি ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল মহম্মদ রফির গায়কি নিয়ে একটি কুৎসিত ও অপমানজনক মন্তব্য। বাপি লাহিড়ী থেকে সোনু নিগম – অনেকেই শামিল হয়েছিলেন প্রতিবাদে। তার পরই নিঃশর্তে ক্ষমা চেয়ে পিছু হটতে হয়েছিল গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল ওই প্রযোজক–পরিচালককে। জীবনাবসানের এত দিন পরেও কি এমন জনপ্রিয়তা সম্ভব? কিংবদন্তি সঙ্গীত পরিচালক জুটির (লক্ষ্মীকান্ত) প্যারেলাল শর্মা মনে করেন, সম্ভব। হিন্দি সিনেমায় রফি সবচেয়ে বেশি (৩৮৮টি) গান গেয়েছেন লক্ষ্মী–প্যারের সুরেই। ৩১ জুলাই ১৯৮০–র সকালেও তাঁদের সুরেই জীবনের শেষ গানটি (ছবি: আসপাস) রেকর্ড করেছিলেন রফি। প্রায় চার দশক পরেও সেদিনের কথা মনে করে গলা ধরে আসে প্যারেলালজির। বলেন, আমাদের প্রথম সিনেমা ‘পরশমণি’ থেকেই মূল গায়ক ছিলেন রফিসাব। তারপর যত দিন গেছে, আমরা বুঝেছি ওর কণ্ঠটি ছিল আসলে স্বয়ং ঈশ্বরের। তবে শুধু কণ্ঠ নয়। রফি সাব গান গাইতেন ওঁর আত্মা দিয়ে।
অথচ গোঁড়া মুসলিম পরিবারে জন্ম হওয়ায়, গান–বাজনায় কড়া নিষেধ ছিল রফির। জন্মস্থান পাঞ্জাবের কোটলা সুলতান সিংহের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে তাই গান গেয়ে বেড়ানো ফকিরদের নকল করত শিশু রফি। সেখান থেকে লাহোরে গিয়ে সেলুনের ব্যবসা শুরু করেছিলেন রফির আব্বা। তিনি চাইতেন ৬ ছেলে তাঁর ব্যবসায় মন দিক। কিন্তু মেজ ছেলে ফিকো (রফির ডাক নাম) ১৩ বছর বয়সে মঞ্চে উঠে গাইতে শুরু করল কে এল সায়গলের গান। তার পরই শুরু দৌড়। ২০ বছরে বয়সে মুম্বই। ঘিঞ্জি ভেন্ডিবাজার এলাকায় খেয়ে, না–খেয়ে এক খুপরিতে মাথা গুঁজে সিনেমা চৌহদ্দি চষে ফেলা স্রেফ পায়ে হেঁটে। বাকিটা তো ইতিহাস!
৬টি ফিল্মফেয়ার, ১টি জাতীয় পুরস্কার। ১৯৬৭–তে পদ্মশ্রী। যা রফির ক্যারিশমার তুলনায় কিছুই নয় বলে দাবি করেন বিশেষজ্ঞরা ও তাঁর তামাম ভক্তকুল। ৫টি বিদেশি ভাষা ও প্রায় ১৫টি ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন। বিশ্বের যেখানে পৌঁছেছে মহম্মদ রফির গান, সেখানেই তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে হু হু করে। হিন্দি সিনেমার ১০০ বছর উপলক্ষে বিবিসি এশিয়া নেটওয়ার্কের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় শতাব্দীর জনপ্রিয়তম গানের শিরোপা পেয়েছে মহম্মদ রফিরই গাওয়া ‘বাহারো ফুল বরসাও’! সেই শিল্পীর আকস্মিক জীবনাবসানে সেই সময়ের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক ও প্রযোজকরা পথে বসবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো রাতারাতি জায়গা পেয়ে গিয়েছিলেন মহ. আজিজ, সাব্বির কুমার, মনোহর, আনোয়ার, উদিত নারায়ণ, সোনু নিগমের মতো সেই সময়ের রফিকণ্ঠি গায়কেরা। আজও দেশ–বিদেশের ছোটবড় প্রায় জলসাতেই সাদরে ডাক পড়ে নামী অনামী রফিকণ্ঠিদের। এমনকি সারা দেশের প্রায় প্রতিটি মিউজিক বারেও বহাল তবিয়তে চাকরি করে চলেছেন হাজার হাজার রফিকণ্ঠি। এখনও ভারতের প্রায় প্রতিটি শহরের রাস্তার ধারে পোস্টারের দোকানগুলোতে সার দিয়ে ঝোলে মহম্মদ রফির রং–বেরঙের ছবি।
প্রিয় শিল্পীকে কুর্নিশ জানাতে কাপর্ণ্য করেননি তাঁর অনুরাগীরা। ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে রফি অনুরাগীরা বছর দশেক আগে গড়ে তুলেছেন মহম্মদ রফি স্মৃতিমন্দির। উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে পনেরো বছর ধরে চলছে মহম্মদ রফি হাই স্কুল। পশ্চিম বান্দ্রার সিক্সটিন্থ রোডটি রফি অনুরাগীদের চাপে নামকরণ হয়েছে পদ্মশ্রী মহম্মদ রফি মার্গ। অথচ, বান্দ্রারই টোয়েন্টি এইটথ রোডে রফি ম্যানসনের একটি ঘরে রফি সাহেবের স্মৃতিবিজড়িত যাবতীয় রেকর্ড, পুরস্কার, স্মারক, ক্যারম বোর্ড, রেডিও, ফ্লাস্ক, খাবারের প্লেট তাঁর পরিবারের সদস্যরা সযত্নে সাজিয়ে রাখলেও, রফি সাহেবের প্রিয় সেই সাদা গাড়িটি বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। খোলা আকাশের নিচে।
শুধু সিনেমা জগৎই নয়, সাধারণ মানুষও কখনও মহম্মদ রফির কাছ থেকে খালি হাতে ফেরেননি। বহু প্রযোজক, পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালকের দুঃসময়ে তিনি টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। প্রয়াত সুরকার লক্ষ্মীকান্ত বলতেন, রফিসাহেব কোনও কিছু প্রত্যাশা না করেই কারও জন্য কাজ করে দিতেন। লক্ষ্মী–প্যারে জুটির কাছে রফিসাহেব ছিলেন ‘ফরিস্তা’। পাকিস্তানের সুরকার নিসার বাজমির জন্য মাত্র ১ টাকায় গান গেয়েছিলেন রফি। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গেও তাঁর তিক্ততার কথা মনে আছে বলিউডের প্রবীণ মানুষদের। কারণ লতা চেয়েছিলেন, সিনেমার গানে কণ্ঠশিল্পীদের রয়্যালটি দেওয়া হোক। কিন্তু রফির যুক্তি ছিল- প্রযোজক ছবি তৈরি করেন আর্থিক ঝুঁকি নিয়ে। আর গান সৃষ্টি করেন সঙ্গীত পরিচালক। সে ক্ষেত্রে কণ্ঠশিল্পী তাঁর পরিশ্রমিক তো আগেই পেয়ে যান। পরে কেন সেই গান–বিক্রির লভ্যাংশ দাবি করবেন সেই শিল্পী? স্বাভাবিকভাবেই লতা–সহ প্রায় সব গায়ক–গায়িকারই চক্ষুশূল হয়েছিলেন মহম্মদ রফি। কিন্তু তাতেও টলানো যায়নি সত্যনিষ্ঠ ও আদর্শবাদী মানুষটিকে। পুরো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিই সেদিন কুর্নিশ জানিয়েছিল নিলোর্ভ ও মহান সেই তারকা শিল্পীকে। মৃত্যু পরবর্তীকালে তাঁর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একসময় সুরকার হিসেবে নিসার বাজমী (পরবর্তীতে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হন) বলেছিলেন, ‘‘যখন রফিকে তিনি তাঁর দেনা পরিশোধ করতে পারেননি, তখন রফি এক টাকার বিনিময়ে তার জন্য একটি সঙ্গীত গান ও তাঁকে দায়মুক্ত করেন। এছাড়াও তিনি প্রযোজকদের বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।’’ লক্ষ্মীকান্ত-পিয়ারেলাল জুটির অন্যতম লক্ষ্মীকান্ত তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন যে, ‘‘রফি সর্বদাই অর্থ সাহায্য করেছেন অনেককেই; কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি অর্থ ফেরতের আশা করেননি।’’
সেই তারকাই মাত্র ৫৫ বছরে খ্যাতির মাঝআকাশে জ্বলজ্বল করতে করতে যখন দপ করে নিভে যান, তখন তো চোখের জলের বাঁধ ভাঙবেই। ভেঙেও ছিল। তামাম বলিউড হাউহাউ করে কেঁদেছিল ইন্দ্রপতনে। রমজান মাসের ২৭তম দিন ছিল সেটি। উপোসি থেকেও রেকর্ডিং করতে গিয়েছিলেন। ইফতারের আগেই ফিরে এসেছিলেন বাড়িতে। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ শেষ কথাটি বলেছিলেন স্ত্রীকে, ‘‘মেরে লিয়ে দুয়া করনা!’’ পরদিন ম্মিতবাক মাটির মানুষটির ঠাঁই হয়েছিল জুহু মুসলিম গোরস্থানে। শোকযাত্রায় মুম্বইয়ের ইতিহাস ভেঙে প্রায় কুড়ি হাজার অনুরাগীর চোখের জলে বিদায় নিয়েছিলেন ভারতীয় সঙ্গীতের দিগ্বিজয়ী সুলতান।
এর পর থেকে প্রতি বছর তাঁর জন্মদিন (২৪ ডিসেম্বর) ও মৃত্যুদিনে তাঁর সমাধিতে ছুটে যেতেন রফি–অনুরাগীরা। যেখানে শুরুতে ছিল রফিসাহেবের নামাঙ্কিত একটিমাত্র ফলক। কয়েক বছর হল সেই ফলক আর নেই। এমনকি সেখানে নেই শায়িত শিল্পীর দেহাবশেষও। ঠাঁই নেই যুক্তি দিয়ে গোরস্থান কর্তৃপক্ষ সেখানে মাটির নতুন আস্তরণ চাপিয়ে দিয়েছেন। তাই হারিয়ে গেছে তালাত মেহমুদ, মধুবালা, নৌশাদ, লুধিয়ানভি, খাজা আহমদ আব্বাস, জান নিসার আখতার, পরভিন ববির মতো রফিসাহেবেরও সমাধি। গোরস্থান কর্তৃপক্ষের দাবি, মৃত্যুর পর এখানে সবাই সমান। বলিউডের নতুন প্রজন্মের এসব নিয়ে মাথাব্যথা না থাকলেও, রফিভক্তরা এই নিদানে রীতিমতো মর্মাহত। তাঁরা খুঁজে নেন সেই নারকোল গাছটি, যার নিচেই চিরঘুমে শায়িত হয়েছিলেন এ যুগের তানসেন।
রফি–অনুরাগীদের দীর্ঘদিনের দাবি, মরণোত্তর ভারতরত্ন দেওয়া হোক মহম্মদ রফিকে। সরকার শুনুক না শুনুক, এ দাবি আজও হয়তো আবার উঠবে। আবার প্রমাণিত হবে, ৪০ বছর কাটল, সময় মহম্মদ রফিকে ভোলেনি! মহম্মদ রফি আমাদের প্রাত্যহিক, গতানুগতিক জীবনের জেলখানা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সেই গুপ্ত চাবি। মারা যাওয়ার চল্লিশ বছরের পরেও। আজও।
(তথ্যসূত্র:
১- Mohammed Rafi: My Abba: a Memoir, Yasmin Khalid Rafi, Tranquebar (২০১২)।
২- Mohammed Rafi: Golden Voice of the Silver Screen, Shahid Rafi and Sujata Dev, Om Books International (২০১৫)।
৩- Mohammed Rafi: God’s Own Voice, Dhirendra Jain and Raju Korti, Niyogi Books (২০১৬)।
৪- আজকাল পত্রিকা, ৩১শে জুলাই ২০১৮ সাল।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬শে জুলাই ২০১৪ সাল।
৬- The unforgettable Rafi, Times of India, 25/12/2010)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত