নিজের জীবদ্দশায় কম সন্মান পাননি নন্দলাল বসু। শ্রদ্ধেয় এই শিল্পীকে ভারত সরকার ১৯৫৪ সালে পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করেন। প্রায় সাত হাজারেরও বেশী চিত্র-প্রণেতা নন্দলাল দেশের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর অনুরোধে পদ্মশ্রী পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণের জন্য মানপত্রের নকশা ও সচিত্রকরণ করেন। অশ্বত্থপাতার ন্যায় ভারতরত্নের নকশা তাঁরই সৃষ্টি। ভারতীয় সংবিধানের পাণ্ডুলিপি অলঙ্করণের মূল কৃতিত্বও তাঁর।
অথচ, তাঁর শিল্পী হয়ে ওঠার জীবনের একেবারে গোড়াতেই হোঁচট খেয়েছিলেন তিনি। বাংলা তথা ভারতের অঙ্কনশিল্প জগতের আরেক কিংবদন্তী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফিরিয়েই দিয়েছিলেন তাঁকে। অবশ্য তাতে হার মানেন নি নন্দলাল। এর জন্যই পরবর্তীকালে ভারত পেয়েছিল তার শ্ৰেষ্ঠ চিত্রশিল্পীদের মধ্যে একজনকে। কেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন নন্দলাল, সেটা জানতে আমাদের চলে যেতে হবে অনেকটা পিছনে।
১৯০৬ সালের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। ‘‘না হে, তোমার দ্বারা আঁকাজোকা হবে না! তুমি বরং …’’ – ধমক খেয়ে কালোপানা ছেলেটির চারপাশে যেন আঁধার নেমে এল। মুখ নিচু। মাটির দিকে চোখ। ছবির কিছুই হয়নি! ছেলেটি আকাশপাতাল ভাবছে। ভেবেই চলেছে। সব ভুল? রঙের মেদুরতা-রেখার বাঁক, উত্তর কলকাতার এ দোকান- সে দোকান ঘুরে ঘুরে সচিত্র দেশি-বিদেশি পত্রিকার পাতায় রাফায়েল, বিলাসী রেমব্রান্টের মতো ধ্রুপদী চিত্রকরদের ছবি দেখা… সব, সব বৃথা? হবে না! কলকাতা শিল্প বিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে হেভেল সাহেব, অবনঠাকুরের পায়ের কাছে বসে নেওয়া হবে না শিল্পের দীক্ষা? ‘‘কাল বরং একটি সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি এঁকে এনো।’’ শিল্পের পাঠ নিতে আসা লাজুক, স্বল্পবাক ছেলেটিকে ফিরিয়ে দিলেন ঠাকুরবাড়ির অবনঠাকুর!
এই ছেলেটিরই নাম নন্দলাল! কী এমন এঁকেছিলেন নন্দলাল, যা দেখে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ? পাতা উল্টে দেখে নেব স্মৃতির সে ছবি ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ থেকে। কথক স্বয়ং অবনঠাকুর।
‘‘সত্যেন বটব্যাল বলে এনগ্রেভিং ক্লাসের এক ছাত্র, একটি ছেলেকে নিয়ে এসে হাজির, বললে, ‘একে আপনার নিতে হবে।’ তখন মাস্টার কিনা, গম্ভীর ভাবে মুখ তুলে তাকালুম।… আমি বললুম, ‘দেখি তোমার হাতের কাজ।’ একটি ছবি দেখালে— একটি মেয়ে, পাশে হরিণ, লতাপাতা গাছগাছড়া, শকুন্তলা এঁকেছিল। এই আজকালকার ছেলেদের মতোন একটু জ্যাঠামি ছিল তাতে।’’
অবনঠাকুরের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরতি পথে শিল্প-বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়েও নন্দলাল চুপটি করে ভেবেছে। কেবলই তাঁর মনে পড়ে গিয়েছে, ‘প্রবাসী’-র পাতায় রবি বর্মা, অন্নদা বাগচিদের ছবির সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের ছাপা ‘বুদ্ধ ও সুজাতা’, ‘নল-দময়ন্তী’, ‘শাহজাহাঁ’, ‘বজ্রমুকুট’ ছবির কথা। সেই সব দেখেই তো অবনঠাকুরের কাছে শিল্পের পাঠ নেওয়ার কথা ভেবে ছিল সে। কিন্তু …!
পরদিন গণেশ এঁকে নিয়েই এসেছিলেন নন্দলাল। তাঁর ‘সিদ্ধিদাতা’ দেখে খুব কৌতুক হয়েছিল অভিজাত ঠাকুর পরিবারের মেজাজি শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের। চশমার ফাঁক দিয়ে ছবির দিকে অপলক চেয়েছিলেন বহুক্ষণ। স্মৃতির অতল থেকে তিনি লিখেওছিলেন পরে, ‘‘একটি কাঠিতে ন্যাকড়া জড়ানো, সেই ন্যাকড়ার উপরে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি। বেশ এঁকেছিল প্রভাতভানুর বর্ণনা দিয়ে। বললুম, ‘সাবাস’!’’
এটা গত শতকের একেবারে গোড়ার কথা (১৯০৬)। প্রতিবেশী যুবকের হাত ধরে কলকাতার সরকারি শিল্পবিদ্যালয়ে হাজির বছর বাইশের এক যুবক। মনে প্রবল ইচ্ছা ভর্তি হওয়ার। যদিও এর আগে শহর কলকাতার তিন-তিনটে কলেজ তার ঘোরা হয়ে গিয়েছে। কোথাও সুবিধা করতে পারেননি। জেনারেল এসেমব্লিজ ইন্সটিটিউশনে প্রথমে অকৃতকার্য হয়ে মেট্রোপলিটনের গুড়ি ছুঁয়ে শেষে প্রেসিডেন্সিতে। সেখানেও গতানুগতিক বাণিজ্যিক বিষয়ের পঠন পাঠনে যে সফল হবেন না, তা বুঝে উঠতে তাঁর বেশী সময় লাগেনি। অবশেষে সরকারি আর্ট স্কুল। কেননা ইতিমধ্যে সেখানকার এনগ্রেভিংয়ের ছাত্র সত্যেন বটব্যালের মুখে এ কলেজ সম্পর্কে তার অনেক গল্প শোনা হয়ে গিয়েছে।
সম্পর্কে আত্মীয় এক দাদাও সেখানকার ছাত্র। তা ছাড়া প্রেসিডেন্সিতে থাকার সময় ছবি আঁকার কাজে খানিকটা হাতও পাকিয়েছে। চিত্রকলায় তার গভীর আগ্রহ। আর্ট স্কুলে তখন সবে শুরু হয়েছে দেশীয় শিল্পচর্চার কর্মযজ্ঞ। যার পুরোভাগে ঋত্বিকের ভূমিকা নিয়েছেন ঠাকুরবাড়ির প্রখ্যাত শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর শিল্পকর্মের সোনালী ফসল প্রবাসী পত্রিকা মারফত দেশের ঘরে ঘরে ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে। সে সব দেখে ভালোলাগার এক আবেশ জমাট বেঁধেছে আমদের এ যুবকের মনে। অবনীন্দ্রনাথের ‘বুদ্ধ ও সুজাতা’ ‘বজ্রমুকুট’ দেখে মুগ্ধ সে। প্রতিবেশী সত্যেন বটব্যাল ছেলেটিকে এক দিন অবনীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, স্যার একে আপনার নিতে হবে। তিনি তখন সেখানকার ভাইস-প্রিন্সিপাল। মুখ তুলে তাকালেন অবনীন্দ্রনাথ। দেখলেন শ্যামবর্ণ একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্কুল পালিয়ে আসা হয়েছে বুঝি? পড়াশুনায় মন নেই, তাই মশকো করতে এসেছো। লেখা পড়া শিখেছ কিছু?’ উত্তর এল –‘আজ্ঞে স্কুল নয় ,কলেজ। তবে ফেল করেছি’। মানতে চাইলেন না মাস্টারমশাই। ‘‘উঁহু বিশ্বাস হচ্ছে না। সার্টিফিকেট দেখতে চাই।’ পরে বললেন, ‘দেখি তোমার হাতের কাজ।’ ছেলেটি একটি ছবি বার করলো, লতাপাতা গাছগাছালির মাঝে একটি মেয়ে, পাশে হরিণ, শকুন্তলার ছবি। অবনীন্দ্রনাথের মন ভরল না তাতে। বললেন, ‘এতে হবে না। কাল একখানা গনেশের ছবি এঁকে নিয়ে এসো দেখি।’ পর দিন আবার হাজির সে। সঙ্গে শ্বশুর মশাই। গোটানো একখানা কাগজ বের করে মেলে ধরলো অবনীন্দ্রনাথের সামনে— একটা কাঠিতে ন্যাকড়া জড়ানো আর সেই ন্যাকড়ার ওপর সিদ্ধিদাতা গনেশের অবয়ব। চমৎকার ছবি অবনীন্দ্রনাথ অস্ফুটে বলে উঠলেন, শাবাশ। শ্বশুরমশাই পাশ থেকে বললেন— ‘ছেলেটাকে আপনার হাতে দিলাম’। অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘লেখাপড়া শেখালে বেশী রোজগার করতে পারবে কিন্তু।’ এতক্ষণ চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা সে ছেলের মুখ থেকে এ বার কথা সরল, ‘লেখাপড়া শিখলে তো ত্রিশ টাকার বেশী রোজগার হবে না। এতে আমি তার বেশী রোজগার করতে পারবো।’ ভাইস-প্রিন্সিপাল আর না করতে পারলেন না। সেই থেকে ছেলেটি নাড়া বাঁধল অবনীন্দ্রনাথের কাছে। পরবর্তীকালে এই ছেলেই হয়ে উঠেছিলেন ভারত শিল্পের অন্যতম পথিকৃত নন্দলাল বসু।
কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হ্যাভেল সাহেব বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথকে ভাইস প্রিন্সিপালের পদে বসিয়েছিলেন। দুপুরে ঘুমের ব্যাঘাত হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মনিষ্ঠার অসহ্য বেড়াজালের ওজর তুলে অবনীন্দ্রনাথ সাহেবের মাস্টারির প্রস্তাবকে পাশ কাটাতে চেয়েছিলেন। হ্যাভেল কিন্তু তাঁকে ছাড়েননি। কলেজেই দুপুরের বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছিলেন। শেষে সাহেবের জেদের কাছে হার মেনে ভাইস-প্রিন্সিপাল হলেন অবনীন্দ্রনাথ। শুরুতে সুরেন গাঙ্গুলি ও আরও দু-চার জনকে নিয়ে তার মাস্টারি জীবনের পথ চলা শুরু। এমন সময় হঠাৎ এক দিন নন্দলালের আবির্ভাব। এরপর এক পাশে নন্দলাল আর অন্য পাশে সুরেন গাঙ্গুলিকে রেখে অবনীন্দ্রনাথ ভারত-শিল্পের পথ পরিক্রমা করলেন সারথী হয়ে। তার শিক্ষাগুণে আর নন্দলালের হাতের যাদুতে এ সময়ে রূপ পেল ‘কর্ণের সূর্যস্তব’, ‘কৈকেয়ী-মন্থরা’, ‘সতী’, ‘শিব ও সতী’, ‘উমার তপস্যা’র মতো বিখ্যাত সব ছবি।
সে বার জনৈক আইরিশ দুহিতা এসেছেন আর্ট স্কুলে। অবনীন্দ্রনাথ তাকে ছাত্রদের শিল্প-কর্ম দেখাচ্ছেন। তিনটে ছবিতে অতিথির চোখ আটকে গেল। প্রথমটি কৃষ্ণ-সত্যভামা’র তো পরের দু’টি কালী আর দশরথ-কৌশল্যা’র।
‘কৃষ্ণ-সত্যভামা’র ছবিতে সত্যভামার পা ধরে বাসব তার মানভঞ্জনে রত। অবাক হলেন অতিথি নারীর পা ধরে পুরুষের মানভঞ্জন! দৃষ্টিকটু বটে, খারাপ দেখায়। শিল্পীকে এ জাতীয় ছবি আর আঁকতে নিষেধ করলেন। মা কালীর ছবি তাঁকে তৃপ্তি দিয়েছিল যদিও, তবু দীর্ঘ বস্ত্র পরিহিতা সে কালীমূর্তি যেন স্বাভাবিকতার গণ্ডি খানিকটা অতিক্রম করে গিয়েছিল। মা-কালী যে দিগ্বসনা, প্রলয়ঙ্করী। শিল্পীকে তিনি কালী সম্পর্কে স্বামীজীর লেখা কবিতাখানি (‘Kali the Mother’) একটিবার পড়তে বললেন।
তৃতীয় ছবি ‘দশরথের মৃত্যু-শয্যা’য় রামচন্দ্রের বনাগমনের শোকে মৃত দশরথের দেহের পদমূলে উপবিষ্ট কৌশল্যার বিয়োগ ব্যথা মূর্ত। হাতে তার একখানা পাখা। ছবিতে ফুটে ওঠা শান্তির বাতাবরণ অতিথির মন ছুঁয়ে গেল। এ যেন মা সারদা’র গৃহের প্রশান্তি! তবে স্মিত হেসে তিনি বললেন, কৌশল্যা রাজরানি। তাঁর হাতে তালপাতার পাখা? রাজরানির হাতে হাতির দাঁতের পাখাই শোভা পায়। শিল্পীকে ডেকে বললেন, যাদুঘরে হাতির দাঁতের পাখা রাখা আছে, তিনি যেন একবারটি গিয়ে তা’ দেখে আসেন।
যাঁর চিত্রকলা সম্পর্কে জনৈক আইরিশ অতিথি এ মন্তব্য করেছিলেন, কলকাতার সরকারি শিল্প বিদ্যালয়ে নবাগত সে ছাত্রটি পরবর্তীকালে হয়ে উঠবেন বিশ্ববিশ্রুত নন্দলাল। আর দ্রষ্টা-সমালোচকের ভূমিকায় আইরিশ দুহিতা মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল, আমাদের ভগিনী নিবেদিতা। ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন তিনি। যাবার সময় বললেন, ‘গণেন একে তুমি আমার বাগবাজার বোসপাড়া লেনের বাড়িতে নিয়ে এসো।’ অসিতকুমার হালদারকে নিয়ে কিছুদিন পরেই নন্দলাল হাজির হয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। কিন্তু নিবেদিতার গৃহে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা নিদারুণ। বোসপাড়া লেনের ছোট্ট দোতলা বাড়ির আরও ছোট এক ঘর। মেঝেতে কার্পেট পাতা। তার ওপর সোফা। বসতে বলা হলে, নন্দলাল-রা সোফায় গিয়ে বসলেন। তা দেখে নিবেদিতা তাদের আসন করে বসতে বললেন। আসন করে বসা মানে তো মাটিতে বসা। নীরবে তারা সোফা থেকে নেমে মেঝেতে বসলেন। নন্দলালদের মনে অভিমানের ফুলকি জ্বলল। বোধ হয় বুঝতে পারলেন তিনি। স্বীকার করলেন, বুদ্ধের দেশের লোক হয়ে তাদের সোফায় বসতে দেখে তাঁর ভাল লাগে না। মাটিতে আসন করে বসাতে তাদের যেন ঠিক বুদ্ধের মত লাগছে। দেখাচ্ছেও বেশ। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে সে দিকে চেয়ে থেকে, কি দেখলেন কে জানে, খুশিতে উচ্ছ্বল হয়ে সঙ্গী ক্রিস্টিনাকে ডেকে তাঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
এরপর থেকে শুরু হল বাগবাজারে নিবেদিতার কাছে নন্দলাল বসুর নিয়মিত যাতায়াত। সঙ্গী কখনও সুরেন গঙ্গোপাধ্যায়, অসিতকুমার হালদার তো কখনও বা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এক দিন নন্দলাল তাঁর ‘জগাই-মাধাই’ ছবিখানা দেখালেন তাঁকে। খুব খুশি হলেন দেখে। জানতে চাইলেন, ‘ওদের মুখচ্ছবি কোথায় পেলেন?’ নন্দলাল জবাব দিয়েছিলেন, গিরিশবাবুর, মানে গিরিশচন্দ্র ঘোষের মুখ দেখে এঁকেছেন। এ কথায় হেসে ফেলেছিলেন নিবেদিতা। খানিক চুপ করে থেকে বলেছিলেন, ‘ছবি সব সময় ধ্যান করে আঁকবে। এই তো আমাদের ভারতীয় ছবি আঁকার রীতি।’ ছবিটিতে জগাইয়ের কোমরে একখানা থেলো হুঁকো গোঁজা দেখে নিবেদিতা মন্তব্য করেছিলেন, ‘জগাইয়ের আমলে তামাক খাওয়ার চল ছিল না। ছবি আঁকার সময়, বিষয়ের সমসাময়িক আচার-ব্যবহার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার।’ নন্দলাল বসুর জীবন ছবি দিয়ে ঘেরা। জীবনভর একের পর এক ছবি এঁকেছেন। আর লোকে ধন্য ধন্য করেছে। শিল্প-রসজ্ঞ নিবেদিতা প্রথম দেখাতেই বুঝেছিলেন, এ ছেলে ভবিষ্যতে শিল্পের পথে অনেক দূরকে নিকট করবে। আর সে লক্ষ্যে তাঁকে পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছিলেন আজন্ম শিল্পরসিক এই বিবেক-শিষ্যা।
বিশ শতকের সূচনায় বাংলার শিল্প-চেতনায় যে প্রতিশ্রুতি প্রস্ফুটিত হচ্ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসুর হাত ধরে অনতিকালের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা ভূ-ভারতে। পাশ্চাত্য শিল্প-আঙ্গিকের সঙ্গে দূরত্ব গড়ে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এই নব্য শিল্পরীতি জাতীয় জাগরণে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিল। যার কাণ্ডারি ছিলেন নন্দলাল বসু। নন্দলালের শিল্প অমরত্বের ঘোষণা সম্ভবত নিবেদিতার কণ্ঠেই প্রথম ভাষা পেয়েছিল। সমকালীন অন্য শিল্পীর চেয়ে নন্দলালের ছবিরই সবথেকে বেশি সমালোচনা করেছিলেন নিবেদিতা। তারই আগ্রহে নন্দলাল, অসিত হালদার-রা অজন্তায় হেরিংহামের সহকারী হিসেবে ভিত্তিচিত্রের প্রতিলিপি এঁকেছিলেন। অজন্তায় যাওয়ার ব্যাপারে নন্দলাল দ্বিধায় ছিলেন। নিবেদিতাই তাঁকে বোঝান যে, অজন্তার অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে শিল্পী হিসেবে উন্নত হওয়ার কাজে লাগবে। শুধু তাই নয়, অবনীন্দ্রনাথকে দিয়ে টিকিট ইত্যাদির ব্যবস্থা করে তাঁদের অজন্তায় পাঠিয়েও দেন। অজন্তার অভিজ্ঞান পরবর্তীকালে নন্দলালদের শিল্প দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। দেশীয় শিল্পকে বোঝার তৃতীয় নয়ন যেন খুলে গিয়েছিল।
হ্যাভেল সাহেবের পরে প্রিন্সিপাল হয়ে এলেন পার্শি ব্রাউন। নিয়মনিষ্ঠ প্রশাসক ব্রাউনের সঙ্গে স্বাধীনচেতা অবনীন্দ্রনাথের জমলো না। আর্ট স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। শিষ্যরাও গুরুকে অনুসরণ করলেন। নন্দলাল, অসিতকুমার, শৈলেন দে, ক্ষিতিন মজুমদার-সহ আরও কয়েক জন স্কুল ত্যাগ করলেন। নন্দলালকে পার্শি ব্রাউন আর্ট স্কুলে অধ্যাপনা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাজি হননি তিনি। অগত্যা কী করেন? প্রথমে ঠিক করলেন, সবাই মিলে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে একত্রে ছবি আঁকার কাজ করবেন। সেই সঙ্গে কমার্শিয়াল কাজের অর্ডার ধরবেন। জোড়াসাঁকোয় অবনীন্দ্রনাথের বাড়ির কাছেই ভাড়া-বাড়ি নেওয়া হবে বলে ঠিক হ’ল। তাতে অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগেরও সুবিধা হবে। কিন্তু এ খবর যখন অবনীন্দ্রনাথের কানে গেল, তিনি নন্দলালকে নিজের স্টুডিয়োতে কাজ করার জন্য ডেকে নিলেন। গুরু-আজ্ঞা শিরোধার্য করে নন্দলালও সেখানে যোগ দিলেন। উপরি হিসেবে জুটল মাসিক ৬০ টাকা বৃত্তি। এখানেই জাপানি মনীষী ওকাকুরা, শিল্পী টাইকান, হিশিদা, শিল্পকলাবেত্তা আনন্দকুমারাস্বামীর সঙ্গে পরিচয় হল তাঁর। রপ্ত করলেন জাপানি শিল্পের ধরণ-ধারন। তাঁদের সাহচর্য নন্দলালের মনীষাকে আরও শাণিত করল।
অবনীন্দ্র-শিষ্য নন্দলাল ঠাকুরবাড়ির সবথেেক খ্যাতিমান পুরুষটির সান্নিধ্যে এসেছিলেন ‘চয়নিকা’র সূত্র ধরে। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছেয় ১৯০৯ সালে নন্দলাল ‘চয়নিকা’ কবিতা সংগ্রহের জন্য সাতটি ছবি এঁকে দেন। পরে ১৯১৩ সালে ‘ক্রিসেন্ট মুন’- এর জন্য আরও দু’খানি- ‘The Home’ , ‘The Hero’। সেই থেকে উভয়ের সম্পর্ক-বন্ধন। তবে সে শুরুটা বেশ মজার। নন্দলালদের হাতিবাগানের বাড়িতে সে বার বাঁকুড়া থেকে এক সাধু এসেছিলেন। পুজোর জন্যে নন্দলাল সে সময়ে এক তারা-মূর্তি এঁকে দিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় সেই সাধু আশীর্বাদ করে চিত্রখানি হস্তগত করে চলে গেলেন। এর কিছু দিন পরেই জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে নন্দলালের ডাক এল। সসংকোচে গিয়ে হাজির হলেন কবির সামনে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, তাঁর তারা-মূর্তি তিনি দেখেছেন। হয়েছে বেশ। এ বার তাকে তাঁর নতুন কবিতার বই ‘চয়নিকা’র জন্য ছবি এঁকে দিতে হবে। শুনে তো নন্দলাল চমকে উঠলেন, তারা-মূর্তির ছবি কবি দেখলেন কী করে? ভাবলেন, অবনীন্দ্রনাথ বুঝি তাঁকে বলেছেন। সে যাইহোক, কবিকে তিনি বললেন, তাঁর বই তিনি খুব একটা পড়েননি, আর পড়লেও বোঝেননি। উত্তরে কবি বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে, পড়লেই বোঝা যাবে।’ বলেই ‘চয়নিকা’ েথকে একের পর এক পড়তে শুরু করলেন— পরশপাথর-ঝুলন-মরণ মিলন সমস্ত কবিতা। আর তাঁর পড়ার ভঙ্গীতেই নন্দলালের কল্পনায় ডানা মেললো নানা ছবি। পরে তিনি কবির জন্য রং-তুলি ধরলেন। সৃষ্টি হল ‘পরশ পাথর’ ‘অন্নপূর্ণা ও শিব’ ‘নকল বুঁদি’, ‘শিব তাণ্ডব’ প্রভৃতি। নন্দলালের মোট সাতটি ছবি জায়গা পেল ‘চয়নিকা’র প্রথম সংস্করণে।
জোড়াসাঁকোর লালবাড়িতে ‘বিচিত্রা’ সভাগৃহ স্থাপন করে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-শিল্প-চর্চার আয়োজন করেছিলেন। কবি তাঁর কবিতা-নাটক-প্রবন্ধ এখানেই শহরের সুধী সমাজকে পাঠ করে শোনাতেন। চিত্র প্রদর্শনী বা নাটক মঞ্চস্থ করা সবেরই আয়োজন হতো এখানে। ১৯১৬ সালে কবির আহ্বানে নন্দলাল বিচিত্রায় এসে যোগ দেন। সেখানে কবির পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী,অবনীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ পারুলদেবী বা নীলরতন সরকারের কন্যা অরুন্ধতী প্রমূখ নন্দলালের কাছে আঁকা শিখতে আসতেন। ইতিপূর্বে অবশ্য কবির আহ্বানে নন্দলাল প্রথম বারের জন্য শান্তিনিকেতনে যান ১৯১৪ সালের এপ্রিলে। বৈদিক মতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অভিবাদন জানান। মাটির উঁচু বেদিতে আলপনা এঁকে পদ্ম-পাতার আসন বিছিয়ে শঙ্খনিনাদ মাঝে পুস্পার্ঘ্য সহযোগে শান্তিনিকেতন বরণ করে নেয় শিল্পীকে। আশীর্বাণীতে কবি লেখেন –
‘‘তোমার তুলিকা রঞ্জিত করে
ভারত-ভারতী চিত্ত।
বঙ্গ-লক্ষী ভাণ্ডারে সে যে
যোগায় নূতন বিত্ত।’’
সে বার অবশ্য নন্দলাল বেশি দিন বোলপুরে থাকেননি। কিছু দিন পরেই কলকাতায় ফিরেছিলেন।
১৯১৯ সালে রবীন্দ্রনাথ কলা ভবনের গোড়াপত্তন করেন। প্রথম অধ্যক্ষ অসিতকুমার হালদার। নন্দলালও যোগ দিয়েছিলেন। তবে বেশি দিন তাঁর সেখানে থাকা হয়ে ওঠেনি। অবনীন্দ্রনাথের আহ্বানে কলকাতায় ফিয়ে যান ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েণ্টাল আর্টের চিত্রবিদ্যা শিক্ষণের কাজ নিয়ে। পরে ১৯২০ সালে আবার ফিরে এসে কলাভবনের কাজে স্থায়ী ভাবে যোগ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নামক বটবৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় নেন। ১৯২২ থেকে অধ্যক্ষ হিসেবে এ কলাকেন্দ্রর হাল ধরেন।
শান্তিনিকেতনে এসেও নন্দলালের অস্থিরতা দূর হল না। অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউয়ে তাঁর মন আন্দোলিত। মনকে এ সব থেকে সরিয়ে নেওয়ার সুযোগও এল। নন্দলাল লিখেছেন, ‘‘১৯২১ সাল শান্তিনিকেতনে কাজ নিয়ে স্থির হয়ে বসার চেষ্টা করছি। কিন্তু সারা দেশ ময় রাজনৈতিক তোলপাড় চলছে। তাতে আমার মনও বেশ বিক্ষিপ্ত। এমন সময় একটা অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণ এল গোয়ালিয়র রাজদরবার থেকে ভগ্নন্মুখ বাঘ গুহার ভিত্তি চিত্রগুলি কপি করার। আমার তখনকার মানসিক অবস্থার পক্ষে কাজ এবং পারিপার্শ্বিকের এরূপ একটা সাময়িক পরিবর্তনের সুযোগ লাভের খুবই প্রয়োজন ছিল।” কাজ পেয়ে অসহযোগ আন্দোলনজনিত মনের উত্তেজনা প্রশমিত হল। কিন্তু গাঁধীজির নেতৃত্ব ও আদর্শের প্রতি নন্দলালের শ্রদ্ধা অটুট ছিল চিরকাল।
আসলে নন্দলাল বসুর জীবন ছিল আদ্যন্ত দেশপ্রেমে ভরপুর। স্বদেশী আন্দোলন তাঁর কৈশোর ও যৌবনের ঘটনা। বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ যোগের হয়তো প্রমাণ নেই, তবে বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতি ও সময়ে সময়ে সাহায্য করার প্রমাণ আছে। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ থেকে যে বিশেষ আধ্যাত্মিক ভাব ও ভারতপ্রেম নানা ধারায় প্রবাহিত হয়ে নন্দলালের জীবনে প্রবেশ করে, তার একটি ধারা এসেছিল ভগিনী নিবেদিতার মধ্য দিয়ে। তাঁর ছাত্র শ্রী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় কে তিনি বলতেন, ‘পরাধীনতার জ্বালা তোমরা অনুভব করতে পারবে না।’ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পোস্টার আঁকতেন রাত জেগে। তাঁর বাড়ির জানালার শিক আলগা করা থাকত। ছেলেরা এসে তা উঠিয়ে ভিতরে ঢুকত। পোস্টার কোমরে বেঁধে নিয়ে বেরিয়ে যেত। হরিপুরা কংগ্রেসে নন্দলালের কাজ তো একাধারে দেশপ্রেম ও শিল্পবোধের অসামান্য মেলবন্ধন। গান্ধীজির অনুরোধে হরিপুরার কংগ্রেস নগর সাজাবার ভার নিয়েছিলেন তিনি। প্রচারপত্রে আঁকা ছবিতে ওই রকম লাইন, রঙের ব্যবহার ভারতের আর কোনও শিল্পী পারবেন না, নির্দ্বিধায় বলা যায়। তিনি সাজিয়েছিলেন হরিপুরা কংগ্রেসের মূল মণ্ডপ। তার সামনে একটা চৌকো জায়গা করে, মাটি ভরাট করে প্রচুর ধান ছড়িয়ে দেওয়া হয়। নিয়মিত তাতে জল দেওয়া হত। আর সরষে গাছ লাগিয়েছিলেন। তাতে মণ্ডপ সবুজ আর হলুদের অসাধারণ রূপ নিল। ওখানে কাজ করতে করতে বাইরে চাটাই পেতে শুতেন সকলে। লম্বা চাটাইয়ে গান্ধীজিও শুয়ে থাকতেন, শুয়ে থাকতেন নন্দলাল বসুও। তিনি খুব সংশয়ে থাকতেন, পাছে পা লেগে যায় গান্ধীজির গায়ে! শান্তিতে ঘুমোতে পারতেন না। তাঁর ছাত্ররা লক্ষ করেছিল, ওখানে কোনও নেতা এলে আগে থেকে ঘোষণা করা হত, ‘…আ রহে হ্যায়’— এই আওয়াজে যাঁরা গেট সামলাতেন, খুলে দিতেন। তখন মাস্টারমশাইয়ের ছাত্ররাও তিনি আসা মাত্র, ‘নন্দলালজি আ রহে হ্যায়’ বলে চিৎকার করতেন।
গান্ধীজির কাছেও আর্ট সম্পর্কিত ব্যাপারে নন্দলালের মত ছিল সবার উপরে। পুরীতে একবার কংগ্রেস অধিবেশন হওয়ার কথা। সেই সময়ে পুরী, কোণারক, ভুবনেশ্বরের মন্দিরের মূর্তিগুলি নিয়ে কংগ্রেস নেতাদের দুশ্চিন্তা হয়। তা দেখে বিদেশিরা কী ভাববে? একদল মত দেয়, চুনকাম করে দেওয়া হোক। এক শিল্পপতি খরচ দিতেও রাজি ছিলেন। গান্ধীজি সম্মতি জানানোর আগে নন্দলালের মত জানতে চাইলেন। নন্দলাল বললেন, এমন অপূর্ব ভাস্কর্য নষ্ট হলে ভারতের অমূল্য সম্পদ লুপ্ত হয়ে যাবে। বেঁচে গেল অসাধারণ সে শিল্পসৃষ্টি! গান্ধীজির মতো রোগী সেবার উদারতা নন্দলালেরও ছিল। সামনে আর্ত বিপন্ন দেখলে স্থির থাকতে পারতেন না। অথচ নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা এই মানুষটির প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। শান্তিনিকেতনে নৃত্য, নাটক অভিনয়ে সার্থক সাজসজ্জা যাঁর সৃষ্টি, তাঁকে কিন্তু কখনও সামনে আসতে দেখা যেত না। পারতপক্ষে কোনও সভার সামনের দিকে তিনি বসতেন না। নন্দলালের যে ‘স্বাভাবিক আভিজাত্য’র কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এটি তারই লক্ষণ। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, পুরনো গ্রন্থাগারের (বর্তমান পাঠভবন দফতর) বারান্দায় জয়পুরী প্রথায় অনবদ্য দেওয়াল চিত্রণ আঁকার সে ঘটনা। ওখানে বিরাট মুরালটি তৈরির সময়ে নন্দলাল তাঁর ছাত্রছাত্রীদের সাবধান করে দিয়েছিলেন, জয়পুরী পদ্ধতি শেখানোর জন্য যিনি এসেছিলেন, তাঁর কাছে নন্দলালের আসল পরিচয় যেন গোপন রাখা হয়। সেই কারণেই ওই কারিগর মুরালটি গড়ার সময়ে নন্দলালকে অনেক বার বকেছিলেন। আবার তাঁকে দেখিয়ে বাকি ছাত্রদের ধমকেছিলেন, ‘তোমরা শিল্পী হয়ে কাজ শিখতে এত দেরি করছ, আর দেখো তো এই মিস্ত্রি কেমন তাড়াতাড়ি সব শিখে ফেলছে!’ সবচেয়ে মধুর হল, মুরালের কাজ শেষ হওয়ার পরে জয়পুরী শিল্পীদের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সেই বয়স্ক মানুষটি নন্দলালের আসল পরিচয় জানতে পারেন। তখন সাশ্রুনয়নে ক্ষমা প্রার্থনা করায় নন্দলাল বলেছিলেন, ‘আমি তো সেই সময়ে তোমার ছাত্রই ছিলাম।’ এমন কত অসাধারণ সব ঘটনা আশ্রমের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, যাদের তুলনা নেই।
তাঁর সমস্ত কাজের সঙ্গে মাটির যোগসূত্র। চাষাভুষো, সাধারণ লোক … ক্লাসিক্যাল ছবি যেমন তিনি এঁকেছেন, তেমনই এই মানুষগুলোও ছিল নন্দলালের বিরাট অবলম্বন। তাঁকে রোজ তেল মাখাত ধামাই নামে এক সাঁওতাল ছেলে। একদিন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বললেন, ‘জানো তো, ধামাইয়ের ছাগলটা কে যেন চুরি করে নিয়েছে। ওর মনটা খারাপ।’ পরদিন গিয়ে রামানন্দ গিয়ে দেখেন, নন্দলাল একটা ছবি এঁকেছেন ধামাইয়ের জন্য। মাঝখানে ধামাই দাঁড়িয়ে, তার চারিদিকে ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে! সম্পর্কের যে নিবিড় আত্মিক বুনন, তা ওই কাজটা দেখলেই বোঝা যায়।
ছাত্রছাত্রীদের প্রতিও যে কী অসীম মমতা ছিল! শান্তিনিকেতনে তখন কিছু সেকেলে শৌচাগার ছিল। মেথর রসিক তাঁর দলবল নিয়ে সেগুলো পরিষ্কার রাখত। গান্ধীজি যে দিন দক্ষিণ আফ্রিকার ফনিক্স আশ্রমের অধিবাসীদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে প্রথম এসে উঠেছিলেন, সেই দিনটির স্মরণে গান্ধী পুণ্যাহ পালন করা হয়। ওই দিনটি আশ্রমের সেবাকর্মীদের ছুটি দেওয়া হত। কাজের ভার নিতেন ছাত্র শিক্ষক-কর্মী আশ্রম পরিবারভুক্ত সকলে। প্রতি বছর নন্দলাল বেছে নিতেন মেথরের কাজটি। চেলাও জুটে যেত, তাঁরই ছাত্রদের একটি দল। রান্নাঘরের বাগানের জন্য কমপোস্ট সারের খাদ তৈরি হত। সমস্ত ময়লা, পচা পাতা আর কাটা জঙ্গল দিয়ে সেটা ভরাট করা হত। তার উপরে পড়ত মাটির আস্তরণ। এ হেন কাজের পুরোধা নন্দলাল বসু মহাশয়!
(তথ্যসূত্র:
১- নন্দলাল বসু, আবুল মনসুর, বাতিঘর (২০১৬)।
২- Rhythms of India – The Art of Nandalal Bose, San Diego Museum of Art (২০০৮)।
৩- নন্দলাল বসু: ভারতশিল্পের পথিকৃৎ, দিনকর কৌশিক, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট (২০১১)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত