তুলসী চক্রবর্তীর শেষ জীবনটা বড় কষ্টে কেটেছিল। শেষ জীবনে তুলসী অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। শরীর ভেঙে গিয়েছিল। শরীর একটু ভালো হতেই একদিন বাজারে গিয়ে নিয়ে এসেছিলেন ফুলকপি, কড়াইশুঁটি আর গলদাচিংড়ি। রাতে তাঁকে যত্ন করে রেঁধে খাইয়েছিলেন স্ত্রী। এরপরে ভোররাত থেকে তাঁর শুরু হয়েছিল বমি। ডাক্তার আসতে না আসতেই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। অভিশপ্ত সেই সাল-তারিখ ছিল ১৯৬১ সালের ১১ই ডিসেম্বর। আরও দুঃখের বিষয় যে, তাঁর ন্যূনতম শেষযাত্রাটুকুও হয়নি। তুলসী চক্রবর্তীর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রী ঊষারানি, বাকি জীবন একমুঠো অন্নের জন্য লোকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছিলেন। দারিদ্র্যের কারণে স্বামীর সবকটি মেডেল বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এইভাবে তিনি কাটিয়েছিলেন প্রায় ৩৫টি বছর। আর্টিস্ট ফোরাম তাঁকে কিছু সাহায্য করেছিল। শেষের দিকে তাঁকে সাহায্য করতেন মিঠুন চক্রবর্তী। তবে, কোনও সরকারি সাহায্য তিনি পাননি। শেষমেশ অন্নকষ্টে চলে গিয়েছিলেন তিনিও। অভাব অনটন মানুষগুলির সঙ্গে কেড়ে নিয়েছিল মেডেলগুলিও। সেই সাথে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা আস্ত ইতিহাস চলে গিয়েছিল কালের গর্ভে।
তুলসী চক্রবর্তী, সেই অর্থে কখনওই তাঁকে সুপুরুষ বলা যাবে না। সম্বল বলতে ছিল একটা নোয়াপাতি ভুঁড়ি, সাদামাঠা পিঠ ও অপূর্ব উজ্জ্বল একজোড়া চোখ। যে চোখ জুড়ে ‘পরশপাথর’ ছবির পোস্টার করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। এইটুকু নিয়েই তুলসী চক্রবর্তী দাপিয়ে বেড়িয়েছেন অভিনয়ের আঙিনায়। উদোম গায়েই মাতিয়ে দিয়েছেন নানা রঙের চরিত্রে। নায়ক-নায়িকা থাকলেও শুধু অভিনয়ের জোরেই ছবিতে আলাদা করে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতেন তিনি। মাটিতে পা দিয়ে চলেছেন চিরকাল। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে চড়ে যাতায়াত করতেন। স্টারডমের ছটা কোনওদিন গায়ে লাগতে দেননি। তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় সম্বন্ধে বলতে গিয়ে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক জায়গায় বলেছেন, ‘‘কেউ যদি দেখাতে পারেন কোনও ছবিতে খারাপ অভিনয় করেছেন তুলসী চক্রবর্তী, তাহলে আমি লাখ টাকা বাজি হেরে যাব। নাটক এবং চলচ্চিত্র দু’ক্ষেত্রেই কী সাবলীল, স্বাভাবিক অভিনয়! কখন কেমন অভিনয় করতে হবে, সে মাপটাও যে কখন বদলে ফেলতেন, কেউ ধরতেই পারত না। কোনও প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই খুব উঁচু দরের সহজাত অভিনয় ক্ষমতার মালিক ছিলেন তিনি।’’ নিজের মধ্যে যে কী পরিমাণ অভিনয়ের ক্ষমতা ছিল, তা কিছুতেই বুঝতে চাইতেন না তুলসী। তাঁর অভিনয়টাকে কখনওই অভিনয় বলে মনে হতো না। এতটাই ‘প্রপারলি বিহেভ’ করতেন তিনি। জিজ্ঞাসা করতে বলতেন, ‘‘ওরে, আমি হলাম গিয়ে হেঁশেলবাড়ির হলুদ। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সবেতেই আছি। হাসতে বললে হাসব, কাঁদতে বললে কাঁদব, নাচতে বললে নাচব, দু’কলি গান গেয়ে দিতে বললে তাও পারব। হলুদ যেমন সব ব্যঞ্জনেই লাগে তেমনই আর কী! কিন্তু হলুদের কি নিজস্ব কোনও স্বাদ আছে? তাই আমার এই অভিনয়কে আমি অভিনয় বলি না গো! হ্যাঁ, অভিনেতা ছিলেন বটে আমার গুরু অপরেশ মুখুজ্যে। উনি আমাদের মতো সব গাধাকে পিটিয়ে ঘোড়া বানিয়েছেন। অভিনেতা বললে উনি-ই। অমন আর হবে না!’’ বহু রঙ্গমঞ্চের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা-পরিচালক তথা নাট্যকার অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় যে তুলসী চক্রবর্তীকে অভিনেতা তৈরির পিছনে অবদান রেখেছিনে, এ কথা সত্য। কিন্তু অভিনেতা হওয়ার কথা প্রথম জীবনে ভাবার অবকাশ ছিল না তুলসীর। ছোটবেলাটা খুব এলোমেলোভাবে কেটেছে তাঁর। বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী চাকরি করতেন রেলে। কৃষ্ণনগরের গোয়ারি নামে এক ছোট্ট গ্রামে ১৮৯৯ সালের ৩রা মার্চ তুলসী চক্রবর্তীর জন্ম হয়। মা নিস্তারিণী দেবী ছিলেন সাধারণ গৃহবধূ। তাই ছোটবেলায় এ গ্রাম-সে গ্রাম ছুটে বেড়িয়েছেন তুলসী। চাকরির প্রয়োজনে তাঁর বাবাকে নানা জায়গায় ঘুরতে হতো। ফলে বালক তুলসীকে জোড়াসাঁকোয় জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছেই থাকতে হতো অনেক সময়। অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় পড়াশোনাটাও বেশি দূর চালাতে পারেননি তুলসী। সামান্য যা কিছু শিখেছিলেন, তাও মাঝ পথে বন্ধ করে দিতে হয়। শুরু হয় যাযাবর জীবন। অপরেশ মুখুজ্যের আগে তুলসী চক্রবর্তীর মাথায় অভিনয়ের পোকাটা নাড়িয়েছিলেন তাঁর জ্যাঠামশাই প্রসাদবাবু। পুরোপুরি অভিনয়ে মনোনিবেশ করার আগে উপার্জনের জন্য নানা কাজ করতে হয়েছে এই অভিনেতাকে। লোকের জন্য মদের চাট তৈরি করা থেকে শুরু করে সার্কাসে জন্তু-জানোয়ার স্নান করানো কী না করেছেন! কিন্তু সে সব পরে। বাবা মারা যাওয়ার পর জ্যাঠামশাইয়ের আশ্রয়েই পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন তুলসী। প্রসাদবাবুর একটা অর্কেস্ট্রা গ্রুপ ছিল। আর ছিল তাঁর অ্যামেচার ক্লাবে গান-বাজনা-যাত্রা-থিয়েটার। প্রসাদবাবু দিনরাত ওসব নিয়েই পড়ে থাকতেন। কলকাতা শহরে বড়লোকদের বাড়ির পুজোআচ্চায় তাঁর দল গান গাইতে যেত। নাটক করতেন। কলকাতার বাইরেও দলের জন্য বায়না আসত। আর এখান থেকেই প্রাথমিক অভিনয়ের ইচ্ছাটা তাঁর মনে জাগল। প্রসাদ চক্রবর্তীর অ্যামেচার ক্লাবে অভিনয়ের সুযোগ না পেলেও গান গাওয়ার সুযোগ পেতেন তুলসী। গানের গলাটা মন্দ ছিল না তাঁর। কীর্তন, কবিয়াল, শ্যামাসঙ্গীত – সব ধরনের গান গাইতে পারতেন। মাঝে মাঝে তরজার আসরেও মূল গায়কের সঙ্গী হয়ে নেমে পড়তেন। গান গাওয়ার পাশাপাশি নাচও রপ্ত করে ফেললেন। অভিনয়ের প্রাথমিক পাঠ হয়ে গেল সেখান থেকেই। গিরিশ পার্কের কাছে এক ব্যায়ামাগারে শরীরচর্চাও করতেন নিয়মিত। কিন্তু সেসব বেশিদিন চলল না। প্রসাদবাবু দারুণ হারমোনিয়াম বাজাতেন। সেই সুবাদে তিনি স্টার থিয়েটারে অর্কেস্ট্রা গ্রুপে চাকরি নিলেন। ক্লাব গেল বন্ধ হয়ে। এদিকে লেখাপড়া বিশেষ জানেন না বলে তুলসী ভালো কোনও কাজ জোটাতে পারলেন না। আবার বসে বসে জ্যাঠামশাইয়ের অন্ন ধ্বংস করতেও মনে বাঁধত। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অভিপ্রায়ে চিৎপুরে এক চাটের দোকানে চাকরি নিলেন তুলসী। সন্ধেবেলা দোকানে মাতালরা ভিড় করত। মদের সঙ্গে পাঁঠার ভুঁড়ির চচ্চড়ি, কষা মাংস চাট হিসাবে তারা খেত। মাতালদের এঁটো প্লেট ধুয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন পরবর্তীকালে বাংলা ছবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা হয়ে ওঠা তুলসী চক্রবর্তী। সেই দোকানে হঠাৎই একদিন এসে হাজির হন প্রসাদবাবু। ভাইপোর কাজের ধরন দেখে তো তিনি রেগে এক্কেবারে অগ্নিশর্মা। একটাও কথা না বলে ভাইপোর চুল ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে গেলেন। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, ‘‘ব্যাটা, সাবলম্বী হতে চাইছ? তা আর কোনও কাজ জুটল না! বামুনের ছেলে হয়ে মাতালদের এঁটো পরিষ্কার করতে লেগেছ!’’ এই বলে তুলসীর মাথায় বসালেন এক রামগাঁট্টা। এই রামগাঁট্টাই কিছুটা সম্বিত ফেরাল তুলসীর। বাকি খোঁচাটা দিল জাত্যভিমান। তুলসী নিজেই বলে গিয়েছেন, ‘‘ওই যে জ্যাঠা বললেন, বামুনের ছেলে। তাতেই অনেকটা কাজ হল। আমার আবার বামনাই ব্যাপারটা চিরদিনই একটু বেশি বেশি কিনা।’’
জ্যাঠামশাইয়ের গাট্টা খেয়েই যে তিনি অভিনয় জগতে চলে এলেন এমনটা নয়। কাজ নিলেন একটি ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে। সেখানেও বেশি দিন মন টিকল না। একদিন ভোরবেলা কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালালেন তুলসী চক্রবর্তী। একেবারে চলে গেলেন বার্মায়। তখন ব্রিটিশ রাজত্ব ভারতে। বার্মা যাওয়ার জন্য ভিসা-পাসপোর্টের কোনও ব্যাপার ছিল না। বাড়ি থেকে পালিয়ে চড়ে বসলেন একটি জাহাজে, যেটি বার্মা যাচ্ছিল। সেই জাহাজেই ছিল ‘বোসেস সার্কাস’ নামে একটি সার্কাসের দল। তুলসী বেমালুম সেই সার্কাস পার্টির সঙ্গে ভিড়ে গেলেন। পরে যখন তুলসী চক্রবর্তী পুরোপুরি অভিনয়ে চলে আসেন, তখন তিনি বাংলা ভাষার ছবির পাশাপাশি বেশ কিছু হিন্দি ও উর্দু ভাষার ছবিতেও চমৎকার অভিনয় করেছেন। সেই সব ছবিতে অভিনয়ের ভিত্তিপ্রস্তর তিনি স্থাপন করেছিলেন ওই সার্কাস দলে কাজ করতে করতে। কীভাবে? সার্কাস দলের মালিক বাঙালি হলেও ‘বোসেস সার্কাস’-এ বাঙালি কর্মচারী বেশি ছিল না। বেশিরভাগই ছিলেন আপ-কান্ট্রির লোক। ওদের সঙ্গে সারাক্ষণ ওদের ভাষাতে কথা বলতে বলতে হিন্দি আর উর্দু দুই ভাষাতেই বেশ সড়গড় হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। যা পরবর্তীকালে তাঁর নতুন পেশাতে সহায়তা করেছিল।
সার্কাসের দলেও বেশি দিন চাকরি করা হয়নি তাঁর। সিংহের খেলা দেখানো আর ট্রাপিজের কসরত ছাড়া সার্কাস দলের প্রায় সব ফাইফরমাস খাটতে হতো তাঁকে। বেশ কিছু ছোটখাট খেলাও শিখে ফেলেছিলেন। মাঝে মধ্যে শো-এর ফাঁকে ফাঁকে জোকার সাজতেন। এভাবেই তিনি হাস্যকৌতুকের দিকে ঝোঁকেন। কিন্তু একদিন এই সার্কাস দল থেকেই চম্পট দিলেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘‘যেদিন দেখলাম আমার শরীর থেকে জন্তু-জানোয়ারের গন্ধ বেরতে শুরু করেছে, সেদিনই ঠিক করলাম যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এলাম।’’ বার্মা থেকে কলকাতায় আসার পর জ্যাঠামশাই প্রসাদ চক্রবর্তী তাঁকে নিয়ে গিয়ে চিৎপুরের এক ছাপাখানায় ভর্তি করে দিলেন। কম্পোজিটরের কাজ করার জন্য মন দিয়ে টাইপের কাজ শিখতে লাগলেন তুলসী। আর এই ছাপাখানার কাজ করতে করতেই আবার তাঁর মাথায় অভিনয়ের পোকা নড়ে উঠল। সেই ছাপাখানায় থিয়েটার পাড়ার পোস্টার আর হ্যান্ডবিল ছাপা হত নিয়মিত। পোস্টারে জ্বল জ্বল করা শিল্পীদের নাম আর হ্যান্ডবিলে বিভিন্ন থিয়েটারের মনোহারী ভাষা পড়ে তুলসীর মন আনচান করে উঠত। ভাবতেন, যদি নিজে কোনওদিন অভিনেতা হতে পারেন তাহলে তাঁর নামও এভাবে পোস্টারে ছাপা হবে। এই ভাবনায় ভর করেই জ্যাঠামশাইয়ের কাছে এসে তাঁকে থিয়েটারে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন তুলসী। এমনিতেই স্টারে জ্যাঠামশাইয়ের টিফিন বাক্স পৌঁছতে যেতেন তিনি। জ্যাঠাও মনে মনে ভাবেন, এই ভালো। ভাইপো অভিনয়টা মন্দ করে না। আর ভাইপো অ্যাক্টিং করলে তাঁকে চোখে চোখে রাখতেও পারবেন তিনি। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তিনি তুলসীকে নিয়ে গেলেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। প্রসাদবাবুর অনেক অনুরোধ-উপরোধে অবশেষে অপরেশবাবু স্টার থিয়েটারে সুযোগ দিলেন তুলসীকে। সালটা ছিল ১৯১৬। অপরেশবাবুই তালিম দিলেন তাঁকে। টপ্পা গান, পাখোয়াজ বাজানো শেখালেন। ধীরে ধীরে তিনি স্টেজে অভিনয় করার সুযোগও পেলেন। ১৯২০ সালে প্রথম নাটকে অভিনয় করলেন – ‘দুর্গেশনন্দিনী’। অভিনয় জীবনের শেষটা তাঁর স্টার থিয়েটারে – ১৯৬১ সালে ‘শ্রেয়সী’ নাটকে। ওই নাটকে অভিনয় করতে করতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। আর মঞ্চে ফেরা হয়নি। তার আগে অবশ্য ৪২টি নাটকে অভিনয় করা হয়ে গিয়েছিল তাঁর। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত স্টার থিয়েটারেই ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। তারপর যোগ দেন মনমোহন থিয়েটারে। সেখানে থেকে আবার ফিরে আসেন স্টারে। নাটকে ধীরে ধীরে নাম হতে লাগল। নাটকের সূত্রেই এল ফিল্মের অফার। কিন্তু থিয়েটার থেকে ফিল্মে আসতে আসতেও লেগে গেল আরও ১২টি বছর। প্রথম ছবি ‘পুনর্জন্ম’, ১৯৩২ সাল। ছবিটির পরিচালক ছিলেন সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। তুলসী মুখ দেখিয়েছিলেন একটি ছোট্ট ভূমিকায়। তারপর থেকে একের পর এক ছবিতে অফার আসতে থাকে। ‘শচীদুলাল’ ছবিতে নিমাই সন্ন্যাসীর গুরু অদ্বৈতাচার্যের ভূমিকায় তুলসীর অভিনয় তাঁকে পরিচিতি এনে দেয়। বাঙালি দর্শক তুলসী চক্রবর্তীকে মূলত কমেডিয়ান হিসাবেই চেনেন। অথচ, প্রথমদিকের ছবিগুলিতে তিনি কিন্তু কমিক রোলে অভিনয় করতেন না। ‘মেজদিদি’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘শ্রীগৌরাঙ্গ’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘মানদণ্ড’, ‘নবীন যাত্রা’, ‘পণ্ডিত মশাই’ … বাংলার পাশাপাশি প্রায় ২৫টা হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সে সব ছবির প্রিন্ট আজ আর নেই। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘একটি রাত’ – তিনটি সিনেমায় কোথাও তিনি মেস মালিক। কোথাও আবার হোটেল মালিক বা সরাইখানা কাম ধর্মশালার মালিক। সবকটি চরিত্রেই তুলসী তাঁর স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন। কখনও তাঁর অভিনয় এক ছাঁচের হয়ে যায়নি। পথে চলতে চলতে বহু মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তুলসীর। বহু পেশার মানুষ দেখেছেন। তাই যে কোনও চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে অভিজ্ঞতার ঝাঁপি উপুড় করে দিতেন। নিজের দেখা মানুষের ছাঁচে ফেলে গড়ে তুলতেন চরিত্রটি। তাই তাঁর অভিনয় ওরকম স্বাভাবিক মনে হতো। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে কলকাতা থেকে দেশের বাড়িতে ফিরে গায়ের জামা খুলে দু’হাতে পৈতে পরিমার্জনের দৃশ্যটি যেন একদম ন্যাচারাল লাগে। এই প্রসঙ্গে পরে তুলসী চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘‘ছবির পরিচালক নির্মল দে বলেছিলেন, বাড়িতে যা যা করেন ঠিক তেমনটিই করবেন। প্রপারলি বিহেভ করাই হল গিয়ে অভিনয়ের অঙ্গ। তা আমি এমনিতেই কিছু করি বা না করি পৈতে টিকে মেজে ধপধপে করে রাখতাম। কাজের থেকেও বাড়ি ফিরেও রোজ পৈতে মাজা আমার অভ্যাস ছিল। ওটাই আমার ব্রাহ্মণত্বের পরিচয়। শ্যুটিংয়েও তেমনটিই করেছিলাম।’’ ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে ট্রাক ড্রাইভারের পাশে বসে ঢুলতে ঢুলতে চলেছেন তুলসী। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষে আর তাঁর তন্দ্রা ভাব কেটে যায়। ঘুমন্ত অবস্থায় চমকে ওঠা দেখলে দর্শককেও চমকে উঠতে হয়। এখানেও পরিচালক বিমল রায় আলাদা করে কোনও নির্দেশ দেননি তুলসীকে। হাওড়া থেকে ট্রামে-বাসে করে যেমন ঢুলতে ঢুলতে টালিগঞ্জ আসতেন তিনি, সেই অভিজ্ঞতাই ওই দৃশ্যে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি একজন গীতিকারও ছিলেন। বহু ছবির গান মুখে মুখে তৈরি করে গেয়ে দিতেন। কীর্তন আর টপ্পা অসাধারণ গাইতেন বলে বহু ছবিতে তরজা দৃশ্যে কবিয়ালের চরিত্রে তাঁকে এমন স্বাভাবিক দেখিয়েছে।
চলচ্চিত্র জগতে অনেকেই অভিনয় করতে আসেন রূপের জোরে। কেউ আসেন টাকার জোরে। কেউ আবার আসেন প্রথাগত ডিগ্রি নিয়ে। এর কোনও কিছু না থেকেও ১৯৩২ থেকে ১৯৬১ – তিন দশক ধরে আমৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রকে একের পর এক রত্ন উপহার দিয়ে গিয়েছেন তুলসী চক্রবর্তী। আটপৌরে ধুতি, গলায় পৈতে। জীবনে এক ফোঁটাও মেকআপ করে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি। কখনও তিনি ‘পথের পাঁচালি’র প্রসন্ন পণ্ডিত। কখনও ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-এর মেস-মালিক রজনীবাবু। আবার কখনও ‘একটি রাত’ ছবির সন্দেহপ্রবণ সরাইখানার মালিক গোঁসাইজি। অনবদ্য অভিনয়ে ম্লান হয়ে যায় আশপাশের তারকা, মহাতারকারা। দেখিয়ে গিয়েছেন নিজের চেষ্টা আর কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে কিংবদন্তি হওয়া যায়। অভিনয় দিয়ে দর্শকদের মনে গভীর রেখাপাত করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে বলতেই হয় অভিনয়ের প্রাথমিক পাঠটা তুলসীর জবরদস্ত হয়েছিল। স্টার থিয়েটারে অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের তালিম দেওয়ার ঘটনা নিজেই বলে গিয়েছেন তুলসী। অপরেশবাবুকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতেন তিনি। বলতেন, ‘‘স্যার বেশি জোর দিতেন বাচনিক অভিনয়ের উপর। কোন চরিত্র কী ধরনের স্বরক্ষেপণ করবে সেটা ধরে ধরে শেখাতেন।’’ এই অভিনয় শিক্ষা নিয়েই একটা মজার ঘটনা। তখন স্টার থিয়েটারে কয়েক বছর কাটিয়ে ফেলেছেন তুলসী চক্রবর্তী। একদিন রিহার্সাল চলছে। অপরেশবাবু একটা সাধারণ সংলাপ তুলসীকে একটু চেঁচিয়ে বলার নির্দেশ দেন। এই সময় একটা কাণ্ড করে বসেন তিনি। ঘরভর্তি লোকের সামনে প্রশ্ন করে বসেন, ‘‘স্যার, এটা কি অত জোরে বলার দরকার আছে?’’ অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের মুখের উপর কারও কথা বলার উপায় ছিল না। প্রশ্নটা শুনে তিনি খানিক তাকিয়ে রইলেন। তারপর তুলসীকে বললেন, ‘‘তোকে আজ আর রিহার্সাল দিতে হবে না। বাড়ি যাওয়ার আগে দেখা করে যাস আমার সঙ্গে।’’ স্যারের কথা শুনে তুলসী তো প্রমাদ গুনলেন। ধরেই নিলেন, তাঁর আজই ছুটি হয়ে গেল। অভিনয় শেখা ঘুচে গেল। রিহার্সাল শেষ হয়ে যাওয়ার পর সবাই যখন চলে গেল তখন অপরেশবাবু তুলসীকে ডেকে পাঠালেন। তুলসী যেতেই অপরেশ মুখুজ্যে হলের পিছনের সারির দিকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘ওইখানে বসে যে লোকটা থিয়েটার দেখে সে হল পাবলিক। ওরা থিয়েটারের লক্ষ্মী। টিকিট কেটে ওরা আসে। ওদের ভালো লাগা-মন্দ লাগার উপর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভাগ্য নির্ভর করে। অভিনয় ভালো লাগলে ওরা বাইরে গিয়ে মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করে। থিয়েটারের মালিকদের কাছেও ওদের মতামতই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তা তোমার ডায়লগ যদি পিছনের সারির ওই লোকটির কানে না পৌঁছয়, তাহলে কী হবে জানো?’’ স্যারের এই প্রশ্নে তুলসী চুপ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। অপরেশবাবু তখন বললেন, ‘‘তোমার প্রশ্নটা খুবই সঙ্গত এবং সঠিক। আমরা তো ব্যবহারিক জীবনে অত চেঁচিয়ে কথা বলি না। কিন্তু থিয়েটারে এটা করতেই হয়। ওই পিছনের সারি থেকে একবার যদি লাউডার প্লিজ আওয়াজ ভেসে আসে তাহলে তার পরদিনই থিয়েটার মালিক বলবে, তোমার গলায় জোর নেই। তুমি এসো বাপু।’’ তাই থিয়েটারে একটু চেঁচিয়ে সংলাপ বলতেই হবে। নাহলে অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। তাই যে কোনও অভিনেতাকে তার অভিনয়ের অংশকে দুটো ভাগে ভাগ করতে হয়। একটা অংশ নিজের জন্য। আর অন্য অংশ রাখতে হয় দর্শকের জন্য। অপরেশবাবু বুঝিয়ে বললেন, ‘‘দুটো ভাগের একটা ডায়লগ পোর্শন আর অন্যটা হল সাইলেন্ট পোর্শন। ডায়লগ পোর্শনে একেবারে নাভিস্থল থেকে আওয়াজ বের করে এনে সংলাপ বলবে। আর সাইলেন্ট পোর্শনে তুমি একেবারে ন্যাচারাল বিহেভ করবে। সেখানে বাড়াবাড়ি করলে বা পাকামি করলে দর্শক সহ্য করবেন না।’’ অপরেশবাবুর এই উপদেশ সারাজীবন মনে রেখেছেন তুলসী চক্রবর্তী। সিনেমায় অ্যাক্টিং করার সময় এই ‘ন্যাচারাল বিহেভ করার উপদেশ’ তাঁর দারুণ কাজে এসেছে। যদিও ‘অভিনয়’ যে তিনি করতে পারেন সেটা কখনও স্বীকার করতেন না। জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘‘অভিনয় আমি তেমন বুঝি না। স্ক্রিপ্টের খাতায় যা লেখা থাকে, স্টেজে দাঁড়িয়ে সেটাই গড়গড় করে আওড়ে যাই। প্রম্পটিংয়ের ধার ধারি না। কো-অ্যাক্টররা এদিক-ওদিক সংলাপ বলে বিপদে ফেললে তখন আত্মরক্ষার জন্য দু-একটা বাড়তি কথা আমাকেও বলতে হয়। নইলে নিজের ক্যারেক্টার নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার কথা মাথায় আসে না। বেশিরভাগ যা রোল করেছি সেগুলোকে ক্যারেক্টার বললে তো ক্যারেক্টারেরই অপমান করা হয় গো।’’ এমনই আমুদে মানুষ ছিলেন তিনি। সার্কাসে ছিলেন বলেই বোধহয় ভালো জাগলারি করতে পারতেন। স্টারে একসঙ্গে কাজের সুবাদে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল তুলসী চক্রবর্তীর। ভানু-পুত্র গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্যে, ‘‘বাবা বলতেন, অঙ্গভঙ্গি না করেও যে হাসানো যায় তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ চ্যাপলিন। আর আমাদের দেশে তুলসী লাহিড়ী ও তুলসী চক্রবর্তী। এতবড় অভিনেতা অথচ কত কম পয়সা পেয়েছেন। বাবার সঙ্গে আমি ছোটবেলায় স্টার থিয়েটারে যেতাম। তখন স্টারের সেকেন্ড গেটের বাইরে এক জায়গায় বসে তুলসী জেঠু আমাকে চারটে বল নিয়ে জাগলারির খেলা দেখাতেন। কত মানুষ ভিড় করে দেখত।’’ তুলসী চক্রবর্তীর জীবনের একটি ঘটনা শোনা যায় গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কাঞ্চনমূল্য’ নামে একটি ছবি প্রযোজনা করেছিলেন। ছবির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন গৌতম। ছবিতে একটি তরজা গানের দৃশ্যে ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে শ্যুটিং চলছিল। তুলসী চক্রবর্তীর কোনও কারণে কোমর ‘স্টিফ’ হয়ে গিয়েছিল। গৌতম জানিয়েছেন, ‘‘বাবা বলছিলেন, কোমরটা একটু বাঁকাও না তুলসীদা। উনি কিছুতেই পারছিলেন না। লজ্জায় ঘেমে গিয়েছিলেন। তারপর শ্যুটিং শেষ হতেই হন হন করে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। বাবা ছুটতে ছুটতে গিয়ে ধরলেন। বলেন, ‘তুলসীদা কোথায় যাচ্ছ?’ তুলসী জেঠু বলেন, ‘শ্যুটিং শেষ, তাই চলে যাচ্ছি।’ …’’ ভানু তখন ১০০ টাকার নোট পকেট থেকে বের করে তাঁর হাতে দেন। উনি তখন ভানুকে বলেন, ‘‘আমার কাছে চেঞ্জ নেই ভাই।’’ ভানু প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘‘চেঞ্জ লাগবে না। তুমি ১০০ টাকাই রাখো।’’ তখন তুলসী বলে ওঠেন, ‘‘না, আমাকে ৭৫ টাকাই দে। রেট বাড়িয়ে দিয়েছি জানতে পারলে কেউ আমাকে ডাকবে না। আমার অভিনয় ভালো লেগেছে তো?’’ ভানু তখন প্রণাম করে বলেন, ‘‘খুব ভালো হয়েছে। তুমি টাকাটা রাখো, কেউ জানবে না।’’ আনন্দে চোখ চিকচিক করে ওঠে তুলসীর। আশীর্বাদ করে বলেন, ‘‘সত্যি বলছিস তো! তোর ছবি হিট করবে রে ভানু।’’
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তীর নানা মজার ঘটনা রয়েছে। তার একটি এরকম – একদিন স্টার থিয়েটারে ‘পরিণীতা’র শো করতে যাচ্ছিলেন ভানু। যাওয়ার পথে হঠাৎ দেখেন, রাস্তায় একদল চ্যাংড়া ছেলে তুলসী চক্রবর্তীকে ঘিরে ধরেছে। ধুতির কোঁচা ধরে, জামা ধরে টানছে। মাঝে মাঝে মাথায় চাঁটিও মারছে। এসব দেখে ভানু তো রেগে কাঁই। গাড়ির দরজা খুলে নেমে সোজা এক-একজনকে দিলেন রাম ধোলাই। কিল, ঘুসি, লাথি – সবাই হাওয়া নিমেষে। সে তো হল, কিন্তু যাঁর জন্য এতকিছু সেই তুলসী ভানুকে বললেন, ‘‘আহা! অত রাগিস কেন, একটু মজা করে যদি ওরা আনন্দ পায়, পাক না। খামোকা মারলি!’’ এই হচ্ছেন তুলসী চক্রবর্তী। ভানু ওঁর কাছে পুরনো দিনের গল্প শুনতে চাইতেন। তুলসী ঘণ্টার পর ঘণ্টা কুসুমকুমারী, তারাসুন্দরী, দানিবাবুদের গল্প শোনাতেন। বাবার কাছ থেকে শোনা তুলসী চক্রবর্তীর প্রথম দিনের নাটকের একটি মজার ঘটনা স্মৃতিচারণে জানা যায় ভানু-পুত্র গৌতমের কাছ থেকে। তুলসী চক্রবর্তী যে নাটকে তবলা বাজাতেন, সেই নাটকের এক ছোট চরিত্রের অভিনেতা একদিন অনুপস্থিত। এক লাইনের একটা সংলাপ। তো তুলসী চক্রবর্তীকেই নামিয়ে দেওয়া হল। তাঁর সংলাপ ছিল, সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিকে হাতে চিঠি দিয়ে বলবেন, ‘জাঁহাপনা পত্র।’ প্রথম স্টেজে নেমে অত লোক দেখে জেঠু গেলেন ঘাবড়ে। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ‘হাজাপনা পোঁ’। বলেই বুঝলেন বড় ভুল করে ফেলেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার কোনওরকমে ডায়লগ বলে ভেতরে চলে এলেন। স্টেজের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অভিনেত্রী কুসুমকুমারী। উনি তুলসী চক্রবর্তীর কান ধরে বলেছিলেন, ‘‘ছোকরা দুটো কথাও ঠিকভাবে কইতে পারো না, অ্যাক্টিং করতে এয়েচো!’’ কীভাবে সংলাপ বলতে হয়, অথচ কীভাবে অভিনয় করতে হয় পরবর্তীকালে সকলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন তুলসী চক্রবর্তী। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবির কথা মনে করুন। সেই ছবিতে প্রধান আকর্ষণ ছিলেন কিন্তু তুলসী চক্রবর্তীই। উত্তমকুমার সেখানে কার্যত ব্রাত্য। টাইটেল কার্ডে বড় করে নাম ছিল তুলসী আর মলিনা দেবীর। তাঁদের থেকে একটু ছোট হরফে সুচিত্রা সেন। নিজের কেরিয়ারের শুরুর দিকের যে গল্প বলতে গিয়ে উত্তমকুমার লিখেছেন, ‘‘ছবির বিজ্ঞাপনে প্রথম যে কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল প্যারাডাইস চিত্রগৃহে বাংলা ছবি। দ্বিতীয় আকর্ষণ ছিল তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত একটি ছবি। নায়ক হিসেবে আমার কোনও হদিসই রইল না বিজ্ঞাপনের কোথাও। আমি নগণ্য, আমি সামান্য।’’ উত্তম-সুচিত্রার উপস্থিতিতেও সেই ছবির প্রাণ ভোমরা ছিল তুলসী-মলিনা জুটিই। উত্তম-সুচিত্রা দু’জনেই পরে স্বীকার করেছেন, ‘সাড়ে চুয়াত্তর ছবির আসল নায়ক-নায়িকা তুলসী-মলিনা।’ ছবির সমালোচনাতে সেই সময়কার একটি পত্রিকা লিখেছিল, ‘‘তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, মলিনাদেবী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সুচিত্রা সেন যেটুকু সুযোগ পেয়েছেন তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন।’’ কিন্তু ‘রামপ্রীতি’ উত্তমকুমারকে তৎকালীন সমালোচনায় গ্রাহ্যই করা হয়নি। যদিও সেই ছবি দিয়েই উত্তম-সুচিত্রা জুটির জয়যাত্রা শুরু। ছবিতে তুলসী এক মেস মালিকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, সেকথা সকলেই জানেন। প্রতি রবিবার শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বউ-বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। সেখানে তুলসী চক্রবর্তীর মুখে লা-জবাব সংলাপ। হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে মলিনাদেবীকে বলছেন, ‘‘বউ মানে কী? বউ মানে গাছতলা। মানুষ তেতেপুড়ে এসে গাছতলায় বসে। তা তুমি হচ্ছ আমার খেজুর গাছ। কাঁটা আছে, ছায়া নেই।’’ মলিনাদেবীর প্রত্যুত্তর, ‘‘তা বেশ তো। ছায়া আছে এমন গাছতলায় গিয়ে বসলেই তো পারো।’’ বাংলা ছবির দর্শক নিশ্চয়ই আর একটি দৃশ্যের কথাও চিরকাল স্মরণে রাখবেন। মলিনাদেবীর উপর রাগ করে কলকাতায় গিয়েছেন তুলসী। প্রতিবারের মতো গ্রামের বাড়িতে সপ্তাহান্তে আসেননি। এদিকে মলিনাদেবীর মন উচাটন। তাহলে কি তাঁর স্বামীটি হাতছাড়া হয়ে গেল? স্বামীকে ধরে রাখতে তিনি প্রতিবেশিনীর পরামর্শমতো মুখে রুজ-পাউডার-লিপস্টিক মেখে লুচি-মিষ্টি-মন্ডা সাজিয়ে স্বামীকে সোহাগ করছেন তুলসী গ্রামের বাড়িতে আসামাত্র। এই দৃশ্যের শুরুতে তুলসী ঘরে ঢোকার সময় লণ্ঠন স্ত্রীর মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে আগে ভালো করে দেখলেন। কী অসাধারণ শরীরী ভাষায় বিনয়, পুলক আর লজ্জার সহাবস্থান অনিন্দ্যসুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুললেন। উত্তম-সুচিত্রা জুটির সাফল্যেও অনেকাংশে অবদান আছে তুলসীর। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছাড়াও ‘একটি জীবন’ বা ‘চাওয়া পাওয়া’র মতো অজস্র ছবিতে ছোট চরিত্রেও কী অভিনয়টাই না করেছেন তিনি! নায়ক-নায়িকার জায়গায় উত্তম-সুচিত্রা-সাবিত্রী বা সুপ্রিয়া যেই থাকুন না কেন, তুলসী পর্দায় এসেছেন আর দর্শকের মনোযোগ পাননি এমনটা হয়নি। আপনার প্রিয় অভিনেতা কে, এই প্রশ্নের উত্তরে সুচিত্রা সেন একটুও না ভেবে বলতেন, ‘তুলসী চক্রবর্তী’। উত্তমকুমার অভিনীত প্রায় তিন ডজন সিনেমায় তুলসী চক্রবর্তী অভিনয় করেছেন। উত্তম বলতেন, ‘‘তুলসীদা যেভাবে অভিনয় করেন, আমি তা কোনওদিনই পারব না। ওঁর মতো জীবন্ত হয়ে ওঠা আমার দ্বারা হবে না। তুলসী চক্রবর্তীকে প্রণাম জানানোর একটাই পথ আছে আমার কাছে। যখনই কাজ পাই, পরিচালক-প্রযোজককে বলে ওঁকে ডেকে নিই। তুলসীদা থাকলে সিনটা দারুণভাবে উতরে যায়। ওঁর ঋণ তো শোধ করতে পারব না, যেটুকু পারি সাহায্য করি।’’ তুলসী ছিলেন নিঃসন্তান। তাই অভিনেতাদেরই পুত্রজ্ঞানে স্নেহ করতেন। উত্তমকুমার, তরুণকুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপকুমারদের ছেলে বলেই সম্বোধন করতেন। নিজস্ব ভঙ্গিতে খুনসুটিও চলত। ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ কৌতুকাভিনেতার ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পেয়ে তুলসী চক্রবর্তীকে প্রণাম করেছিলেন ভানু। তখন মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে ভানুকে সস্নেহে তুলসী বলে ওঠেন, ‘‘ব্যাটা বাঙাল, সেদিন এসে আমাদের হারিয়ে দিলি।’’
মলিনাদেবীই শুধু নয়, রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গেও তুলসী চক্রবর্তীর জুটি ছিল মেগাহিট। বাংলা ছবির দর্শকদের নিশ্চয়ই স্মরণে থাকবে ‘হাসি শুধু হাসি নয়’ ছবিটির কথা। নায়ক বিশ্বজিৎ আর জহর রায়। ছবিতে তুলসীর আটখানা বাড়ি ছিল। আরও চারখানা বানিয়েছেন তিনি। আট মেয়ের বিয়েতে দশ দশ করে আশি হাজার টাকা খরচ করেছেন, তবু স্ত্রী রাজলক্ষ্মীর মন পাননি। তেরো বার তুলসীর সন্তান গর্ভে ধারণ করেছেন রাজলক্ষ্মী। যদিও তুলসী বলেন তাঁর নয়টি সন্তান। রাত বিরেতে মদ গিলে মুখে গন্ধ নিয়ে রোজ বাড়ি ফেরেন। ‘ধিঙ্গি’ মেয়েদের নিয়ে হুল্লোড় করেন বলে তুলসীর রোজগার করা টাকার মুখে ঝাঁটা মারেন রাজলক্ষ্মী। তাই ৩০ বছর সংসার করার পরেও অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে উকিলের চেম্বারে ডিভোর্স করতে ছুটে আসেন তুলসী-রাজলক্ষ্মী। – ডিভোর্স চাই, ডিভোর্স চাই, ডিভোর্স চাই … ওই একটা দৃশ্যেই মাত করে দিয়েছেন দু’জনে। এই দৃশ্যটা দেখার জন্যই ছবিটা বারবার দেখা যায়। কী অভিনয়ের দাপট দু’জনের! তুলসীর সংলাপের মতোই বলতে হয়, ‘বাপরে বাপরে বাপরে বাপ …।’ ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবি ছাড়াও তুলসীর অভিনয় জীবনে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকা। ‘পথের পাঁচালি’র পণ্ডিতমশাইয়ের পাঠশালা আর মুদির দোকানের মিলমিশ। পণ্ডিত মশাইয়ের ছিল একখানা ছড়ি। সেই ছড়ি কিন্তু তিনি শুধু ছাত্র পেটাতেই কাজে লাগাতেন না। নিজের পিঠ চুলকানো, মশা-মাছি তাড়ানোর বা নিজের পিঠের ঘাম মোছা সবই চলত। ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে পণ্ডিতমশাইয়ের চরিত্রে অভিনয় দেখেই পরবর্তীকালে সত্যজিৎ ‘পরশপাথর’ ছবিতে তাঁকে মূল চরিত্রে বেছেছিলেন। সত্যজিৎ নিজে তুলসীর বাড়ি গিয়ে ‘পরশপাথর’-এ অভিনয়ের অফার দিয়েছিলেন। এত বড় পরিচালক তাঁর বাড়িতে যাওয়ায় আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন অভিনেতা। তুলসী চক্রবর্তীর চলচ্চিত্রপঞ্জিতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ থেকে ‘পরশপাথর’-এর ব্যবধানে মুখ্য চরিত্রে তাকে রেখে আর ছবি কোথায়? এ নিয়ে তাঁর মনেও কি একটা চাপা অভিমান ছিল? দুঃখ করে বলতেন, ‘‘সিনেমায় বেশকিছু ভালো কাজ পেয়েছি সেটা সত্যি, কিন্তু তার সংখ্যা হাতে গোনা। এতগুলো ছবিতে অভিনয় করলেও ক’টা মাত্র ছবিতে অভিনয় করে আনন্দ পেয়েছি সেটা আঙুল গুনেই বলা যায়। এসবের জন্য অভিমান আমার নেই। আর হবেই বা কেন? আমার কতটা কী কেরদানি দেখাবার ক্ষমতা সেটা তো আমি সবথেকে ভালো জানি। যেটুকু যা ভালোবাসা পেয়েছি, তা আমার মা-বাবা আর জ্যাঠামশাইয়ের আশীর্বাদের ফল।’’ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জহর রায় চ্যাপলিন, বাস্টার কিটন, হ্যারি ল্যাংডেন প্রমুখ হলিউডের মহান ক্লাউনদের কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাই এঁদের কিছু প্রভাব ভানু-জহরের অভিনয়-শিল্পে কোথাও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়ে কোথাও কোনও বিদেশি অভিনতোর প্রভাব লক্ষ করা যায় না। তাঁর অভিনয় নিতান্তই দেশজ। দেশের মানুষের চরিত্র লক্ষণের মধ্যেই তার শিকড় নিহিত। এমন এক অভিনেতা তুলসী যিনি বেশিদূর লেখাপড়া করেননি। পৃথিবীর সিনেমা বা থিয়েটারের এমন কিছু খবর যিনি রাখতেন না, তিনি কী করে এমন ক্ষণজন্মা শিল্পী হয়ে উঠলেন, এটা সত্যিই বিস্ময়ের। শুধুমাত্র অভিনয়-কলার কুশলতা থাকলেই তো আর অত বড় শিল্পী হওয়া যায় না! কুশলী অভিনেতা থেকে মহৎ শিল্পীতে উত্তরণের পথে সবথেকে বড় প্রয়োজন জীবনবোধের। এই জীবনবোধ কেউ শিল্পীকে শেখাতে পারে না। এ একান্তই তাঁর নিজস্ব। মানবজীবনের নানা সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই এই জীবনবোধ গড়ে ওঠে। তুলসী চক্রবর্তীর ক্ষেত্রে এই বোধ পুঁথিপত্র থেকে আহরণ করা জ্ঞান সঞ্চয়ের মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়নি। ছোট থেকেই দুঃখ-দারিদ্র্য জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। মানুষকে চিনেছেন, জেনেছেন। ঠিক একইভাবে তাঁর স্বভাবের মধ্যেও এমন একটা জিনিস ছিল, যা তাঁকে সারাজীবন সাধারণ মানুষের জীবনপ্রবাহে ডুবিয়ে রেখেছে। আচারে, ব্যবহারে তো বটেই, মনের দিক থেকেও তুলসী ছিলেন একেবারে সাধারণ ঘরোয়া মধ্যবিত্ত বাঙালি। এত সাধারণত্বের মধ্যেও একটা অসাধারণত্ব ছিল তাঁর। তা হল মানুষকে চেনার আগ্রহ ও দেখার চোখ। নটশ্রেষ্ঠ অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি বলেছিলেন, ‘‘আমি দেখি, তোমরা দেখিতে জানো না। তাই তোমাদের শিখিতে এক কষ্ট হয়। অভিনয় শিক্ষা কোনও ব্যক্তিবিশেষের নিকট হয় না – প্রকৃত অভিনয় সমাজের কাছে শিখিতে হয়। দেখিতে শিখিতে হয় – দেখিয়া বিচার করিতে হয়। … এবং উপযুক্ত অবসরে তা আরোপ করিতে চেষ্টা করিতে হয়।’’ তুলসী চক্রবর্তী যেন অর্ধেন্দু শেখরের উদ্ধৃত কথাগুলোই নিজের জীবনের সঙ্গে সমানুপাত করে নিয়েছিলেন। ওঁর নাম শুনলেই আমাদের মনে যে ছবিটা ভেসে ওঠে তার থেকে বেরিয়ে একদল অন্য ধারায় দুটি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। একটি ছবির নাম ‘জনক-নন্দিনী’। ওই ছবিতে সীতার বাবা জনক রাজার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। জনক রাজার ভূমিকায় তাঁর যে রাজকীয় আভিজাত্য প্রকাশ পেয়েছিল, তা যাঁরা সেই ছবিটি দেখেছিলেন তাঁরাই জানেন। অন্য ছবিটির নাম ‘ভাবিকাল’। পরিচালনায় নীরেন লাহিড়ী। কাহিনীকার ছিলেন সাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্র। ছবিটা সে বছর শ্রেষ্ঠ ছবির ‘বিএফজেএ’ পুরস্কার পেয়েছিল। তুলসী সেখানে একটি জটিল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। চরিত্রটি শুরুতে আদর্শবাদী ছিল। পরে ধীরে ধীরে ক্ষমতার মোহ, অর্থলালসা তাঁকে পাল্টে দিতে থাকে। পরবর্তীকালে বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলায়। একসময় আদর্শবাদী, আবার সেই কিছু পরে ক্ষমতালিপ্সু বিরোধী মতাদর্শের মানুষ। এই দ্বৈতসত্তাটি অভিনয়ের মাধ্যমে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তুলসী। এখানেও যে তিনি অসাধারণ অভিনয় করেছেন, তা কিছুতেই মানতে চাইতেন না তিনি। এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘ওই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য ভালো অভিনেতা হওয়ার দরকার হয় না। তুমি যে সমাজে বসবাস করো, একটু চোখ-কান খোলা রেখে যদি সেই সমাজের মানুষগুলোকে দেখ, তাহলেই হবে। চোখের সামনেই তো দেখলাম কত মানুষের আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেল। তাদেরই একজনের ধাঁচে চরিত্রটা করেছি। এতে আমার কোনও ক্রেডিট নেই।’’
নরম মাটি পেলে বিড়ালেও আঁচড়ায়। টলিউডের অনেক প্রযোজক, পরিচালকই এই সহজ, সরল, আমুদে মানুষটির সাদাসিদে স্বভাবের সুযোগ নিয়ে তুলসী চক্রবর্তীকে নানাভাবে হেয় করতেন। চরিত্রাভিনেতা বলে তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। মেকআপ শিল্পীরাও তাঁকে নিয়ে রঙ্গতামাশা করতেন। এসব কিছুই মুখ বুঝে সহ্য করতেন তুলসী। কোনওরকম প্রতিবাদের ধার ধারতেন না। তবে সাড়ে চুয়াত্তরের পরেও যে তুলসী চক্রবর্তী বড় চরিত্রে সুযোগ পাননি তার দায় শুধুমাত্র প্রযোজক-পরিচালকদের নয়। সাফল্য পাওয়ার পরেও ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতন হননি তিনি নিজেও। না বাড়িয়েছেন পারিশ্রমিক, না বাড়িয়েছেন স্বভাবের গাম্ভীর্য। ন্যূনতম পারিশ্রমিকের বিনিময়েই ছবিতে কাজ করতেন তিনি। অনেক সময় ভালোবাসার মানুষদের কাছ থেকে কোনওরকম পারিশ্রমিকই নিতেন না। আরও একটা ব্যাপার হল, তিনি কোনও দিন কোনও ফিল্ম কোম্পানিকে ফেরাতেন না। অফার যা আসত তাতেই রাজি হয়ে যেতেন। ফল হতে থাকল নির্মম। ভালো কাজ সরে গিয়ে বারবার তাঁকে চাকর-বাকরের চরিত্রে ভাবা হতে লাগল। তুলসী চক্রবর্তীকে ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। বোধহয় সত্যজিৎবাবুই তাঁর অভিনয় প্রতিভা সঠিক আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। পরশুরামের কলম থেকে বেরনো পরেশ দত্তকে ছবিতে অবলীলায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন তুলসী। ‘সত্যজিৎ রায়: দ্য ইনার আই: দ্য বায়োগ্রাফি অব আ মাস্টার ফিল্ম মেকার’-এর লেখক অ্যান্ড্রু রবিনসন ‘পরশ পাথর’ ছবিতে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘Chakravarti recalls Chaplin to his best. Instead of Moustache, he has a pair of eyes as bulbous as a frog’s which he opens wide with every emontion known to man.’’ চিৎপুরের ছাপাখানায় কাজ করতে করতে সেখানে হ্যান্ড বিল আর পোস্টারে নাম করা শিল্পীদের ছবি দেখেই যে অভিনয়ের প্রতি ঝোঁকটা বেড়ে গিয়েছিল তুলসী চক্রবর্তীর তা তো আগেই বলা হয়েছে। তবে বেশিরভাগই ছোটখাট পার্ট করায় সেই আশা আর তাঁর পূরণ হচ্ছিল না। আশ মিটল একেবারে শেষ বয়সে এসে ‘পরশ পাথর’ ছবিতে। বড় বড় হোর্ডিংয়ে বিরাট আকারে জ্বলজ্বল করত তাঁর মুখচ্ছবি। ‘পরশ পাথর’ ছবিতে নির্বাচিত হওয়ার পর সত্যজিতের নির্দেশে এক দর্জি তুলসীর বাড়ি গিয়েছিলেন পাঞ্জাবির মাপ নেওয়ার জন্য। তাঁর মতো অভিনেতাকেও যে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে তা কোনও দিন ভাবেননি তিনি। নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য পাঞ্জাবির মাপ নিতে দর্জি আসছেন বাড়িতে! আনন্দে আত্মহারা তুলসী বলেছিলেন, ‘‘উফঃ এ আমি কখনও ভাবতে পারিনি।’’ এই ছবির শ্যুটিংয়ের সময় সত্যজিৎ রায় তাঁকে গাড়িতে করে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। হাওড়া টু টালিগঞ্জ। কিন্তু তুলসী এই সামান্য সুবিধাটুকুও নিতে চাননি। বলেছিলেন, ‘‘না রে বাবা আমার ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসই ভালো। গাড়িতে চেপে এলে অন্য প্রযোজকরা ভেবে বসতে পারেন যে এবার তুলসী বেশি টাকা চাইবে। ওঁরা আর কাজে ডাকবেন না।’’ মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেও অনেক কম পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, তাঁর ছবির নায়ককে এত কম টাকা দিতে পারবেন না। তিনি সাম্মানিক বাড়ানোর কথা বলেছিলেন, তুলসী রাজি হননি। ছবি শেষ হওয়ার পর পরিচালক তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আপনি তো ছবির নায়ক। এত কম টাকায় রাজি হলেন কেন?’’ উত্তরে তুলসীর সেই এক কথা, ‘‘এর থেকে বেশি নিলে বাকি শিল্পীরা কী দোষ করল। আমাকে এত বেশি টাকা দেবেন না। আমি যদি এত হাজার টাকা পাই, তবে পরে আর কেউ আমাকে নেবে না। সবাই বলবে তুলসী রেট বাড়িয়ে দিয়েছে।’’ কেন যে নিজের সম্পর্কে এই মনোভাব ছিল তাঁর! অথচ বাঘাবাঘা সব অভিনেতারা তাঁর সঙ্গে এক ফ্রেমে অভিনয় করতে ভয় পেতেন রীতিমতো। দিকপাল ছবি বিশ্বাস তাঁর এই সতীর্থ সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘‘আমি কখনও কোনও ছায়াছবির সংলাপ সেভাবে মুখস্থ করি না। একটু চোখ বুলিয়ে তা পর্দায় নিজের মতো করে বলি। কিন্তু যখন তুলসীর সঙ্গে অভিনয় করতে হয়, তখন সংলাপগুলো ভালো করে মুখস্থ করে নিতে হয়। কারণ বলা যায় না, তুলসী কখন কী অভিনয়ের প্যাঁচ কষে কুপোকাত করে দেয়।’’ ছবি বিশ্বাস জানতেন সহঅভিনেতা যখন তুলসী, তখন অভিনয়টাও করতে হবে টক্কর দেওয়ার মতো।
একবার এক সিনেমার শ্যুটিংয়ে অনাহুতের মতো উপস্থিত হয়ে বৈষ্ণব সাজার অনুমতি পেয়েছিলেন তুলসী। বৈষ্ণব সেজে শ্রীখোল হাতে পরিচালকের সামনে যেতেই পরিচালক তাঁকে একেবারে সামনের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তুলসী শট দিলেন – খোল বাজাচ্ছেন, মুখে হরিনাম, চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। পরিচালক এত খুশি হলেন যে দেড় মিনিটের শট তিনি চার মিনিট নিলেন এবং সিনেমাতেও সেটা রেখে দিলেন। এমনই ছিল তাঁর অভিনয় প্রতিভা। আবার ‘পরশ পাথর’ ছবির কথায় ফেরা যাক। এই ছবিতে অভিনয়ের সময় তিনি যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন। পরিচিত এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘‘আমাকে নায়ক বানিয়ে ছবি হচ্ছে, এ তো আমি ভাবতেই পারছি না। তাও কি না সত্যজিৎ রায়ের মতো মানুষের ছবিতে! এই বারে আমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাব। জীবনে তো কখনও এত বড় মুখ হোর্ডিংয়ে দেখিনি। এর আগে যাও বা দু-চারবার হয়েছে, তা সেসব মুখ তো দূরবীন দিয়ে খুঁজে বার করতে হতো। এ আমি কী হনু হলাম রে!’’ ছবির পোস্টার ডিজাইন দেখে সত্যজিৎ রায়ের উদ্দেশে কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘মানুষটা কীরকম রসিক দেখেছ! আমার টাক ফাটিয়ে আটখানা করে তার ভেতর থেকে রস বের করেছেন। আবার লিখেছেন আহ্লাদে আটখানা। আহা!’’ পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে এই বর্ষীয়ান অভিনেতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘‘তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতার কদর এই পোড়া দেশে কেউ করবে না। তিনি যদি আমেরিকায় জন্মাতেন, নির্ঘাৎ অস্কার পেতেন।’’
চরিত্র ছোট না বড়, গুরুত্ব আছে না নেই, এসব সাতপাঁচ ভাবনাকে আমলই দিতেন না তুলসী চক্রবর্তী। মন-প্রাণ ঢেলে শুধু অভিনয় করে যেতেন। ‘শুন বরনারী’ ছবিতে সুপ্রিয়াদেবীর সঙ্গে ছিলেন মাত্র একটি দৃশ্যে। ট্রেন যাত্রার সেই একটি মাত্র দৃশ্যেই কিস্তিমাত। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ ছবিতে তবলিয়ার ভূমিকায় কালোয়াতি গানে অসাধারণ তবলা বাজিয়েছিলেন। ‘শুভদা’ ছবিতে নিজের কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন। ‘কবি’ ছবিতে দর্শক তাঁর নাচ প্রত্যক্ষ করেছেন। অভিনয় ও গান-বাজনার পাশাপাশি তুলসী চক্রবর্তী সেলাই-ফোড়াইতেও হাত পাকিয়েছিলেন। জীবনের কোনও কিছুই যায় না ফেলা! থিয়েটারে একবার অন্যের বদলে কয়েকটা দিন রাজার অভিনয় করতে হয়েছিল তাঁকে। তা অভিনয় করতে গিয়ে দেখেন রাজার নাগরা নেই। দমে যাননি তিনি। মোজার উপর সাজার রং লাগিয়ে, এঁকে, সেলাই করে তৈরি করে ফেলেন নাগরা। সেটা পরেই নেমে পড়েন মঞ্চে। এই হলেন তুলসী চক্রবর্তী। বাড়িতে নারায়ণ শিলা ছিল। এই গৃহদেবতার নিত্যপুজো করতেন তিনিই। নিজে নিয়মিত বাজার করতেন। অভিনয়ের পাশাপাশি এই একটা জিনিসেও তাঁর দারুণ ইন্টারেস্ট ছিল। তাঁর সহশিল্পীরাও এই ভালোবাসার কথা জানতেন। একদিন তুলসী চক্রবর্তী যথারীতি স্টার থিয়েটারের লবিতে আসর জমিয়ে বসেছেন। তাঁকে ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকজন। এমন সময় যেখানে হাজির হলেন বাংলা রঙ্গমঞ্চের বিখ্যাত নাট্যকার তথা নাট্য নির্দেশক দেবনারায়ণ গুপ্ত। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন – ‘‘আজ কী বাজার করলেন তুলসীদা?’’ তুলসী চক্রবর্তী বললেন, ‘‘আর বোলো না ভাই। বড্ড হয়রানি হতে হয়েছে আজ ফুল কিনতে গিয়ে। অনেক দোকান ঘুরলাম। কিন্তু কোনও ফুলের দোকানেই আজ কর্তাপাতা নেই।’’ দেবনারায়ণ গুপ্ত তো হতবাক। বিস্ময়াবিষ্ট চোখে জানতে চাইলেন, ‘‘কর্তাপাতা! সে আবার কী! এমন পাতার নাম তো কখনও শুনিনি।’’ ওদিকে তুলসীর থামার লক্ষণ নেই। এক নাগাড়ে বলেই চলেছেন, ‘‘কর্তাপাতা না হলে কি নারায়ণের পুজো হয়?’’ সকলে যখন এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, তখন তুলসী চক্রবর্তীর পাশে বসে থাকা বাংলা থিয়েটার ও সিনেমার আরও এক নমস্য অভিনেতা জহর গাঙ্গুলি রহস্য সমাধানে এগিয়ে এলেন। এই জহর গাঙ্গুলিকে অভিনেতা তৈরির পিছনে বিরাট অবদান তুলসী চক্রবর্তীর সে কথায় পরে আসছি। জহর গাঙ্গুলি বললেন, ‘‘আসলে ওঁর বউ তো তুলসী শব্দটা উচ্চারণ করতে পারে না, আমাদের কাছে সেই কথাটাই কেমন কায়দা করে জানিয়ে দিল, দেখেছেন তো।’’ জহর গাঙ্গুলির কথায় সকলে হেসে উঠল। স্বয়ং, তুলসীও তখন মিটিমিটি হাসছেন। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের স্বনামধন্য অভিনেতা, পরিচালক ও নাট্যকার অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছেই যে অভিনয়ের অ-আ-ক-খ শিখেছিলেন তুলসী, তা তো আগেই বলা হয়েছে। এই অপরেশ মুখোপাধ্যায়কে ধরেই তুলসী পথ দেখিয়েছিলেন জহর গাঙ্গুলিকে। তুলসী না থাকলে যে অপরেশচন্দ্রের কাছে পৌঁছতেই পারতেন না তিনি, তা এক বাক্যে স্বীকার করতেন জহর গাঙ্গুলিও। বন্ধুকে স্টার থিয়েটারে ঢোকানোর জন্য অপরেশবাবুর পা পর্যন্ত ধরেছিলেন তুলসী। সেকথা নিজেই বলে গিয়েছেন জহর গাঙ্গুলি। গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে তখন চোখে সরষে ফুল দেখছেন জহর গাঙ্গুলি। হালে পানি না পেয়ে কোনওক্রমে মিত্র থিয়েটারে ভিড়ের দৃশ্যে অভিনয় করার ছাড়পত্র পেয়েছেন। নতুন বলে অন্য অভিনেতারা তো বটেই চাকর-বাকরেরাও বাঁকা চোখে দেখত। সেই সময় তুলসীর সঙ্গে আলাপ জহরের। তুলসী তখন স্টারে। পাঠ শেষ করে মাঝে-মধ্যে যেতেন মিত্র থিয়েটারে। সেখানেই দু’জনের সুখ-দুঃখের কথা হতো। কলকাতা শহরে একবেলা খেয়ে কী করে দিন কাটছে জহরের, তা শুনে কষ্ট পেতেন তুলসীও। একদিন সহকর্মীদের নিষ্ঠুর ব্যবহারে গুম হয়ে বসে আছেন জহর। সেই সময় তুলসীকে দেখে চোখের জল সামলাতে পারলেন না। সেদিন তুলসী তাঁকে স্টার থিয়েটারে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। বললেন, ‘‘কাল একবার আয়। রিহার্সাল আছে, তখন স্যারের (অপরেশচন্দ্র) কাছে নিয়ে যাব। চেষ্টা করে দেখি। এখানে থাকলে তো তুই গঞ্জনা শুনতে শুনতেই মরে যাবি।’’ পরদিন বিকালে স্টারে গিয়ে জহর দেখেন যে তাঁর জন্য তুলসী চক্রবর্তী স্টার থিয়েটারের গেটের বাইরে অপেক্ষা করছেন। চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। জহর যেতেই বললেন, ‘‘এত দেরি করতে হয়। রিহার্সাল কখন শুরু হয়ে গিয়েছে। স্যারের রিহার্সালে দু’মিনিট দেরি হলেও কথা শুনতে হয়।’’ একথা বলে জহরকে একপ্রকার টানতে টানতে অপরেশ মুখুজ্যের কাছে নিয়ে গেলেন তুলসী। গালভরা একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘‘এই যে স্যার, এই ছেলেটিকে এনেছি আপনার কাছে।’’ অপরেশচন্দ্র তো আকাশ থেকে পড়লেন। ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘‘ছেলেটিকে এনেছ মানে? একে নিয়ে কী করব? জামাই করব?’’ উত্তরে তুলসী বললেন, ‘‘না স্যার! ওকে নিয়ে এলাম অভিনয় করানোর জন্য। মিত্র থিয়েটারে পড়ে পড়ে সকলের গঞ্জনা সইছিল। তা আমিই বললাম, জহর, চল স্যারের কাছে। একবার তিনি যদি তোকে পায়ে ঠাঁই দেন, তবে গোজন্ম থেকে উদ্ধার হয়ে যাবি।’’ অপরেশবাবু বিরক্তই হলেন। বললেন, ‘‘খুব যে তৈলমর্দন করতে শিখেছ! তা আমি কি তোমাকে বলেছিলাম একটা ছেলে ধরে নিয়ে আসতে! না, না, আমার নতুন নাটকে কোনও নতুন ছেলের দরকার নেই।’’ অপরেশবাবুর কথা শুনে জহর গাঙ্গুলি তো মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। তুলসী ঝপ করে অপরেশচন্দ্রর পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘‘এই আপনার পায়ে পড়ছি স্যার! ছেলেটাকে একটু চান্স দিয়ে দেখুন, ও দুঃখী ছেলে স্যার। খুব ভালো ছেলে। আপনি একটু পায়ে ঠাঁই দিলে ও চিরকাল আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকবে।’’ তুলসী চক্রবর্তীর এহেন আচরণে অপরেশ মুখোপাধ্যায় হতচকিত হয়ে গেলেন। খানিকটা বিব্রতও হলেন, বলে উঠলেন, ‘‘আহা কর কী! কর কী! পা ছাড়ো। ঠিক আছে, তুমি ওকে নিয়ে গিয়ে বসাও। রিহার্সালের পর আমি ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলব। পা ছাড়ো।’’ জহর গঙ্গোপাধ্যায় মুক্ত কণ্ঠে বলতেন, ‘‘চক্কোত্তি না থাকলে আমার হয়তো কোন দিন অভিনেতা হওয়াই হতো না।’’ অথচ ভাগ্যের কী পরিহাস! যার জন্য তুলসী চক্রবর্তী সে দিন অপরেশবাবুর পায়ে ধরেছিলেন, পরবর্তীকালে সেই ছেলেটাই হয়ে গেল বাংলা ছবির হিরো। আর তুলসী নিজে সারা জীবন হিরো বা হিরোইনের বাড়ির চাকরের চরিত্রেই অভিনয় করে গেলেন। কিন্তু এই যে জহর গাঙ্গুলি হিরো হতেন, আর তুলসী চক্রবর্তী সাজতেন তাঁর বাড়ির চাকর, এই ব্যাপারটা অন্য কারওর ক্ষেত্রে হলে হয়তো দু’জনের বন্ধুত্বের মধ্যে চিড় ধরাতে পারত। কিন্তু এই দু’জনের ক্ষেত্রে তা কোনওদিনও হয়নি। আর সেই কৃতিত্বও জহর দিয়েছেন তুলসীকেই। জহর গাঙ্গুলির কথায়, ‘‘চক্কোত্তি এমন একজন বড় মাপের মানুষ, বড় মনের মানুষ ছিল, এমনি তার হৃদয়ের উদারতা, যে ওসব ছোটখাট ব্যাপার তার কাছে পাত্তাই পেত না। যদিও আমার মধ্যে ওর সম্পর্কে একটা আড়ষ্টতা বরাবরই ছিল। দেখা হলে ওর সঙ্গে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যে ভালো করে কথা বলব, সেটাও পারতাম না। অথচ চক্কোত্তি ছিল অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। উল্টে বরং ও মাঝেমাঝেই আমাকে ঠাট্টা করে বলত, ‘কি হে সুলালবাবু (জহর গাঙ্গুলিকে এই নামে ডাকতেন সতীর্থরা), আজকাল তুমি তো বড়ই ব্যস্ত, দিনরাত কাজ করছ, ভালোই রোজগারপাতি হচ্ছে। দেখো ভাই, আমাদের মতো অভাজনদের যেন একেবারে ভুলেটুলে যেও না।’ বুঝতে পারতাম এমন রসিকতা চক্কোত্তিই করতে পারে। এইসব কথা বলতে বলতে ওর মুখ হাসিতে ভরে উঠত। বুঝতে পারতাম আমার সাফল্যটাকে ও নিজের সাফল্যই মনে করে। এমনই সিংহ হৃদয়ের মানুষ ছিল ও।’’
মধ্য হাওড়ার সংকীর্ণ গলি ২ নং কৈলাস বসু থার্ড লেন। সেখানে দু’কামরার বাড়িতে থাকতেন তুলসী চক্রবর্তী আর তার স্ত্রী ঊষারানি দেবী। দু’ধারে সারি সারি ঘর, সঙ্গে লাগোয়া রান্নার জায়গা। মাঝখান দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা। সেই পথটুকু পেরিয়েই তাঁর ঘরে পৌঁছতে হতো। সুযোগ পেলেই সেই ঘরে বসাতেন গানের আসর। একটি গান বিশেষ প্রিয় ছিল তাঁর –
‘‘শিবরাত্রির পরের দিন
শিবের হল সর্দি-কাশি,
ঘটি ঘটি জল ঢেলেছে
জেঠি, কাকি, মামি, মাসি
তাই শিবের হল সর্দি-কাশি।
আদা দিয়ে চা করে
দুগ্গা এসে সামনে ধরে
‘সিদ্দি আনলে খেও না, বাপু’
বললে শিবে মুচকি হাসি
শিবের হল সর্দি-কাশি।’’
পর্দায় তুলসী চক্রবর্তীর একটি গানের দৃশ্য দেখার স্মৃতি উঠে আসে সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায়। ছবির নামটা আর এখন মনে নেই অশীতিপর এই পাণ্ডব গোয়েন্দার স্রষ্টার। তবে, দৃশ্যটি এখনও মনে, গেঁথে আছে তাঁর। তাঁর ভাষ্যে, ‘‘সম্ভবতঃ ছবিটার নাম কাঞ্চনমূল্য। ছবিটায় তুলসী চক্রবর্তীকে বাঈজি সাজানো হয়েছিল। মেয়েদের মতো বিনুনি করা চুল, কী সুন্দর যে মানিয়েছিল। ঘাগরা দুলিয়ে চোখ টিপে টিপে যখন গাইছেন, ‘আমি কারে দেখিয়া দেব ঘোমটা/ আহা নাতজামাই আমার ন্যাংটা’ – হলসুদ্ধু লোকের সেই দৃশ্য দেখে সে কী হাসি। আমি তখন বেশ ছোট। পরবর্তীকালে যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করি, মনে আছে, তখন একদিন টিভিতে এই ছবিটা দেখাচ্ছিল। সেদিন ছবিটা দেখার জন্য অফিস পর্যন্ত কামাই করেছিলাম।’’ সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদও হাওড়ার মানুষ। জন্মেছিলেন ষষ্ঠীতলার রামকৃষ্ণপুরে। তাঁর চার-পাঁচটি বাড়ির পরেই থাকতেন তুলসী চক্রবর্তী। কিন্তু শিশু বয়সে তুলসীকে যমের মতো ভয় পেতেন তিনি। সে কথাই তিনি এখনও স্মৃতিচারণে বলেন হাসতে হাসতে – ‘‘তখন আমার দু’-তিন বছর বয়স। দিদি হয়তো কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও হঠাৎ রাস্তায় দেখা তুলসী চক্রবর্তীর সঙ্গে। পরনে ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। আমি তো দিদিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগতাম। ওই রকম চেহারা, যাকে বলে একেবারে শাঁসে-জলে। বড় বড় গোল গোল চোখ নিয়ে যখন আয় আয় বলে হাত বাড়াতেন, তখন আর আমার মধ্যে সেন্স বলে কিছু থাকত না। প্রায় অজ্ঞান হয়ে যেতাম। কোনওক্রমে বাড়ির লোকজন আমাকে নিয়ে ফিরে আসত। অথচ ওর গিন্নিরও বেশ ভালো চেহারা ছিল। উনি যখন ডাকতেন আমি কিন্তু তখন তাঁর কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরতাম। আর একটা ঘটনার কথাও খুব মনে পড়ে। তখন আমার সাত-আট বছর বয়স। তুলসী চক্রবর্তীকে তখনও আমি বেশ ভয় পাই। পারতপক্ষে ওঁদের পাড়াটা এড়িয়ে চলি। একদিন সকালে হল কি! হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড ষাঁড় আমাকে তাড়া করল। আর আমিও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঢুকে পড়লাম তুলসী চক্রবর্তীর বাড়ি। তুলসী চক্রবর্তীর ঘরটা ছিল বড়জোর ৮ ফুট বাই ৬ ফুট। সামনের দাওয়ায় চেয়ার নিয়ে বসতেন। সামনে আয়না ধরে চোখ মুখ বেঁকিয়ে অভিনয় প্র্যাকটিস করতেন। ষাঁড়ের তাড়া খেয়ে প্রাণভয়ে সেই ঘরের দরজার পিছনে গিয়ে লুকলাম। আমাকে দেখে তুলসী চক্রবর্তীর সে কী আনন্দ! গিন্নিকে চিৎকার করে বললেন, ‘দেখো কে এসেছে। যাও, ওর জন্য মিষ্টি নিয়ে এস।’ গিন্নি একটা দানাদার নিয়ে এলেন। ততক্ষণে ষাঁড়টা বিদায় নিয়েছে। একলাফে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে মনে হল যেন যমের হাত থেকে ছাড়া পেলাম। পরবর্তীকালে ভয়টা ধীরে ধীরে কেটে গিয়েছিল।’’ তুলসী চক্রবর্তী দারুণ ঢাক বাজাতে পারতেন। দুর্গাপুজোর সময় ঢাক বাজাচ্ছেন আর ধেই ধেই করে নাচছেন তিনি, এমন দৃশ্য এখনও উজ্জ্বল রয়েছে ষষ্ঠীপদর স্মৃতিতে।
শুধু বালক ষষ্ঠীপদকেই নয়, নিঃসন্তান তুলসী চক্রবর্তী ছোট ছেলেমেয়েদের খুব ভালোবাসতেন। ছোটরাও তাঁকে ‘দাদু’ বলে ডাকত। নাট্যকার দেবনারায়ণ গুপ্ত একদিন কথায় কথায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘আচ্ছা তুলসীদা, ওরা আপনার কীরকম নাতি?’’ তুলসীর উত্তর ছিল, ‘‘ভাইপো, ভাইঝি, ভাগ্নে, ভাগ্নি এদেরই ছেলেপুলে হবে বোধহয়।’’ বিস্মিত দেবনারায়ণ বললেন, ‘‘বোধহয়’’। তিনি বুঝিয়ে বললেন, ‘‘ও‘দের মা-বাপকে কোনওদিন দেখিনি। জানিও নে। ওরা দাদু বলে, আমিও নাতি পাতিয়েছি।’’ পাশেই বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা শ্যাম লাহা বসে বসে এতক্ষণ দু’জনের কথা শুনছিলেন। শ্যাম টিপ্পনি কাটলেন, ‘‘আমাকেই দেখুন না। জাত নয়, জ্ঞাত নয় অথচ আমার ওপর ওর কী টান!’’ তুলসী বাধা দিয়ে বললেন, ‘‘স্নেহ তো দূরের কথা, ওকে আমি এড়িয়ে চলতেই চাই। সব জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে ওকে নাকি আমি পুষ্যি নেব বলেছি।’’ একটু দম নিয়ে আবার বললেন, ‘‘ওকে পুষ্যি নেওয়া মানে ডাইনির কোলে পুত্র সমর্পণ করা। ওকে পুষ্যি নিয়ে বশে আনতে হলে ভীম ভবানীর মতো লোক দরকার।’’ সবাই হেসে উঠল। তুলসীর ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি বলে চললেন, ‘‘হাওড়া থেকে বাসে যাতায়াত করি। শীতে বড় কষ্ট হয়। ভাবলাম একটা ভালো কাপড়ের লং কোট তৈরি করাই। সেই কথা শুনে হুয়া (শ্যাম লাহার ডাকনাম) বলে কিনা, আমার ওপর ভার দিন, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সে কথায় কান দিইনি। কারণ আমার কোট তৈরির নামে এমন একটা জিনিস বানিয়ে আনবে যা হুয়ার গায়ের জন্য ঠিক, আমার জন্য নয়। তাই সাত-পাঁচ ভেবে অন্য ব্যবস্থা করেছি।’’ এই কথোপকথনের মাঝেই হাজির হলেন অনুপকুমার। তুলসী চক্রবর্তীর উদ্দেশে বললেন, ‘‘জ্যাঠামশাই আসুন।’’ অনুপকুমারের বাবা প্রখ্যাত গায়ক-অভিনেতা ধীরেন দাসের সঙ্গে তুলসী মঞ্চে, পর্দায় অনেকদিন কাজ করেছেন। তুলসীকে তাই অনুপ জ্যাঠামশাই বলে ডাকতেন। তাঁকে নিয়ে অনুপকুমার অন্য একটি রুমে গেলেন, গায়ে পরিয়ে দিলেন নতুন গরম কাপড়ের লং কোট। লবিতে এসে অনুপকুমারের দেওয়া কোট সকলকে দেখালেন তুলসী। বললেন, ‘‘অনুপ আমার ভাইপো, আমার বাপধন। কাপড়ের নমুনা এনে, দর্জি ডেকে সব ব্যবস্থা করে দিল। ভগবান ওর ভালো করুন। ওর বাড়বাড়ন্ত হোক। শুধু লোক দেখিয়ে জ্যাঠা বলে ডাকে না। সত্যিই ও ছেলের কাজ করেছে। অনুপ থাকতে আমার আবার ছেলের ভাবনা।’’ বলার সময় চোখ চিকচিক করে উঠেছিল তাঁর। স্টার থিয়েটারের লবিতে যখন আসর জমিয়ে বসতেন তুলসী তখন একদিন সকলে জানতে চেয়েছিলেন যে, কেন তিনি সস্ত্রীক তীর্থ ভ্রমণে বছরে একবার করে বেরিয়ে পড়েন না? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘যে থিয়েটারে একদা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ের ধুলো পড়েছিল, যে স্টারে স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, বেলুড় মঠের প্রণম্য সন্ন্যাসীরা, গিরিশ ঘোষ এসেছেন। তার থেকে বড় তীর্থ আর কিছু হতে পারে? এই স্টেজই আমার পুণ্যতীর্থ।’’ বলার সময় তাঁর ভক্তিমিশ্রিত কণ্ঠ সবাইকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল।
স্ত্রী ঊষারানিকে নিয়ে দোতলা বাড়িতে উঠে যাওয়ার আগে একটা দু’কামরার ফ্ল্যাটে থাকতেন তুলসী। ঘরে আসবাব বলতে ছিল প্রাচীন পালঙ্ক, একটি কাঠের আলমারি, গোটা কয়েক টুল আর একটা ইজিচেয়ার। দোতলা বাড়িটা যখন ৬ হাজার টাকায় কেনেন, স্ত্রী তখন তুলসীকে তাঁর জমানো বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা পেয়ে তিনি যেমন অবাক হন, তেমনই ভয়ও পান। তুলসী অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করে যা পেতেন, তাই দিয়েই সংসার চলত। স্ত্রী যে সেখান থেকেও জমাতে পারেন, ভাবতেও পারেননি। তাই বাড়ি কেনার সময় স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‘কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, বাপের বাড়ি থেকে দিয়েছে।’’ শুনে স্ত্রী হেসেছিলেন। কী-ই বা করবেন! কারণ বিধবা মা বিয়েই দিয়েছিলেন গোটা দু-তিনেক শাড়ি সম্বল করে। প্রচণ্ড অভাব সত্ত্বেও পরে সেই বাড়ি এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের দান করে দিয়েছিলেন তুলসী। স্ত্রীর ভবিষ্যতের কথা ভাবলেও নিজের মহানুভবতা স্ত্রীর জীবনে দুঃখ ডেকে আনে।
অভিনয়ের ঈশ্বর হয়েও তুলসী চক্রবর্তী ইন্ডাস্ট্রি থেকে প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। শতবর্ষ পেরিয়েও তাঁর নামে নেই কোনও পুরস্কার, শহরের কোথাও নেই কোনও মূর্তি। জন্মদিন, মৃত্যুদিনও প্রায় বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গিয়েছে। অথচ পর্দায় তাঁর উপস্থিতি এখনও দর্শকের চোখে পলক ফেলতে দেয় না। আসলে প্রচারসর্বস্ব দুনিয়ায় তুলসী ছিলেন বেমানান। চাইলেই তাঁর শিল্পসত্তার মাধ্যমে বেছে নিতে পারতেন একটা বিলাসবহুল জীবন। কিন্তু চাননি শিল্পের ব্যাপারি হতে। অভিনয় প্রতিভায় ভর করেই আজীবন দর্শক মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেছেন তিনি। বাংলা ছবি এই প্রতিভার ছোঁয়া পেয়েছে বহুবার। সেই ছোট ছোট ছোঁয়াতেই সোনা হয়ে উঠেছে কত সাদামাঠা দৃশ্য। দুঃখকে নিজস্ব মনের অনুঘটকে জারিত করে এমন অসামান্য সব কাজ সহজ ভাষায় যিনি লিখতে পারেন, তাঁর মুখেই তো মানায় ‘‘হলদে সবুজ ওরাং ওটাং …’’। টলিউডের সত্যিকারের পরশপাথর যে তিনিই।
(তথ্যসূত্র:
১- আজও তারা জ্বলে, বর্তমান পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত শ্রী সন্দীপ রায়চৌধুরী লিখিত – তুলসী চক্রবর্তী বিশেষ সংখ্যা।
২- নির্বাচিত এক্ষণ: আখ্যান ও স্মৃতিকথা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি প্রকাশন।
৩- ভানু সমগ্র, পত্রভারতী (২০১৭)।
৪- Bengali Cinema: ‘An Other Nation’ (Routledge Contemporary South Asia Series), Sharmistha Gooptu, Routledge (২০১০)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত