কোভিডের কবলে পড়ার ঝুঁকি সামগ্রিক ভাবে কোন কোন পেশায় রয়েছে, তা হালকা আঁচ করা গেলেও, করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা কর্মক্ষেত্র বা পেশার নিরিখে কেমন, তেমন পেশাগত ঝুঁকির অঙ্ক সেভাবে জানা যায়নি এখনও। তবে, সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের একটি সমীক্ষায় সে সম্পর্কে আভাস দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা। অন্যদের চেয়ে চিকিৎসাকর্মীদের করোনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৮ গুণ বেশি, ইঙ্গিত মিলেছে এমনটাই।
স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সমীক্ষার ফল দেখে কলকাতার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি ও সচেতনতা যেহেতু কম এ মুলুকে, তাই আপেক্ষিক ঝুঁকির এই হার পেশা নির্বিশেষে আরও বেশি এখানে। এর প্রমাণ একের পর এক চিকিৎসাকর্মীর মৃত্যুই। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, শুধু পশ্চিমবঙ্গেই অন্তত সাত হাজার চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গিয়েছেন ৮২ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেশা নির্বিশেষে উপসর্গহীন করোনা-বাহকের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি চিকিৎসকদেরই। সে জন্যই তাঁদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার হারও সর্বাধিক। পুলিশ, পরিবহণকর্মী ও সমাজকর্মীদের মধ্যেও করোনার প্রকোপ বেশ শক্তিশালী। সম্প্রতি, কলকাতার একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হোক বা না-হোক, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে কোভিড পজিটিভ হওয়ার আশঙ্কা প্রায় একই। দু’ক্ষেত্রেই সংক্রামিত হওয়ার নজির শতকরা ১২ জনের। অন্য পেশার লোকজনের কোভিড সংক্রমণ নিয়ে অবশ্য কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না এ যাবৎ। এখন জানা যাচ্ছে, ঝুঁকির এই হার অন্যদের চেয়ে পরিবহণকর্মীদের ২.৫ গুণ, পুলিশ ও সমাজকর্মীদের ২ গুণ, সেলস ও শিক্ষাকর্মীদের ১.৪ গুণ এবং অন্য জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ১.৬ গুণ বেশি। প্রায় এক লক্ষ ২০ হাজার মানুষের উপর চালানো বিশাল সমীক্ষার রিপোর্ট বুধবার প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে (বিএমজে)। সেখানে এ ভাবেই পেশার নিরিখে ঝুঁকির অঙ্ক কষা হয়েছে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে।
বিশেষজ্ঞেরা জানান, শিথিল মনোভাবের কারণেই করোনা হামলা চালায় পেশা নির্বিশেষে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অনির্বাণ দলুইয়ের মতে, করোনা রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে সারা দুনিয়ায় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা মোটামুটি একই প্রোটোকল মেনে চলেন। কিন্তু করোনা সংক্রমণবিহীন রোগীর চিকিৎসায় প্রথম বিশ্বের দেশের সঙ্গে ভারতের মতো দেশের অনেকটাই তফাত। মূলত সেই ফারাক গলেই সংক্রামিত হন চিকিৎসাকর্মীরা। অনির্বাণ জানিয়েছেন, “করোনা সংক্রমণবিহীন অন্যান্য রোগীদের চিকিৎসায় উন্নত দেশগুলিতে ঢের আঁটোসাঁটো করোনা-সুরক্ষা মেনে চলা হয়। সেই নিরিখে আমাদের দেশে ঝুঁকিটা বিদেশের মতো ৮ শতাংশ হবে না, হবে অনেকটা বেশি।”
চিকিৎসক সংগঠন ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টর্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রাজীব পাণ্ডে কিংবা অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটার বক্তব্য, প্রথমে অভিন্ন-চিকিৎসাকর্মীদের সুরক্ষায় সরকার, প্রশাসন ও নিয়োগকর্তাদের আরও জোর দিতে হবে। এসএসকেএমের এন্ডোক্রিনোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক শুভঙ্কর চৌধুরী বলেন, “কলকাতার তিনটি হাসপাতালে সমীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, চিকিৎসকদের মধ্যে বরং অন্য চিকিৎসাকর্মীদের চেয়ে সংক্রমিত হওয়ার নজির কম। ডাক্তারদের (৭.৯%) চেয়ে নার্সদের (১১.৯%) এবং নার্সদের চেয়ে অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের (১৬.১%) আক্রান্ত হওয়ার হার অধিক।”
এ প্রসঙ্গে মাইক্রোবায়োলজি বিশেষজ্ঞ সৌগত ঘোষ জানাচ্ছেন, নির্দিষ্টি কিছু পেশার মানুষ প্রচুর মেলামেশা করতে বাধ্য হন। উপসর্গহীন করোনা-বাহকের সঙ্গে সংস্রব হচ্ছে কি না, তা আগাম বোঝার কোনো উপায় নেই। সে জন্যই চিকিৎসাকর্মীদের মতো না হলেও পুলিশ, পরিবহনকর্মী, সমাজকর্মী ও শিক্ষাকর্মীদের মধ্যেও ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি। তিনি মনে করেন, এর নেপথ্যে গা-ছাড়া মনোভাব অনেকাংশে দায়ী। সৌগতর কথায়, ‘করোনা সংক্রমণের রাস্তাগুলো না-বুঝে, না-জেনে অথবা বেপরোয়া মনোভাব বন্ধ করা যাচ্ছে না বলেই ছড়াচ্ছে রোগটা। অসতর্কতার জন্যই আরও চওড়া হচ্ছে করোনার থাবা।