যেমন গীতা দত্তকে বাদ দিয়ে গুরু দত্তের জীবনকাহিনী অসম্পূর্ণ রয়ে যায়, ঠিক তেমনই উৎপলা সেনকে বাদ দিয়ে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের জীবন নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। দুজনে এতটাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন একে অপরের সাথে যে তাঁদের আলাদাভাবে করা খুবই দুরূহ বিষয়। আর সেই সম্পর্কের চক্রে আছেন তিনজন মানুষ। বেনু সেন, উৎপলা সেন এবং সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। তিনজনের সম্পর্কের গভীরতা এতটাই ছিল যে তিনজনের মৃত্যুতেও পাওয়া যায় অদ্ভুত মিল। কারণ তাঁদের সম্পর্কটা এক-আধ বছরের ছিল না, সম্পর্কটা ছিল তখন থেকে যখন উৎপলা ছিলেন বেণু সেনের ঘরণি। তাঁদের তিন জনের বন্ধুতা, হৃদ্যতা কখনও যে টাল খায়নি একটি বারের জন্যও। ১৯৬৫ সালের ১৩ই নভেম্বর বেণু সেনের অকাল মৃত্যুর পর তাঁর মায়েরই উদ্যোগে সতীনাথ বিয়ে করেছিলেন উৎপলাকে। তার পর তাঁদের জীবন চলেছিল নানা বাঁক পেরিয়ে। হঠাৎ একটা অঘোষিত টাইফুন কোত্থেকে ধেয়ে এসে সব যেন উপড়ে ফেলে দিয়েছিল। ’৯১ সালে উৎপলার ইন্টেস্টিনাল ভলভুলাস ধরা পড়েছিল। জটিল রোগ। অপারেশন হয়েছিল। ওই সময় থেকেই খুব দুশ্চিন্তা করতেন সতীনাথ। কী যে হল তাঁর প্রাণভোমরা রোশনির! এরপরেই হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছিল সতীনাথের। তবু তিনি কাউকে কখনই বুঝতে দিতেন না নিজের শরীরের কষ্ট। নিজে নিজেই ওষুধ খেতেন। শেষে একটা সময়ে বুকে অসহ্য ব্যথা নিয়ে সতীনাথ ভর্তি হয়েছিলেন পিজি-তে। আর বাড়ি ফেরা হয়নি তাঁর। ১৯৯২ সালে ১৩ই ডিসেম্বর তাঁর চলে যাওয়ার পরে তাঁর খাটের জাজিম তুলে বাড়ির লোকজন পেয়েছিলেন গুচ্ছ গুচ্ছ সরবিট্রেটের খালি কৌটো! এর ঠিক আট বছর পরে ২০০০ সালে কোলন ক্যানসার হয়েছিল উৎপলার। আবার অপারেশন হয়েছিল। দীর্ঘদিন হাসপাতালে বন্দি থেকে শেষে একটা সময়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। কিন্তু প্রবল শারীরিক অসুস্থতার জন্য দিনে দিনে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন বিছানায়। তবুও তিনি শুয়ে শুয়েই ঘরকন্নার তদারকি করতেন। আর নিজের জীবনের শেষের বছরটা তিনি জড়িয়ে বেঁচেছিলেন তাঁর সদ্যোজাত নাতিকে নিয়ে। এমনকি তাঁর নামও রেখেছিলেন নিজেই – ‘সূর্য’। ওই অতটুকু শিশুর কানে তিনি সুর ঢেলে দিতেন যখনতখন! আর শিশুর মা পারমিতাকে বলতেন, ‘‘বল তো, ও ক’বে হাঁটতে পারবে? আমি দেখে যেতে পারব?’’ এরপরে আবার শারীরিক অবস্থার অবনতির জন্য উৎপলাকে যেতে হয়েছিল হাসপাতালে। সেখানেই কোমায় চলে যান তিনি। আর শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালে হাসপাতালে কোমার মধ্যেই চলে গিয়েছিলেন উৎপলা সেন। আর কী অদ্ভুত, বেণু সেন আর সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার দিনটির মতো সে দিনও ছিল ১৩ তারিখ! পরপারেও কী আশ্চর্য বাঁধনে জড়িয়ে রইলেন তাঁরা তিন জন!
গানের জগতের সঙ্গে সতীনাথের সম্পর্কটা ছিল যেন জীবনের টান। বলতে গেলে গান ছিল তাঁর প্রাণ ভোমরা। শৈশবে তাঁর ঠাকুরদা নাতির গান বন্ধ করতে শর্ত দিয়েছিলেন, প্রতি বছর ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে। তাই-ই হতেন সতীনাথ। এক বার শুধু পারেননি। সে বছর আর গান শেখা হয়নি। এমনিতে তাঁর বাড়িতে গানবাজনা বলতে, ঠাকুরদা রামচন্দ্র বেহালা বাজাতেন। আর তাঁর বাবা তারকচন্দ্র গান গাইতেন। তবে তাঁদের কেউই পেশাদার ছিলেন না। এঁরা দু’জনেই চাইতেন, মেধাবী ছাত্র সতীনাথ মন দিয়ে পড়াশুনোটাই করুন। এ দিকে ছোট্ট সতীনাথের গানের এমনই নেশা ছিল যে উপনয়নে পাওয়া টাকায় লখনউ থেকে তানপুরা কিনে এনেছিলেন ট্রেনে করে। তা’ও কী, সারা রাত বাজনা আগলে টান টান জেগে বসে ছিলেন। যদি ভেঙে যায়! বাপ-ঠাকুরদার কাজের সূত্রে লখনউতে জন্ম হলেও ছেলেবেলাতেই সতীনাথ চলে এসেছিলেন হুগলির চুঁচুড়ায়। বিএ পাশ করেছিলেন ডিস্টিংশনে। এর পর বাড়ি থেকে প্রবল চাপ এসেছিল এমএ পড়ার। পড়তে হবে কলকাতায়। তত দিনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ধ্রুপদ-ধামার-টপ্পা তাঁকে বুঁদ করে ফেলেছিল। নামেই কলকাতায় পড়তে এসেছিলেন সতীনাথ। পড়া শিকেয় তুলে ছুটতেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরু চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। এ দিকে বাড়ির লোক জানত, ছেলে এমএ পড়ছে। তালিম নিতে নিতে এক-এক দিন এত রাত হয়ে যেত, যে তাঁকে হাওড়ার স্টেশনেই রাত কাটাতে হত। শেষে একদিন ধরা পড়ে গিয়েছিলেন বাড়িতে। বাধ্য হয়ে তাঁকে চাকরি নিতে হয়েছিল এজি বেঙ্গলে।
ওদিকে ঢাকার মেয়ে উৎপলার বাবা রায়বাহাদুর প্রফুল্লকুমার ঘোষ গানবাজনা জানতেন না। তবে মা হিরণবালা হারমোনিয়াম তো বাজাতেনই, বাঁশি, এসরাজ, সেতার খঞ্জনিও বাজাতে পারতেন। মায়ের কাছেই গান শেখার শুরু হয়েছিল উৎপলার। তারপর তো তাঁর অনেক শিক্ষাগুরু হয়েছিল। এমনকী আনন্দময়ী মায়ের কাছেও গান শিখেছিলেন উৎপলা। অল্প বয়েস থেকেই ঢাকা রেডিয়োয় নানা ধরনের গান গাইতেন উৎপলা। এমনকী কবিতা পাঠ, নাটকও করতেন। কিন্তু তাঁর রায়বাহাদুর বাবার এ সব সহ্য হত না। শেষে যে দিন তিনি দেখেছিলেন কলকাতার এক বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকে ছবি সমেত তাঁর মেয়ের গানের প্রশংসা বেরিয়েছে, সে দিন বোধহয় তাঁর মন ঘুরেছিল। উৎপলার এক গুরু ছিলেন সুধীরলাল চক্রবর্তী। তাঁর কাছে গান শেখার জন্য কম কাঠখড় পোড়াতে হয় নি উৎপলাকে। কারণ সুধীরলাল ছিলেন মুডি গোছের মানুষ। তাই তাঁর বাড়িতে গান শিখতে গিয়ে গুরুজির সাধের গুচ্ছ বেড়ালের জন্য মাগুর মাছ রেঁধে দিতেন উৎপলা। গুরুজির প্রিয় পোষ্য বেড়ালদের চুল আঁচড়ে দিয়ে তাদের টিপ পরিয়ে দিতেন। তত ক্ষণে হয়ত গুরুজির দিবানিদ্রা হয়ে যেত। ছাত্রী উৎপলা প্রবল ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করতেন। কারণ উৎপলা ভালোভাবেই জানতেন যে মুড না এলে গুরু সুধীরলাল চক্রবর্তী গান শেখাতে পারেন না।
তখন রেকর্ড কোম্পানি, রেকর্ড করা গানের স্যাম্পেল কপি দিত শিল্পীদের, শিল্পী অ্যাপ্রুভ করলে সেটা প্রিন্ট হয়ে বেরোবে। সে বছর, খুব ভুল না করলে ১৯৫৭, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় আর একজন শিল্পী গিয়েছিলেন উৎপলা সেনের কাছে স্যাম্পেল রেকর্ড নিয়ে। কার গান হিট হবে জানতে, দু’জনই পরস্পরের সুরে গেয়েছিলেন সে বছর। সব কিছু শুনে উৎপলা সেন তাঁদের বলেছিলেন, দু’জনের সুরই অনবদ্য হয়েছে, তবে সতীনাথের সুর দেওয়া গান দুটো হিট হবেই। উৎপলা সেনের সামনে দুই বন্ধু পরস্পরের কাছে বাজি রেখেছিলেন, এইচ.এম.ভি প্রথম ছ’মাসের বিক্রির যে লিস্ট দেবে তাতে যাঁর গানের বিক্রি বেশী হবে, সেই জয়ী। ঐ শিল্পী যদি বাজি জেতেন তাহলে সতীনাথ তাঁকে এক কার্টন বিয়ার দেবেন, আর তিনি হারলে সতীনাথকে দেবেন এক কার্টন গোল্ড ফ্লেক। সে বছর দেখা গিয়েছিল শ্যামল মিত্রের সুর করা সতীনাথের গান, “রাতের আকাশ তারায় রয়েছে ভরে” উলটো দিকে “পথ চেয়ে শুধু মোর দিন কেটে যায়” আর বেস্ট সেলার হিসেবের শ্যামল মিত্রের গান, সতীনাথের সুর করা – “এত আলো আর এত হাসি গান” আর অন্য দিকে “তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর।”
সতীনাথ মানুষটি ছিলেন অনেকটাই আলাভোলা। সুর মাথায় এলে দিকশূন্য। গান মনে এল তো, সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তাতেই কথা লিখতেন, নোটেশন করতেন। চাঁদনি রাতে গাড়িতে যেতে যেতে হঠাৎই লিখে ফেলেছিলেন, ‘‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো’’ কিংবা ‘‘এখনও আকাশে চাঁদ ওই জেগে আছে’’। এমনকি একবার নতুন গানের সুর ভাঁজতে গিয়ে বেখেয়ালে নিয়ম ভেঙে থানাতেও গিয়েছিলেন। একবার ভুল পার্কিং করে ফেলেছিলেন। ট্রাফিক পুলিশ সোজা পার্ক স্ট্রিট থানায় ধরে নিয়ে যায়। তাতেও হুঁশ হয়নি। থানার চেয়ারে বসে বসেই সুর লাগিয়েছিলেন। গলা শুনে ওসি ছুটে এসে দেখেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়! তখন সেই ট্রাফিক পুলিশেরই সাজা হয় আরকী!
একটা সময় সতীনাথ কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে টানা এগারো বছর ছিলেন। সবে তখন এজি বেঙ্গলের চাকরিতে ঢুকেছেন। অফিসের সময়টুকু বাদ দিলে ঘরের মধ্যেই চলত টানা রেওয়াজ। বিকেলের আলো নিভে গিয়ে সন্ধে পেরিয়ে রাত নামত। রেওয়াজে এতটাই মশগুল থাকতেন, ঘরের আলো জ্বালতেও ভুলে যেতেন। এক দিন কেউ একজন ঘরে ঢুকে দেখেন মশার চাদরে যেন ঢাকা পড়েছেন সতীনাথ! মশা কামড়ে এখানে ওখানে রক্তও। তা’ও আপন মনে গলা সেধে চলেছেন তিনি। তবে শুধু যুবকবেলা বলে নয়, গানের জন্য এই একই রকম ধ্যান ছিল তাঁর প্রান্তদিনেও। নিয়ম করে সাত-আট ঘণ্টা রেওয়াজ না করলে স্বস্তি হত না।
উৎপলা সেনের ‘‘ঝিকমিক জোনাকির দীপ জ্বলে শিয়রে’’-র রেকর্ডিং হবে। তার ঠিক আগেই যন্ত্রশিল্পী ভি বালসারার হাত জখম হল। রেকর্ডিং বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। সারা রাত ধরে চেষ্টা করে সতীনাথ হারমোনিয়ামেই পিয়ানোর এফেক্ট এনে ফেললেন। দুনিয়া রসাতলে গেলেও গানের কাজে হাত দিলে তিনি অর্জুন, পাখির চোখটি ছাড়া কিচ্ছু দেখতেন না।
এই একই মানুষ যখন ঘরকন্নার কাজ করতেন, তখন কিন্তু একসঙ্গে অনেক কিছু করতেন। ছেলের বিছানা তুলতে তুলতে চা বসাতেন। তার সঙ্গেই তরিবত করে রান্নার জোগাড় চলতেন। তখনই হয়তো ছাত্রছাত্রী এসে পড়েছে, তাঁদের তবলাটা বেঁধে দিতেন, কারও লয়কারিতে ভুল হলে ঠিক করে দিতেন। রান্নায় পাকা বামুন ঠাকুরকে টেক্কা দিতেন। ছেলে ভালবাসে বলে প্রতি দিন হাজার কাজ থাক, নিয়ম করে চিকেন রোস্ট বানাতেন। ভাত নামাতেন একদম ফুরফুরে। টমেটো, ধনে পাতা দেওয়া আড় মাছের ঝাল থেকে থিন অ্যারারুট বিস্কুট দিয়ে ডিমের স্ক্র্যাম্বল, বাদ যেত না কিছুই। আর রান্নার পাশাপাশি জমিয়ে বাজারও করতেন সতীনাথ। নিউমার্কেটে তাঁর বাঁধা মুরগিওয়ালা ছিলেন আলাউদ্দিন। উর্দুভাষী। আর নিজে উর্দুটা যেহেতু বলতে, লিখতে পারতেন, সতীনাথ তাঁর সঙ্গে উর্দুতেই কথা বলতেন। তাঁর সে-উর্দু এতটাই চোস্ত ছিল, আলাউদ্দিন ধরেই নিয়েছিলেন তাঁর খদ্দের বাবুটি মুসলিম। কিন্তু তাঁর খটকা লাগত অন্য জায়গায়। এক দিন আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললেন, ‘‘আপ মুসলমান হোকে ধোতি কিঁউ প্যাহেনতে হ্যায়?’’ শেষে গলার উপবীত দেখিয়ে তাঁকে বোঝানো গিয়েছিল, ‘‘না বাবা, আমি মুসলিম নই, হিন্দু ব্রাহ্মণ।’’
এই উর্দুটা ভাল জানতেন বলে সতীনাথ গজলটাও ভাল গাইতেন। ’৪৭-এর আগে লাহৌর-করাচিতে তিনি গজল গেয়ে বেড়াতেন গোলাম মুস্তাফা নামে। অনেকটা সেই কাশেম মল্লিক যেমন ভক্তিগীতি গাইতে গিয়ে কে মল্লিক হয়েছিলেন, তেমনই। স্ত্রী উৎপলাকে নিয়ে সতীনাথ গভীর রাত অবধি জেগে মেহেদি হাসান শুনতেন, লাহোর রেডিয়োতে। সেই মেহেদি হাসান যখন প্রথম কলকাতায় গভর্নর হাউসে এলেন, তখন হিন্দি বা ইংরেজিটা তেমন বুঝতেন না। ভূপেন হাজরিকা সতীনাথকে পাকড়াও করে নিয়ে যান তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য। সতীনাথের গজলের ভক্ত ছিলেন খোদ বেগম আখতার। আখতারি বাঈ উৎপলাকেও চিনতেন লখনউ রেডিয়োয় তাঁর ‘গীত’ গাওয়ার সময় থেকে। কলকাতায় এলে উঠতেন ‘ম্যাজেস্টিক’ হোটেলে। তখন একবার না একবার গজল শোনাতে সতীনাথের ডাক পড়ত সেখানে। অথচ নিয়মের গেরোয় পড়ে গজল রেকর্ড করা তাঁর আর হয়নি। বাংলা আধুনিকে সুর করার সময় একবার গজল অঙ্গটাকে জুড়ে দিয়ে আশ মিটিয়েছেন মাত্র – ‘‘বোঝো না কেন আমি যে কত একা’’ গানে! আখতারি বাঈয়ের সঙ্গে সখ্যটা কতটা নিবিড় হয়ে উঠেছিল, কাশ্মীরের ঘটনাটা বললে বোঝা যেতে পারে। সেবার কাশ্মীর রেডিয়োয় গান গাইতে গেছেন উৎপলা। ভারতীয় জওয়ানদেরও গান শোনাতে হবে। সঙ্গে সতীনাথ। তাঁরা উঠেছিলেন ‘হোয়াইট হাউস’ হাউস বোটে। সন্ধে থেকে ধুম জ্বর এল উৎপলার। তার সঙ্গে গলা বুজে গেল। পাশের বোটেই ছিলেন বেগম আখতার। সতীনাথ গিয়ে বলতেই তখনই চলে এলেন তিনি। তালমিছরি, লবঙ্গ, গোলমরিচ জলে ফেলে ফুটিয়ে, বারে বারে সেটা খাওয়াতে লাগলেন। শিয়রে বসে চলল জলপটি দেওয়া। প্রহরে প্রহরে নমাজ পড়লেন। সারা রাত জেগে। ভোরের দিকে জ্বর নামল উৎপলার, গলাও ফুটল। তখন তাঁর ছুটি।
ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে শ্রদ্ধা, মায়া, ভালবাসার সম্পর্কের এক অদ্ভুত রসায়নে বার বার জড়িয়ে পড়েছেন সতীনাথ-উৎপলা। তার শুরুটা কি উস্তাদ বড়ে গোলাম আলিকে দিয়ে? সময়টা পঞ্চাশের শুরু। কলকাতার এক বিখ্যাত জলসার আসর। উস্তাদজির গানের পর মঞ্চে উঠবেন লতা মঙ্গেশকর। এই দুই শিল্পীর মাঝখানের সময়টুকু ভরাট করতে গান গাইতে বসবেন এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। সতীনাথ এগিয়ে এলেন। সদ্য যুবক। আহীর-ভৈঁরো রাগে ধরলেন ‘‘না যেও না গো চলে যেয়ো না’’। গান শেষ হতে শ্রোতারা উচ্ছ্বসিত – ‘‘এনকোর এনকোর’’। তন্ময় সতীনাথ শুনলেন ‘‘নো মোর নো মোর’’। উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন। ভুল ভাঙাতে মঞ্চে উঠে এলেন লতাজি। গ্রিন রুমে জড়িয়ে ধরলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি। বলেন, ‘‘তুমি সতীনাথ নও, শিউনাথ (শিব)।’’ এর পর থেকে ‘শিউনাথ’ ছিলেন উস্তাদজির প্রিয় পাত্র। এক বার ওঁকে বাড়ির সরস্বতী পুজোয় নেমন্তন্ন করার খুব শখ হল। দ্বিধা যে ছিল না, তা নয়। তবু গেলেন। হাতের হিরের আংটি খুলে উস্তাদজিকে পরিয়ে দিয়ে নেমন্তন্ন করলেন। এসেও ছিলেন উনি।
পঞ্চাশের দশক। গভর্নর হাউসে ‘স্টার্স অব ইন্ডিয়া’ বলে শো হবে তিন দিন ধরে। উদ্দেশ্য কার্শিয়াং-এ টিবি স্যানিটোরিয়াম করার জন্য টাকা তোলা। ভারতের প্রায় সব বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হাজির হবেন। দর্শকদের মধ্যে দিলীপকুমার, রাজকপূর, নার্গিসরা কৌটো হাতে ঘুরবেন। এমন এক অনুষ্ঠানে বাবা আলাউদ্দিন খানকে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন উদ্যোক্তা উৎপলা। আলাউদ্দিনের বয়স তখন প্রায় নব্বই। তা’ও রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
সময় পেলেই প্রতি রবিবার সিনেমা দেখতে যেতেন উৎপলা-সতীনাথ। তো, এক বার সিটে বসার পর থেকেই উৎপলা খেয়াল করলেন, পিছন থেকে মাঝে মাঝেই কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছেন তাঁকে। সতীনাথকে উৎপলা বললেন, ‘‘শোনো, এ বার সুড়সুড়ি দিলে কিন্তু আমি তোমার হাতে চিমটি কাটব। তুমি লোকটাকে ধরবে।’’ একটু পরেই হাতে চিমটি খেয়ে সতীনাথ পিছনে ফিরে ‘লোক’টিকে আবিষ্কার করে হো হো করে হেসে উঠলেন। অবাক হয়ে উৎপলা তাকিয়ে দেখেন – উস্তাদ বিলায়েত খান!
এক বছরের ভাড়া বাকি ছিল বলে কলকাতার বাড়ি থেকে এক প্রবাদপ্রতিম ধ্রুপদ শিল্পীকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। টান মেরে ফেলে দেওয়া হয় তাঁর জিনিসপত্র। শিল্পীর ছেলে সেই খবর নিয়ে এলেন উৎপলার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে বকেয়া টাকা দিয়ে, উপরি এক বছরের আগাম ধরিয়ে তাঁকে আরও অপমানের হাত থেকে বাঁচান তাঁরা। আসলে ধ্রুপদ-শিল্পী বলে নয়, গুণী মানুষের কদর করতে কখনও বোধ হয় দু’বার ভাবেননি তাঁরা – সতীনাথ ও উৎপলা। নইলে রেডিয়োয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গিটার শোনামাত্র কী দায় পড়েছিল উৎপলার খুঁজেপেতে তাঁকে এইচএমভি-তে নিয়ে যাওয়ার। সেই তো সুনীলের রেকর্ডিং-এর শুরু হয়েছিল। চোখ রাখা যাক চল্লিশের দশকে। হুগলি মহসিন কলেজে ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে। গোলকিপিং করছে যে ছেলেটি, সে মাঝে মাঝেই গুন গুন করে গান গায়। উপস্থিত দর্শক সতীনাথের কানে গেল। খেলা শেষে ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে তিনি কলকাতায় গিয়ে ভাল গান শেখার পরামর্শ দিলেন। সে দিনের সেই গোলকিপার, পরবর্তী কালের শ্যামল মিত্র। শোনা যায়, বাংলা-হিন্দি গানের এক কিংবদন্তি এক সময় বিপাকে পড়ে অর্থাভাবে অদ্ভুত উপায়ে রোজগার করতেন। ধনী মানুষ, যাঁদের রাতে ঘুম আসে না, তাঁদের তিনি বাড়ি গিয়ে গিয়ে গান শোনাতেন। বিনিময়ে কিছু অর্থ পেতেন। উৎপলা সেন জানতে পেরে তাঁরও পাশে দাঁড়ান। নিউ থিয়েটার্সে এক সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইবার সুযোগ পেতেন না। অভিযোগ ছিল, তাঁর গলা পঙ্কজ মল্লিকের মতো। স্বভাবতই তার জেরে বেকায়দায় পড়েন তিনি। উৎপলার জন্যই আবার তাঁর ওখানে গাওয়ার সুযোগ ঘটে।
গান তো ছিলই, গানের বাইরেও ওঁদের প্রতি অন্যদের কোথাও একটা আলাদা সম্ভ্রমবোধ কাজ করত। সতীনাথের সুরে ‘‘এ বার তা হলে আমি যাই’’ গানটি তুলতে বসে মহম্মদ রফি সুরকারকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার আসল জায়গা হল বম্বে, এখানেই চলে আসুন।’’ ইন্ডোর স্টেডিয়ামে গাইতে এসে কিশোরকুমার উৎপলা সেনের পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করে বলেছিলেন, ‘‘দিদি, আপনার ‘এক হাতে মোর পূজার থালা’ গানটা আমার পার্সোনাল লাইব্রেরির কালেকশনে আছে।’’ ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে উৎপলা সেনকে ফোন করে উত্তমকুমার বলতেন, ‘‘প্লিজ একবার তোমার ‘আমি তোমায় ছাড়া আর কিছু হায় ভাবতে পারি না’ গানটা একটু শোনাবে?’’ এ ধরনের উচ্চারণ কি নিছকই গানের জন্য?
গীতা দত্তর কথা বলা যাক। তখন উৎপলা থাকতেন ২ নম্বর কেয়াতলা রোডের বাড়িতে। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সপ্তমীতে জলসা আয়োজন করতেন তিনি। কে না আসতেন সেখানে! ক্লাবের সদস্যরা সে বার বললেন, ‘‘গীতা দত্তকে বলে দেখুন না, যদি আসেন।’’ গীতা দত্ত তখন সুপারহিট। তাঁকে দেবার মতো টাকা কোথায়! উৎপলা ফোনে ধরলেন। বললেন, ‘‘আমরা তো টাকাপয়সা তোমায় দিতে পারব না, প্লেন ভাড়াটা দিতে পারি।’’ ও পাশ থেকে উত্তর এল, ‘‘তুমি বলছ যেতে, তোমার কাছ থেকে প্লেন ফেয়ার নেব? কী বলছ!’’ ষষ্ঠীর দিন কলকাতায় চলে এসেছিলেন গীতা দত্ত। গুরু দত্ত যখন মারা যান, খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন গীতা দত্ত। তখন বারবার দেখা করতে চাইতেন সতীনাথের সঙ্গে। গীতা দত্তর ভাই কানু রায় তাঁকে নিয়ে যান নার্সিংহোমে। সতীনাথ তখন বেনিয়ান কাটের শেরওয়ানি পরতেন। ঘরে ঢুকতে অসুস্থ শরীরে চমকে উঠে বসেন গীতা দত্ত। সতীনাথকে নাকি হুবহু গুরু দত্তর মতো লেগেছিল তাঁর!
লতা মঙ্গেশকর, সতীনাথের সুরে তাঁর প্রথম বাংলা আধুনিক ‘‘কত নিশি গেছে নিদ হারা’’ আর ‘‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’’ এক বার শুনেই তাঁর পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। সম্পর্কে গাঢ়ত্বের শুরু বোধ হয় তখনই। সে-নৈকট্য কোথায় পৌঁছয়, বোঝাতে একটা ঘটনা বলাই যথেষ্ট। ভূপেন হাজরিকার সুরে ‘জীবনতৃষ্ণা’ ছবির ‘আবার নতুন সকাল হবে’ গানের রেকর্ডিং। উৎপলা গেলেন বম্বে। লতা মঙ্গেশকর ওঁকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন জুহু বিচে। গল্প, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া সব হল। হঠাৎ রেকর্ডিং-এর আগের রাতে খুব জ্বর উৎপলার। গলা বসে গিয়েছিল। সাউন্ড রেকর্ডিস্ট মিনু কাতরাক বললেন, ‘‘উৎপলাদি, আপনি ফিসফিস করে গান। আমি ঠিক টেক করে নেব।’’ তখন ওখানে যা মেশিনপত্তর, কথাটা নিশ্চয়ই ‘স্তোক’ ছিল না। বিশেষ করে ওঁর মতো নামী রেকর্ডিস্টের কাছে। লতা মঙ্গেশকর তা সত্ত্বেও ঠায় বসেছিলেন স্টুডিয়োয়। উৎপলার শরীর খারাপ না!
আরেকবার অসুস্থ উৎপলাকে মুম্বই থেকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনে এসকর্ট করে এসেছিলেন মালা সিনহা। মালার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল বহুকালের। সতীনাথ যখন ১এ, একডালিয়া প্লেসে থাকতেন, তখন মালা সিনহার বাবা অ্যালবার্ট সিনহা মেয়েকে নিয়ে টানা দু’তিন বছর গান শেখাতে সেখানে আনতেন।
তবে উৎপলা-সতীনাথের ভাগ্যে এক এক সময় যা জুটেছিল, তেমনটা বোধ হয় তাঁদের প্রাপ্য ছিল না। ’৪২ সালে সতীনাথ প্রথম রেকর্ড করেছিলেন নজরুলগীতির – ‘‘ভুল করে যদি ভাল বেসে থাকি’’। তুমুল সাড়া পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরের গানের রেকর্ড ‘‘আমি চলে গেলে পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’’ আর ‘‘এ জীবনে যেন আজ কিছু ভাল লাগে না’’ যখন বেরিয়েছিল, তত দিনে পেরিয়ে গিয়েছিল দশটি বছর! এক সময়ে সটিনাথের জন্য বলা হত, ‘‘ওঁর তো পাতলা গলা। তালাত মামুদকে নকল করে।’’ আবার ‘সপ্তপদী’-তে গান গাওয়ার জন্য উৎপলাকে অনুরোধ করেছিলেন সুচিত্রা সেন নিজে। গানটা ছিল, ইতিহাস সৃষ্টিকারী ‘‘এই পথ যদি না শেষ হয়’’। গানটা গাননি উৎপলা। কারণ এক বিখ্যাত গীতিকার ভুল বুঝিয়েছিলেন উৎপলাকে, ‘‘আরে, এ গান তুমি গাইবে কেন? এ তো শুধু লা-লা-লা করে সুর।’’ গাওয়া হল না।
একবার একটি রেকর্ড কোম্পানিতে কোনও এক জন শিল্পীকে রেকর্ড করতে দেওয়া হচ্ছিল না। প্রতিবাদে সে কোম্পানিই ছেড়ে দিয়েছিলেন উৎপলা-সতীনাথ দু’জনেই। এবং তাঁরা অবাক হয়ে পরে দেখেছিলেন, যাঁর জন্য কোম্পানি ছেড়েছিলেন, তিনি সেখানে রয়ে গিয়েছিলেন বহাল তবিয়তে। আরও দুঃখজনক ঘটনা হল রেডিয়ো স্টেশনে গাইবার জন্য সতীনাথের মতো শিল্পীকে বারো বার অডিশন দিতে হয়েছিল। এগারো বার কৃতকার্য না হয়ে তিনি সোজা চলে গিয়েছিলেন স্টেশন ডিরেক্টর অশোক সেনের কাছে। এর পর স্টেশন ডিরেক্টর নিজে কারণ-অনুসন্ধান করতে আসরে নেমেছিলেন। তখন ছাড়পত্র জুটেছিল সতীনাথের।
(তথ্যসূত্র:
১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১শে মার্চ ২০১৫ সাল।
২- বর্তমান পত্রিকা, ২৩শে মার্চ ২০১৫ সাল।
৩- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত