‘‘অবস্থা অতি কাহিল। বাজার আনতে দেওয়ার মতো নগদ পয়সা নিজের হাতে নেই।’’ ১৬ই এপ্রিল ১৯৫৬ সালে, প্রয়াণের মাত্র কয়েক মাস আগে, ডায়েরিতে লিখেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কপর্দকহীন অবস্থায়, দারিদ্র্য আর রোগভোগের সঙ্গে লড়াই করতে করতে কীভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন মানিক তা নিয়ে লেখালেখি হয়েছে বিস্তর। বাংলা সাহিত্যে সদ্য কলম ধরেছেন যে যুবা বা যুবতী— তাঁরাও এ বিষয়ে সম্যক জানেন। আমরা সকলেই জানি। কিন্তু, তবু মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, আর কোনও কবি-লেখকের যাতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পরিণতি না হয়, সেজন্য আমরা তেমন কিছু করে উঠেছি কি? এই প্রশ্নটির সামনে দাঁড়িয়ে কখনও কখনও মনে হয়, বাংলা সাহিত্যে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুবরণ বুঝি বা এক মিথ্যে, অলীক কৌলীন্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ১৯৩৭ সালে কিরণকুমার রায় সম্পাদিত ‘বঙ্গশ্রী’ (মাসিক ও সাপ্তাহিক) পত্রিকার সহকারী সম্পাদক পদে যখন মানিক যোগ দেন তখন তাঁর বেতন ছিল সাকুল্যে ৭৫ টাকা। বিএসসি পরীক্ষায় দু’বার অকৃতকার্য হওয়ার পরে যেহেতু প্রথাগত পড়াশোনাতেও ইতি টেনেছিলেন তাই তাঁর পক্ষে অন্য কোনও ধরনের কাজ করা সম্ভবও ছিল না। দু’টি বিষয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সঙ্গে তাঁর অবশ্য বেশ মিল ছিল। মদ্যপান আর আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা। শোনা যায় যে, ইসলামিয়া হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়েও তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে মদ্যপান করতেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের মৃত্যুর পর নিজের অভাব–অনটন ভুলে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘সুকান্তকে স্মরণ করে আমি ‘স্বাধীনতার’ আর্থিক সচ্ছলতা যতদিন না হবে ততদিন ‘পরিচয়ে’ লেখার জন্য যা মজুরি পাই ‘স্বাধীনতা’ তহবিলে জমা দেব।’’ অতিরিক্ত মদ্যপান কেন করেন তার একটি উত্তর মানিক, সম্ভবত, দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর একটি কবিতায়, যেখানে তিনি লিখেছিলেন,
‘‘মানুষ হয়ে মদ কেন সে খায়?
মানুষ যদি মানুষ হয়ে বাঁচার উপায় পায়
অমানুষের মরার মতো মদ সে কভু খায়!’’
কী নিদারুণ স্বীকারোক্তি! এ এক এমন স্বীকারোক্তি যা বোধহয় পাঠককে বাকরুদ্ধ করে।
জীবনের শেষের দিকে এসে মানিক আক্রান্ত হয়েছিলেন দূরারোগ্য মৃগীরোগে। শরীর আর দিচ্ছিল না। তার মধ্যেই দাঁতে দাঁত চেপে চলছিল তাঁর লড়াই – কেবলমাত্র নিজের রোগের সঙ্গে নয়, চরম দারিদ্রের সঙ্গেও। সেই রোগের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই মানিক শুরু করেছিলেন অপরিমিত মদ্যপান। এর মধ্যেই চিকিৎসক বিধান রায়ের পরামর্শে তিনি বিয়ে করেছিলেন, ছেলে–মেয়ে হয়েছিল। বাবাকে নিয়ে এসেছিলেন নিজের কাছে। বরানগরে গোপাললাল ঠাকুর স্ট্রিটে পরিবারের সকলে মিলে ঠাসাঠাসি করে কোনওমতে থাকতেন। তার মধ্যেই চলেছিল একের পর এক যুগান্তকারী রচনা সৃষ্টি করা। কিন্তু এত লেখালেখি করেও তাঁর সংসার যেন আর চলছিল না। শেষে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন একটা চাকরি নিতে। কিন্তু কিছু দিন পরেই সে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দিয়েছিলেন। আবার পুরোদমে লেখা শুরু করেছিলেন, সেই সঙ্গে আবার জড়িয়ে পড়েছিলেন নিদারুণ দারিদ্রের নাগপাশে। সে দারিদ্র যে কী ভয়ংকর তা জানা যায় মানিকের ডায়েরির একটি পৃষ্ঠা পড়লে। তাঁর স্ত্রী ডলি অর্থাৎ কমলা এক মৃত সন্তানপ্রসব করেছিলেন, আর মানিক তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন,
‘‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বলল, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেব। অনেক খরচ বাঁচবে।’’
দারিদ্র কী অপরিসীম হলে মায়ের মুখ থেকে এমন কথা বেরিয়ে আসে! সংসারের এমন অবস্থায় মানিক আবার ঠিক করেছিলেন যে চাকরি করতে হবে। তখন ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় সাপ্তাহিক বিভাগের জন্য একজন সহকারী সম্পাদক প্রয়োজন ছিল। মানিক আবেদন করেছিলেন। তিনি জানতেন ওই পদের জন্যই আবেদন করবেন আরেক সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী। তাই নিজের আবেদনপত্রের শেষে সম্পাদককে লিখেছিলেন,
‘‘আমি অবগত আছি শ্রীপরিমল গোস্বামী এই পদটির জন্য আবেদন করিবেন। আমার চেয়েও তাঁহার চাকুরির প্রয়োজন বেশি। মহাশয় যদি ইতিমধ্যে তাহার সম্পর্কে অনুকূল বিবেচনা করিয়া থাকেন, তবে অনুগ্রহপূর্বক আমার এই আবেদন প্রত্যাহার করা হইল বলিয়া ধরিয়া লইবেন।’’
চাকরি অবশ্য তাঁরই হয়েছিল। মাস মাহিনা ছিল ৭৫ টাকা। সঙ্গে শর্ত ছিল ‘অমৃতস্য পুত্রা’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে হবে। তার জন্য আরও ১০ টাকা মাসপ্রতি চুক্তি হয়েছিল। কিন্ত মানিকের ভাগ্যে চাকরি ছিল না। তাই সেই চাকরিও তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন কিছু দিন পর। অভাব তাঁকে আর তাঁর পরিবারকে শকুনের মতন ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছিল, আর মানিক তার মধ্যেই লিখে চলেছিলেন, বামপন্থী ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কখনও একাই প্রাণের মায়া ছেড়ে একাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কলকাতার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা রুখতে। ১৯৫০ সালে যখন কমিউনিস্টদের ওপর নেমে এসেছিল চূড়ান্ত সরকারি দমননীতি, তখন বহু পত্রপত্রিকায় মানিকের লেখা ছাপানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে তিনি পড়েছিলেন আরও ভয়ংকর সঙ্কটে। গোটা পরিবারের হাঁ মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর আর যেন সহ্য হত না কিছু, এক এক সময় ধিক্কার লাগত নিজের প্রতি। মদ বাড়ছিল আর সাথে বাড়ছিল মানিকের ক্ষয়। শেষে মদ ছাড়তে চেষ্টা করেও পেরে ওঠেন নি, মদের নেশা তাঁকে রাহুর মতন গ্রাস করে নিয়েছিল। নিজের দাদাকে চিঠি লিখেছিলেন, কিছু টাকা ধার চেয়ে। দাদা চিঠির উত্তরে লিখেছিলেন – ‘‘আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, আমি কাউকে টাকা ধার দিই না।’’ ভাইয়ের সঙ্গে পাবলিশিং হাউজের ব্যবসাও শুরু করেছিলেন একবার, কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে সেই ব্যবসাও মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এরপরে ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হাসপাতালে ভর্তি, লিভার নষ্ট হতে থাকা মানিক পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিল চূড়ান্ত অনটন। মনে মনে কতটা ভেঙে পড়েছিলেন মানিক তা জানতে পারা যায় একটি ছোট ঘটনায়। একদিন মানিক ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় পুজো সংখ্যার লেখা দিতে যাচ্ছিলেন। রাস্তায় তাঁর দেখা হয়েছিল অধ্যাপক বন্ধু দেবীপদ ভট্টাচার্যর সঙ্গে। মানিকের ভেঙে যাওয়া শরীর, মলিন জামাকাপড় দেখে খুব খারাপ লেগেছিল দেবীপদর। তিনি জোর করে সে দিন মানিককে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের বাড়িতে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মানিককে নিজের হাতে বেড়ে খেতে দিয়েছিলেন দেবীপদর মা। বড় তৃপ্তি করে সেই খাবারটুকু খেয়েছিলেন মানিক। তারপর যে মানিক একদিন সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন আমি শুধু সাহিত্যিকই হব, সেই মানিকই সেদিন অস্ফুটে বলে উঠেছিলেন,
‘‘দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।’’
মৃত্যুর কিছু দিন আগেই হাসপাতাল থেকে জেদ করে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন মানিক। বন্ধুবান্ধবদের দেওয়া আর্থিক সাহায্য তাঁর নিতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু বাধা দেওয়ার সামর্থ্যটুকুও তখন তাঁর ছিল। এই অবস্থার মধ্যে আবার তাঁর বাড়িওয়ালা উচ্ছেদের মামলা ঠুকেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে। দিনের পর দিন ভাড়া বাকি রাখা আর তিনি সহ্য করবেন না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন। মানিকের কয়েকজন বন্ধু মিলে মোটা টাকার বিনিময়ে আদালতে মামলার দিন পিছিয়ে দিতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু মানিকের জীবনের আদালতে রায় ঘোষণার দিন যে এগিয়ে আসছিল – সেটা কেউ শুনতে পাননি। ৩০শে নভেম্বর, মানিক আবার জ্ঞান হারিয়েছিলেন। ২রা ডিসেম্বর, তাঁকে সম্পূর্ণ অচেতন অবস্থায় আবার ভর্তি করা হয়েছিল নীলরতন হাসপাতালে। মানিকের এমন অসুস্থতার খবর পেয়ে মানিকের বাড়িতে ছুটে এসেছিলেন কবি, কমরেড সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সেদিন যখন আর একটু পরেই অ্যাম্বুল্যান্সে তোলা হবে মানিককে, সেবার আর বাড়ি ফেরানো যাবে কি না ‘পদ্মানদীর মাঝি’কে, তাই নিয়ে সকলেই সংশয়ে ছিলেন। সুভাষ অনুযোগ করেছিলেন লেখকপত্নীকে, ‘‘বৌদি এমন অবস্থা, আগে টেলিফোন করেননি কেন?’’ ম্লান হেসে কমলা উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই।’’ সেটুকুও ছিল না তাঁদের ঘরে! শেষে এসেছিল অভিশপ্ত ৩রা ডিসেম্বর। ভোর চারটে, পৃথিবীতে একটি নতুন দিন সবে শুরু হচ্ছিল তখন, বহু দিন অনন্ত লড়াইয়ের পর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল এক আটচল্লিশ বছরের জীবন। বিকেল চারটের সময় মানিকের নশ্বর দেহ নিয়ে বের হয়েছিল বিশাল শোকমিছিল। নিমতলা ঘাটের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল শববাহী গাড়ি। তাঁর সেই শেষ যাত্রার পথের ধুলোয় উড়েছিল কত স্মৃতি!
লম্বায় প্রায় ছ’ফুট। গায়ের রং উজ্জ্বল কালো। চোখে চশমা। ঠোঁটে ‘কাঁচি সিগারেট’। বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ন মিশন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করে মানিক এসেছিলেন কলকাতায়। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন অঙ্ক অনার্সে। অঙ্কে ডুবে গিয়েছিলেন, রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যাকে তাঁর মনে হয়েছিল ‘অভিনব কাব্য’। কিন্তু বেশি দিন বিজ্ঞান-প্রীতি টেকে নি তাঁর। মন গিয়েছিল সাহিত্যের অলিন্দে। শুরু করেছিলেন লেখালেখি। ফল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিএসসি-তে অকৃতকার্য হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বার পরীক্ষার সিট পড়েছিল সিটি কলেজে। প্রশ্নপত্র পেয়ে কী যেন হয়ে গিয়েছিল মানিকের। আবোল-তাবোল লিখেছিলেন। ফলে সে বারেও ফেল করেছিলেন। এতে তাঁর পরিবারের লোকজন গিয়েছিলেন রেগে। তাঁরা ভেবেছিলেন এ কী হল ছেলের! মানিক বন্দোপাধ্যায়ের দাদা সুধাংশুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তখনকার ডাকসাইটে বিজ্ঞানী। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের আবহাওয়া দফতরের কর্তারও দায়িত্বও সামলেছিলেন। তিনি ভাইয়ের এমন রেজাল্টের কারণ জানতে চেয়েছিলেন। মানিক তখন মজে ছিলেন সোভিয়েত-সহ নানা বিদেশি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনায়। দাদাকে সটান জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিজ্ঞানের বই পড়ার সময়ই এখন নেই। সঙ্গে এটাও জুড়ে দিয়েছিলেন, কী কী সাহিত্য-পাঠ করছেন, তার দীর্ঘ তালিকা। দাদা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, পরীক্ষায় পাশ করে যত খুশি গপ্পো লিখো। মানিক সে বারেও নির্ভীক উত্তর দিয়েছিলেন। দাদাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা সম্ভব নয়। এমনকী দাদাকে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, ‘‘দেখে নেবেন, লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব।’’ সঙ্গে যোগ করেছিলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমারও নাম ঘোষিত হবে।’’ – বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে এই প্রত্যয় সফলই হয়েছিল।
বৌদ্ধিক ও শারীরিক ক্ষমতা, দু’ক্ষেত্রেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সমান প্রত্যয়ী। সম্ভবত কিশোর বয়সের একটি গল্প। আখড়ায় কুস্তি লড়ে তত দিনে মারপিটে হাত পাকিয়ে ফেলেছেন মানিক। এক বার তাঁর ভাই, সুবোধবাবু দু’দিন ধরে নিখোঁজ। পরে খবর মিলল, এক মস্তান গোছের লোক নাকি তাঁকে লুকিয়ে রেখেছিল। সেই মস্তানের সঙ্গে দেখা করলেন মানিক। নির্দিষ্ট স্থান, দিনক্ষণ জানিয়ে মাঠে আসতে বললেন। টক্কর হবে। ঠিক সময়ে পাড়ার মাঠে মস্তান তাঁর দলবল-সহ হাজির। হাজির হয়েছিলেন মানিক’ও। শোনা যায়, মানিক নাকি খালি হাতে বেদম মেরে মস্তানকে সটান হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কুস্তির আখড়ায় মুগুর ভাঁজতেন। গুন্ডার দল সামলেছেন একা হাতে। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর দুরন্তপনার অন্ত নেই। এই একই মানুষ আবার জ্যোৎস্নারাতে আড়়বাঁশি বাজাতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত-অতুলপ্রসাদী গাইতেন। তাঁর সাহিত্যসাধনা, সংসারযাপন থেকে চরম দারিদ্রের সঙ্গে সহবাস, তাঁর গল্প-উপন্যাসের কাহিনীর মতোই রূঢ়, কঠিন।
তাঁর তখন বয়স মাত্র চার। হলদি নদীর পাশেই একটা খালের এক হাঁটু কাদাজলে নেমে এক হাতে লাল কাঁকড়া ধরছেন। আর অন্য হাতে ধরা কাচের বয়ামে সেই কাঁকড়া ভরে ফেলছেন। আচমকাই আঠালো এঁটেলমাটিতে পা’দুটো গেঁথে গেল। আর নড়াচড়ার উপায় নেই। চটচটে কাদামাটি ক্রমশ ভেতরে টেনে নিচ্ছে। একটা বাঁশ ধরে কোনও মতে নিজেকে টেনে তোলার চেষ্টা করলেও চোরাবালির মতো সেই মাটির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। আর বুঝি বাঁচার আশা নেই। … তারপর কী যে হল, কী করে প্রাণ বাঁচল আর স্মৃতিতে নেই। অনেক বছর পেরিয়ে মানিক বড় হয়ে বাড়ির লোককে, পরিচিতদের জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না। তাহলে কি আদৌ কিছুই ঘটেনি এমন? শুধুই কল্পনা? তা হলে বার বার কেন মনের মধ্যে অষ্পষ্টভাবে ঘুরতে থাকে ওই স্মৃতিটুকু আর অশান্ত করে তোলে তাঁকে? ঠিক করে ফেললেন আবার যেতে হবে ছোটবেলার সেই জায়গায়। গেলেন। কিন্তু তত দিনে নদীর ধারের সেই খালের পরিবেশ অনেক বদলে গেছে। পরিচয় হল খালপাড়ে দর্মার ঘরে থাকা এক বুড়োর সঙ্গে। ছেঁড়া সবুজ কোট পরা সেই বৃদ্ধ বড্ড বকবক করে। তাকে এড়িয়ে একা হলেন। সারাটা দিন ওই খালের ধারেই ভাবতে ভাবতে অন্ধকার নামল একসময়। পাড়ে রাখা একটি নৌকোয় গিয়ে বসলেন তিনি। আবার ভাবনা।ভাবতে ভাবতে একসময়ে চোখ বন্ধ হয়ে গেল ঘুমে। চোখ যখন খুললেন, দেখলেন তিনি এক হাঁটু পাঁকের মধ্যে। সেই সবুজ কোট বৃদ্ধ তাকে কাদা থেকে টেনে হিঁচড়ে ডাঙায় তুলে ‘বাবু বাবু উঠুন’ বলে গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে। সম্বিৎ ফিরল মানিকের। কিন্তু আবার পাঁকের মধ্যে গেলেন কী করে! বৃদ্ধ বলল, ‘‘আমার রাতে ঘুম আসে না। বাইরে বসে তামাক টানছিলাম। চাঁদের আলোয় দেখলাম আপনি হাঁটতে হাঁটতে ওই খালে নেমে যাচ্ছেন। প্রথমটায় বুঝতে পারিনি, তারপর দৌড়ে গিয়ে দেখি আপনি ডুবে যাচ্ছেন। ওহ্! আমি না থাকলে আজ যে কী হত!’’ এইটুকু বলে একটু দম নিয়ে সেই বৃদ্ধ যা বললেন, তা শুনে শিউরে উঠলেন মানিক। ‘‘জানেন বাবু, আজ থেকে অনেক বছর আগে, ঠিক আপনার মতো করেই একটি বাচ্চা ছেলে ওই পাঁকে ডুবে যাচ্ছিল। তাকেও এইভাবে বাঁচিয়েছিলাম। কাদের ছেলে জানি না। পরে আমাকে অনেকগুলো টাকা বখশিশ দিয়ে গেছিল ছেলেটি।’’ আর মানিকের মনে পড়ল, তাই তো! ছেলেবেলায় বাবার পকেট থেকে অনেকগুলো টাকা চুরি করে কাকে যেন দিয়ে এসেছিল, আর সেই চুরি নিয়ে বাড়িতে হুলুস্থুলও হয়েছিল খুব। কে চুরি করেছে শেষ পর্যন্ত জানা যায়নি কিন্তু অনেক দিন পর্যন্ত বাড়ির সকলে সেই চুরি নিয়ে আলোচনা করত। কিন্তু ওই পাঁকে ডুবে যাওয়ার কাণ্ডটা রহস্যজনক ভাবেই বেমালুম চেপে গেছিল সকলে। আজ সেই একই ঘটনার হুবহু পূনরাবৃত্তি! একই মানুষ আবার প্রাণ বাঁচাল তার! এমনও হয়! মনে পড়ছে, মনে পড়েছে সব! স্মৃতি ঘেঁটে ফেলে আসা অতীতকে এইভাবে খুঁজে চলার ঘটনা বারবার ঘটেছে মানিকের জীবনে।
চার ভাইবোনের পর জন্ম হল ঘুটঘুটে এক কালো ছেলের। অমন গায়ের রং দেখে আঁতুড় ঘরেই নাম দেওয়া হল ‘কালোমানিক’। বামুনের ছেলে। রীতমতো গণক ডেকে জন্মঠিকুজি তৈরি করা হল। ঠিকুজিতে নাম রাখা হল ‘অধরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়’। সেই নামে কেউ কোনও দিনও ডাকল না। এমনকী বাবা হরিহর সাধ করে ছেলের নাম রাখলেন ‘প্রবোধকুমার’। সেই নামও আড়ালেই থেকে গেল। ভালবেসে ‘কালোমানিক’ বলেই ডাকত সকলে। তারপর যা হয়, বয়স বাড়তে ‘কালোমানিক’ থেকে ‘কালো’ গেল খসে। পড়ে রইল শুধু ‘মানিক’। ওই নামেই জীবনের প্রথম গল্প ‘অতসী মামী’ ছাপা হয়েছিল।
তখন গণিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। একদিন কলেজ ক্যান্টিনে বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল তর্ক। এক বন্ধুর লেখা গল্প কোনও একটি নাম করা পত্রিকা থেকে অমমোনীত হয়ে ফেরত এসেছে। সেই বন্ধু মহা খাপ্পা হয়ে বলল, বড় পত্রিকাগুলি নামী লেখকদের লেখা ছাড়া ছাপায় না। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলেন মানিক – ‘‘এটা হতেই পারে না। তুমি ভুল বলছ। তোমার গল্প ভাল হয়নি বলেই তারা ছাপেনি। পছন্দ হলে নিশ্চয়ই ছাপত।’’ বন্ধুও পাল্টা নিলেন, ‘‘প্রমাণ করে দেখাতে পারবে?’’ মানিক বললেন – ‘‘বেশ, আমি আগামী তিন মাসের মধ্যে একটা গল্প লিখে কোনও নামী পত্রিকায় ছাপিয়ে দেখাব।’’ তিন মাস নয়, তিনদিনের মধ্যে একটা গল্প লিখে ফেললেন। গল্পকারের নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখতে গিয়েও থমকালেন। জীবনের প্রথম গল্প। সম্পাদকের পছন্দ হবেই সে বিষয়ে নিশ্চিত। কিন্তু বারো তেরো বছর বয়সের মধ্যেই বাংলার সেরা সাহিত্যগুলো যার পড়া হয়ে গেছে সেই মানিক কিন্তু বুঝেছিলেন ‘অতসী মামী’ আসলে ‘অবাস্তব রোম্যান্টিকতায় ভরা’।সেই সংকোচেই প্রবোধকুমারের বদলে লিখলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর সেই গল্প নিয়ে নিজেই সটান হাজির ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার দফতরে। সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ সেই সময় দফতরে ছিলেন না। তাঁর জায়গায় বসেছিলেন আরেক দিকপাল সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। স্মৃতিকথায় অচিন্ত্যকুমার লিখছেন, ‘‘একদিন বিচিত্রার দফতরে কালোপানা একটি লম্বা ছেলে এল। বলল গল্প এনেছি। বললাম, দিয়ে যান। সেই ছেলে লম্বা হাত বাড়িয়ে গল্পের পাণ্ডুলিপি দিয়ে বলল, এই যে রাখুন। এমন ভাব যেন এখুনি ছাপতে দিয়ে দিলে ভাল হয়। চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস চুঁইয়ে পড়ছে। গল্প জমা দিয়ে সে চলে গেল। আমি তারপর এমনিই গল্পে একবার চোখ বোলাতে গিয়ে চমকে উঠলাম। এ যে রীতিমতো দুর্দান্ত গল্প!’’ সেই গল্প প্রকাশ তো পেলই, বাংলার পাঠকমহলেও হইহই পড়ে গেল। বিচিত্রার সম্পাদক খোঁজখবর নিয়ে ছুটে এলেন মানিকের সঙ্গে দেখা করতে। লেখার সাম্মানিক কুড়িটা টাকা হাতে দিয়ে অনুরোধ করলেন, ‘‘আপনি আবার গল্প দিন আমাদের।’’ ইচ্ছে ছিল ত্রিশ বছরের আগে কোনও দিন গল্প লিখবেন না, কিন্তু কুড়ি বছর বয়েসেই বাজি রেখে গল্প লিখে এমনই বিখ্যাত হয়ে গেলেন যে সেদিন আবার গল্প লিখতে রাজি হতে হল, আর সেদিনই ঠিক হয়ে গিয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়তি।
একেবারে ছোট বয়স থেকেই সাংঘাতিক দস্যি। ফলে একের পর এক দুর্ঘটনা। হাঁটতে শিখেই বাড়ির আঁশবটিতে নিজের পেট কেটে প্রায় দুই ফালা করে ফেলেছিলেন। ডাক্তারবাবু সেলাই করলেন। সেই সেলাই নিয়েই পরদিন ওই হাসপাতালেই দাপাদাপি শুরু। দস্যিপনার সঙ্গে ছিল এক উদ্ভট স্বভাব। যতই চোট-ব্যথা লাগুক কিছুতেই কাঁদতেন না। কাঁদার বদলে বিচিত্র সুরে কালোয়াতি গান ধরতেন। ফলে বাড়ির বড়রাও কেউ বুঝতে পারতেন না, মানিক আবার কোনও বিপদ ঘটাল কি না। একবারের ঘটনা। সবার অলক্ষ্যে উনুন থেকে চিমটে দিয়ে জ্বলন্ত কয়লা তুলে খেলতে গিয়ে সেই কয়লা পড়ল পায়ের গোড়ালির পাশে। ব্যস, কালোয়াতি গান শুরু। কেউই বুঝতে পারে না আসলে কী হয়েছে। তারপর মাংস পোড়ার গন্ধ পেয়ে সকলে ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে চোখের জলে গলা বুক ভেসে যাচ্ছে মানিকের, কিন্তু গলায় গান আর পায়ে গর্ত হয়ে গেঁথে যাওয়া গনগনে কয়লার টুকরো। সেই এক ইঞ্চি পোড়া দাগ আর জীবনে ওঠেনি। আরেকবার। মানিক তখন ক্লাস সেভেন। ম্যালেরিয়ায় কাবু। স্কুল যাওয়া বন্ধ। এদিকে কালীপুজোর বাকি আর কয়েকদিন। বাড়ি বসে কী করা যায়? মাথায় বুদ্ধি এল পটকা বানালে হয়। ভাবামাত্র ছোট দুই ভাইকে নিয়ে কাজ শুরু। ন্যাকড়ার ফালিতে পাথরকুচি পেঁচিয়ে বাঁধছে মানিক। পাশে কাঁচের শিশিতে রাখা বারুদ। দাদার পিছনে বসা এক ভাইয়ের কৌতূহল হল বারুদ কেমন ভাবে জ্বলে তা দেখার। মেঝেতে কিছুটা বারুদ ঢেলে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে ছোঁওয়ানো মাত্রই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। কাঁচের শিশি ফেটে তার কুঁচি তিন ভাইয়ের গোটা শরীরে। ধোঁয়া কাটার পর দেখা গেল তিন ভাই বারান্দায় শুয়ে ছটফট করছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বারান্দা। সঙ্গে সঙ্গে তিনজনকেই নিয়ে যাওয়া হল ডাক্তারখানায়। অতিরিক্ত রক্তপাতে তিনজনই কাহিল। ছোট ভাইয়ের অবস্থা সব থেকে সঙ্গিন। সরু ফুটো করে কাঁচ শরীরে ঢুকেছে। আগে শলা ঢুকিয়ে কাঁচের অবস্থান বুঝতে হবে, তারপর মাংস কেটে মুখ বড় করে কাঁচ বার করতে হবে। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘‘মানিক তুমি তিন ভাইয়ের মধ্যে সব থেকে বড়। আর এইভাবে বাজি বানাতে গিয়ে তুমি খুব অন্যায় করেছ, তাই তোমাকে দিয়েই শুরু করব। কিন্তু একটা কথা, যতই ব্যথা লাগুক, টুঁ শব্দ করবে না। তুমি যদি চেঁচামেচি করো, তা’হলে তোমার দুই ভাই আরও ভয় পেয়ে যাবে। শুরু হল চিকিৎসা। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বুজল মানিক। ডাক্তারবাবু ক্ষতর ভেতর লোহার শলা ঢুকিয়ে নেড়েচেড়ে কাঁচ খুঁজলেন, তারপর কাঁচি দিয়ে ওই কচি হাতের চামড়া মাংস কেটে কাঁচের টুকরোগুলো একে একে বার করলেন। ততক্ষণ মানিক পুরো চুপ।শেষ ব্যান্ডেজটা বেঁধে ডাক্তার অবাক হয়ে বাবা হরিহরকে বললেন, ‘‘আশ্চর্য ছেলে তো আপনার! এত ব্যাথাতে সত্যিই একটু শব্দ করল না!’’ সেদিনের ডাক্তারবাবুর ওই কথার উত্তর দিয়েছেন মানিক অনেক পরে। স্মৃতিকথায় লিখছেন –
‘‘ডাক্তার বা আত্মীয়স্বজন বোঝেনি ব্যাপারটা। তাই তারা আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। বীরত্ব বা অসাধারণ সহ্যশক্তির কোনও পরিচয়ই আমি সেদিন দিইনি। আমি চোখ বুজেছিলাম আহত রক্তমাখা ভাইদুটির চেহারা, যন্ত্রণায় বিকৃত কাতর তাদের মুখ মনের চোখের সামনে রাখার জন্য।’’
স্বভাব তো ছোটবেলা থেকে ডাকাবুকো ছিলই, তার ওপর জোয়ান বয়সে কুস্তির আখড়ায় গিয়ে নিয়মিত শরীরচর্চা, মুগুর ভেঁজে শরীরটাও হয়ে গিয়েছিল লোহার মতো। ভয়ডর নেই। একবার গ্রামের এক গুন্ডা মানিকের ছোটভাই লালুকে জোর করে ধরে আটকে রেখেছিল। সেই খবর মানিকের কানে পৌঁছানো মাত্র গুন্ডাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ – ‘‘হিম্মৎ থাকলে মাঠে এসো। মোকাবিলা হবে।’’ গুন্ডা এল সদলবলে আর ময়দানে মানিক একা। একাই একশো। সব ক’টাকে এমন তুলোধোনা করেছিল যে কয়েক দিনের জন্য তাদের আস্তানা হয়েছিল হাসপাতালের বিছানা। কেউ কল্পনাও করতে পারেনি এমন সিংহের মতো শক্তিমান মানুষটাই আর কিছু বছর পর থেকে ক্ষয়ে ধুঁকতে শুরু করবে!
বাঁশি ছিল তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। মাঝেমাঝেই বাঁশি হাতে বেরিয়ে পড়েন একা। আদাড়েবাদাড়ে, নদীর ধারে ঘুরে বেড়ান। সঙ্গে গান আর বাঁশি। বাড়ি ফেরার হুঁশ থাকে না। ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ান কিংবা নৌকোর মাঝিদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে আড্ডা। এক-এক দিন থেকেও যান তাঁদের সঙ্গে। তখন চোদ্দ কী পনেরো বছর বয়স হবে, হঠাৎই বাড়ি থেকে নিখোঁজ। কয়েক দিন পেরিয়ে গেল মানিকের খবর নেই। বাড়ির সকলে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। মা কেঁদেকেটে অস্থির।অনেক খোঁজের পর মানিককে পাওয়া গেল টাঙ্গাইলের নদীর ধারে যে নৌকোগুলো নোঙ্গর করা রয়েছে, তাদের মাঝিমাল্লাদের সঙ্গে। দুই বেলা তাদের সঙ্গে গল্প,গান খাওয়াদাওয়া করে দিব্যি রয়েছে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার বাড়ি ফেরানো হল। সেদিন কেই বা জানত মাঝির সঙ্গে, নদীর সঙ্গে ছেলেটির এই আত্মীয়তাই একদিন জন্ম দেবে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ নামের এক উপন্যাস!
ফেলে আসা জীবনের ছবি মানিককে তাড়া করে গেছে আজীবন। সেই ছবিগুলোকে মনে মনেই জোড়া দিয়ে একটা গোটা ঘটনাকে সাজাতে চেষ্টা করতেন। সাজিয়ে তারপর বাস্তবে তা ঘটেছিল কি না যাচাইয়ের চেষ্টা। একবারের মানিক অস্থির হয়ে উঠেছেন একটি ভাবনাকে নিয়ে। সারাক্ষণ তার মনের মধ্যে আসছে শৈশবের একটি মুহূর্ত। কোনও একটি বাড়িতে গেছেন। সেই বাড়ির একটি ঘরের খাটের তলায় ঢুকে হাতে একটি নরুন দিয়ে খাটের নীচের দিকে দাগ কাটছেন।ব্যস, এইটুকুই। আর কিছু মনে নেই। কার বাড়ি, কোথায় সেই বাড়ি কিছুই মনে আসছে না। কিন্তু যেভাবেই হোক তাকে জানতেই হবে। একদিন রওনা দিলেন বাড়ি থেকে মাইল দশেক দূরে এক আত্মীয়ের বাড়ি। এত দিন পর তাঁদের কালোমানিক এসেছে। পরিবারের সকলে খুব খুশি। খাটে বসিয়ে গল্প করছেন বাড়ির কর্তা। মানিক কথা বলছেন, তাদের কথা শুনছেন ঠিকই কিন্তু শুধু মনে হচ্ছে এই ঘরটাই! কিন্তু এখন তো আর সে ছোটটি নেই যে ইচ্ছে হলেই হুট করে খাটের তলায় ঢুকে পড়া যাবে। অপেক্ষায় থাকলেন কখন একটু একা হবেন। একা হতে দিলে তো! সারাদিন ওখানেই কাটল। স্নান-খাওয়ার পর এবার বিশ্রামের জন্য ওই ঘরেই একটু একা হওয়ার সুযোগ পেলেন আর সময় নষ্ট না করে ঢুকে পড়লেন খাটের নীচে। গেরস্থালির হাঁড়ি কড়াই, আরও অনেক সরঞ্জাম ঠেলে অবশেষে খাটের তলায় ওই লম্বা শরীর নিয়ে ঢুকলেন। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করলেন খাটের নীচে নরুনের দাগ। – ‘‘ওই তো, হ্যাঁ ওই তো রয়েছে। সত্যিই রয়েছে!’’ নিজের শৈশবের করা আঁকিবুঁকিতে কয়েকবার আঙুল বুলিয়ে বেরিয়ে এলেন মানিক। গোটা শরীরে ঝুলকালি আর এক বুক আনন্দ! কিন্তু ঘরের দরজার সামনে তাকাতেই পুরো স্থির। বাড়ির সব লোক হতভম্ব হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে মানিককে দেখছেন!
পরীক্ষায় বরাবর ভাল রেজাল্ট। কিন্তু কলেজে পড়ার সময়েই জড়িয়ে পড়লেন সক্রিয় বাম রাজনীতিতে। তার সঙ্গে দিনরাত সাহিত্য চর্চা। কলেজের লেখাপড়া শিকেয়। ফলে বিএসসি-তে পরপর দু’বার ফেল। তখন পড়াশোনার যাবতীয় খরচ চালাতেন বড়দা। ভাইয়ের রাজনীতি করার খবর পেয়ে চিঠিতে লিখলেন, ‘‘তোমাকে ওখানে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়েছে, ফেল কেন করেছ, তার কৈফিয়ত দাও।’’ উত্তরে মানিক লিখলেন, গল্প উপন্যাস পড়া, লেখা এবং রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে দাদা বললেন, ‘‘তোমার সাহিত্য চর্চার জন্য খরচ পাঠানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’’ টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন দাদা। উত্তরে মানিক লিখলেন, ‘‘আপনি দেখে নেবেন, কালে কালে লেখার মাধ্যমেই আমি বাংলার লেখকদের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে স্থান করে নেব। রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্রের সমপর্যায়ে আমার নাম ঘোষিত হবে।’’ ষোলো বছর বয়েসে মাকে হারানোর পর এমনিই জীবন হয়ে উঠেছিল ছন্নছাড়া, এবার দাদা টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়ায় শুরু হল প্রকৃত দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই। চলে এলেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি মেসে। বাবা রইলেন মুঙ্গেরে ছোটভাই সুবোধের কাছে। দিনরাত এক করে নাওয়া খাওয়া ভুলে তখন মানিক শুধু লিখছেন, প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। নিজের শরীরের কথা ভুলে এই ভাবে অমানুষিক পরিশ্রমের ফলও ফলল কিছু দিন পরেই। এক সময় কুস্তি লড়া, একা হাতে দশজনের সঙ্গে মোকাবিলা করা মানিক ভেঙে যেতে থাকলেন।
১৯৩৩ সালে কলকাতায় এসেছিল এক বিখ্যাত পুতুল নাচের দল। সেই কার্নিভালের নাচ দেখে এমনই মুগ্ধ হলেন যে সেই পুতুলদের সঙ্গে মানুষের জীবনকে মিলিয়ে লিখতে শুরু করলেন ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। সেই উপন্যাস লিখতে বসে নিজের কথাই যেন ভুলে গেলেন মানিক। অনেক পরে এক চিঠিতে লিখেওছেন সেই কথা। যুগান্তর চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘অপ্রকাশিত মানিক’ বইয়ের ২৪ নম্বর চিঠিতে দেখতে পাই মানিক লিখছেন,
‘‘প্রথমদিকে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ প্রভৃতি কয়েকটা বই লিখতে মেতে গিয়ে যখন আমি নিজেও ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার একটা শরীর আছে এবং আমার পরিবারের মানুষরাও নিষ্ঠুরভাবে উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন। তখন একদিন হঠাৎ আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। একমাস থেকে দু’তিনমাস অন্তর এটা ঘটতে থাকে। তখন আমার বয়স ২৮/২৯, ৪/৫ বছরের প্রাণান্তকর সাহিত্যসাধনা হয়ে গেছে।’’
কবিতা ভবন থেকে যখন ‘এক পয়সায় একটি’ সিরিজ বেরোলো তার কবিতা সম্পাদক হলেন বুদ্ধদেব বসু, গল্পের সম্পাদক হলেন তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী প্রতিভা বসু। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তা জেনে প্রতিভাকে বললেন, ‘তবে তো আপনার সম্পাদনায় আমার গল্পই প্রথমে যাওয়া উচিত।’ তাই গেল, কিন্তু মানিকবাবুকে সম্মান দক্ষিণা দেওয়া গেল না। প্রতিভা লিখেছেন, ‘‘মোটা কাচের চশমার ফাঁকে তাঁর সেই দুই উজ্জ্বল চোখের দৃষ্টি প্রজ্বলিত করে আমাকে ভস্ম করে দিয়ে বললেন, ‘লেখা আমি স্বেচ্ছায় দিয়েছি, টাকার জন্য দিইনি।’ …’’
কলেজে পড়া কয়েকজন তরুণ মাঝেমাঝেই সাহিত্যের পাঠচক্রের আয়োজন করতেন। সেখানে কখনও আমন্ত্রণ করা হত নামীদামি লেখকদের। একবার ঠিক করা হল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ করা হবে। মানিক তখন বাংলা সাহিত্য জগতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু কে সাহস করে যাবে তাঁকে আমন্ত্রণ করতে? তিনি কি এই অল্পবয়েসি ছেলেছোকরাদের পাঠচক্রে আদৌ আসবেন? অনেক আলোচনার পর লেখককে আমন্ত্রণ জানানোর দায়িত্ব পড়ল এক তরুণের। দুরুদুরু বুকে এক সকালে রওনা দিল সে। তখন মানিক থাকেন বরানগরে। ছেলেটির মাথায় নানা চিন্তা। অত বড় সাহিত্যিকের বাড়ি কেমন হবে? কী ভাবে কথা শুরু করবে? বাস থেকে নেমে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে মানিকের বাড়ির সামনে যখন পৌছল সে, বেশ কিছুটা অবাক। নেহাতই সাধারণ ছোটখাটো একটি বাড়ি। সামনে বিশাল মাঠ। বুকে অনেকটা সাহস জড়ো করে দরজায় কড়া নাড়ল। দরজা খুললেন একজন মহিলা। ‘‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি আছেন?’’ ‘‘বাজারে গেছেন।’’ লেখক আবার বাজারও করে! বিস্মিত সেই তরুণ। ‘‘কিছু বলবেন?’’ ‘‘না, আমি এই মাঠটায় একটু ঘুরে বেড়াই। উনি ফিরলে কথা বলছি তা’হলে।’’ দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় আধঘণ্টা মাঠে চক্কর দেওয়ার পর সে দেখল, একজন লম্বা কালোপানা মানুষ লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে, দুই হাতে দুই থলে নিয়ে ওই বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ইনিই মানিকবাবু নাকি? গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল সে-ও। মানিক তাঁকে আড়চোখে দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনি কি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন?’’ ‘‘হ্যাঁ।’’ ‘‘আসুন ভেতরে। আমি বাজারটা রেখে দিয়ে আসছি,’’ বলে মানিক চলে গেলেন ভেতরের ঘরে। সামনের যে ঘরের চৌকিতে ছেলেটি বসল, চারদিকে তাকিয়ে দেখল ঘরে ওই চৌকি ছাড়া আছে একটা নড়বড়ে টেবিল। ব্যস, আর কিছুই নেই!। এমনকী টেবিলের ওপরেও কোনও বইখাতা রাখা নেই। মানিক ভেতরের ঘর থেকে ফিরে এসে বললেন, ‘‘বলুন কী চান? গল্প? পত্রিকা করেন বুঝি’’? কী ভাবে কথা শুরু করবে বুঝে পাচ্ছিলেন না সেই যুবক। মানিক তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘কী ভাবছেন? ভাবছেন যে একজন লেখকের ঘর এমন ফাঁকা কেন? আপনারা পাঠকেরা কিছু দেন না সেইজন্য ফাঁকা। ভাবছেন যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে হাতে বাজার করেন কেন?’’ ছেলেটি হতবাক। ঠিক এই কথাগুলোই তো ভাবছিল। মানিক জানলেন কী করে! মানিকই উত্তর দিলেন, ‘‘না করে আর উপায় কী বলুন। লিখবার সময় পেতে হলে এসবের জন্য যে কোনও ঝি-চাকর রাখব, সে-রকম টাকা কে দেবে আমাকে? দেন কি আপনারা? পড়েন কি কেউ আমার লেখা? আপনি যে এসেছেন এখানে? আমার কোনও লেখা কি পড়েছেন?’’ অমন কথা শুনে মনে মনে বেজায় অপমানিত হল যুবক। কী বলছেন উনি? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়িনি! মুখে বলল, ‘‘পড়েছি অনেক।’’ ‘‘তাতে কী সুবিধে হল? কোনও বই কিনেছেন?’’ চাঁচাছোলা গলায় ফের প্রশ্ন করলেন মানিক। ‘‘না, কিনে পড়িনি, সবই এর ওর কাছ থেকে চেয়ে কিংবা লাইব্রেরি থেকে। কলেজ ছাত্রদের অত বই কেনার টাকা কোথায়’’? ‘‘তবে! পাঠকেরা কেউ বই কিনবেন না, প্রকাশক বলবেন বই বিক্রি হয় না, টাকাটা আসবে কোথা থেকে? লেখকের ঘরটাও তাই এমনই থাকবে। দুঃখ পেলে চলবে কেন?’’ মানিকের কথায় মাথা নিচু করল সেই তরুণ ছেলেটি। ঠিক তখনই মানিক দরাজ গলায় বলে উঠলেন, ‘‘বলুন এবার কী জন্য এসেছেন? গল্প চাই একটা’’? এ বার নিজের নাম পরিচয় দিয়ে পাঠচক্রের কথা জানাল সে। মনে মনে প্রস্তুতই হয়ে গিয়েছিল যে এই আমন্ত্রণে মানিক সাড়া দেবেন না। কিন্তু তাঁকে একেবারে চমকে দিয়ে মানিক বললেন, ‘‘ঠিক আছে যাব। কোথায় কবে কখন সব লিখে দিয়ে যান চিরকুটে।’’ এ বার আনন্দে উচ্ছ্বসিত তরুণ বলল, ‘‘আমরা এসে নিয়ে যাব আপনাকে।’’ কিন্তু অবাক হওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল তাঁর। মানিক বললেন, ‘‘কিচ্ছু দরকার নেই। আপনারা পয়সা পাবেন কোথায়? যেতে পারব একাই। পথনির্দেশটা শুধু রেখে যান।’’ তারপর আরও দু-চারকথা সেরে লেখকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল সেই কলেজ পড়ুয়া যুবক। ফেরার সময় বাসভাড়াটুকু পকেটে থাকলেও সেদিন আর বাসে চাপতে ইচ্ছে হয়নি তাঁর। শরীর আনন্দে যেন পালকের মতো হালকা হয়ে গিয়েছিল। ওই বরানগর থেকে হাঁটতে হাঁটতেই কলেজস্ট্রিট, সেখান থেকে বউবাজারে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে তারপর কলেজ। বন্ধুদের হইহই করে জানিয়েছিল সেই বিজয়বার্তা। সেদিনের সেই ঊনিশ বছরের তরুণের নাম শঙ্খ ঘোষ।
১৯৫৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর, চিতার সর্বগ্রাসী আগুনে যখন মানিক বন্দোপাধ্যায়ের নশ্বর দেহটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল, তখন সাথে ছাই হয়ে যাচ্ছিল তাঁর লড়াই, অভাব আর যন্ত্রনাও। সেই সর্বগ্রাসী আগুন তাঁকে মুক্তি দিয়েছিল সবকিছু থেকে। মানিকের শেষ দুই দিনের সবসময়ের সঙ্গী দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, ‘‘পালঙ্ক শুদ্ধু ধরাধরি করে যখন ট্রাকে তোলা হয় তখন একটা চোখ খোলা, একটা বন্ধ। শরীরের ওপর রক্তপতাকা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার ওপরে ফুল। মুখটুকু বাদে সমস্ত শরীরটা ফুলে আর ফুলে ছেয়ে গেছে। উপচে পড়ছে দুপাশে …। মাথা এবং পায়ের কাছে দেশনেতা এবং সাহিত্যিক! সামনে পিছনে, দুইপাশে বহু মানুষ। সর্বস্তরের মানুষ। মোড়ে মোড়ে ভিড়। সিটি কলেজের সামনে মাথার অরণ্য। কিন্তু কাল কেউ ছিল না, কিছু ছিল না … জীবনে এত ফুলও তিনি পাননি।’’ আর তাঁর বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন – ‘‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও আমার লাগছে। মালা জমে জমে পাহাড় হয় ফুল জমতে জমতে পাথর। পাথরটা সরিয়ে নাও আমার লাগছে।’’ সেই ফুলের ভারে সেদিন সত্যিই দামি পালঙ্কের একটি পায়ায় চিড় ধরে গিয়েছিল। অকালমৃত্যু মানিককে মুক্তি দিলেও প্রশ্নটা কিন্তু আমাদের সকলের জন্য আজও রয়ে গেছে – আর কোনও কবি-লেখকের যাতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পরিণতি না হয়, সেজন্য আমরা তেমন কিছু করে উঠেছি কি? এর উত্তর কি কোনদিন পাওয়া যাবে?
(তথ্যসূত্র:
১- ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্ষেত্র গুপ্ত, বিশ্বসাহিত্য ভবন (২০১১)।
২- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অঞ্জন আচার্য, কথাপ্রকাশ (২০১৫)।
৩- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শতবার্ষিক স্মরণ, ভীষ্মদেব চৌধুরী, অবসর প্রকাশনা সংস্থা (২০০৮)।
৪- জীবনের জলছবি, প্রতিভা বসু, আনন্দ পাবলিশার্স (১৯৯৩)।
৫- জীবনের জলছবি, শঙ্খ ঘোষ।
৬- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. ভূঁইয়া ইকবাল, মাওলা ব্রাদার্স।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত