‘‘একদিন দক্ষিণেশ্বর-মহাতীর্থে শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণের পদসেবা করিতে করিতে শ্রীসারদাদেবী জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আমাকে তোমার কি ব’লে মনে হয়?’; শ্রীশ্রীঠাকুর বলিয়াছিলেন, ‘যে মা মন্দিরে আছেন, যিনি এই শরীরের জন্ম দিয়েছেন ও এখন নহবতে বাস করছেন, তিনিই এখন আমার পদসেবা করছেন। সাক্ষাৎ আনন্দময়ীর রূপ বলে তোমায় সর্বদা সত্য সত্য দেখতে পাই।’ বিস্ময়বিমুগ্ধ হইয়াছিলেন শ্রীমা শ্রীশ্রীঠাকুরের সেই কথা শুনিয়া। শ্রীশ্রীঠাকুর আপনার সহধর্মিণীকে সাক্ষাৎ-জগজ্জননীর চিন্ময়-মূর্তি বলিয়া মনে করিতেন ও পূজা করিতেন। শুধু তাহাই নহে, স্বীয় সহধর্মিণীর মতো বিশ্বের প্রতিটি নারীই ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিকট পূজ্যা ও জগন্মাতার প্রতিচ্ছবি। সত্যই শ্রীশ্রীঠাকুর স্বীয় গর্ভধারিণী জননী ও দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রীভবতারিণীর প্রতিমূর্তি বলিয়া মনে করিতেন শ্রীমা সারদাকে। সেজন্য শ্রীরামকৃষ্ণদেব একদিন গভীর অমানিশায় শ্রীসারদাদেবীকে ষোড়শী বা ত্রিপুরসুন্দরীরূপে পূজা করিয়া বিশ্বের নারীজাতিকে মাতৃত্বের মহিমময় আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। ত্রিপুরসুন্দরীর অপর নাম ললিতা ও শ্রীবিদ্যা। শ্রীবিদ্যা যন্ত্র দেবীর পীঠস্থান। ত্রিপুরসুন্দরী বঙ্গদেশীয়-তন্ত্রে শ্যামা বা দক্ষিণকালিকা বলা যাইতে পারে। ফলহারিণী কালীপূজার গভীর অমানিশায় শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রীসারদাদেবীকে সম্মুখে আসনে বসাইয়া ষোড়শোপচারে পূজা করিলেন ও ধ্যান করিলেন এবং পূজা ও ধ্যানের শেষে শ্রীমাকে বন্দনা করিয়া জপের মালা শ্রীমার পাদপদ্মে সমর্পণ করিয়া প্রণাম করিতে করিতে বলিলেন,
‘সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী নারায়ণি নমোহস্তু তে।।’
ইহাই বিদ্যাভাবের শক্তিপূজা। তন্ত্র বলে ‘শিবশক্ত্যাত্মকং জগৎ’, সমগ্র বিশ্ব শিব ও শক্তির দিব্যপ্রকাশ। দিব্যাচারের পূজায় শিব ও শক্তি অভিন্ন, ব্রহ্ম ও ব্রহ্মময়ীর মধ্যে কোন ভেদ নাই, যেমন অগ্নি ও তাহার দাহিকাশক্তি অভিন্ন। দিব্যাচারী সাধকের দৃষ্টিতে বিশ্বচরাচর শিব ও শক্তির যুগলরূপ এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শিব ও শক্তিরই মহিমময় লীলাক্ষেত্র। তন্ত্রে যিনি অচঞ্চল নির্বিকার সদাশিব বা মহাকাল-শিব, তিনিই আবার লীলায় চিরচঞ্চলা কালী। শিব অর্থে সদাশিব ও মহাকাল-শিব যখন শবরূপে আপন মহিমায় বিভোর থাকেন, তখন তিনি নিত্য ও নির্গুণ ব্রহ্ম এবং শিব যখন লীলার জন্য শক্তিরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন, তখন তিনি নৃত্যচঞ্চলা ত্রিলোকপ্রসবিনী মহাশক্তি কালী। তাই তন্ত্রশাস্ত্রের মতে মহাকাল ও মহাকালী এক ও অদ্বিতীয় একই সত্যের রূপভেদ ও নামভেদ মাত্র।’’
(বিশ্বরূপিণী মা সারদা, শ্রীমতী শুক্লা ঘোষ, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ)
মায়ের মূর্তি আমাদের হৃদয় আপ্লুত করে, মায়ের মধুর উপদেশে অমৃত বর্ষিত হয়, সেই মা-ই হলেন শ্রীরামকৃষ্ণের পরম শক্তি বহুরূপিণী বিশ্বজননী সারদামণি। মা একদিকে যেমন অসুরদলনী, অন্যদিকে ত্রাণকারিণী। হরিশের কুবুদ্ধি দমনের জন্য বগলামূর্তি, আবার তেলোভেলোর মাঠে ডাকাত দম্পতির কাছে কালীরূপ ধারণ করেছিলেন। বহুরূপিণী মা সারদা তাঁর নিত্যশুদ্ধ আত্মা ভক্তদের কাছে আরাধ্য দেবীমূর্তিরূপে দেখা দিয়েছিলেন। আমরা যে সকল দেবীকে পূজা করি, মায়ের চরিত্রে সেইসব দেবীর প্রকাশ ঘটতে ভক্তেরা দেখেছিলেন। তাঁর এই রূপের উল্লেখ করে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাগনে হৃদয়কে বলেছিলেন, ‘‘ওরে ওর নাম সারদা ও সরস্বতী। জ্ঞান দিতে এসেছে। রূপ থাকলে পাছে অশুদ্ধ মনে দেখে লোকের অমঙ্গল হয় তাই এবার রূপ ঢেকে এসেছে।’’ শ্রীমা সারদামণিকে কালীরূপে দর্শন করেছিলেন অনেক ভক্ত। মা-ও ‘কালী’ বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন, তবে কোন বারই সরাসরিভাবে নয়। তেলোভেলোর মাঠে ডাকাত দম্পতি মাকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি তো সাধারণ মানুষ নও। আমরা তোমাকে কালীরূপে দেখছি।’’ মা তাঁকে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘কী জানি, আমি তো কিছু জানি না। ঠাকুর একবার বলেছিলেন, সেই যে নহবতে আছে আর মন্দিরে ভবতারিণী – একই।’’ মা কালী কি না জানতে চাইলে মা বলতেন, ‘‘লোকে বলে কালী।’’ প্রশ্ন আসত, ‘‘কালী তো? ঠিক?’’ এক ভক্ত তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘বলো, তুমি আমার সকল ভার নিয়েছ। আর সাক্ষাৎ মা কালী কিনা?’’ মা তাঁর মাথায় হাত দিয়ে গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, তাই।’’ একবার মা বিষ্ণুপুর স্টেশনে গাড়ির অপেক্ষায় বসেছিলেন, এমন সময় এক পশ্চিমা কুলি তাঁকে দেখে ছুটে এসেছিল, বলেছিল, ‘‘তু মেরে জানকী। তুঝে ম্যায়নে কিতনা দিনো সে খোঁজা থা। ইতনে রোজ তু কঁহা থি?’’ – এই বলে সে কাঁদতে শুরু করেছিল। মা তাঁকে শান্ত করে ফুল আনতে বলেছিলেন। সে ফুল এনে মায়ের চরণে অর্পণ করেছিল। মা সেই পশ্চিমা কুলিকে তখনই মন্ত্রদীক্ষা দিয়েছিলেন। আর স্বামী বিবেকানন্দের দৃষ্টিতে শ্রীমা সারদা ছিলেন ‘জ্যান্ত দুর্গা’। ভক্ত ‘গিরিশচন্দ্র ঘোষ’ সেই জ্যান্ত দুর্গার পূজা করে ধন্য, কৃতকৃতার্থ হয়েছিলেন। গিরিশচন্দ্রের জেদ ছিল, মা স্বয়ং না এলে পূজা করা নিরর্থক। গিরিশের বাড়িতে পূজা চলছিল। খিড়কির দরজায় গভীর রাতে করাঘাত হয়েছিল – ‘‘আমি এসেছি।’’ পূজামণ্ডপে সত্যি সত্যিই মা অবতীর্ণা হয়েছিলেন। ভক্তগণ মায়ের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছিলেন। শ্রীমা সারদামণির আরও পরিচয় হল তিনি করুণাময়ী, কৃপাময়ী ও ভক্তবৎসলা। মা জানতেন, ভগবানলাভের জন্য যে সবকিছু ত্যাগ করে, সে ধন্য। কিন্তু আবার কোনও সংসারী সন্ন্যাস নিতে চাইলে মা বলতেন, ‘‘দেখ দিকিনি, কী অন্যায়। সে বেচারী এই কাচ্চাবাচ্চাদের নিয়ে যায় কোথায়? তিনি সন্ন্যাসী হবেন! কেন সংসার করেছিলেন? যদি সংসার ত্যাগই করতে চাও, আগে এদের খাওয়া থাকার সুব্যবস্থা করো।’’ একজনের বাবা মারা গিয়েছিলেন। ছেলে সন্ন্যাস নিতে চাইছিলেন। মা আগে ভালো করে জেনে নিয়েছিলেন, ছেলেটি না থাকলে বাড়িতে কোনও অসুবিধা হবে কি না। তাঁদের চলবে তো? জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে তবে ছেলেটিকে মা মন্ত্রদীক্ষা দিয়েছিলেন। সদ্য প্রসূতি একটি মেয়ে মাঠে কাজ করছিল। তাই দেখে মা কাতর হয়ে পড়েছিলেন। অভিমানে মা মনে মনে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘তুমি এসব দেখতে পাচ্ছ না? মানুষের এত দুঃখ দুর্দশা? একটা কোনও বিহিত করো।’’ মা বলতেন, ‘‘পৃথিবীর মতো সহ্যশক্তি চাই। অর্থাৎ যদি শান্তি চাও, তো শান্ত থাকো।’’ মা যে কত রূপে বিরাজিতা। তিনি নিজেই ছিলেন পৃথিবী-কন্যা সীতার মতো আশ্চর্য সহনশীলা। একবার একজন মহিলাকে ঠাকুর মায়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন। বলে দিয়েছিলেন, নহবতে যিনি আছেন তিনিই তোমার দুঃখ কষ্ট দূর করবেন। যাও তাঁকে গিয়ে সব খুলে বলো। মা তাঁকে বলে দিয়েছিলেন, ‘‘তুমি মা, ওঁর কাছেই যাবে। উনিও জানবেন।’’ ঠাকুর আবার ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন তাঁকে – ‘‘না, না, তুমি গিয়ে ভালো করে তাঁকে বলো।’’ এইভাবে বার তিনেক সেই মহিলা ঘোরানো হয়েছিল। শেষে মা তাঁর কৃপাশক্তি প্রকাশ করেছিলেন। মহিলার হাতে একটি বেলপাতা দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘এইটে নিয়ে যাও। তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে।’’ সেটাই হয়েছিল। মায়ের সেবা ছিল অতুলনীয়। একবার ভক্তজননী খুব সকালবেলা গোয়ালার বাড়িতে দুধ আনতে গিয়েছিলেন। তাঁর বাতের ব্যথায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করলে বলেছিলেন, ‘‘কলকাতা থেকে আমার সন্তান ক’জন এসেছে। তাদের সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস। তাই দুধ নিতে এসেছি।’’ অসুস্থ শরীরে নিজের হাতে তাঁদের বিছানার চাদর পর্যন্ত কেচেছিলেন। ভক্তরা আঁতকে উঠে বলেছিল, ‘‘এ কী করছেন?’’ মা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘ময়লা বিছানাতে ছেলেরা শোবে কী করে?’’ কষ্টকে তিনি কোনদিন কষ্ট বলে মানেন নি। আর একটা ঘটনার কথা বলা যাক। জয়রামবাটীতে জগদ্ধাত্রী পূজার পরে ভক্ত ত্যাগী সন্তান যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা সবাই ম্যালেরিয়াতে শয্যাগত হয়েছিলেন। মায়ের তখন চিন্তা-উদ্বেগের শেষ ছিল না, শুধু বলতেন, ‘‘মা গো কী হবে? ছেলেরা সবাই পড়ে পড়ে ভুগছে।’’ মা সব কাজ করেছিলেন, আর একটু অবসর পেলেই দরজায় দাঁড়িয়ে রোগীদের দেখে যেতেন। সেই সময় গ্রামে দুধ দুষ্প্রাপ্য ছিল। মা তখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে এক পোয়া আধ পোয়া যা পেতেন, সেই দুধ নিয়ে আসতেন। নিজের হাতে রোগীদের পথ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। অন্ন-পথ্যের পরে মায়ের পরিশ্রম যাতে আর না বাড়ে তাই সবাই জোর করে চলে যাচ্ছিলেন। মা তাঁদের বলেছিলেন, ‘‘আর ক’দিন থাকো। শরীরে একটু বল পাও।’’ তাঁরা যখন চলে যাচ্ছিলেন, মা তখন খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে অপলকে চেয়ে ছিলেন, তাঁর চোখে ছিল জল। মা ছিলেন সামাজিক বিধিনিষেধের ওপরে। তাঁকে ‘গণ্ডিভাঙা মা’ বলে ভক্তেরা অভিহিত করেছিলেন। আজ কারও অজানা নয় যে তিনি মুসলমান আমজাদের এঁটো পরিষ্কার করেছিলেন আর বলেছিলেন, ‘‘আমার শরৎ (সারদানন্দজি) যেমন ছেলে, আমজাদও তেমন ছেলে।’’ শ্রীরামকৃষ্ণের মতো তাঁর প্রেম ও কৃপাও আচণ্ডালকে ধন্য করে প্রবাহিত হত। মা ছিলেন সকলের ইহকাল ও পরকালের আশ্রয়। কেই বা তাঁর করুণায় বঞ্চিত ছিলেন? মুচি, মেথর, ডোম, বাগদি, চণ্ডাল, মুসলমান, আতুর সকলেই মায়ের কাছে অবাধ আশ্রয় পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন। একদিন জয়রামবাটীতে মা অন্যমনস্কভাবে কাজ করতে করতে বলেছিলেন, ‘‘আমি আর অনন্ত হাতে কাজ করেও শেষ করতে পারছি না।’’ বলেই বলেছিলেন, ‘‘দেখ তো, আমার আবার অনন্ত হাত, এ কী বলছি।’’ এইভাবে নানারূপে মায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বিভিন্ন দেবীর মহিমায়। ঠাকুর বলেছিলেন, ‘‘মাতৃভাব সবচেয়ে শুদ্ধভাব।’’ মাতৃভাব সব সাধনার শেষ কথা। মাতৃরূপে আমাদের মা-কে ষোড়শী পূজার মাধ্যমে জগৎকল্যাণের জন্য পরমশক্তির উদ্বোধন করেছিলেন প্রাণের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। ভারতের ইতিহাসে আদর্শ নারীর অভাব নেই। কিন্তু মাতৃভাবের পূর্ণ বিকাশ আমরা এঁদের মধ্যে খুব একটা দেখতে পাই না। তিনি নিবেদিতাকে গ্রহণ করেছিলেন সাদরে। শরৎ ও আমজাদের মধ্যে ফারাক রাখেননি কোনও দিন। সর্বজনীন মাতৃত্বের আদর্শ তিনিই। তাই তো স্বামীজি বলেছিলেন, ভারতে ‘জননী’ই আদর্শ নারী। মাতৃভাবই প্রথম ও শেষ কথা।
মা এমনই জিনিস যে, সকল সন্তানই তা জানে, সে তাঁর মাকে চেনে। শুধু তাই নয়, তাঁর মতন আর কেউ তাঁর মাকে জানে না। মা-ও কোন সন্তানকে অস্বীকার করেন না। অতএব বিদ্বানের যেমন অধিকার, মূর্খেরও তেমনি অধিকার এই একটি দরবারে। ‘‘আমি সতেরও মা, আমি অসতেরও মা, আমি সু-এর মা, আমি কু-এর মা, আমি শরতের মা, আমি আমজাদের মা। আমি মা। যে-ই মা বলে ডাকে আমি তারই মা। আমি সকলেরই মা।’’ দেখা যাক এই লজ্জাপটাবৃতা, চিরঅবগুণ্ঠিতা মহাশক্তি বিশ্বপ্রসবিনী, জগজ্জননীর জীবনালেখ্যে সামান্য তিমিরান্ধ বুদ্ধিতে কি প্রতিভাসিত হয়। ইতিহাস ও পুরাণ সতীত্বের ও পাতিব্রত্যের কি ভূয়সী প্রশংসাই না করেছে। রামের সঙ্গে সীতার বনগমন, সত্যবানের জীবনের প্রশ্নে সাবিত্রীর দৃঢ়তার কাছে যমের নতিস্বীকার, বিষ্ণুপ্রিয়ার তপস্বিনী জীবন, উপনিষদের ব্রহ্মবাদিনীদের কথা, খ্রীস্টীয় এবং বৌদ্ধ লিপিতে সন্ন্যাসিনীদের কথা কত মহিমান্বিত। কিন্তু মাতৃত্বের কথা, বিশ্বমাতৃত্বের কথা, মানুষের ইতিহাসে বিশেষ সূচিত হয় শ্রীমা সারদা দেবীর জীবনে। গর্ভধারিণী মায়ের অপরিসীম স্নেহ, ত্যাগ ও সেবার কথা অবিদিত নয়, কিন্তু ‘সকলের মা’ কথাটি সত্যি নতুন নয় কি? ভগবান সকলের একথা নতুন নয়। কিন্তু ‘সকলের মা’ এ কথাটি মহা আশ্চর্য। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে দেখা যায় গৃহে ও সমাজে কত রকমের সম্পর্কঃ গুরু-শিষ্য, পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, যজমান-পুরোহিত, প্রভু-ভৃত্য, চিকিৎসক-রোগী, দোকানী-ক্রেতা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এমন নজির কি কোথাও আছে যেখানে আমরা দেখতে পাই কোন এক নারী সকলের প্রতি সমানভাবে সন্তানভাব রক্ষা করেন অথবা নিজেকে সকলের মা মনে করেন? এ কি সম্ভব? এ প্রসঙ্গই বোধ হয় অভিনব। কিন্তু অভিনব হলেও এ যে ঘটেছে। এ যে বাস্তব। এ অনস্বীকার্য।
বাঁকুড়ার জয়রামবাটীতে রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও শ্যামাসুন্দরীদেবীর বাড়িতে যে সময়ে শ্রীশ্রী সারদাদেবীর জন্ম (২২শে ডিসেম্বর, ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ) হয়, সে সময়ে কলকাতায় চলছিল নারীমুক্তি ও নারী প্রগতির উদ্দেশ্যে একাধিক সংস্কার। ঊনিশ শতকের প্রথম থেকেই এক দল সংস্কারকামী মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় বঙ্গের নবজাগরণের ইতিহাসে। ডেভিড হেয়ার ও তাঁর সঙ্গে এ দেশীয় মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় একে একে নারী-লাঞ্ছনার চিত্রগুলি বদলাতে শুরু করেছিল। এ জন্য তাঁদের কম পরিশ্রম করতে হয়নি। রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা নিবারণ বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আইন পাশ ও বহু বিবাহ রদ করার কথা বহুল প্রচারিত। এ ছাড়াও সমাজের অগণিত কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতি রোধে বহু হিতাকাঙ্ক্ষী মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন। কেবল সমাজ নয় – ধর্মীয় ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও এই সংস্কার হয়েছিল।
বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম ও বড় হওয়া সারদাদেবীর উত্তর-জীবন কেটেছিল কলকাতা ও জয়রামবাটীতে। ফলে এক দিকে যেমন গ্রাম্য সরলতায় পূর্ণ ছিল তাঁর হৃদয়, তেমনই শহরের জীবনযাত্রা ও জাতীয় ঘটনাবলি সম্পর্কেও তিনি যথেষ্টই ওয়াকিবহাল ছিলেন। সংসারের যাবতীয় কাজের সঙ্গে তাই তাঁকে দেখা গিয়েছিল জাতীয় স্তরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ভক্ত-শিষ্যদের সঙ্গে আলোচনা করতে। তাঁর কাছে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে যেমন সকল মানুষের অবাধ যাতায়াত ছিল, তেমন আসতেন সে যুগের বহু বিপ্লবীও। ফলে জীবন ও জাতীয়তাবোধে সারদাদেবী অনেক বেশি আধুনিক ছিলেন। এই আধুনিকতার সোপান বেয়েই তাঁর মনন ও মানসিকতা প্রবাহিত হয়েছিল প্রগতির খাতে। তখন স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন সে ভাবে ছিল না। সারদাদেবীও খুব বেশি পড়াশোনা করে উঠতে পারেননি। ‘রাসসুন্দরীদেবী’ তাঁর ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “সেকালে মেয়েছেলের বিদ্যাশিক্ষা ভারী মন্দ-কর্ম বলিয়া লোকের মনে বিশ্বাস ছিল।” কিন্তু সারদাদেবী মনে করতেন, স্ত্রীশিক্ষার বিস্তার না ঘটলে স্ত্রীজাতি নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তিনি নিজে চিঠি লিখতেন না ঠিকই, কিন্তু পড়তে পারতেন ভাল ভাবেই। তিনি ভাল ভাবে পড়তে শিখেছিলেন বা পড়তেন বিয়ের পরে, দক্ষিণেশ্বরে ও শ্যামপুকুরে থাকাকালীন। স্ত্রীজাতিকে স্বাবলম্বী হতে হবে – এই বিশ্বাস নিয়েই তিনি মেয়েদের পড়াশোনা করতে বলতেন। ‘রাধু’, ‘মাকু’ প্রমুখ ভাইঝিদের তিনি নিজে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। বিবাহিতা রাধুকে তিনি উদ্বোধনের কাছে একটি স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি করে দিয়েছিলেন। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণকেও গুরুত্ব দিতেন। নিবেদিতার স্কুল খুবই পছন্দ করতেন। কারণ, সেখানে যেমন পড়াশোনা হত, তেমন শেখানো হত হাতের কাজও।
সে যুগে প্রচলিত অন্যতম একটি প্রথা ছিল বাল্যবিবাহ। তবে শুধু সে সময়ে নয় – এমনকিএখনও নাবালিকা বিয়ের খবর প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় জায়গা করে নেয়। ঋতুমতী কন্যা গৃহে রাখা পাপ। খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে ‘স্মার্ত রঘুনন্দন’ তাঁর ‘উদ্বাহতত্ত্বে’ এই বিধানই দিয়েছিলেন, যা বঙ্গে ‘চিরসত্য’ বলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় প্রচলিত ‘বিবাহ-আইনে’ নারীর ক্ষেত্রে সহবাসে সম্মতির সর্বনিম্ন বয়স দশ ঠিক করা হয়েছিল। ১৮৭২-এ ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলনের ফলে পাশ হওয়া বিবাহ আইনে স্থির হয়েছিল, বিয়ের জন্য ছেলের বয়স হতে হবে ন্যূনতম আঠারো আর মেয়ের চোদ্দো। সারদাদেবীর নিজের কম বয়সে বিয়ে হলেও তিনি বাল্যবিবাহ প্রথার বিরোধী ছিলেন। রাধুর কম বয়সে বিয়ে হওয়াকে তাঁর যন্ত্রণার কারণ বলে দুঃখপ্রকাশ করতেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি এক বার বলেছিলেন, “আহা, তারা (দু মাদ্রাজী কুড়ি-বাইশ বছর বয়সী তরুণী) কেমন সব কাজকর্ম শিখেছে! আর আমাদের! এখানে পোড়া দেশের লোকে কি আট বছরের হতে না হতেই বলে, ‘পরগোত্র করে দাও, পরগোত্র করে দাও!” সারদাদেবীর মেজো ভাই কালীকুমার তাঁর বড় ছেলের তেরো আর ছোট ছেলে রাধারমণের এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। ছোট ছেলের বিয়ের পত্র পেয়ে তিনি খেদোক্তি করেছিলেন, “ছোট ছোট ছেলের বিয়ে দিচ্ছে – আমার কাছে (মত) আদায় করে নিচ্ছে। আখেরে যে কষ্ট পাবে তা জানে না।”
শুধু শিক্ষার অধিকার বা বাল্যবিবাহ রোধ নয় – সঠিক প্রেক্ষিতে মেয়েদের ব্রহ্মচর্য ও সন্ন্যাস গ্রহণ এবং শাস্ত্রপাঠ ও পূজার্চনার অধিকারের কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। ঋগ্বৈদিক যুগ এবং পরবর্তী সময়ে ‘ব্রহ্মবাদিন’ নামে এক শ্রেণির স্ত্রীজাতির কথা জানা যায়, যাঁরা সন্ন্যাস জীবন যাপন করতেন এবং ধর্ম ও দর্শন চর্চা করতেন। মহীশূরের নারায়ণ আয়েঙ্গারের কন্যা ব্রহ্মচারিণী হতে চাইলে সারদাদেবী, স্বামী সারদানন্দকে দিয়ে এই মর্মে চিঠি লিখিয়েছিলেন যে, মেয়েদেরও সেই অধিকার আছে। এ কারণেই গৌরী-মার আশ্রমের ব্রহ্মচারিণীরা ও নিবেদিতার স্কুলের ত্যাগী মেয়েরা সারদাদেবীর এত প্রিয় ছিল।
নারীর সার্বিক উন্নতি ও বিকাশ সারদাদেবীর ভাবনায় ছিল। নারীর স্বাধীনতা আদায়ে পুরুষের প্রয়োজন নেই। সে নিজে তাঁর অধিকার আদায় করে নিতে শিখুক – এটাই তাঁর অন্যতম বক্তব্য ছিল। আর সে কারণেই তিনি বারেবারে চেয়েছিলেন নারীরা শিক্ষিত হোক। কারণ, শিক্ষা না পেলে আত্মশক্তি বাড়ে না। সারদাদেবী নিজে স্ত্রী-মঠ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন এবং বলতেন, স্ত্রী-মঠে নারীরাই হবে প্রধান ও পরিচালক। ‘দুর্গাপুরীদেবী’র লেখা ‘সারদা-রামকৃষ্ণ’ গ্রন্থে আছে, সারদাদেবী এক বার এক ভক্তকে বলেছিলেন, “সন্তানদের অনেককে তো দেখি নিজেদের ভুলত্রুটি অপরাধের ইয়ত্তা নেই, তবু তারা চায় বউ-ঝিরা তাদের কাছে নত হয়ে থাকুক। এই অন্যায়ের ফলে যে দিন আসছে, মেয়েরা আর পৃথিবীর মতো সইবে না।” যে সারদাদেবী সহ্যের কথা বলতেন, সেই তিনিই অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলে গিয়েছিলেন। প্রায় একশো বছর আগের প্রেক্ষাপট থেকে আজকের সময়ে পদার্পণ করলে তার হাজারো নমুনা পাওয়া যায়।
সারদাদেবী অন্য সংস্কারকদের মতো একা বা দল গঠন করে রাস্তায় নেমে নারীমুক্তি আন্দোলন করেননি ঠিকই, কিন্তু নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছিলেন কী ভাবে ব্যক্তিজীবন সুন্দর করে তৈরি করা সম্ভব এবং সেই সঙ্গে সম্ভব নারীর সার্বিক উন্নতিও।
পরিবর্তিত মূল্যবোধ, তলানিতে পৌঁছে যাওয়া নৈতিকতা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ও তাকে বেশির ভাগ সময়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার মানুষকে আজ প্রেম-প্রীতি-সৌহার্দ্যের জগৎ থেকে বিচ্যুত করে চূড়ান্ত ভোগবাদী জীবনযাপনে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমান সমাজে আমাদের মানবিক হওয়ার প্রয়াস নেই, বিশ্বাস নেই, ভালবাসা নেই, অধ্যাত্মপথের হদিস জানা নেই, চিন্তাচর্চা নেই। এই ‘নেই’-এর রাজত্বকে সদর্থকতায় পূর্ণায়ত করে তুলতে পারে একমাত্র নিঃস্বার্থ ভালবাসা – যার প্রতিমূর্তি শ্রীমা সারদা। তাঁর জীবনের সারসত্যটুকুই ছিল ভরপুর ‘ভালবাসা’। এ যেমন তাঁর পারিবারিক জীবনে – যেখানে তিনি চন্দ্রমণিদেবীর পুত্রবধূ বা পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের লজ্জাপটাবৃত স্ত্রী, এলোমেলো-চূড়ান্ত অগোছালো অনুজদের দায়িত্বপরায়ণা অগ্রজা। অন্য দিকে রামকৃষ্ণসঙ্ঘের ‘জননী’ – রামকৃষ্ণপার্ষদ-সহ অগণিত সন্ন্যাসী ও গৃহী সন্তানের ‘মা’। সেই কবে তাঁর স্বামী কাশীপুর বাগানবাড়ি থেকে তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতার দিকে আঙুল তুলে সেখানকার লোকজনের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরই ওপর। তার পর শুধু কলকাতার কেন; তাবৎ বিশ্বের লক্ষ কোটি মানুষের জননী তিনি। উচ্চারণ করেছিলেন, ‘‘সব সময় মনে রেখো, তোমাদের এক জন মা আছেন। সেই মা, পাতানো নন, গুরুপত্নী নন, কথার কথা মা নন, সত্যিকারের মা।’’
পারিবারিক জীবনকে, আধ্যাত্মিক ভাবভূমিকে সুসংহত-সুগঠিত করার জন্য নিজের জীবনটি তিনি মেলে ধরেছিলেন। কী নেই সেখানে! দক্ষিণেশ্বরে ভোর-ভোর প্রাত্যহিক কাজ শেষ করে রান্না বসানো, স্বামীর জন্য একটু ‘জিওল’ মাছের আয়োজন, শাশুড়ির যত্নআত্তি; শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আগত অনেক জ্ঞানী-গুণী, নগর কলকাতার তাবড় তাবড় লোকজন – তাঁদের দেখভাল; অল্পবয়সি, যাঁদের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ, রাখাল, লাটু অগ্রগণ্য – তাদের জন্যও একহাত ঘোমটা মাথায় টেনে, রুটির ময়দা ঠেসেছিলেন। রেঁধেছিলেন ছোলার ডাল। আবার ওরই মধ্যে চলেছিল নীরবে নিজের জপধ্যান, লোককল্যাণের জন্যও প্রার্থনা।
পরবর্তী কালে উদ্বোধনের বাড়িতে দেখা গিয়েছিল ভক্তদের জন্যও ঠাকুরের প্রসাদের ব্যবস্থা করা, অসুস্থ ভক্তের পথ্য, তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তোলা এবং এই সব দায়িত্ব সামলে নিজের কাজে মনোনিবেশ। এত কাজ-দায়িত্ব একা হাতে সামলানো, আবার কখনও ভবতারিণী মন্দিরে পুজোর জন্য ফুল তুলে মালা গেঁথে পাঠানো। কিন্তু কাউকে টের পেতে দেননি এ সব। কলকাতার বিশিষ্ট ভক্তরা জয়রামবাটীতে গেলে ঘুরে ঘুরে চায়ের দুধ জোগাড় করেছিলেন, এমনকি শাকসব্জিও। নিজের হাতে বাড়িঘর-সংলগ্ন পথঘাট পরিষ্কার করেছিলেন। শুধু নিজের পরিবার নয়, সবার জন্য নিরলস চিন্তা – প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দটুকু মাথায় রাখা – এত কিছু ভালবাসা ছাড়া কি হয়! শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির পর রাণী রাসমণির তহবিল থেকে আসা টাকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলাফল হয়েছিল চূড়ান্ত দারিদ্র। সারদা তাতেও অবিচল থেকেছিলেন।
প্রাত্যহিকতার এই বিষয়গুলি শুধু সত্য নয়, চিরন্তন সত্য। আর এই যে জীবনাভিজ্ঞতা তা সারদার আধ্যাত্মিক চেতনাকে ভক্ত-পার্ষদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন সহজেই। জাগতিক এই সংসার সম্পর্কে বলেছিলেন, “বাবা, সংসার মহা দঁক (পাঁক), দঁকে পড়লে ওঠা মুশকিল। ব্রহ্মা-বিষ্ণু খাবি খান, মানুষ কোন ছার! তা এই জগৎসংসারে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার নিদান কী? নির্বাসনা প্রার্থনা করা, কারণ, ‘দেহে মায়া দেহাত্মবুদ্ধি, শেষে এটাকেও কাটাতে হবে। কিসের দেহ, মা, দেড় সের ছাই বই তো নয়’ – তার আবার গরব কিসের?” যে সব সংস্কার আমাদের মনকে খর্ব করে, যে সঙ্কীর্ণ ধর্মবুদ্ধি আমাদের ভেদনীতি শিক্ষা দেয়, সারদা চিরদিন তাকে বর্জন করেছিলেন। স্বল্পান্তর তিনি থাকতেন পরিচিত পরিমণ্ডলে, কিন্তু কেউ না কেউ তাঁকে খবরের কাগজ পড়ে শোনাতেন নিয়মিত। পাশ্চাত্যের সঙ্গে সেই সময় নিয়ত সাংস্কৃতিক সংযোগ ঘটেছিল তাঁর। ভক্তদের ইংরেজি শিখতে বলেছিলেন। গভীর দার্শনিক প্রজ্ঞায় বুঝেছিলেন, জীবনে দুঃখ যেমন সত্য, দুঃখ না থাকাও তেমনই সত্য। তাই নির্ভার মনে বলতে পেরেছিলেন, ‘‘চিরদিন কেউ দুঃখী থাকবে না।’’ ঈশ্বরলাভ করে যাঁরা মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল, তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘‘ভগবান লাভ হলে কী হয়? দুটো কি শিং বেরোয়? সদসৎ বিচার আসে? জ্ঞানচৈতন্য হয় – ভাবে কথাবার্তা, ভাবে সব হয়।’’ কী অমোঘ সত্য, কী অবলীলায় বলা কথাগুলি!
সারদা ‘রামকৃষ্ণগতপ্রাণা’, কিন্তু কখনও কখনও স্বামীর আপত্তি সত্ত্বেও অনেককে নিজের কাছে ঠাঁই দিয়েছিলেন। জীবনপথে যারা ভ্রষ্ট হয়েছিল কোনও কারণে তাঁদের শরণাগতি এবং ভুল বুঝতে পারাকেই তিনি সম্মান করেছিলেন, সরিয়ে দেননি। কোনও চেষ্টা ছাড়াই বলতে পেরেছিলেন, ‘‘আমি সতেরও মা, অসতেরও মা; আমার শরৎ (স্বামী সারদানন্দ)-ও যেমন ছেলে, এই আমজাদও (সেই সময় কুখ্যাত ডাকাত, পরে সারদার একনিষ্ঠ ভক্ত) তেমন ছেলে।’’
ভালবাসার অফুরান উৎস সারদা, আর সেই ভালবাসা থেকেই মেয়েদের দুঃখ-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেননি। ডোমরমণীর ওপর তাঁর স্বামীর অত্যাচারে সরব হয়েছিলেন। বাপের বাড়িতে (কালীমামার) ভাইয়ের ছেলেদের অল্পবয়সে বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর হয়েছিলেন। মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না এলে যে এ দুর্দশা ঘুচবে না, আর তার জন্য যে লেখাপড়া শেখা জরুরি বুঝেই উত্তর কলকাতার অবিবাহিত মেয়েদের নিবেদিতা স্কুলে পাঠাতে বলেছিলেন। শুধু মেয়েদের নয়, সাধু-ব্রহ্মচারীদের ইংরেজি শিক্ষার জন্য তিনি মঠ-মিশনে শিক্ষক রাখার পরামর্শও দিয়েছিলেন। জগৎজীবন সম্পর্কে কতখানি ওয়াকিবহাল হলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি স্থাপনের যে চোদ্দো শর্ত প্রেসিডেন্ট উইলসন দিয়েছিলেন, তা শুনে কেতাবি শিক্ষা বর্জিত সারদা মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘ওঁরা যা বলেন সব মুখস্থ। … যদি অন্তঃস্থ হত, তা হলে কথা ছিল না।’’ কী দূরদর্শিতা! অন্তঃস্থ যে নয়, তা তো দেখিয়ে দিয়েছে অল্প দিনের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
সারদার সব কিছুর মূলে ছিল প্রজ্ঞা, ভালবাসা। তাই আজ যে মানসিক চাঞ্চল্য মানুষকে গ্রাস করেছে, তা থেকে যত কুৎসা-কুকর্মের-মিথ্যাচারের বেসাতি, তার নিরসনে তিনি বলেছিলেন, ‘‘মনও তো মত্ত হাতি, তাকে নিয়ন্ত্রণ করাই তো জীবনের ধর্ম।’’
(তথ্যসূত্র:
১- বিশ্বরূপিণী মা সারদা, শ্রীমতী শুক্লা ঘোষ, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ।
২- মমতাপ্রতিমা সারদা, স্বামী আত্মস্থানন্দ।
৩- শ্রীমা সারদা দেবী, স্বামী গম্ভীরানন্দ।
৪- সারদা-রামকৃষ্ণ, দুর্গাপুরীদেবী।
৫- শতরূপে সারদা, পোদ্দার বুকস্ ইন্টারন্যাশনাল।
৬- সেকালের সারদা মা একালের স্নেহময়ী মা, সুভাষ চন্দ্র সোম, ছায়া পাবলিকেশন।
৭- মমতাময়ী শ্রী শ্রীমা সারদা, অঞ্জনকুমার রায়, বুলবুল প্রকাশন।
৮- শ্রীমা সারদা ও তাঁর সময়, মঞ্জুরী দাস, আনন্দ পাবলিশার্স।
৯- রামকৃষ্ণ-সারদা: জীবন ও প্রসঙ্গ, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত