শৈশবে তিনি স্বপ্ন দেখতেন ‘প্রাণিবিজ্ঞানী হওয়ার’, কল্পনা করতেন ‘পক্ষী-তত্ত্ব’ তাঁর বিষয় হবে, ‘দুঃসাহসী অভিযাত্রী’ হবেন, ‘দুর্ধর্ষ শিকারি’ হবেন। শৈশবের এই সব ডাকাবুকো চিন্তার জন্মের কারণ বোধ হয় ছিলেন তাঁর মামা, সে কালের ‘দুঁদে শিকারি’ ‘আমিরউদ্দিন তৈয়বজি’। খুব ছোট বয়সে বাবা-মা মারা যাওয়ায় মামার বাড়িতেই বড় হয়েছিলেন তিনি ও তাঁর ভাইবোনেরা। সেখানে মাঝেমধ্যেই বাঁশের ঝাঁকায় করে আসত ‘তিতির’ ও ‘বটের পাখি’। শৈশবে তিনি তাঁর চেয়েও ছোট্ট ভাগ্নে ‘সুলেমান’কে নিয়ে সকলের অলক্ষ্যে পাখির ঝাঁকা থেকে কয়েকটা পাখি সরিয়ে ফেলে প্যাকিং বাক্সের খাঁচা বানিয়ে তার মধ্যে পাখিগুলো রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মশগুল হয়ে দেখতেন। সম্ভবতঃ তাঁর মধ্যে পরবর্তী কালে ‘বার্ডম্যান’ হয়ে ওঠার বীজ রোপিত হয়েছিল এ ভাবেই। নিজের আত্মজীবনী ‘দ্য ফল অব আ স্প্যারো’-তে তিনি লিখেছিলেন,
‘‘অস্থিতপঞ্চক সভ্যতার দ্রুতবেগের এই যান্ত্রিকযুগের কোলাহলময় ডামাডোল থেকে আমার মুক্তির রাস্তা হল পাখি দেখা।’’
এই বইটিই পরে ‘চড়াই উতরাই’ নামে বাংলায় অনূদিত হয়েছিল। পাখি যে গবেষণার বস্তু হতে পারে, ঘরের বাইরে গিয়ে তাদের ইতিহাস বার করা যায়, এই বিষয়টা ভারতীয়দের মধ্যে তাঁর আগে সে রকম ভাবে কেউ ভাবেননি। ভারতের পাশাপাশি ‘আফগানিস্তান’, ‘তিব্বত’, ‘ভুটানের’ ‘পাখির প্রজনন’, তাদের ‘বাসস্থান’, ‘জীবনযাত্রা’ সব কিছু নিয়ে খুঁটিয়ে কাজ করেছিলেন তিনি। প্রতিটি সমীক্ষার উপর লিখেছিলেন বই। তাঁর লেখা ‘বুক অব ইন্ডিয়ান বার্ডস আজও পক্ষী-প্রেমীদের কাছে বাইবেলসম। তিনি ‘সেলিম আলি’, ‘বার্ডম্যান অফ ইন্ডিয়া’!
‘‘১৯০৬/০৭ সাল। বাইরে পুরুষ চড়াইটি কাঠের গোঁজে বসে আছে। গর্তের প্রবেশপথের প্রায় মুখে। ভেতরে স্ত্রী চড়াই ডিমে তা দিতে বসেছে। আস্তাবলের কাছে একটি ঘোড়ার গাড়ির পেছনে নিজেকে আড়াল ক’রে অতর্কিতে আমি তাদের উপর আক্রমণ করলাম। পুরুষ চড়াইটা গুলি খেয়ে মরল। কিছুক্ষণ যেতে না যেতে দেখি মেয়েটি এক ফাঁকে আরেকটি পুরুষ-চড়াই জুটিয়ে এনেছে। সেও বাইরের গোঁজটাতে ভর দিয়ে ‘পাহারা’য় বসে গেছে। এই মরদটিকেও আমি ঘায়েল করলাম। চোখের পলকে দেখি মেয়েটি আবার এক মরদ এনে হুজুরে হাজির করেছে। পরের সাত দিনে ঐ একই দাঁড়ে-বসা গুটি আষ্টেক পুরুষ চড়াইকে আমি সাবাড় করি। …’’
নয়-দশ বছর বয়সে এই কথাগুলো ডায়েরিতে লিখেছিলেন সেলিম আলি! উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতীয়দের কাছে ‘পক্ষী সংরক্ষণ’ ব্যাপারটা ছিল কল্পনাতীত। বরং পশুপাখি শিকারে যে যত কামাল দেখাতে পারবে সে তত বড় ‘পুরুষসিংহ’। শিকার-শিকার খেলতে খেলতেই সেলিম হয়েছিলেন ‘বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া’।
মাত্র তিন বছর বয়সে সেলিম মা-বাবাকে হারান। অনাথ হয়েও পাঁচ ভাই ও চার বোনের সঙ্গে সেলিম নিঃসন্তান মামা-মামির কাছে বড়ই আদরে মানুষ হয়েছিলেন। মামা ‘আমিরউদ্দিন’ ছিলেন বড় শিকারি। সাহেবরা তাঁকে নেকনজরে দেখতেন। নয় বছরের ছোট্ট সেলিমকে তিনি একটি এয়ারগান উপহার দিয়েছিলেন। ছোট থেকেই মাসে ২ টাকা হাতখরচ পেতেন সেলিম। সেই টাকা জমিয়ে ‘মুম্বাইয়ের ক্রফোর্ড মার্কেটের পাখির বাজার’ থেকে নানা ধরনের পাখি কিনে, তারের জাল ও প্যাকিং বাক্স জুড়ে খাঁচা বানিয়ে তাতে পাখিগুলিকে রাখতেন। এমনও হয়েছে, বাড়িতে মেহমানদের জন্য বস্তাবন্দি ‘তিতির’ বা ‘বটের পাখি’ এসেছে। সে সব সুস্বাদু পদ হওয়ার আগেই বস্তা খুলে জ্যান্ত পাখি চুপিসারে সরিয়ে ফেলতেন। সেই সব পাখিদের জায়গা হত খাঁচায়। বড়দের অলক্ষে খুদেদের এই সব কাজে সাহায্য করত বাড়ির পুরনো ভৃত্য ‘নান্নু’। আত্মজীবনী ‘ফল অব আ স্প্যারো’-তে সেলিম লিখেছেন, তিনি বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন না খাঁচার বন্দি পাখিগুলিকে। তার পরেই হাতে আসে এয়ারগান। সেলিমের বাড়ির ভিতরে ছাদে বারান্দায় ছিল অগুনতি চড়াইয়ের বসবাস। চোখের সামনে এত চড়াই ছিল প্রশিক্ষণের জন্য মোক্ষম। তিনি জেনে নিয়েছিলেন, মুসলমান সন্তান হিসেবে চড়াইয়ের মাংস গ্রহণে পাপ নেই। কিন্তু তা উপযুক্ত ‘হালাল’ হওয়া চাই। মৃত চড়াইকে ‘হালাল’ করার পদ্ধতি, কী ভাবে তেল মশলা দিয়ে এদের সদগতি করতে হবে, সবই শিখেছিলেন ‘নান্নু’র কাছেই!
এমনই এক দিন, শিকারের পর এক চড়াইপাখি হালাল করতে গিয়ে তার চোখ আটকে গিয়েছিল পাখির গলায়। এ তো ঠিক পরিচিত চড়াইয়ের গলার মেটে দাগ নয়। তা হলে? মৃত পাখিটির গলায় ঝোল পড়ার দাগের মতো হলদে ছাপ। ‘হালাল’ না করে মৃত পাখিটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের মামার কাছে। মামাও এর বিহিত করতে না পারায় একটি চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ‘বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র তৎকালীন ‘অবৈতনিক সেক্রেটারি’ ‘ডব্লু এস মিলার্ড’-এর কাছে। সেখান থেকে তাঁর আমন্ত্রণ এসেছিল। গিয়েছিলেন সেলিম। সোসাইটির ভিতরে দেওয়াল জুড়ে মাউন্ট করা জীবজন্তু, শো কেসে সাজানো প্রজাপতি ও পাখির ডিম, দেওয়ালে টাঙানো চিতাবাঘ-বাঘের মাথার খুলি … প্রথম বার এই সব দেখে সেলিমের ছোট্ট মনে একরাশ বিস্ময় তৈরি হয়েছিল। তৈরি হয়েছিল কৌতূহল। সেই কৌতূহলই সেলিমের জীবন বদলে দিয়েছিল। প্রথম দিনের এই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে সেলিম আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘‘এটা নিশ্চয় ১৯০৮ সালের কোনও একটা সময়ে ঘটে থাকবে। বি এন এইচ এস-এর সঙ্গে সেই আমার প্রথম যোগাযোগ। পরে আমার জীবন গড়ে তুলতে এবং বিশেষ একটি খাতে বইয়ে দিতে এই যোগাযোগ বড় রকমের সাহায্য করেছিল।’’
পাখি ও প্রকৃতির বাইরে সেলিম আলি পাগল ছিলেন আর একটি ব্যাপারে। সেটি হল ‘মোটরসাইকেল’! কাজের সূত্রে মায়ানমারে গিয়ে প্রথম তাঁর হাতে আসে মোটরসাইকেল, ‘জেনিথ’। ‘হার্লে ডেভিডসন’, ‘ডগলাস’, ‘স্কট’, ‘নিউ হাডসন’ এবং ‘মেক’… সেরা কোম্পানিগুলির মোটরসাইকেল ব্যবহার করেও তাঁর আমৃত্যু আফসোস ছিল ‘বিএমডব্লু’-র মোটরসাইকেল ব্যবহার করার সুযোগ পাননি বলে! বছর-বছর মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনে কোথায় কী নকশা বদলাল, তা জানার জন্য তিনি মুখিয়ে থাকতেন। কৌতূহল মেটাতেন মোটরবাইক সংক্রান্ত বিভিন্ন জার্নাল আর প্রস্তুতকারকদের ক্যাটালগ পড়ে। নতুন মোটরসাইকেল হাতে এলেই, তিনি তার ইঞ্জিন খুলে বোঝার চেষ্টা করতেন, কোম্পানি নতুন কী যন্ত্রপাতি তাতে দিল এবং কেন দিল। সপ্তাহান্তে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিতেন মোটরসাইকেলের ভিতর ও বাইরে পরিষ্কার করতে।
১৯৫০-এ সুইডেনে আন্তর্জাতিক পক্ষিতাত্ত্বিক কংগ্রেস-এ তিনি একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বাইক ‘সানবিম’। একটাই উদেশ্য, ওই বাইকে করে গোটা ইংল্যান্ড চষে বেড়ানো। তাঁর স্বপ্ন সফল হয়েছিল।
‘সেলিম মঈজুদ্দীন আব্দুল আলী’ (জন্ম: নভেম্বর ১২, ১৮৯৬ – মৃত্যু: জুলাই ২৭, ১৯৮৭) একজন বিখ্যাত ভারতীয় ‘পক্ষীবিদ’ এবং ‘প্রকৃতিপ্রেমী’। তিনিই প্রথম কয়েকজন ভারতীয়দের মধ্যে একজন যাঁরা ভারতের পাখিদের সম্বন্ধে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জরিপ পরিচালনা করেন। তাঁর পাখিবিষয়ক বইগুলো পক্ষীবিজ্ঞানের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৭-এর পর তিনি ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’তে গুরুত্বপূর্ণ আসনে জায়গা করে নেন এবং সংগঠনটির উন্নয়নে সরকারী সাহায্যের সংস্থান করে দেন। তিনি ‘ভরতপুর পক্ষী অভয়ারণ্য’ (‘কেওলাদেও জাতীয় উদ্যান’) প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁরই উদ্যোগে বর্তমান ‘সাইলেন্ট ভ্যালি জাতীয় উদ্যান’ নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়। ভারত সরকার তাঁকে ১৯৫৮ সালে ‘পদ্মভূষণ’ এবং ১৯৭৬ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক উপাধি ‘পদ্মবিভূষণে’ ভূষিত করে। এছাড়াও তিনি ১৯৫৮ সালে ‘রাজ্যসভায় সদস্যরূপে মনোনীত’ হন। পাখি বিষয়ে তার অনবদ্য অবদানের জন্য তিনি ‘ভারতের পক্ষীমানব’ হিসেবে পরিচিত।
সেলিম আলী ১৮৯৬ সালে ভারতের মুম্বইয়ে (তৎকালীন বোম্বে) ‘সুলাইমানী বোহরা’ গোত্রের এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর বয়স যখন এক বছর তখন তাঁর পিতা ‘মইজুদ্দীন’ মৃত্যুবরণ করেন এবং তিন বছর বয়সে তাঁর মা ‘জিনাত-উন-নিসা’ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নিঃসন্তান মামা-মামী ‘আমিরুদ্দীন তায়েবজী’ ও ‘হামিদা বেগম’ তাঁর লালন-পালনের ভার নেন। তাঁর আরেক মামা ‘আব্বাস তায়েবজী’ একজন প্রখ্যাত ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। ছোটবেলায় সালিম তাঁর খেলনা এয়ারগান দিয়ে একটি অদ্ভুতদর্শন চড়ুই শিকার করেন আর সেই চড়ুইয়ের সূত্র ধরে ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র তৎকালীন ‘সচিব’ ‘ওয়াল্টার স্যামুয়েল মিলার্ডের’ সাথে তাঁর পরিচয় হয়। ‘মিলার্ড’ চড়ুইটিকে ‘হলদেগলা চড়ুই’ হিসেবে সনাক্ত করেন। তিনি সালিমকে সোসাইটিতে সংগৃহীত স্টাফ করা পাখির সংগ্রহ ঘুরিয়ে দেখান। তিনি সালিমকে পাখি সম্পর্কিত কিছু বই ধার দেন, তার মধ্যে ‘কমন বার্ডস অব বোম্বে’ অন্যতম। সালিমকে পাখির একটি সংগ্রহ সৃষ্টির জন্য তিনি উৎসাহ দেন আর কিভাবে পাখির চামড়া ছাড়াতে হয় ও সংরক্ষণ করতে হয় সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ‘মিলার্ড’ ছোট্ট সালিমের সাথে ‘নরম্যান বয়েড কিনিয়ারের’ পরিচয় করিয়ে দেন। ‘কিনিয়ার’ ছিলেন ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র সর্বপ্রথম ‘বেতনভোগী কিউরেটর’। নিজের আত্মজীবনী ‘দ্য ফল অফ আ স্প্যারো’তে সালিম হলদেগলা চড়ুইয়ের ঘটনাটাকে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেন। সেই ঘটনাটাই তাঁর ‘পক্ষীবিদ’ হওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে। তখনকার দিনে ভারতের হিসেবে পেশাটি একটু অন্যরকমই বলতে হবে। অথচ জীবনের প্রথম দিকে তিনি শিকার সম্পর্কিত বইপত্র পড়তেন আর তাঁর ঝোঁক ছিল শিকারের দিকেই। তাঁর পালক পিতা আমিরুদ্দীনের শিকারের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল। তাঁর আশেপাশের এলাকায় প্রায়ই শিকার প্রতিযোগিতা হত। তাঁর শিকারের অন্যতম ‘সহচর’ ছিলেন ‘পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতি’ ‘ইস্কান্দার মির্জা’, যিনি নিজে খুব ভাল শিকারী ছিলেন।
সেলিম আলি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন ‘জেনানা বাইবেল মেডিকেল মিশন গার্লস হাই স্কুল’ থেকে। পরবর্তীতে তিনি বোম্বের ‘সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে’ ভর্তি হন। তেরো বছর বয়স থেকে তিনি প্রায়ই মাথাব্যথায় ভুগতেন। সে কারণে তিনি স্কুলে অনিয়মিত ছিলেন। তাঁর এক আত্মীয়ের পরামর্শে তিনি সিন্ধুতে চলে যান। অনিয়মিত শিক্ষাজীবনের জন্য তিনি কোনমতে ১৯১৩ সালে ‘বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে ‘মেট্রিকুলেশন’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অঙ্ক ছিল ছাত্র সেলিমের আতঙ্ক, যে ভীতির কথা তিনি আত্মজীবনীতে লিখতে ভোলেননি, ‘‘ছেলেবেলায় ক্লাসে বসে ক্ষেত্রমিতির অখাদ্য সব অঙ্ক কষার চেয়ে আমি ঢের বেশি ভালবাসতাম মনোরম পরিবেশে মনের সুখে পাখির পিছনে ছুটতে।’’
সেলিম আলি, তাঁর ‘বোম্বের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের’ প্রথম দিনগুলো বেশ সমস্যার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেন। কলেজ বাদ দিয়ে তিনি বার্মার ‘তেভয়ে’ (‘তেনাসেরিম’) চলে যান তাঁর পারিবারিক ‘টাঙস্টেনের খনি’ ও ‘টিম্বারের ব্যবসা’ দেখাশোনার জন্য। সে এলাকার অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও অসাধারণ সম্বৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য তাঁর প্রকৃতিপ্রেমী সত্ত্বাকে (একই সাথে শিকারী সত্ত্বাকেও) জাগ্রত করে। সেখানে ‘জে সি হোপল্যান্ড’ আর ‘বার্থোল্ড রিবেনট্রপে’র সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁরা দু’জন তখন ‘বার্মার ফরেস্ট সার্ভিসে’ কর্মরত ছিলেন। সাত বছর পর, ১৯১৭ সালে সেলিম আলী ভারতে ফেরত আসেন। তিনি তাঁর অসমাপ্ত পড়াশোনা শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন। ‘দেবরের কলেজ অফ কমার্সে’ তিনি ‘বাণিজ্যিক আইন’ আর ‘হিসাববিদ্যা’য় ভর্তি হন। তাঁর আগ্রহ ঠিকই ‘সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের’ ‘ফাদার এথেলবার্ট ব্লাটার’-এর নজরে আসে। তিনি সেলিমকে ‘জীববিদ্যা’ পড়ার জন্য উৎসাহ দেন। সকালে ‘দেবর কলেজে’ ক্লাস করে পরে ‘সেন্ট জেভিয়ার্সে’ ক্লাস করতে যেতেন সেলিম। এতসব প্রতিকূলতার মধ্যে তিনি ঠিকই ‘জীববিদ্যার কোর্স’ সফলভাবে পাশ করেন। ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে তাঁর এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়া ‘তাহমিনা’র সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
ছোটবেলা থেকেই মোটরসাইকেলের প্রতি সেলিমের তীব্র আকর্ষণ ছিল। তেভয়ে তিনি প্রথমবারের মত একটি ৩.৫ অশ্বশক্তির ‘NSU’ কেনেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে তিনি একটি ‘সানবিম’, তিনটি মডেলের ‘হার্লে-ডেভিসন’, একটি ‘ডগলাস’, একটি ‘স্কট’, একটি ‘নিউ হাডসন’, একটি ‘জেনিথ’ এবং আরও অনেক মোটরসাইকেল কেনেন। একবার ১৯৫০ সালে ‘সুইডেনের উপসালায়’ ‘অর্নিথোলজিক্যাল কংগ্রেস’ থেকে তিনি আমন্ত্রণ পান। বোম্বে থেকে ‘এস এস স্ট্রেথডেনে’ করে তাঁর ‘সানবিম’ নিয়ে তিনি সুইডেনে নামেন আর সেটা নিয়ে সমগ্র ইউরোপ চষে বেড়াতে শুরু করেন। ‘জার্মানি’র প্যাঁচানো সব রাস্তায় ছোটখাটো দুর্ঘটনা ছাড়াও ‘ফ্রান্সে’ তিনি অ্যাক্সিডেন্ট করে জখম হন। পুরো ইউরোপ ঘুরে যখন তিনি ঠিক সময়ে সুইডেনে প্রথম অধিবেশনে যোগ দেন, তখন সবাই বলাবলি করতে শুরু করে যে লোকটা ভারত থেকে গোটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে। সেবার একটা ‘বিএমডব্লিউ’ সাথে না থাকাতে সালিম আলীর খুব আফসোস হয়েছিল।
কোন প্রাতিষ্ঠানিক ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি’ না থাকাতে ‘জ্যুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’য় ‘পক্ষীবিদের পদ’ পেতে সালিম আলী ব্যর্থ হন। তার পরিবর্তে ‘এম এল রুনওয়াল’ পদটি পেয়ে যান। ১৯২৬ সালে নবনির্মিত মুম্বাইয়ের ‘প্রিন্স অব ওয়েলস মিউজিয়ামে’ তিনি ‘গাইড লেকচারার পদে’ চাকরি পান। তখন তাঁর মাসিক বেতন ছিল সাড়ে তিনশো টাকা। তবে নতুন কাজে তিনি বেশিদিন স্থায়ী হন নি। দুই বছর পর, ১৯২৮ সালে তিনি শিক্ষা অবকাশ নিয়ে ‘জার্মানি’ চলে যান। সেখানে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান জাদুঘরে অধ্যাপক ‘এরউইন স্ট্রেসমানের’ অধীনে তিনি কাজ করার সুযোগ পান। বার্মা থেকে ‘জে. কে. স্টানফোর্ড’ সংগৃহীত বিভিন্ন নমুনা বিশ্লেষণ করা ছিল তাঁর অনেকগুলো কাজের মধ্যে একটি। ‘স্টানফোর্ড’ নিজেও ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র একজন সদস্য ছিলেন। তিনি সালিমকে কারো অধীনে কাজ না করার জন্য উৎসাহ দেন এবং ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’ থেকে সবরকম সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস জানান। ‘স্টানফোর্ড’ ‘ক্লড টাইসহার্স্টের’ সাথে এ ব্যাপারে কথাবার্তা বলেন। একজন ভারতীয়কে বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে জড়ানোর বিষয়টি ‘টাইসহার্স্টের’ মনঃপূত হয় নি। আবার একজন জার্মানের (‘স্ট্রেসমান’) সংশ্লিষ্টতাও তাঁকে ক্ষুব্ধ করে। ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’তে তিনি চিঠি লিখে জানান যে ‘স্ট্রেসমানের সংশ্লিষ্টতা’ তাঁর কাছে ব্যক্তিগতভাবে অপমানজনক। তাঁর মন্তব্য অবশ্য পরবর্তীকালে আমলে নেওয়া হয়নি। ‘বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ়ুলজিক্যাল মিউজিয়ামে’ কাজ করার সময় তাঁর আলাপ হয়েছিল দিকপাল জীববিজ্ঞানীদের সঙ্গে। জার্মানিতে সেলিম ‘বের্নহার্ট রানশ্’, ‘অস্কার হাইনরোথ’, ‘আর্নস্ট মায়ারের’ মত তৎকালীন জার্মানির সেরা সেরা ‘পক্ষীবিজ্ঞানী’র সংস্পর্শে আসেন। বার্লিনে তাঁর সাথে ‘বিপ্লবী চম্পাকর্মণ পিল্লাইয়ের’ সাথে সাক্ষাৎ হয়। জার্মানিতে অবস্থান তাঁর পাখি বিষয়ক আগ্রহ আরও বৃদ্ধি করে, সাথে সাথে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিকেও সম্বৃদ্ধ করে। ‘পাখিদের প্রজনন’ নিয়ে তিনি কাজ করতে গিয়েছিলেন ‘হেলিগোল্যান্ড দ্বীপে’। শিখেছিলেন ‘পাখিদের পায়ে রিং পরানোর কারিকুরি’, যা পরে তিনি ভারতে এসে শুরু করেছিলেন।
১৯৩০ সালে সেলিম আলী ভারতে ফিরে আসেন। ভারতে এসে তিনি আবিষ্কার করলেন, তাঁর গাইড লেকচারারের পদটি ‘তহবিলের অভাবে বিলোপ’ করা হয়েছে। উপযুক্ত চাকরির অভাবে সালিম ও তাহমিনা মুম্বাইয়ের নিকটে ‘কিহিম’ নামক একটি সমুদ্রতীরবর্তী গ্রামে চলে যান। সেখানে তিনি দেশি বাবুইয়ের জন্ম ও প্রজনন প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। তিনি আবিষ্কার করেন, এদের ‘প্রজনন প্রক্রিয়া’ আসলে ‘অনুবর্তী বহুগামী’। পরবর্তীকালে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন যে এ তথ্য বহু আগে ‘মুঘল প্রকৃতিবিদরা’ আবিষ্কার করেন। ‘কে. এম. অনন্তন’ নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক চিকিৎসকের নিমন্ত্রণে তিনি পরের কয়েকটি মাস ‘কোটাগিরি’তে কাটিয়ে দেন। দেশে এসে কোনও চাকরি না পাওয়ায় তাঁর মাথায় এসেছিল ‘অঞ্চলভিত্তিক পাখি জরিপের চিন্তা’। সাহায্যের আশ্বাস পেয়েছিলেন ‘নিজামের প্রশাসন’ থেকে। প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন ‘হায়দরাবাদে’। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ – এই দু’দশকে ‘হায়দরাবাদ’ দিয়ে শুরু করে গোটা ভারতের পাখির ‘প্রজনন’, তাদের ‘বাসস্থান’, ‘জীবনযাত্রা’ সব কিছু নিয়ে প্রথম পুঙ্খানুপুঙ্খ সমীক্ষা করেছিলেন তিনি। এর কিছুদিন পরে তিনি ‘হায়দারাবাদ’, ‘কোচিন’, ‘ত্রিবাঙ্কুর’, ‘গোয়ালিয়র’, ‘ইন্দোর’ ও ‘ভূপাল’সহ আরও কয়েকটি করদ রাজ্যে ‘নিয়মতান্ত্রিক পক্ষী-জরিপ’ চালানোর অভিনব এক সুযোগ পেয়ে যান। এসব ‘পক্ষী-জরিপের খরচ’ পুরোপুরি বহন করে এসকল রাজ্য। এ জরিপে তিনি ‘হিউ হুইসলারের’ অসীম সহায়তা পান। ‘হুইসলার’ নিজে পুরো ভারতজুড়ে এ ধরনের জরিপ কাজ চালিয়েছিলেন ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। প্রথম দিকে ‘হুইসলার’ অবশ্য একজন অচেনা ভারতীয়ের এ ধরনের যোগাযোগে বিরক্ত হয়েছিলেন। ‘হুইসলার’ তাঁর ‘দ্য স্টাডি অব ইন্ডিয়ান বার্ডস’-এ উল্লেখ করেছিলেন – বড় ভিমরাজের লেজে লম্বা পালকগুলোতে রক্তনালী জালকের মত বিস্তৃত নয়। সেলিম আলী তাঁকে চিঠি লিখে জানান যে তথ্যটি সঠিক নয়। ‘হুইসলার’ এই অচেনা ভারতীয়ের মন্তব্যে বেশ ক্ষুব্ধই হন। পরে অবশ্য তিনি তাঁর নমুনাগুলো আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন এবং তাঁর ভুল স্বীকার করে নেন। তাঁরা দু’জনে পরবর্তীতে ভাল বন্ধু হয়েছিলেন।
‘হুইসলার’ বিখ্যাত পক্ষীবিদ ‘রিচার্ড মেইনার্ৎসেনের’ সাথে সালিমের পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁরা দু’জনে মিলে আফগানিস্তানে অভিযানে যান। সেলমের মতে, ‘মেইনার্ৎসেন’ ছিলেন তাঁর দেখা সেরা পক্ষীবিদ। তাঁর কাছ থেকেই সেলিম জেনেছিলেন, পাখিদের গায়ের পোকারাও সমীক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সব পোকা সব প্রজাতির পাখির গায়ে বসে না। তাই যদি ভিন্ন প্রজাতির পাখির পালক থেকে একই ধরনের পোকা পাওয়া যায়, তা হলে বুঝতে হবে তাদের বংশধারায় কোথাও মিল আছে! সেলিমের ব্যাপারে ‘মেইনার্ৎসেনের’ একটু ‘ঋণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গী’ থাকলেও তাঁরা দু’জনে ছিলেন ভাল বন্ধু। সেলিম প্রথম দিকে ‘মেইনার্ৎসেনের পক্ষী-চর্চা’ নিয়ে তেমন কিছু না বললেও পরে প্রমাণ করেন তাঁর ‘পাখি বিষয়ক তথ্যাদি’তে বেশ গলদ রয়েছে। ‘মেইনার্ৎসেনের ডায়েরি’ আর সেলিমের আত্মজীবনীতে তাঁদের পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সালিম আলী সম্পর্কে ‘মেইনার্ৎসেন’ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন –
‘‘30.4.1937 … I am disappointed in Salim. He is quite useless at anything but collecting. He cannot skin a bird, nor cook, nor do anything connected with camp life, packing up or chopping wood. He writes interminable notes about something-perhaps me …’’
(‘‘সেলিমের উপর আমি বিরক্ত। নমুনা সংগ্রহ ছাড়া ও প্রায় সব ব্যাপারেই আনাড়ি। ও মুরগির চামড়া ছাড়াতে জানে না, রাঁধতে পারে না, ক্যাম্পের জীবনের সাথে যুক্ত কোন কাজই সে পারে না; কি জিনিসপাতি গোছগাছ করা বা কাঠ কাটা। সে সারাক্ষণ কী নিয়ে যেন লিখেই যাচ্ছে লিখেই যাচ্ছে – মনে হয় আমাকে নিয়ে …’’)
‘‘20.5.1937 … He is prepared to turn the British out of India tomorrow and govern the country himself. I have repeatedly told him that the British Government have no intention of handing over millions of uneducated Indians to the mercy of such men as Salim …’’
(‘‘সে কালকেই ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়িয়ে নিজেই দেশ চালাতে একপায়ে খাড়া। আমি তাকে বার বার বলেছি, লাখ লাখ অশিক্ষিত ভারতীয়কে সালিমের মত মানুষদের দয়ার ওপর ছেড়ে দিতে ব্রিটিশ সরকার একেবারেই প্রস্তুত নয় …’’)
প্রথম দিকের জরিপগুলোতে সেলিমের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও সহযোগী ছিলেন তাঁর স্ত্রী ‘তাহমিনা’। ১৯৩৯ সালে এক ছোট অস্ত্রোপচারে তাহমিনা মৃত্যুবরণ করেন। তাহমিনার মৃত্যুর পর তিনি তাঁর ‘বোন কামু আর শ্যালকের সাথে’ বসবাস করতে শুরু করেন। এসময় বিভিন্ন ভ্রমণে তিনি ‘কুমায়নের তেরাইয়ে’ নতুন করে ‘ফিনের বাবুই’ আবিষ্কার করেন। তবে ‘হিমালয়ী বটেরা’ (‘Ophrysia superciliosa’) খুঁজে বের করতে তিনি ব্যর্থ হন, যার অস্তিত্ব এখনও পর্যন্ত অজানা।
সমীক্ষার কাজ শেষ করতে গিয়ে সেলিমের বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ভারতকে নিবিড় ভাবে চিনেছিলেন, তাঁর পরিচয় হয়েছিল বহু নামী পক্ষী-বিশারদদের সঙ্গে। প্রতিটি অঞ্চলের সমীক্ষার পরে বই লিখেছিলেন সেলিম। ‘কাশ্মীর’, ‘হিমাচলপ্রদেশ’, ‘গঢ়বাল’, ‘কুমায়ুনে’ পক্ষী-সমীক্ষার কাজ করতে করতে তাঁর মনে হয়েছিল ‘পশ্চিম তিব্বত’ থেকে আসা ‘বড়িহাঁস’, ‘কালো সারসের’ প্রজননস্থলে না গেলে জীবন বৃথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমস্যা উপেক্ষা করে তোড়জোড় করেছিলেন ‘কৈলাস ও মানস সরোবর অভিযানের’। পাশে পেয়েছিলেন ‘সিঙ্গাপুরের পক্ষী-তাত্ত্বিক ও ফোটোগ্রাফার’ ‘লোক ওয়ান থো’-কে, যিনি সিকিমে পাখি সংগ্রহ ও ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজে খরচ জুগিয়েছিলেন সেলিমকে। ‘ওয়ান থো’-র একটি লেখায় পাওয়া যায়, ‘সিকিমে’ এক বার একটি পাখির বাসার ছবি তোলার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার পরে পাখিটিকে ঠাঁইনাড়া করার জন্য ‘গড সেভ দ্য কিং’ গানটি গলা ছেড়ে গেয়েছিলেন সেলিম! তাঁর এক একটা সার্ভে ছিল এক একটা অ্যাডভেঞ্চার। কখনও অসতর্ক হয়ে গভীর খাদে পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গিয়েছিলেন, আবার কখনও জঙ্গলে বুনো হাতির সামনেও পড়েছিলেন। ‘তিব্বত’ যাওয়ার তোড়জোড় যখন করছিলেন, ঠিক সেই সময় ‘কচ্ছের রাজা মহারাও বিজয়রাজে’র কাছ থেকে ‘টেলিগ্রাম’ পেয়েছিলেন ‘কচ্ছের রান অঞ্চলে’ ‘ফ্লেমিংগোদের সমাগম’ দেখার জন্য। সেখানেই তিনি ‘অ্যাভোসেট’ এবং ‘রোজি পেলিক্যান’ আবিষ্কার করেছিলেন। ভারতে এই দু’টি প্রজাতি সম্পর্কে তিনিই প্রথম লিখেছিলেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ‘ভুটানে’ ছ’টি সংগ্রহ অভিযান করেছিলেন সেলিম। ‘উত্তর-পূর্ব ভারত ও ভুটানের পাখিদের নিয়ে’ তাঁর লেখা বই হল – ‘ফিল্ড গাইড টু দ্য বার্ডস অব দি ইস্টার্ন হিমালয়াজ’।
সেলিম প্রথম ‘সাইবেরিয়ান সারস’ দেখেছিলেন ১৯৩৭ সালে ‘রাজস্থানের ভরতপুরের কেওলাদেও ঘানার অরণ্যে’। জায়গাটি ছিল ‘পরিযায়ী হাঁসদের স্বর্গরাজ্য’। বর্তমানে সেটি ‘অভয়ারণ্য’ হলেও অতীতে সেটি ছিল ‘রাজা সুরজমলের শিকারভূমি’। ১৯৩৮ সালে নভেম্বর মাসে ‘পক্ষী-মেধ যজ্ঞের’ প্রধান হোতা ছিলেন তখনকার ‘বড়লাট লিনলিথগো’। মারা পড়েছিল ৪,২৭৩ হাঁস আর রাজহাঁস! এই শিকার বন্ধ করার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছিলেন সেলিম, পাশে পেয়েছিলেন ‘জওহরলাল নেহরু’কে। সমীক্ষার মতো ‘পক্ষী-সংরক্ষণ’ নিয়েও তিনি কাজ করেছিলেন। সেলিম অকারণে জীবহত্যাকে বর্বরতা মনে করতেন। যদিও পাখির নমুনা সংগ্রহের জন্য তাঁকেও পাখি শিকার করতে হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘তা যদি না করতাম, ভারতীয় পাখিদের সম্পর্কে চর্মসংরক্ষণমূলক জ্ঞানের ক্ষেত্র কিছুতেই প্রশস্ত হতে পারত না।’’ বইপুস্তকে পড়াশোনার চেয়ে বনে-বাদাড়ে পাখি খুঁজে বেড়াতে উৎসাহ পেতেন সেলিম আলী। ‘আর্নস্ট মায়ার’, ‘রিপলি’কে লিখেছিলেন যে সেলিম যথেষ্ট পরিমাণ নমুনা সংগ্রহ করতে ব্যার্থ হয়েছেন – ‘‘এখন পর্যন্ত কেবল সংগ্রহই মুখ্য বিষয় হলেও আমার সন্দেহ আছে সে সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা বোঝে কিনা। মনে হয় আপনি ওকে বোঝাতে পারবেন।’’ তবে সালিমের এ স্বভাব পরিবর্তিত হয়নি। তিনি লিখেছিলেন, ‘‘প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবিত পাখি’’ দেখতেই তাঁর ভাল লাগে।
‘সিডনি ডিলন রিপ্লি’র সাথে সেলিম আলীর ঘনিষ্ঠতা নানান ‘প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি’ করেছিল। অতীতে ‘রিপ্লি’ ‘সিআইএ’র একটি সহযোগী সংস্থায় চাকরি করতেন। তাঁদের দু’জনের নামে অভিযোগ ওঠে যে, তাঁরা যে পাখির পায়ে ‘রিং’ পড়ান তা ‘সিআইএ’র একটি পরিকল্পনা অংশ।
পাখির চিত্রগ্রহণের ব্যাপারে সালিম আলী তাঁর ধনকুবের সিঙ্গাপুরী বন্ধু ‘লোকি ওয়ান থো’র মাধ্যমে উৎসাহিত হন। লোকির সাথে আলীকে পরিচয় পরিয়ে দিয়েছিলেন ‘জেটিএম গিবসন’। ‘গিবসন’ ছিলেন ‘রাজকীয় ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার’ এবং ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র একজন সভ্য। তিনি লোকিকে সুইজারল্যান্ডে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে সহায়তা করেছিলেন। পাখির প্রতি অসীম আগ্রহের কারণে ‘লোকি’ এ খাতে আলী ও ‘গিবসন’কে আর্থিক সহায়তা করতেন।
ভারতে পক্ষীবিদ্যার ঐতিহাসিক পটভূমি নিয়েও সেলিম আলীর বিরাট আগ্রহ ছিল। তাঁর প্রথম দিকের কয়েকটি নিবন্ধতে ভারতের প্রাকৃতিক ইতিহাসে মুঘল সম্রাটদের অবদান বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীতে একাধিক বক্তৃতায় তিনি বেশ জোরের সাথে ‘ভারতে পাখি বিষয়ক গবেষণার গুরুত্ব’ তুলে ধরেছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে ‘গোয়ার বার্ড স্যাংচুয়ারি’, ‘কেরলের থাট্টেকাড বার্ড স্যাংচুয়ারি’, ‘পুদুচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স বিভাগ’ ইত্যাদি। বাদ যায়নি পাখির নামও। ২০১৬ ভারতে আবিষ্কৃত হয়েছিল ‘হিমালয়ান ফরেস্ট থ্রাস’, সেলিম আলীর নামে যার বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে ‘জুথেরা সেলিমআলি’। ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র টিকে থাকার জন্য সেলিম আলীর অবদান অনস্বীকার্য। এই শতবর্ষী প্রতিষ্ঠানটি সংরক্ষণের জন্য তিনি ‘আর্থিক সাহায্য’ চেয়ে তৎকালীন ‘প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু’কে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন।
সেলিম আলী সারা জীবনে পেয়েছিলেন বহু সম্মান ও পুরস্কার। সে সবের ফিরিস্তি দিয়ে তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘‘পাখি নিরীক্ষণ করার মতন আপাত নিরর্থক বৃত্তিতেও কেউ যদি কায়মনোবাক্যে লেগে থেকে নিজেকে উজাড় করে দেন, তা হলে তাঁর প্রাপ্তির ঘর কিছুতেই ফাঁকা যাবে না।’’
(তথ্যসূত্র:
১- The Fall of a Sparrow, Salim Ali, Oxford University Press (১৯৮৫)।
২- পাখিবিশারদ সালিম আলী, রেজা খান, প্রথমা প্রকাশন (২০১৮)।
৩- সালিম আলি পাখিদের বন্ধু, আলী ইমাম, ন্যাশনাল পাবলিকেশন (২০১৯)।
৪- Bird study in India: Its history and its importance, Salim Ali, Indian Council for Cultural Relations, New Delhi (১৯৭৯)।
৫- The Illustrated Lives in the Wilderness: Three Classic Indian Autobiographies, Oxford University Press (২০০৯)।
৬- Salim Ali India’s Birdman, Reeta Dutta Gupta, Rupa (২০০৯)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত